দুর্নীতির শীর্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা -টিআইবি’র রিপোর্ট
আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই সেবাগ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার। এ
বাহিনীর কাছে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে ৭২ দশমিক ২ ভাগ সেবাগ্রহীতা। আর আইনি
সেবা পেতে ৪৯ দশমিক ৮ ভাগ মানুষকে গুনতে হচ্ছে ঘুষের টাকা। একইভাবে ২৩টি
সেবা খাতে প্রাত্যহিক ও গুরুত্বপূর্ণ সেবা পেতে ঘুষ-দুর্নীতিতে গলদঘর্ম হতে
হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দেশে দুর্নীতির এমন চিত্র উঠে এসেছে
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
পরিচালিত ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ এ। গতকাল সকালে
রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই
জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, টিআইবি’র ট্রাস্টি
বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড.
ইফতেখারুজ্জামান, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ ও
পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন
করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো.
ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম
ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।
টিআইবির ২০১৭ সালের খানা জরিপে তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২৭টি সেবা খাতে এই জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে প্রধান ১৫টি খাত হলো- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি, সেবা, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা এবং গ্যাস। দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলার গ্রাম ও শহরাঞ্চলের ১৫ হাজার ৫৮১টি খানা বা পরিবারের উপর চূড়ান্তভাবে এই জরিপ চালানো হয়। তাতে সেবাখাতে ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারকে দুর্নীতি হিসেবে ধরা হয়েছে। এই দুর্নীতির আওতার মধ্যে রয়েছে ঘুষ, সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন ধরনের হয়রানি। খাতগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।
এই বাহিনীগুলোর কাছে গত বছর গ্রামাঞ্চলের ৭৬ ও শহরাঞ্চলের প্রায় ৭১ভাগ খানা প্রধান বা পরিবারের কর্তা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। অপরদিকে দুর্নীতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পাসপোর্ট সেবা পেতে ৬৭, বিআরটিতে ৬৫, বিচারিক সেবায় ৬০, ভূমি সেবায় প্রায় ৪৯, শিক্ষায় ৪২, স্বাস্থ্যে (সরকারি) ৪২, কৃষিতে ৪১, বিদ্যুতে প্রায় ৩৯, গ্যাসে ৩৮, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ২৬, বীমায় ১২, কর ও শুল্কে ১১, ব্যাংকিংয়ে প্রায় ৬, এনজিওতে (ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ) ৫ ভাগ সেবা গ্রহীতা দুর্নীতির শিকার।
অপর দিকে এসব ক্ষেত্রে সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয় প্রায় ৫০ ভাগ সেবা গ্রহীতাকে। ঘুষে শীর্ষে রয়েছে বিআরটিএ। গত বছর ৬৩ ভাগ সেবা গ্রহীতাকে বিআরটিতে ঘুষ গুণতে হয়। দ্বিতীয় স্থানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের কাছে প্রায় ৬১ ভাগ সেবা টাকা দিয়ে পেতে হয়েছে। প্রায় ৬০ ভাগ মানুষকে পাসপোর্টের জন্য অর্থ দিতে হয়। এছাড়া ভূমি সেবায় প্রায় ৩৮, শিক্ষায় ৩৪, বিচারিক সেবায় প্রায় ৩৩, কৃষিতে ৩০, স্বাস্থ্যে প্রায় ১৯, বিদ্যুতে ১৮, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ১৮, গ্যাসে প্রায় ১২ ভাগ সেবাগ্রহীতাকে ঘুষের টাকা গুনতে হয়। দু’বছর পর পর পরিচালিত জরিপের মধ্যে ইতিপূর্বে ২০১৫ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ পয়েন্ট কম। তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার খানার হার কমলেও ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে।
২০১৭ সালে একজন সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৫ হাজার ৯৩০টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ২০১৫ সালে তা ছিল ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা। সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়ের হয় গ্যাস (৩৩,৮০৫ টাকা), বিচারিক সেবা (১৬,৬৮৮ টাকা) ও বীমা খাত (১৪,৮৬৫ টাকা)। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ গত ২০১৫ সালের জরিপে ৮ হাজার ৮২১ কোটি টাকা থাকলেও গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪% এবং বাংলাদেশের জিডিপি’র ০.৫%। ঘুষ প্রদানের প্রধান কারণ হলো ঘুষ না দিলে সেবা মিলবে না এমন ধারণা বা মানসিকতা। ঠিক এই কারণে ৮৯ ভাগ সেবাগ্রহীতা ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া হয়রানি বা জটিলতা এড়াতে ঘুষ দিচ্ছে ৪৭ ভাগ মানুষ। নির্ধারিত ফি না জানা ও নির্ধারিত সময়ে সেবা পেতে ঘুষ দিচ্ছে যথাক্রমে ৩৭ ও ২৩ ভাগ সেবাগ্রহীতা। অন্য কারণগুলোর মধ্যে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায়।
অপর দিকে দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রায় ৫০ ভাগ মানুষই ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের ফাঁদে পড়ে তাতে শিকার হচ্ছেন। দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুর্নীতির শিকার প্রায় ৪০ ভাগ সেবাগ্রহীতার।
এ ছাড়া জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষিতদের চেয়ে কম বা অশিক্ষিতরা বেশি ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার। শিক্ষিত পেশাজীবীদের চেয়ে কৃষক, জেলে, পরিবহন শ্রমিক, কামার, কুমার, প্রবাসী, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি ইত্যাদি স্বল্প বা অশিক্ষিত পেশাজীবীদেরকে বেশি টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়। স্বল্প আয়ের লোকেদেরকেই ঘুষের বোঝা বেশি বইতে হচ্ছে। যেমন ১৬ হাজার টাকার নিচে যাদের আয় তাদের আয়ের ২ দশমিক ৪১ ভাগ টাকা যাচ্ছে ঘুষে। অন্য দিকে ৬৪ হাজার টাকা বেশি যাদের আয় তাদেরকে ঘুষে দিতে হচ্ছে দশমিক এক দুই ভাগ টাকা। তবে আশার কথা হলো, বয়স্কদের চেয়ে অল্প বয়স্ক তরুণরা কম দুর্নীতির শিকার।
সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। যাদের ওপর দায়িত্ব তারা দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনছেন না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘুষ ও দুর্নীতি মেনে নেওয়া সার্বিকভাবে আমাদের জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে কিছু সূচক ও খাতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও সার্বিকভাবে দেশের দুর্নীতির চিত্র উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ কমে যাবে বলে অনেকের প্রত্যাশা থাকলেও গবেষণার ফলাফল বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন কমেছে যার পেছনে বর্ধিত বেতন-ভাতাসহ অন্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করে অভ্যস্ত তাদের জন্য বেতন-ভাতা কোনো বিষয় নয়। তারা বেতন-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করেন দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেবাগ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী, পর্যবেক্ষক ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আন্তরিক হন এবং দুর্নীতির বিচারের সময় যদি দুর্নীতিকারীর পরিচয়, অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনা করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা না থাকে তাহলে দুর্নীতির মাত্রা এত বেশি হতো না।
জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলোকে আরো বেশি প্রসারিত করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন যত বেশি স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে বলে ড. জামান অভিমত ব্যক্ত করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সেবাখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে টিআইবি ১২ দফা সুপারিশ পেশ করে। এর মধ্যে রয়েছে, বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকর করা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদৃঢ় নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে তার ভিত্তিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
এ ছাড়া রয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণ-শুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও জন-অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করাসহ গণমাধ্যমের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করা। ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ ও ‘তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১’ এর কার্যকর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ সকল অংশীজনের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করা।
উল্লেযোগ্য অপর সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে অনলাইনে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ বৃদ্ধি, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়া প্রচলন ও কার্যকর করার পাশাপাশি নাগরিক সনদের কার্যকর বাস্তবায়ন করা এবং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় ধাপ ও অন্যান্য বাধা দূর করতে পদ্ধতিগত সংস্কার করা। এছাড়াও জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকস এর ঘাটতি দূরীকরণে সেবাখাতগুলোতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে টিআইবি।
টিআইবির ২০১৭ সালের খানা জরিপে তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২৭টি সেবা খাতে এই জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে প্রধান ১৫টি খাত হলো- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি, সেবা, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা এবং গ্যাস। দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলার গ্রাম ও শহরাঞ্চলের ১৫ হাজার ৫৮১টি খানা বা পরিবারের উপর চূড়ান্তভাবে এই জরিপ চালানো হয়। তাতে সেবাখাতে ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারকে দুর্নীতি হিসেবে ধরা হয়েছে। এই দুর্নীতির আওতার মধ্যে রয়েছে ঘুষ, সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন ধরনের হয়রানি। খাতগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।
এই বাহিনীগুলোর কাছে গত বছর গ্রামাঞ্চলের ৭৬ ও শহরাঞ্চলের প্রায় ৭১ভাগ খানা প্রধান বা পরিবারের কর্তা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। অপরদিকে দুর্নীতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পাসপোর্ট সেবা পেতে ৬৭, বিআরটিতে ৬৫, বিচারিক সেবায় ৬০, ভূমি সেবায় প্রায় ৪৯, শিক্ষায় ৪২, স্বাস্থ্যে (সরকারি) ৪২, কৃষিতে ৪১, বিদ্যুতে প্রায় ৩৯, গ্যাসে ৩৮, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ২৬, বীমায় ১২, কর ও শুল্কে ১১, ব্যাংকিংয়ে প্রায় ৬, এনজিওতে (ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ) ৫ ভাগ সেবা গ্রহীতা দুর্নীতির শিকার।
অপর দিকে এসব ক্ষেত্রে সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয় প্রায় ৫০ ভাগ সেবা গ্রহীতাকে। ঘুষে শীর্ষে রয়েছে বিআরটিএ। গত বছর ৬৩ ভাগ সেবা গ্রহীতাকে বিআরটিতে ঘুষ গুণতে হয়। দ্বিতীয় স্থানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের কাছে প্রায় ৬১ ভাগ সেবা টাকা দিয়ে পেতে হয়েছে। প্রায় ৬০ ভাগ মানুষকে পাসপোর্টের জন্য অর্থ দিতে হয়। এছাড়া ভূমি সেবায় প্রায় ৩৮, শিক্ষায় ৩৪, বিচারিক সেবায় প্রায় ৩৩, কৃষিতে ৩০, স্বাস্থ্যে প্রায় ১৯, বিদ্যুতে ১৮, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ১৮, গ্যাসে প্রায় ১২ ভাগ সেবাগ্রহীতাকে ঘুষের টাকা গুনতে হয়। দু’বছর পর পর পরিচালিত জরিপের মধ্যে ইতিপূর্বে ২০১৫ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ পয়েন্ট কম। তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার খানার হার কমলেও ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে।
২০১৭ সালে একজন সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৫ হাজার ৯৩০টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ২০১৫ সালে তা ছিল ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা। সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়ের হয় গ্যাস (৩৩,৮০৫ টাকা), বিচারিক সেবা (১৬,৬৮৮ টাকা) ও বীমা খাত (১৪,৮৬৫ টাকা)। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ গত ২০১৫ সালের জরিপে ৮ হাজার ৮২১ কোটি টাকা থাকলেও গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪% এবং বাংলাদেশের জিডিপি’র ০.৫%। ঘুষ প্রদানের প্রধান কারণ হলো ঘুষ না দিলে সেবা মিলবে না এমন ধারণা বা মানসিকতা। ঠিক এই কারণে ৮৯ ভাগ সেবাগ্রহীতা ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া হয়রানি বা জটিলতা এড়াতে ঘুষ দিচ্ছে ৪৭ ভাগ মানুষ। নির্ধারিত ফি না জানা ও নির্ধারিত সময়ে সেবা পেতে ঘুষ দিচ্ছে যথাক্রমে ৩৭ ও ২৩ ভাগ সেবাগ্রহীতা। অন্য কারণগুলোর মধ্যে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায়।
অপর দিকে দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রায় ৫০ ভাগ মানুষই ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের ফাঁদে পড়ে তাতে শিকার হচ্ছেন। দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুর্নীতির শিকার প্রায় ৪০ ভাগ সেবাগ্রহীতার।
এ ছাড়া জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষিতদের চেয়ে কম বা অশিক্ষিতরা বেশি ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার। শিক্ষিত পেশাজীবীদের চেয়ে কৃষক, জেলে, পরিবহন শ্রমিক, কামার, কুমার, প্রবাসী, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি ইত্যাদি স্বল্প বা অশিক্ষিত পেশাজীবীদেরকে বেশি টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়। স্বল্প আয়ের লোকেদেরকেই ঘুষের বোঝা বেশি বইতে হচ্ছে। যেমন ১৬ হাজার টাকার নিচে যাদের আয় তাদের আয়ের ২ দশমিক ৪১ ভাগ টাকা যাচ্ছে ঘুষে। অন্য দিকে ৬৪ হাজার টাকা বেশি যাদের আয় তাদেরকে ঘুষে দিতে হচ্ছে দশমিক এক দুই ভাগ টাকা। তবে আশার কথা হলো, বয়স্কদের চেয়ে অল্প বয়স্ক তরুণরা কম দুর্নীতির শিকার।
সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। যাদের ওপর দায়িত্ব তারা দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনছেন না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘুষ ও দুর্নীতি মেনে নেওয়া সার্বিকভাবে আমাদের জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে কিছু সূচক ও খাতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও সার্বিকভাবে দেশের দুর্নীতির চিত্র উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ কমে যাবে বলে অনেকের প্রত্যাশা থাকলেও গবেষণার ফলাফল বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন কমেছে যার পেছনে বর্ধিত বেতন-ভাতাসহ অন্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করে অভ্যস্ত তাদের জন্য বেতন-ভাতা কোনো বিষয় নয়। তারা বেতন-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করেন দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেবাগ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী, পর্যবেক্ষক ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আন্তরিক হন এবং দুর্নীতির বিচারের সময় যদি দুর্নীতিকারীর পরিচয়, অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনা করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা না থাকে তাহলে দুর্নীতির মাত্রা এত বেশি হতো না।
জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলোকে আরো বেশি প্রসারিত করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন যত বেশি স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে বলে ড. জামান অভিমত ব্যক্ত করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সেবাখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে টিআইবি ১২ দফা সুপারিশ পেশ করে। এর মধ্যে রয়েছে, বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকর করা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদৃঢ় নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে তার ভিত্তিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
এ ছাড়া রয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণ-শুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও জন-অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করাসহ গণমাধ্যমের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করা। ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ ও ‘তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১’ এর কার্যকর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ সকল অংশীজনের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করা।
উল্লেযোগ্য অপর সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে অনলাইনে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ বৃদ্ধি, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়া প্রচলন ও কার্যকর করার পাশাপাশি নাগরিক সনদের কার্যকর বাস্তবায়ন করা এবং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় ধাপ ও অন্যান্য বাধা দূর করতে পদ্ধতিগত সংস্কার করা। এছাড়াও জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকস এর ঘাটতি দূরীকরণে সেবাখাতগুলোতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে টিআইবি।
No comments