৮ বছর ধরে ওএসডি: এসপি আরেফ এখনো হয়রানিতে

বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আরেফ। ২০০১ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। এসপি হিসেবে পদোন্নতি পান ২০১৩ সালে। কিন্তু এরপর আর তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সর্বশেষ পদোন্নতি পাওয়ার ১১ বছর পর তিনি এখনো এসপি। তার ব্যাচমেটরা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। জুনিয়ররাও অতিরিক্ত ডিআইজি। অথচ ৪টি বিভাগীয় মামলার গ্যাঁড়াকলে পড়ে তিনি আর পদোন্নতি পাননি। উল্টো ওএসডি হয়ে আছেন বছরের পর বছর। এরমধ্যে একটি মামলা থেকে সম্প্রতি তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি মামলার পুনঃতদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু আরেফ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক সকল মামলা প্রত্যাহার করে তাকে পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করতে দেয়ার সুযোগ চাচ্ছেন। তিনি বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় যে স্থগিতাদেশ ছিল সেটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অথচ তার মামলাগুলো প্রত্যাহার করে পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করা হচ্ছে না। পুনঃতদন্ত হলে তিনি আরও অনেক দিনের জন্য ওএসডি হয়ে থাকতে হবে। তার সময়কালে যাদেরকে রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করা হয়েছিল তাদেরকে আগেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করা হয়েছে। অজানা কারণেই তার মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে না।

আরেফের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০শে আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর এক আবেদনে আরেফ বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা বিভাগীয় মামলা দিয়ে তার ২টি প্রমোশন থেকে বঞ্চিত করে দীর্ঘদিন ওএসডি করে খুলনা রেঞ্জে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার প্রতি এই অবিচার ও বৈষম্যকে বন্ধ করে মামলা প্রত্যাহার করে তার পদোন্নতি দিয়ে তার প্রাপ্য অবস্থান নিশ্চিত করার আবেদন জানিয়েছেন। ২২শে আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি শাহজাদা মো. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর এক চিঠিতে বলা হয় আরেফ বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য সিনিয়র সচিব বরাবর আবেদন দাখিল করেছেন। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের আইন কর্মকর্তার মতামত গ্রহণ করা হলে তিনি মতামত দিয়ে বলেন, দায়েরকৃত মামলাসমূহ প্রত্যাহার সাপেক্ষে সরকার তার আবেদনটি বিবেচনা করতে এখতিয়ার সম্পন্ন তাই আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো যেতে পারে। ১লা সেপ্টেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগের শৃঙ্খলা-১ শাখা থেকে আরেফকে দেয়া এক চিঠিতে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানির জন্য ডাকা হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তিনি সিনিয়র সচিবের দপ্তরে শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। পরে সচিবের নির্দেশেই আরেফ তার বিরুদ্ধে মামলা স্থগিতাদেশ হাইকোর্ট থেকে উঠিয়ে নেন। ১৯শে সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-১ শাখার এক চিঠিতে তার বিরুদ্ধে ড্রাইভারসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যকে গালিগালাজ, মারধর ও চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি প্রদান করার মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বাকি মামলাগুলো পুনঃতদন্তের জন্য বলা হয়। ৫ই সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-৩ শাখা আরেফসহ আরও ৪ পুলিশ কর্মকর্তার ওএসডি প্রত্যাহারপূর্বক প্রাপ্য পদোন্নতি প্রদান, চাকরিতে যোগদান ও পুনর্বহালের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
এদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ল এনফোর্সমেন্ট অফিসার্স এসোসিয়েশনের (আইএলইওএ) পক্ষ থেকেও আরেফের ওএসডি প্রত্যাহার করে চাকরিতে পুনর্বহাল ও প্রাপ্য পদোন্নতি দেয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আরেফ এই সংগঠনটির বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি। আইএলইওএ এর ইন্টারন্যাশনাল সভাপতি লিনড্রো পোলিনো চিঠিতে আরেফকে বিনা কারণে হয়রানি করার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হাইকোর্ট থেকেও এক রিট আদেশে ষড়যন্ত্রের শিকার আরেফকে হয়রানি না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং তার প্রাপ্য পদোন্নতি ও পদায়ন দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে। এক আদেশে বলা হয়েছে কোনো কর্মকর্তার বিভাগীয় মামলায় শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত এবং বিভাগীয় মামলা চলমান থাকলেও ওই কর্মকর্তার পদোন্নতি দেয়া যাবে।  
ভুক্তভোগী পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আরেফ মানবজমিনকে বলেন, গত সরকারের সময় বিনা কারণে বিভাগীয় মামলা দিয়ে আমাকে ওএসডি করে রাখা হয়। আমার নামে এমন কিছু অভিযোগ দেখিয়ে মামলা দেয়া হয়েছে যা অত্যন্ত তুচ্ছ ও হাস্যকর। এসব ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। প্রায় ৮ বছর ওএসডি থাকার কারণে আমি কোনো পদোন্নতি পাইনি। আমার ব্যাচমেটরা সবাই এখন ডিআইজি। অনেক জুনিয়র কর্মকর্তারাও এখন অতিরিক্ত ডিআইজি। অথচ আমি এখনো ওএসডি এসপি। এমনকি আমার সঙ্গে অন্য যাদেরকে ওএসডি করা হয়েছিল তাদের মামলা প্রত্যাহার করে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার পতনের পর আমি যথাযথ নিয়ম মেনেই পুলিশ প্রধানের সঙ্গে দেখা করে পুরো বিষয়টি খুলে বলি। তিনি বুঝতে পারেন বিগত আমলে আমাকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এসব মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছিল। তাই তিনি আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি ভিত্তিতে চিঠি পাঠিয়ে সুপারিশ করেন। নিয়ম মেনেই আমি সচিবের শুনানিতে অংশগ্রহণ করি। সচিবের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আমি আমার বিরুদ্ধে করা মামলার স্থগিতাদেশসহ সকল কার্যক্রম প্রত্যাহার করে নেই। অথচ অজানা কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার বিরুদ্ধে করা ৪টি মামলার একটি প্রত্যাহার করলেও বাকি তিনটি মামলার পুনঃতদন্ত দিয়েছে। এটি আমার কাছে হয়রানিমূলক মনে হচ্ছে। কারণ বিএনপিকে সাপোর্ট করার জন্য আমার বিরুদ্ধে এসব মামলা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় নাই। একটি নিরপেক্ষ সরকার কাজ করছে। তাই আমি আমার ওপর থেকে হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করে আমার পদোন্নতিসহ স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবকে অনুরোধ করছি। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.