প্রতিবাদী ওয়াক আউট
গণপ্রতিনিধিত্ব
আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের
পদ্ধতি যুক্ত করার প্রতিবাদে নির্বাচন কমিশনের সভা বর্জন করেছেন নির্বাচন
কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সভা শুরুর আধা ঘণ্টা পর
তিনি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
নোট অব ডিসেন্টে ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিরোধিতার কারণ হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপে ইভিএমের উল্লেখ না থাকা, ইভিএম প্রকল্পের তথ্য না জানা, রাজনৈতিক দলের অনীহা ও ইভিএম সম্পর্কিত যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। পরে মাহবুব তালুকদারকে ছাড়াই কমিশন সভায় ইভিএম রেখেই আরপিও সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসি কেএম নূরুল হুদা নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে বলেন, ওনার ভিন্নমত থাকতে পারে, এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।
একজন কমিশনারের আপত্তি থাকলেও বাকি চার কমিশনার আরপিও সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানান সিইসি। সিইসির ঘোষণার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মাহবুব তালুকদার সভা বর্জনের কারণ সম্পর্কে বলেন, আমি এটার (ইভিএম ব্যবহারের) বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মোটেই চাই না আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধন হোক। এখন ওনারা বসে বসে আরপিও সংশোধন করতে থাকবেন আর আমি সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার পর মূর্তির মতো বসে থাকব, এটা আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি।
মাহবুব তালুকদার আরো বলেন, ওনারা ওনাদের কাজ করুক, আমি আমার কাজ করি। আমার মনে হয়েছে ওখানে বসে থাকাটা সমীচীন না। মাহবুব তালুকদার জানান, এর আগে কোনো কমিশন সভায় ইভিএম প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। অতীতের কমিশন সভার কার্যবিবরণী খুঁজে এমন কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে না বলে দাবি করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুকদার বলেন, আমি একজন গণতন্ত্রমনা মানুষ। সংসদ নির্বাচন এখনও বেশ দূরে। তখনকার অবস্থা কী হবে এই মুহূর্তে বলতে পারি না। অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে বলেছে ইভিএম চায় না। কেউ যদি বলে চায় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, আমি যে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি এটা কারও বিরুদ্ধে নয়। এটা একটা মতের বিরুদ্ধে আমার ভিন্নমত। আমি দ্বিমত পোষণ করতে পারি, ভিন্নমত পোষণ করতে পারি। তাই বলে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আমার কোনো মতবিরোধ নেই।
নোট অব ডিসেন্টে যা লিখেছেন মাহবুব তালুকদার
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্টে লেখেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। এমতাবস্থায় ওই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি। ২৬শে আগস্ট অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কমিশন সভার প্রসঙ্গ টেনে ‘নোট অব ডিসেন্টে’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বাকি তিন কমিশনারের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনে ইসি তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় রূপান্তর-যা একজন পরার্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন।
সর্বশেষ প্রস্তাবটি হলো-একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময়স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন। নির্বাচন কমিশনের ২৬শে আগস্টের সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। ইভিএম ও আরপিও সম্পর্কে আরো বিচার-বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিমিত্ত কমিশনের সভা ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। মাহবুব তালুকদার বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে ইতিমধ্যে ব্যবহার হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগতভাবে সংলাপকালে ইভিএম সম্পর্কে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পর বিরোধী। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অধিকতর আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল।
স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলক ইভিএম ব্যবহারের শুরুতে বলা হয়েছিল উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সমপ্রতি ৩৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, তা বিবেচনাযোগ্য। এতে সরকারি অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত রকিব উদ্দিন কমিশন ইভিএম ব্যবহার বাতিল করে অনেক ইভিএম ধ্বংস করে দেয়। এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনই কাম্য নয়।
পরিকল্পনা কমিশন অদ্যাবধি প্রকল্পটির সম্ভাব্য যাচাই করে নি বলে তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, যে ইভিএম বিএমটিএফ থেকে সরকারি সংস্থার সুবাদে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, এর অরিজিন কী, কে উদ্ভাবন করেছে কিংবা কোত্থেকে আমদানি করা হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কারিগরি দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করার পর অদ্যাবধি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি বলে জানা যায়।
মাহবুব তালুকদার নোটে বলেন, আরপিও তে শুধু ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনীটি আনা হয়েছে তা ইতিমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। আমি ধারণা করি সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া সঙ্গত হবে না।
যন্ত্রের অগ্রগতির যুগে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধী নন বলে উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঘাটতি তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রথমত, ইভিএম ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশন যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পর্কে আমি সন্দিহান। দ্বিতীয়ত, অনেক ভোটার অজ্ঞাতপ্রসূত কারণে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তারা ইভিএমের বিষয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তা নিরসনের জন্য ব্যাপক প্রচার ও ভোটারদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। সিটি নির্বাচনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ধীরে ধীরে ইভিএম ব্যবহার বাড়ানো হলে ভোটাররা তাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়বেন। এই অভ্যস্থতার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তা একাদশ জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করলে ৫-৭ বছর পরে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেন এ নির্বাচন কমিশনার। বর্তমান ইসির অধীনে ৩০শে অক্টোবর থেকে ২৮শে জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে আসায় আইন সংস্কারের কাজ বাদ দিয়ে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো এগোচ্ছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে ইভিএম নিয়ে নতুন প্রকল্প নেয়া ও নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে ইসি।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধিতা ও দক্ষ জনবলের বিষয়টি তুলে ধরে ইভিএম নিয়ে আরপিও সংশোধন নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন মাহবুব তালুকদার। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনের আচরণবিধি সংশোধন নিয়ে অন্যদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার। এর আগে ইসি কর্মকর্তাদের বদলি নিয়েও আন-অফিসিয়াল (ইউও নোট) দেন তিনি। সেনা মোতায়েন ও গাজীপুরের ভোটে অনিয়ম নিয়েও নিজের মতামত দিয়ে আলোচনায় ছিলেন এ নির্বাচন কমিশনার। বড় নির্বাচনে অনিয়ম রোধে সিইসির এক বক্তব্য নিয়েও সর্বশেষ আলোচিত হন মাহবুব তালুকদার। উল্লেখ্য, কমিশন সভা বর্জন ও নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার ঘটনার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৬ সালে ভোটার তালিকা নতুন করে নাকি হালনাগাদ করে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করা হবে এ নিয়ে সাবেক এমএ আজিজের কমিশনের দু’জন কমিশনার বিরোধী করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বর্জন করেছিলেন ওই সংক্রান্ত সভাও।
নোট অব ডিসেন্টে ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিরোধিতার কারণ হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপে ইভিএমের উল্লেখ না থাকা, ইভিএম প্রকল্পের তথ্য না জানা, রাজনৈতিক দলের অনীহা ও ইভিএম সম্পর্কিত যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। পরে মাহবুব তালুকদারকে ছাড়াই কমিশন সভায় ইভিএম রেখেই আরপিও সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসি কেএম নূরুল হুদা নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে বলেন, ওনার ভিন্নমত থাকতে পারে, এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।
একজন কমিশনারের আপত্তি থাকলেও বাকি চার কমিশনার আরপিও সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানান সিইসি। সিইসির ঘোষণার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মাহবুব তালুকদার সভা বর্জনের কারণ সম্পর্কে বলেন, আমি এটার (ইভিএম ব্যবহারের) বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মোটেই চাই না আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধন হোক। এখন ওনারা বসে বসে আরপিও সংশোধন করতে থাকবেন আর আমি সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার পর মূর্তির মতো বসে থাকব, এটা আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি।
মাহবুব তালুকদার আরো বলেন, ওনারা ওনাদের কাজ করুক, আমি আমার কাজ করি। আমার মনে হয়েছে ওখানে বসে থাকাটা সমীচীন না। মাহবুব তালুকদার জানান, এর আগে কোনো কমিশন সভায় ইভিএম প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। অতীতের কমিশন সভার কার্যবিবরণী খুঁজে এমন কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে না বলে দাবি করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুকদার বলেন, আমি একজন গণতন্ত্রমনা মানুষ। সংসদ নির্বাচন এখনও বেশ দূরে। তখনকার অবস্থা কী হবে এই মুহূর্তে বলতে পারি না। অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে বলেছে ইভিএম চায় না। কেউ যদি বলে চায় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, আমি যে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি এটা কারও বিরুদ্ধে নয়। এটা একটা মতের বিরুদ্ধে আমার ভিন্নমত। আমি দ্বিমত পোষণ করতে পারি, ভিন্নমত পোষণ করতে পারি। তাই বলে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আমার কোনো মতবিরোধ নেই।
নোট অব ডিসেন্টে যা লিখেছেন মাহবুব তালুকদার
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্টে লেখেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। এমতাবস্থায় ওই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি। ২৬শে আগস্ট অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কমিশন সভার প্রসঙ্গ টেনে ‘নোট অব ডিসেন্টে’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বাকি তিন কমিশনারের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনে ইসি তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় রূপান্তর-যা একজন পরার্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন।
সর্বশেষ প্রস্তাবটি হলো-একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময়স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন। নির্বাচন কমিশনের ২৬শে আগস্টের সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। ইভিএম ও আরপিও সম্পর্কে আরো বিচার-বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিমিত্ত কমিশনের সভা ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। মাহবুব তালুকদার বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে ইতিমধ্যে ব্যবহার হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগতভাবে সংলাপকালে ইভিএম সম্পর্কে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পর বিরোধী। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অধিকতর আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল।
স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলক ইভিএম ব্যবহারের শুরুতে বলা হয়েছিল উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সমপ্রতি ৩৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, তা বিবেচনাযোগ্য। এতে সরকারি অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত রকিব উদ্দিন কমিশন ইভিএম ব্যবহার বাতিল করে অনেক ইভিএম ধ্বংস করে দেয়। এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনই কাম্য নয়।
পরিকল্পনা কমিশন অদ্যাবধি প্রকল্পটির সম্ভাব্য যাচাই করে নি বলে তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, যে ইভিএম বিএমটিএফ থেকে সরকারি সংস্থার সুবাদে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, এর অরিজিন কী, কে উদ্ভাবন করেছে কিংবা কোত্থেকে আমদানি করা হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কারিগরি দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করার পর অদ্যাবধি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি বলে জানা যায়।
মাহবুব তালুকদার নোটে বলেন, আরপিও তে শুধু ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনীটি আনা হয়েছে তা ইতিমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। আমি ধারণা করি সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া সঙ্গত হবে না।
যন্ত্রের অগ্রগতির যুগে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধী নন বলে উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঘাটতি তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রথমত, ইভিএম ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশন যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পর্কে আমি সন্দিহান। দ্বিতীয়ত, অনেক ভোটার অজ্ঞাতপ্রসূত কারণে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তারা ইভিএমের বিষয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তা নিরসনের জন্য ব্যাপক প্রচার ও ভোটারদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। সিটি নির্বাচনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ধীরে ধীরে ইভিএম ব্যবহার বাড়ানো হলে ভোটাররা তাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়বেন। এই অভ্যস্থতার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তা একাদশ জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করলে ৫-৭ বছর পরে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেন এ নির্বাচন কমিশনার। বর্তমান ইসির অধীনে ৩০শে অক্টোবর থেকে ২৮শে জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে আসায় আইন সংস্কারের কাজ বাদ দিয়ে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো এগোচ্ছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে ইভিএম নিয়ে নতুন প্রকল্প নেয়া ও নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে ইসি।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধিতা ও দক্ষ জনবলের বিষয়টি তুলে ধরে ইভিএম নিয়ে আরপিও সংশোধন নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন মাহবুব তালুকদার। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনের আচরণবিধি সংশোধন নিয়ে অন্যদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার। এর আগে ইসি কর্মকর্তাদের বদলি নিয়েও আন-অফিসিয়াল (ইউও নোট) দেন তিনি। সেনা মোতায়েন ও গাজীপুরের ভোটে অনিয়ম নিয়েও নিজের মতামত দিয়ে আলোচনায় ছিলেন এ নির্বাচন কমিশনার। বড় নির্বাচনে অনিয়ম রোধে সিইসির এক বক্তব্য নিয়েও সর্বশেষ আলোচিত হন মাহবুব তালুকদার। উল্লেখ্য, কমিশন সভা বর্জন ও নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার ঘটনার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৬ সালে ভোটার তালিকা নতুন করে নাকি হালনাগাদ করে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করা হবে এ নিয়ে সাবেক এমএ আজিজের কমিশনের দু’জন কমিশনার বিরোধী করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বর্জন করেছিলেন ওই সংক্রান্ত সভাও।
No comments