অসহিষ্ণু সমাজের আলাপ by মোহাম্মদ আরিফ
প্রশ্ন জাগে, সমাজ কি ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে? তাহলে কেন? স্বাধীনতার অনেক স্বপ্নের একটি ছিল স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। যেখানে মানবিক অধিকার সমুন্নত থাকবে। বস্তুত তা হয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর একদল লোক মেতে ওঠে লুণ্ঠন আর হত্যায়। সমাজে বিশৃঙ্খলার বীজ রোপিত হয়। সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের স্বপ্ন ভুলুণ্ঠিত হতে শুরু করে।
আমাদের সামাজিক অধঃপতনের অনেক কারণ। তবে অন্যতম কারণ বৈষম্য। সমাজে নানা ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। এর মধ্যে ধর্মীয় এবং অর্থনীতি- এই বিশেষ দু’টি কারণে সমাজ সবসময় অস্থিতিশীল থাকে। চলমান অসহিষ্ণুতার পেছনেও এ দু’টি কারণ রয়েছে মনে বলে করি। বিগত চার দশকে এদেশে এক শ্রেণির লুটেরা, লুম্পেন সম্পদের পাহাড় গড়েছে।
অপরদিকে মধ্যবিত্তের অনেকেই নেমে গেছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর্থিক অসঙ্গতি সাধারণের মধ্যে সার্বক্ষণিক চাপা ক্ষোভ তৈরি করছে। কাঙ্ক্ষিত জীবন অর্জনে ব্যর্থতা সমাজে তৈরি করছে অসম প্রতিযোগিতা। বেকারত্ব সৃষ্টি করছে হতাশা। একই সমাজে উচ্চ শ্রেণির বর্ণাঢ্য জীবন নিম্নবিত্তকে ঈর্শাকাতর করছে। প্রেমে পরাজয় জন্ম দিয়েছে প্রতিহিংসার। ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে বেড়েছে উন্মাদনা। অযোগ্য ব্যক্তির উত্থান এবং যোগ্যতমের পতনে তৈরি হয়েছে বিভেদ। সমাজের এই অসম বাস্তবতা সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। তারা মানসিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
বাংলাদেশের সমাজ জীবন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছে রাষ্ট্র পরিচালকগণ। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে আর্থিক বৈষম্য। এদেশের বেশির ভাগ মানুষ যেখানে মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খায়, সেখানে লুটেরা শ্রেণি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তবৈভবে আয়েশি জীবনযাপন করে। তারা আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, লন্ডনে সেকেন্ড হোম গড়ে তোলেন। হাওয়া বদলাতে উড়াল দিয়ে চলে যান পৃথিবীর নামি-দামি সৈকতে। বিনোদনের জন্য বেছে নেন জগৎসেরা সব এমাউজমেন্ট হোটেল। তাদের ব্যাংক হিসাবে থাকে কোটি কোটি টাকা।
অপরদিকে দেশের সাধারণ নাগরিক তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না। চিকিৎসার খরচ জোটে না। করতে পারে না মাথাগোঁজার একটু খানি ঠাঁই। জীবন-যাপনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তবু শাসকগোষ্ঠী ‘উন্নয়ন’-এর জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন গণমাধ্যম আর রাজনীতির ময়দানে।
গত কয়েক দশক ধরে ‘উন্নয়ন’ শব্দটি বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদগণ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলে উন্নয়নকে ফিতে দিয়ে মাপবার চেষ্টা করেন। অথচ তারা জানেন না এদেশে একজন পোশাক শিল্প শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত? এই সামান্য টাকায় একজন মানুষের পরিবার চলে কী করে? তারা খোঁজ রাখেন না দেশের এটিএম বুথগুলোয় যারা সিকিউরিটির জব করেন, তাদের। তারা জানেন না, গ্রামে কৃষিক্ষেত্র থেকে আয় দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসায় অনেক কৃষক নগরে পাড়ি জমাচ্ছেন। শহরে এসে রিকশাচালক বা দিনমজুরের কাজ করে কোনোমতে বেঁচেবর্তে আছেন।
বর্তমান সমাজে চারপাশে এত অন্যায়, বৈষম্য, বিভেদ সাধারণকে মনে মনে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সেজন্য তুচ্ছ ঘটনাতেও হিংস্র হয়ে উঠতে দেখা যায়। মানুষের ভেতর থেকে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই নিষ্ঠুর, পাশবিক হয়ে উঠছি। সাধারণ মানুষ এখন তার ক্ষুদ্ধতাকে কোথাও না কোথাও উগরে দিতে চায়। যা আমরা মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে দেখতে পাই। সুযোগ পেলেই সে এই কাজটি করে। কারণ অন্যকিছু নয়। মূলত পেশি শক্তিই হয়ে উঠছে ব্যক্তির কাছে ন্যায্যতার অন্যতম হাতিয়ার। তাই, খুনের মতো অমার্জনীয় অপরাধ করতে কেউ দ্বিধা করছে না।
সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার পেছনে রাজনীতির দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। গত তিন তিনটে নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। গণতন্ত্র হয়েছে ভুলুণ্ঠিত। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। সাধারণ মানুষ আইনানুগ সহায়তা পায়নি। হত্যা, গুম, খুনের কোনো বিচার হয়নি। অসহায় মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। ধর্ষিত নারী পায়নি সুবিচার। রাজনৈতিক গুণ্ডারা জবর দখল করে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য। ফুটপাথের ভিখারীকেও চাঁদা দিতে হয়েছে। খুনি, অত্যাচারী সমাজে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেন না তাদের ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সনদ। সরকারবিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতারা পালিয়ে বেড়িয়েছে। সরকার অনেককে করেছে দেশান্তরী।
উক্ত বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না, তবে খুঁজতে হবে মুক্তির উপায়। সদ্য আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনদিন দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। মাঝের দিনগুলোতে ঢাকাসহ সারা দেশে চুরি, ডাকাতি, হত্যাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটেছে। সরকার গঠনের পর চুরি, ডাকাতি কমলেও হত্যাযজ্ঞ থামেনি। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। হত্যাযজ্ঞ থামাতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এককভাবে দায় দেয়া যাবে না। আমরা জানি, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিতর্কিত হওয়ায় বিদ্যমান পুলিশর দায়িত্ব পালনে পূর্ণ পেশাদারী হয়ে উঠতে পারছে না।
মনে রাখতে হবে প্রতিহিংসাপরায়ণতা শান্তি আনতে পারে না। শান্তি আসে অহিংসায়। আমাদের অনেক ক্ষোভ আছে, না পাওয়ার কষ্ট আছে, হারানোর বেদনা আছে। কিন্তু প্রতিহিংসা এর কোনোটারই সমাধান নয়।
No comments