ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প: প্রতি মিনিটের অডিও ভিডিও খরচ ২০ হাজার, আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের by মো. আল আমিন

দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করতে ‘ই-জুডিশিয়ারি’- নামের একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে আইন ও বিচার বিভাগ। দুই হাজার ৬২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রকল্পটির কিছু খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় কিছু খাত যুক্ত করা হয়। এ সব নিয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। সূত্র বলছে, প্রকল্পটিতে প্রতি মিনিট অডিও-ভিডিও বা চিত্রতথ্য নির্মাণের জন্য ২০ হাজার টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। মাত্র ২০ মিনিটের একটি অডিও বা ভিডিও নির্মাণে ব্যয় হবে ৪ লাখ টাকা। এই খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পের উপদেষ্টার জন্য চার কোটি টাকা ব্যয়ে জিপ গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি বাদ দিতে বলা হলেও পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় তা বাদ দেয়া হয়নি। অন্যদিকে অফিস স্টেশনারি, অফিস ভাড়া, পরামর্শক সেবা, পেট্রোল, গ্যাস ও জ্বালানি, কম্পিউটার সামগ্রী, কম্পিউটার মেরামত, যানবাহন সংরক্ষণ ও মেরামত ইত্যাদি ব্যয় আরও পর্যালোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ ও বছরভিত্তিক বিভাজন দেখানোর কথা বলা হয়েছিল আইন ও বিচার বিভাগকে। কিন্তু পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় সেই প্রস্তাবও মানা হয়নি।

এদিকে সেমিনারের ব্যয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী ধরা হয়নি বলেও জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। এছাড়া ইলেকট্রিক আর্চওয়ে, এক্স-রে ব্যাগেজ স্ক্যানার ও নিরাপত্তা অঙ্গে ১০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এসব যন্ত্রপাতির কারিগরি বৈশিষ্ট্য ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি। এসব সরঞ্জাম ই-জুডিশিয়ারি কার্যক্রমের সঙ্গে কতটুকু সম্পর্কিত, প্রশ্ন উঠেছে সেটি নিয়েও।
ই-কোর্ট রুমের সম্পূর্ণ বিচারিক কার্যক্রম সিসি ক্যামেরা ও ভিডিও রেকর্ডিং এর আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব নিয়ে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলেছে, বিচারিক কার্যক্রমে বাদী-বিবাদীর বক্তব্য, জেরা তাদের ছবির প্রাইভেসি রাখার ক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরা ও অডিও-ভিডিও অন্তরায় হতে পারে। ফলে প্রাইভেসি বিবেচনায় এগুলো রাখা ঠিক হবে কিনা আলোচনা হতে পারে।
প্রকল্পের পরামর্শক সেবা খাতেই ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। পরামর্শক সেবা, টেকনিক্যাল পরামর্শক সেবা ও আইনি পরামর্শক সেবা নামের তিনটি অঙ্গে যথাক্রমে ১৭ কোটি ৩১ লাখ, ৬ কোটি ৩৩ লাখ ও ৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চতর প্রশিক্ষণ খাতে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ই-জুডিশিয়ারি অনেক বড় একটি প্রকল্প। প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতের ব্যয় নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কিছু অঙ্গের প্রয়োজনীয়তা ও ব্যয় নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলেছি। অহেতুক ব্যয়ের কোনো সুযোগ নেই।

অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প অগ্রাধিকার দিচ্ছে জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কিছু কর্মকর্তা বলেন, ই-জুডিশিয়ারি সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নের প্রকল্প। সেক্ষেত্রে প্রকল্পটি এখনই একনেকে অনুমোদন নাও হতে পারে।
আইন ও বিচার বিভাগ বলছে, নাগরিকদের আইনি অধিকার নিশ্চিতকরণে এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন ও সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নেই। কিন্তু সীমিতসংখ্যক বিচারক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী, গতানুগতিক পদ্ধতির বিচার কার্যক্রম ইত্যাদি কারণে যথাসময়ে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন ও রায় প্রদান করা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় মামলার জট বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচার কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার জন্য এবং বিচার প্রাপ্তিতে জনগণের প্রবেশাধিকার সহজলভ্য করার জন্য বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশন করা জরুরি। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনিক এবং বিচার কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করা, ই-আদালত কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা এবং আইসিটি’র জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা বিচারক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

এদিকে মাত্র পিইসি সভায় উত্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হলেও ই-জুডিয়িশারি প্রকল্পটি নতুন নয়। ২০১৬ সালের ১২ই জুলাই ওই সময়কার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটি ৩২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে দেশের নির্বাচিত কয়েকটি জেলার বাস্তবায়নের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়। ওই সভায় উদ্যোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে আইন ও বিচার বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে যৌথভাবে উপস্থান করে প্রকল্প এলাকার পরিধি বিস্তৃত করে সারা দেশে বাস্তবায়নের জন্য অন্যান্য সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। পরে আইন ও বিচার বিভাগ বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কারিগরি সহায়তায় ই-জুডিশিয়ারি পাইলট প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাস্তবায়নের মেয়াদ রেখে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয় প্রকল্পটি। ২০১৮ সালের ১৪ই নভেম্বর প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এরপর আর তেমন অগ্রগতি ছিল না প্রকল্প নিয়ে। দীর্ঘ  ৬ বছর পর প্রকল্পটি নিয়ে আবারো তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে জানতে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানীর সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.