সুচি: গণতন্ত্রের আইকন থেকে রোহিঙ্গা গণহত্যার সহযোগী by ডেভিড আই স্টেইনবার্গ
একজন
জাতীয় নেতা যখন রক্তশূন্য করে দেয়ার মতো, উড়িয়ে দেয়ার মতো কথা বলেন, যখন
বলেন ‘এটা (রোহিঙ্গা সংকট) আরো ভালোভাবে মোকাবিলা করা যেত’ তখন চোখের সামনে
বিশ্বের সবচেয়ে বিপর্যয়কর একটি ট্র্যাজেডি ভেসে ওঠে। মিয়ানমারের স্টেট
কাউন্সেলর, বেসামরিক শাসক অং সান সুচি সরকারি সফরে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন।
সেখানে তিনি রাষ্ট্রহীন, রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপরে মিয়ানমারের
সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতা প্রকাশ্যে ডিসমিস করে দেন। সেনাবাহিনীর ওই
নৃশংসতায় কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।
ধরে নেয়া হয় হত্যা করা হয়েছে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে। গণধর্ষণ ও শিশুদের
হত্যার প্রমাণও রয়েছে।
এই নৃশংসতার বিষয়ে এমন অবস্থান নিয়েছেন সেই নোবেলজয়ী নেত্রী, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব সামনে তুলে ধরেছে গণতন্ত্রের একজন আইকন হিসেবে। তিনি প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে।
এটা সত্য যে, তিনি গণতন্ত্রের আইকন হতে চান নি। এমনটি তিনি নিজেই বলেছেন। অচেনা পথে ছুটে চলা দেশকে গণতন্ত্রের পথে নেয়ার চেষ্টা করে তিনি একজন রাজনীতিক হতে চেয়েছেন। কিন্তু এজন্য তিনি আন্তর্জাতিক ইতিবাচক স্পটলাইট ব্যবহার করেছেন। সাহস ও গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়তার জন্য তিনি পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ যাকে জাতি নিধন বলে অভিহিত করেছে, তিনি তা অস্বীকার করছেন। ওই জাতি নিধনকে অনেকেই এখন দেখছেন গণহত্যা হিসেবে। তারপরও রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে প্রকাশ্যে অমনোযোগী ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার মতো সুচির বিবৃতি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার সুনাম ধ্বংস হচ্ছে। পশ্চিমারা যে বিনিয়োগ করেছিল তা কমে যাচ্ছে। তার দেশ এমন একটি সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা দীর্ঘায়িত হবে এবং দুঃসাধ্যকর হবে।
এর মধ্যেই, রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার সংবাদ প্রকাশ করায় মিয়ানমারে রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে সাত বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। সুচির দাবি অনুযায়ী, অভিযুক্ত সাংবাদিকরা বৃটিশ আমলে প্রণয়ন করা অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী সমপূর্ণ দোষী। এর মধ্য দিয়ে সুচি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আগে তিনি যে সাধনা করেছিলেন সেগুলো আসলেই অর্থহীন। একজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা অনুসারেই দুই সাংবাদিকের বিচার করা হয়েছে। ওই আদালত নিরপেক্ষ ছিল না।
রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের প্রতি তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, সুচিকে অবশ্যই বেসামরিক প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ন্যূনতম ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। দেশটিতে মন্ত্রিপরিষদের নিম্ন স্তরের প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। এমন অবস্থায় তিনি যদি সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেন, তাহলে সংবিধান অনুসারে সামরিক আইন জারি করার বৈধ ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে। এমনকি আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাসের সুযোগও তাদের রয়েছে।
পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট থেন সেইনের আমলে সামরিক বাহিনীতে যে ব্যাপক সংস্কার ও উদারীকরণ করা হয়েছে তা দরকার ছিল। তখন এ পদক্ষেপ দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর আচরণের ভিত্তিতে মিয়ানমারকে বিবেচনা করছে। গত সরকারের আমলে মিয়ানমারে যেসব উন্নতি হয়েছে তার ভিত্তিতে না।
মিয়ানমার সরকারের কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। আর এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটায় মিয়ানমার সরকার, অন্তত সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন ও মুসলিম বিদ্বেষী জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে চীন পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছে। একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো অভিযানের সমালোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীন। দেশটি হয়তো উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কায় এমন ভূমিকা রেখেছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, গুটিকয়েক সশস্ত্র মুসলিম বিদ্রোহীর কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার জন্যই তারা অভিযান চালিয়েছে। কেননা সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা সংকট সমাধানে যথাযথ না। কিন্তু সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো সমন্বিত ও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া উস্কে দিতে পারে। কয়েক দশক আগে যেমন ওসামা বিন লাদেন মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপর দমনপীড়ন চালানোর অভিযোগ তুলেছিলেন।
এ সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। বর্তমান বিপর্যয়ের আগেও রোহিঙ্গারা নিয়ন্ত্রণ ও দমন-পীড়নের মধ্যে বসবাস করছিল। সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক উপকরণগুলোও তাদের ছিল না। এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
দায়সারা নিন্দাজ্ঞাপন ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে আমাদের দোষারোপ করা হতে পারে। কিন্তু এ সংকটের মূল অপরাধী মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর অং সান সুচি হলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা সহ-ষড়যন্ত্রকারী।
(সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। লেখক ডেভিড আই স্টেইনবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিভাগের অধ্যাপক)
এই নৃশংসতার বিষয়ে এমন অবস্থান নিয়েছেন সেই নোবেলজয়ী নেত্রী, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব সামনে তুলে ধরেছে গণতন্ত্রের একজন আইকন হিসেবে। তিনি প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে।
এটা সত্য যে, তিনি গণতন্ত্রের আইকন হতে চান নি। এমনটি তিনি নিজেই বলেছেন। অচেনা পথে ছুটে চলা দেশকে গণতন্ত্রের পথে নেয়ার চেষ্টা করে তিনি একজন রাজনীতিক হতে চেয়েছেন। কিন্তু এজন্য তিনি আন্তর্জাতিক ইতিবাচক স্পটলাইট ব্যবহার করেছেন। সাহস ও গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়তার জন্য তিনি পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ যাকে জাতি নিধন বলে অভিহিত করেছে, তিনি তা অস্বীকার করছেন। ওই জাতি নিধনকে অনেকেই এখন দেখছেন গণহত্যা হিসেবে। তারপরও রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে প্রকাশ্যে অমনোযোগী ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার মতো সুচির বিবৃতি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার সুনাম ধ্বংস হচ্ছে। পশ্চিমারা যে বিনিয়োগ করেছিল তা কমে যাচ্ছে। তার দেশ এমন একটি সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা দীর্ঘায়িত হবে এবং দুঃসাধ্যকর হবে।
এর মধ্যেই, রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার সংবাদ প্রকাশ করায় মিয়ানমারে রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে সাত বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। সুচির দাবি অনুযায়ী, অভিযুক্ত সাংবাদিকরা বৃটিশ আমলে প্রণয়ন করা অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী সমপূর্ণ দোষী। এর মধ্য দিয়ে সুচি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আগে তিনি যে সাধনা করেছিলেন সেগুলো আসলেই অর্থহীন। একজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা অনুসারেই দুই সাংবাদিকের বিচার করা হয়েছে। ওই আদালত নিরপেক্ষ ছিল না।
রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের প্রতি তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, সুচিকে অবশ্যই বেসামরিক প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ন্যূনতম ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। দেশটিতে মন্ত্রিপরিষদের নিম্ন স্তরের প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। এমন অবস্থায় তিনি যদি সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেন, তাহলে সংবিধান অনুসারে সামরিক আইন জারি করার বৈধ ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে। এমনকি আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাসের সুযোগও তাদের রয়েছে।
পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট থেন সেইনের আমলে সামরিক বাহিনীতে যে ব্যাপক সংস্কার ও উদারীকরণ করা হয়েছে তা দরকার ছিল। তখন এ পদক্ষেপ দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর আচরণের ভিত্তিতে মিয়ানমারকে বিবেচনা করছে। গত সরকারের আমলে মিয়ানমারে যেসব উন্নতি হয়েছে তার ভিত্তিতে না।
মিয়ানমার সরকারের কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। আর এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটায় মিয়ানমার সরকার, অন্তত সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন ও মুসলিম বিদ্বেষী জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে চীন পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছে। একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো অভিযানের সমালোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীন। দেশটি হয়তো উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কায় এমন ভূমিকা রেখেছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, গুটিকয়েক সশস্ত্র মুসলিম বিদ্রোহীর কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার জন্যই তারা অভিযান চালিয়েছে। কেননা সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা সংকট সমাধানে যথাযথ না। কিন্তু সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো সমন্বিত ও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া উস্কে দিতে পারে। কয়েক দশক আগে যেমন ওসামা বিন লাদেন মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপর দমনপীড়ন চালানোর অভিযোগ তুলেছিলেন।
এ সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। বর্তমান বিপর্যয়ের আগেও রোহিঙ্গারা নিয়ন্ত্রণ ও দমন-পীড়নের মধ্যে বসবাস করছিল। সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক উপকরণগুলোও তাদের ছিল না। এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
দায়সারা নিন্দাজ্ঞাপন ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে আমাদের দোষারোপ করা হতে পারে। কিন্তু এ সংকটের মূল অপরাধী মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর অং সান সুচি হলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা সহ-ষড়যন্ত্রকারী।
(সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। লেখক ডেভিড আই স্টেইনবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিভাগের অধ্যাপক)
No comments