স্যার, আমার পেটে বাচ্চা, আমাকে বাঁচান: অন্তত ৪০ জনকে উদ্ধার করেন সুমন by জিয়া চৌধুরী
এক
কথায় অসহায়ের সহায়। বিশাল সমুদ্রে যেন এক টুকরো খড়কুটো। আস্থার জায়গা। আর
তা ভেবেই মাঠে নামেন তারা। কাজও করেন। কখনো হন নন্দিত। কখনো নিন্দিত। তাতে
তাদের কিছু যায় আসে না।
তাদের টার্গেট কাজ করে যাওয়া। বিপদকে সঙ্গি করে বিপদগ্রস্থ মানুষকে আগলে তোলা। সংকট সময়ে তারা জানান দেয় ‘মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য’। এরই প্রমাণ দিয়েছেন বনানীর ফারুক রূপায়ন টাওয়ারের আগুনের সঙ্গে লড়াই করা বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। তাদের একেক জন কর্মী বাঁচিয়েছেন বহু প্রাণ।
এরমধ্যে স্টেশন অফিসার শহীদুল ইসলাম সুমন একাই জীবন রক্ষাকারী মই (টার্নট্যাবল ল্যাডার) নিয়ে আগুনের মাঝ থেকে বিভিন্ন তলা থেকে কমপক্ষে চল্লিশ জনকে উদ্ধার করেছেন। অন্তঃস্বত্তা নারী, সদ্য চাকরিতে যোগ দেয়া তরুণী কিংবা বয়োবৃদ্ধ, সুমনের বাহুতে ভর করে যেন নতুন জীবন ফিরে পান। মৃত্যুর দুয়ারে থাকা মানবগুলো আরেক মানবের সহায়তায় ফের দেখেন পৃথিবীর আলো। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আটকে পড়া মানুষগুলোকে পরম মমতায় নিরাপদে নামিয়ে আনেন সুমন। এ যেন সুমনের আরেক যুদ্ধ। এ যুদ্ধকেই তিনি বেছে নিয়েছেন পেশা হিসাবে। এখন যা তার কাছে নেশায় পরিণত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দুপুরে কথা হয় শহীদুল ইসলাম সুমনের সঙ্গে। ভাঙ্গা গলায় কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। বনানীতে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়ার সময় ধোঁয়ায় ফুসফুসে সংক্রমণ হয়। পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন কিছুটা সুস্থ তিনি। তবে, বনানীর আগুনের ঘটনা মনে করলেই বারে বারে এক মায়ের আর্তি ভিজিয়ে দেয় সুমনের চোখ। ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে মন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকালে সচিবালয়ের এলাকায় একজন শ্রমিক বহুতল ভবন থেকে পড়ে যায়। তাকে উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে মনটা ভারী হয়ে যায়।
সচিবালয়ে উদ্ধার কাজ শেষে ফায়ার সার্ভিসের গুলিস্থান সদর দফতরে ফিরে যান সুমন। তখনো দুপুরের খাবার সারেননি। সদর দফরের অফিসার্স মেসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক বারেটা ৫১ মিনিটে জরুরি ঘণ্টা বাজতে থাকে। সুমনের বুক তখন আঁতকে ওঠে। জরুরি ঘণ্টার মানে কোথাও ভয়াবহ আগুন লেগেছে। স্থানীয় ও পাশের স্টেশনগুলো সক্ষম না হলে ছুটে যেতে হবে সদর দফতর থেকে। আদতে হলো তাই। দ্রুত মহাখালী, কুর্মিটোলা ও বারিধারা ফায়ার স্টেশন রেসপন্স করার পরও ডাক পড়ে শহীদুল সুমনদের মতো বহু কর্মীর। দুপুরে না খেয়েই রওনা হন বনানীর এফ আর টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। যানজট ঠেলে বনানী পৌঁছাতে পোঁছাতে ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে কয়েকটি তলায়। ল্যাডারবাহী গাড়ি থেকে মই বের করে কাজ শুরু করতে গিয়ে বাধে আরেক বিপত্তি। উৎসাহী কিছু জনতার রোষানলের শিকার হন শহীদুল সুমন ও তার গাড়িচালক। এ সময় গাড়িচালককে মারধরও করেন কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এতে অন্তত ছয় মিনিট সময় নষ্ট হয়। এর মধ্যেই একজনকে ঝাঁপ দিতে দেখেন। এর মধ্যেই চিৎকার করে বলতে থাকেন আপনারা কেউ লাফ দিবেন না। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের নামিয়ে আনবো।
একটু অপেক্ষা করুন। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, হয়তো জনতা বাধা না দিলে আরো কয়েকটি প্রাণ বেঁচে যেত। ল্যাডারটি ষোল তলা পর্যন্ত যেতে সক্ষম, বাকি তলার মানুষদের কি হবে এমন ভাবনাও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল সুমনকে। তবে যতদূর পেরেছেন মানুষকে নিচে নিরাপদে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি জানান, ল্যাডার থেকে কোনভাবেই আগুনের কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না শুরুতে। প্রায় দুই হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মই থেকেই আগুনের ভয়াবহ উত্তাপ টের পাচ্ছিলেন। তবুও মানুষকে বাঁচানোর পথ খুঁজছিলেন তিনি। এর মাঝে কয়েকটি তলার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেন সুমন ও তার সহকারী সোহাগ কর্মকার। পানি ছিটিয়ে ধোঁয়া সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পানির বোতল ছুঁড়ে দেন আটকে পড়া মানুষদের কাছে। সব যজ্ঞই চলছিল আগুনের কাছে থেকে ল্যাডারে চড়ে, এক নিশ্চিত ঝুঁকিতে।
সুমন জানান, গ্লাস ভেঙ্গে পানি ছিটিয়ে দেয়ার পর আস্তে আস্তে ধোঁয়া সরে যায় বেশ কয়েকটি ফ্লোরে। এমন ঝুঁকির সময়ে ফায়ার ফাইটারদের ব্রিদিং অ্যাপারেটর নামে এক ধরনের মাস্ক পরে থাকতে হয়। আগুনের তাপ ও ধোঁয়ায় শ্বাসনালী ও ফুসফুসে ক্ষতি থেকে এমন মুখোশ পরতে হয়। কিন্তু মাস্ক পরে কোনভাবেই আটকে পড়া মানুষদের সাথে কথা বলতে পারছিলেন না সুমন। তাই মাস্ক খুলে মানুষদের না দাঁড়িয়ে থেকে নিচু হয়ে বসে যেতে বলেন। কারণ ধোঁয়ার প্রকট উপরের দিকেই বেশি। নিচে বসে পড়লে শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকি কম থাকে। তাদের ছুঁড়ে দেয়া পানির বোতল থেকে অনেকে তোয়ালে ও কাপড় ভিজিয়ে মুখ চেপে ধরে মইয়ের কাছে আসতে থাকেন একে একে। পানি ছড়ানোর কারণে অনেকে বেঁচে যান বলেও জানান সুমন। এমন সময় একজন নারীর আর্তনাদ কানে বাজে তার। ভেঙ্গে ফেলা গ্লাসের ফাঁক দিয়ে দেখতে পান একজন গর্ভবর্তী বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। সুমন মানবজমিনকে বলেন, কাছে গিয়ে শুনতে পাই ওই নারী আমাকে বার বার বলছে, ভাই আমি মরে যাই। কিন্তু আমার পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচান।
পরিবাররে কথা মনে পড়ে যায় আমার। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল আমারও তো পাঁচ মাস বয়সের একটি ছেলে আছে। আমার ছেলেটা তো পৃথিবীর আলো দেখেছে। অঙ্গীকার করেছিলাম জীবন দিয়ে হলেও আমি ওই বাচ্চাটাকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখাব। অনেক চেষ্টা করছি ওই নারীর কাছে যাবার জন্য কিন্তু তাপ, ধোঁয়া এতো পরিমাণ ছিলো যে, কাছে যেতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অনেক কষ্টের পর তাকে সুস্থভাবে উদ্ধার করতে পেরেছি। উনি কান্নায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে একটি বারের জন্যও স্ত্রী-সন্তান কারো কথা মনে পড়েনি আমার। অন্তঃস্বত্তা নারীর আকুতি মনে করিয়ে দেয় আমার ঘরে ছয় মাসের একটি সন্তান। প্রতিজ্ঞা করি, আমি মরে গেলেও এই নারীকে তার সন্তানসহ নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। ধীরে ধীরে ভবনের কাছে গিয়ে ওই নারীকে ল্যাডারে তোলার কাজ করতে থাকেন সুমন। সমান তালে চলতে থাকে আগুনের সাথে লড়াই। শেষমেষ সুমনের দৃঢ়তার কাছে হার মানে আগুন।
গর্ভবতী ওই নারীকে নিয়ে নিরাপদে নিচে নেমে যান তিনি। পরে একে একে কয়েকবারের চেষ্টায় নামিয়ে আনেন অন্তত চল্লিশ জনকে। বার বার চিৎকার করে নিচে বসে পড়ার কথা বলতে গিয়ে গলা ভেঙ্গে যায় সুমনের। তারপরও থামেনি তার চিৎকার। ‘গ্লাসের কাছে আসেন। পানিতে রুমাল ভিজিয়ে নেন। নিচে বসে পড়েন’ মানুষকে বাঁচাতে আরেক মানুষের চিৎকার। শহীদুল সুমন মানবজমিনকে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ল্যাডারটি মোট ৩০০ কেজি ওজন বহন করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী তিনি আর তার সহযোগী সোহাগহ আর দুজনের বেশি একবারে উঠতে পারার কথা নয়। তবে বিভিন্ন তলায় আটকে পড়া মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের অসহায় আবেদন আর বাঁচার তাড়নাকে না করতে পারেননি সুমন। একেক বারে ল্যাডারে করে ছয়-সাতজনকে নিচে নামিয়ে আনেন তিনি। যা ছিল কল্পনাতীত ঝুঁকি।
এমন সাহসিকতায় ফিরে আসে চল্লিশ প্রাাণ। অন্তত চার ঘণ্টার যুদ্ধের পর নিজেকে আবিষ্কার করেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের কেবিনে। সুমন বলেন যতদূর মনে পড়ে, সবশেষ ল্যাডারে আটকে পড়াদের ফিরিয়ে আনার পর ভেতরে আর কাউকে দেখা যায়নি। এফ আর টাওয়ারে আগুনের দিন দশম তলায় থাকা আমারা টেকনোলজির অফিসে আটকা পড়েন সেঁজুতি স্বর্ণা নামে একজন। কয়েক ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর চেষ্টার পর ওই ভবন থেকে নিরাপদে ফিরে আসেন তিনি। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে ফায়ার ফাইটার শহীদুল সুমনকে উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন সেঁজুতি। তিনি লিখেন, ‘এই ভদ্রলোক আমার কাছে ফেরেশতার সমান। আল্লাহ নিজ হাতে উনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের বাঁচানোর জন্য। নিজের জীবনের পরোয়া না করে আমাদের উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য অনেক দোয়া করছি আল্লাহ যেন আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করেন। ভাইয়া, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন শুধু মনে রাখবেন আপনার এই বোন আপনার জন্য দোয়া করবে....’। গতকাল কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল শহীদুল ইসলাম সুমনের। ঝালকাঠির কাঠালিয়ার মো. শাহ আলম জমাদ্দার ও মাজেদা আলমের সন্তান সুমন। স্ত্রী খালেদা ইয়াসমিনও তার মতো যোদ্ধা, যার মানে ফায়ার ফাইটার। সদরঘাট ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের স্টাফ অফিসার। ছয় মাসের ছেলে সাদমান সাদিরকে নিয়ে সদরঘাট এলাকায় থাকেন স্ত্রী খালেদা।
আর সুমন থাকেন তেজগাঁও লাভ লোড এলাকায়। তিন/চার দিন পর পর ছেলেকে দেখতে যাওয়ার সময় পান সুমন। এক শহরে থেকেও দায়িত্বের কারণে আলাদা থাকতে হয় দুজনকে। তবে নিরাপদে ফিরে আসা মানুষগুলোর কথা মনে করে এসব কষ্ট ভুলে যান। সুমনের কাজে বুক ভরে যায় স্ত্রী খালেদার। তিনি বলেন, বনানীর ঘটনার পর সুমনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের কথা মনে পড়েছিল কিনা। সে যখন বললো না। আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল তখন। তার না কথাটা শুনে খুশিতে বুকটা ভরে যায় আমার। শহীদুল ইসলাম সুমনদের এমন পাওয়াতেই আনন্দ। পরিবারকে দূরে রেখেও মানুষকে বাঁচাতে লড়ে যান প্রতিনিয়ত। আর প্রাণভরে রোজ সকালে একটাই প্রার্থণা করেন, ‘আর যেন কোথাও আগুন না লাগে।
তাদের টার্গেট কাজ করে যাওয়া। বিপদকে সঙ্গি করে বিপদগ্রস্থ মানুষকে আগলে তোলা। সংকট সময়ে তারা জানান দেয় ‘মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য’। এরই প্রমাণ দিয়েছেন বনানীর ফারুক রূপায়ন টাওয়ারের আগুনের সঙ্গে লড়াই করা বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। তাদের একেক জন কর্মী বাঁচিয়েছেন বহু প্রাণ।
এরমধ্যে স্টেশন অফিসার শহীদুল ইসলাম সুমন একাই জীবন রক্ষাকারী মই (টার্নট্যাবল ল্যাডার) নিয়ে আগুনের মাঝ থেকে বিভিন্ন তলা থেকে কমপক্ষে চল্লিশ জনকে উদ্ধার করেছেন। অন্তঃস্বত্তা নারী, সদ্য চাকরিতে যোগ দেয়া তরুণী কিংবা বয়োবৃদ্ধ, সুমনের বাহুতে ভর করে যেন নতুন জীবন ফিরে পান। মৃত্যুর দুয়ারে থাকা মানবগুলো আরেক মানবের সহায়তায় ফের দেখেন পৃথিবীর আলো। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আটকে পড়া মানুষগুলোকে পরম মমতায় নিরাপদে নামিয়ে আনেন সুমন। এ যেন সুমনের আরেক যুদ্ধ। এ যুদ্ধকেই তিনি বেছে নিয়েছেন পেশা হিসাবে। এখন যা তার কাছে নেশায় পরিণত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দুপুরে কথা হয় শহীদুল ইসলাম সুমনের সঙ্গে। ভাঙ্গা গলায় কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। বনানীতে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়ার সময় ধোঁয়ায় ফুসফুসে সংক্রমণ হয়। পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন কিছুটা সুস্থ তিনি। তবে, বনানীর আগুনের ঘটনা মনে করলেই বারে বারে এক মায়ের আর্তি ভিজিয়ে দেয় সুমনের চোখ। ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে মন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকালে সচিবালয়ের এলাকায় একজন শ্রমিক বহুতল ভবন থেকে পড়ে যায়। তাকে উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে মনটা ভারী হয়ে যায়।
সচিবালয়ে উদ্ধার কাজ শেষে ফায়ার সার্ভিসের গুলিস্থান সদর দফতরে ফিরে যান সুমন। তখনো দুপুরের খাবার সারেননি। সদর দফরের অফিসার্স মেসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক বারেটা ৫১ মিনিটে জরুরি ঘণ্টা বাজতে থাকে। সুমনের বুক তখন আঁতকে ওঠে। জরুরি ঘণ্টার মানে কোথাও ভয়াবহ আগুন লেগেছে। স্থানীয় ও পাশের স্টেশনগুলো সক্ষম না হলে ছুটে যেতে হবে সদর দফতর থেকে। আদতে হলো তাই। দ্রুত মহাখালী, কুর্মিটোলা ও বারিধারা ফায়ার স্টেশন রেসপন্স করার পরও ডাক পড়ে শহীদুল সুমনদের মতো বহু কর্মীর। দুপুরে না খেয়েই রওনা হন বনানীর এফ আর টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। যানজট ঠেলে বনানী পৌঁছাতে পোঁছাতে ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে কয়েকটি তলায়। ল্যাডারবাহী গাড়ি থেকে মই বের করে কাজ শুরু করতে গিয়ে বাধে আরেক বিপত্তি। উৎসাহী কিছু জনতার রোষানলের শিকার হন শহীদুল সুমন ও তার গাড়িচালক। এ সময় গাড়িচালককে মারধরও করেন কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এতে অন্তত ছয় মিনিট সময় নষ্ট হয়। এর মধ্যেই একজনকে ঝাঁপ দিতে দেখেন। এর মধ্যেই চিৎকার করে বলতে থাকেন আপনারা কেউ লাফ দিবেন না। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের নামিয়ে আনবো।
একটু অপেক্ষা করুন। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, হয়তো জনতা বাধা না দিলে আরো কয়েকটি প্রাণ বেঁচে যেত। ল্যাডারটি ষোল তলা পর্যন্ত যেতে সক্ষম, বাকি তলার মানুষদের কি হবে এমন ভাবনাও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল সুমনকে। তবে যতদূর পেরেছেন মানুষকে নিচে নিরাপদে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি জানান, ল্যাডার থেকে কোনভাবেই আগুনের কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না শুরুতে। প্রায় দুই হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মই থেকেই আগুনের ভয়াবহ উত্তাপ টের পাচ্ছিলেন। তবুও মানুষকে বাঁচানোর পথ খুঁজছিলেন তিনি। এর মাঝে কয়েকটি তলার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেন সুমন ও তার সহকারী সোহাগ কর্মকার। পানি ছিটিয়ে ধোঁয়া সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পানির বোতল ছুঁড়ে দেন আটকে পড়া মানুষদের কাছে। সব যজ্ঞই চলছিল আগুনের কাছে থেকে ল্যাডারে চড়ে, এক নিশ্চিত ঝুঁকিতে।
সুমন জানান, গ্লাস ভেঙ্গে পানি ছিটিয়ে দেয়ার পর আস্তে আস্তে ধোঁয়া সরে যায় বেশ কয়েকটি ফ্লোরে। এমন ঝুঁকির সময়ে ফায়ার ফাইটারদের ব্রিদিং অ্যাপারেটর নামে এক ধরনের মাস্ক পরে থাকতে হয়। আগুনের তাপ ও ধোঁয়ায় শ্বাসনালী ও ফুসফুসে ক্ষতি থেকে এমন মুখোশ পরতে হয়। কিন্তু মাস্ক পরে কোনভাবেই আটকে পড়া মানুষদের সাথে কথা বলতে পারছিলেন না সুমন। তাই মাস্ক খুলে মানুষদের না দাঁড়িয়ে থেকে নিচু হয়ে বসে যেতে বলেন। কারণ ধোঁয়ার প্রকট উপরের দিকেই বেশি। নিচে বসে পড়লে শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকি কম থাকে। তাদের ছুঁড়ে দেয়া পানির বোতল থেকে অনেকে তোয়ালে ও কাপড় ভিজিয়ে মুখ চেপে ধরে মইয়ের কাছে আসতে থাকেন একে একে। পানি ছড়ানোর কারণে অনেকে বেঁচে যান বলেও জানান সুমন। এমন সময় একজন নারীর আর্তনাদ কানে বাজে তার। ভেঙ্গে ফেলা গ্লাসের ফাঁক দিয়ে দেখতে পান একজন গর্ভবর্তী বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। সুমন মানবজমিনকে বলেন, কাছে গিয়ে শুনতে পাই ওই নারী আমাকে বার বার বলছে, ভাই আমি মরে যাই। কিন্তু আমার পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচান।
পরিবাররে কথা মনে পড়ে যায় আমার। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল আমারও তো পাঁচ মাস বয়সের একটি ছেলে আছে। আমার ছেলেটা তো পৃথিবীর আলো দেখেছে। অঙ্গীকার করেছিলাম জীবন দিয়ে হলেও আমি ওই বাচ্চাটাকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখাব। অনেক চেষ্টা করছি ওই নারীর কাছে যাবার জন্য কিন্তু তাপ, ধোঁয়া এতো পরিমাণ ছিলো যে, কাছে যেতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অনেক কষ্টের পর তাকে সুস্থভাবে উদ্ধার করতে পেরেছি। উনি কান্নায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে একটি বারের জন্যও স্ত্রী-সন্তান কারো কথা মনে পড়েনি আমার। অন্তঃস্বত্তা নারীর আকুতি মনে করিয়ে দেয় আমার ঘরে ছয় মাসের একটি সন্তান। প্রতিজ্ঞা করি, আমি মরে গেলেও এই নারীকে তার সন্তানসহ নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। ধীরে ধীরে ভবনের কাছে গিয়ে ওই নারীকে ল্যাডারে তোলার কাজ করতে থাকেন সুমন। সমান তালে চলতে থাকে আগুনের সাথে লড়াই। শেষমেষ সুমনের দৃঢ়তার কাছে হার মানে আগুন।
গর্ভবতী ওই নারীকে নিয়ে নিরাপদে নিচে নেমে যান তিনি। পরে একে একে কয়েকবারের চেষ্টায় নামিয়ে আনেন অন্তত চল্লিশ জনকে। বার বার চিৎকার করে নিচে বসে পড়ার কথা বলতে গিয়ে গলা ভেঙ্গে যায় সুমনের। তারপরও থামেনি তার চিৎকার। ‘গ্লাসের কাছে আসেন। পানিতে রুমাল ভিজিয়ে নেন। নিচে বসে পড়েন’ মানুষকে বাঁচাতে আরেক মানুষের চিৎকার। শহীদুল সুমন মানবজমিনকে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ল্যাডারটি মোট ৩০০ কেজি ওজন বহন করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী তিনি আর তার সহযোগী সোহাগহ আর দুজনের বেশি একবারে উঠতে পারার কথা নয়। তবে বিভিন্ন তলায় আটকে পড়া মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের অসহায় আবেদন আর বাঁচার তাড়নাকে না করতে পারেননি সুমন। একেক বারে ল্যাডারে করে ছয়-সাতজনকে নিচে নামিয়ে আনেন তিনি। যা ছিল কল্পনাতীত ঝুঁকি।
এমন সাহসিকতায় ফিরে আসে চল্লিশ প্রাাণ। অন্তত চার ঘণ্টার যুদ্ধের পর নিজেকে আবিষ্কার করেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের কেবিনে। সুমন বলেন যতদূর মনে পড়ে, সবশেষ ল্যাডারে আটকে পড়াদের ফিরিয়ে আনার পর ভেতরে আর কাউকে দেখা যায়নি। এফ আর টাওয়ারে আগুনের দিন দশম তলায় থাকা আমারা টেকনোলজির অফিসে আটকা পড়েন সেঁজুতি স্বর্ণা নামে একজন। কয়েক ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর চেষ্টার পর ওই ভবন থেকে নিরাপদে ফিরে আসেন তিনি। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে ফায়ার ফাইটার শহীদুল সুমনকে উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন সেঁজুতি। তিনি লিখেন, ‘এই ভদ্রলোক আমার কাছে ফেরেশতার সমান। আল্লাহ নিজ হাতে উনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের বাঁচানোর জন্য। নিজের জীবনের পরোয়া না করে আমাদের উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য অনেক দোয়া করছি আল্লাহ যেন আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করেন। ভাইয়া, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন শুধু মনে রাখবেন আপনার এই বোন আপনার জন্য দোয়া করবে....’। গতকাল কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল শহীদুল ইসলাম সুমনের। ঝালকাঠির কাঠালিয়ার মো. শাহ আলম জমাদ্দার ও মাজেদা আলমের সন্তান সুমন। স্ত্রী খালেদা ইয়াসমিনও তার মতো যোদ্ধা, যার মানে ফায়ার ফাইটার। সদরঘাট ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের স্টাফ অফিসার। ছয় মাসের ছেলে সাদমান সাদিরকে নিয়ে সদরঘাট এলাকায় থাকেন স্ত্রী খালেদা।
আর সুমন থাকেন তেজগাঁও লাভ লোড এলাকায়। তিন/চার দিন পর পর ছেলেকে দেখতে যাওয়ার সময় পান সুমন। এক শহরে থেকেও দায়িত্বের কারণে আলাদা থাকতে হয় দুজনকে। তবে নিরাপদে ফিরে আসা মানুষগুলোর কথা মনে করে এসব কষ্ট ভুলে যান। সুমনের কাজে বুক ভরে যায় স্ত্রী খালেদার। তিনি বলেন, বনানীর ঘটনার পর সুমনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের কথা মনে পড়েছিল কিনা। সে যখন বললো না। আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল তখন। তার না কথাটা শুনে খুশিতে বুকটা ভরে যায় আমার। শহীদুল ইসলাম সুমনদের এমন পাওয়াতেই আনন্দ। পরিবারকে দূরে রেখেও মানুষকে বাঁচাতে লড়ে যান প্রতিনিয়ত। আর প্রাণভরে রোজ সকালে একটাই প্রার্থণা করেন, ‘আর যেন কোথাও আগুন না লাগে।
No comments