ঢাবিতে মধ্যরাতের তুঘলকি কাণ্ডে তোলপাড়, বিক্ষোভ by ফররুখ মাহমুদ
মধ্যরাতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুঘলকি কাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। সর্বত্র
চলছে তোলপাড়। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে করেছে বিক্ষোভ। ঢাবির কবি সুফিয়া
কামাল হল থেকে রাতের আঁধারে ছাত্রীদের বের করে দেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন
বিশিষ্টজনরাও। ছাত্রীদের অভিযোগ, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ায় তাদের
বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নিয়েছে হল প্রশাসন। শুধু তাই নয়, বের করে দেয়ার সময়
ছাত্রীদের ‘গোয়েন্দা নজরদারি’র ভয় দেখান হল প্রাধ্যক্ষ ও যুব মহিলা লীগের
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ড. সাবিতা রেজোয়ানা। তাদের মোবাইল ফোন জব্দ করে
তল্লাশি চালান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তদন্ত কমিটি করে ছাত্রীদের
বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটি কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে?
তারা জানাতে পারেন নি। এমনকি তদন্তের রিপোর্টও দেখাতে পারেন নি তারা। হল
সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে
বের করে দেয়া হয়। ছাত্রীদের অভিভাবকরা হলে এসে তাদের নিয়ে যান। খবর পেয়ে
তাৎক্ষণিক হলের গেটে ছুটে যান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী
বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ মঞ্চের নেতারা। ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল বিকাল
৪টায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে সংগঠনটি। মিছিল শেষে এক প্রতিবাদ সমাবেশে
সংগঠনটি ঘটনার তীব্র নিন্দা ও হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করেন। এদিকে
বিক্ষোভ মিছিলে যাতে শিক্ষার্থীরা আসতে না পারে সেজন্য ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে
কড়া নজরদারি করে। হলে হলে শিক্ষার্থীদের ডেকে হুমকি দেয়।
গত ১০ই এপ্রিল কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশার নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায় ছাত্রীরা। ছাত্রীদের দাবির মুখে এশাকে বিশ্ববিদ্যালয়, হল ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ছাত্রলীগ এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। একই সঙ্গে এশাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ২৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘গোপন তদন্তের’ মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া এবং এশাকে মারধর করার অভিযোগে ২৬ ছাত্রীকে চিহ্নিত করে। তবে ওই ২৬ জনের কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে তাদেরই হল থেকে বের করে দিয়েছে বলে ছাত্রীরা জানান। তারা বলেন, রাত ৯টা থেকে ছাত্রীদের বের করে দেয়া শুরু হয়। যাতে ঘটনা জানাজানি না হয় সেজন্য ১/২ জন করে বের করে দেয়া হচ্ছিল। রাত সাড়ে ১১টায় হলের গেটে গেলে দেখা যায়, হলের কর্মচারীরা গেটের ভেতরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে গুমোট পরিস্থিতি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে এক ছাত্রীকে তার অভিভাবকের সঙ্গে বের হতে দেখেন তারা। ১১টার দিকে বের হন আরেক ছাত্রী। তার সঙ্গেও অভিভাবক হিসেবে বাবা ছিলেন। সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরে বের করে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে বলতে নিষেধ করা হয়েছে। রাত ১২টা ১৫ মিনিটে আরেক ছাত্রী তার বাবাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত হল থেকে বের হয়ে যান। সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা বলেননি। সাড়ে ১২টায় হলের গেটে আসেন অপর এক ছাত্রীর বাবা ফারুক হোসেন। তার মেয়ে ফিজিক্সের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। হল প্রশাসন ফারুক হোসেনকে কল দিয়ে তার মেয়েকে হল থেকে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু বাইরে সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে হল প্রশাসন ওই ছাত্রীকে বের করে দেয়নি। পরে ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, মাঝরাতে এভাবে একটি মেয়েকে কোনো কারণ ছাড়াই হল থেকে বের করে দেয়া নিষ্ঠুর বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়। আমার মেয়েকে কি কারণে গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয়া হলো আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এর কারণ জানতে চাই। এদিকে হল থেকে বের করে দেয়ার সময় ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ জানায়। পরে হল প্রাধ্যক্ষ ড. সাবিতা রেজোয়ানা তাদের গোয়েন্দা নজরদারির ভয় দেখান। প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রীদের সেসময়ের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে শোনা যায়, ছাত্রীদের হুমকি দিচ্ছেন প্রাধ্যক্ষ। ছাত্রীদের উদ্দেশে সাবিতা রেজোয়ানা বলেন, অনেকে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেয়। ইনটেলিজেন্স সেল দেখবে যে কারা কারা বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিচ্ছে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট অ্যানি ইনভলভমেন্ট। এরপর এই হলে ছাত্রলীগ যদি গণ্ডগোল করে আমাকে বিচার দেবে। জেনারেল মেয়ে গণ্ডগোল করলে আমাকে বিচার দেবে। এখন থেকে সিট হল প্রশাসন দেবে। আর কোনো পয়েন্টে এর বাইরে আর কোনো সিট হবে না। হলে যদি আর কেউ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে বা তোমরা কোনো পোস্ট দেয়ার চেষ্টা করো হলকে বিভ্রান্ত করার জন্য, তাহলে কিন্তু আমরা সরকারকে বলব। আমার নলেজের বাইরে আমার ভিডিও যে আপলোড করে সেটা কিন্তু ক্রাইম। আজকে আমি বলে দিলাম সেটা কিন্তু সাইবার ক্রাইম। আই ওয়ান্ট টু বি লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। কারও কিছু প্রশ্ন আছে? জবাবে ছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ নেত্রী ইফফাত জাহানকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, তাতে হলের দুই হাজার ছাত্রী সম্পৃক্ত ছিল বলে উল্লেখ করেন। তখন সাবিতা রেজোয়ানা বলেন, দুই হাজার মেয়ে কিছু করেনি। আমার সিসিটিভি ফুটেজে আছে কারা কারা করেছে। দুই হাজার মেয়ে স্বাক্ষর দাও, আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেব। আমি দুই হাজার মেয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে দেব। আমার শিক্ষকেরা দেখেছে, আমার সিসিটিভি প্রমাণ আছে ওরা মেরেছে। তোমরা যদি মেরে থাক, নাম লেখ। ওই দিন যেটা হয়েছে, সেটা অপপ্রচার। ওই মেয়ে যার পা কেটেছে, সে নিজে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ওর শুধু পা-ই কাটা হয়েছে। এই মেয়েটাকে যে পরিমাণ মারা হয়েছে, সেটা কি বিচারে মারা হয়েছে? যে মেয়ে ভয় পেয়েছে, সে নিজে বলেছে। অডিওর শেষ দিকে প্রাধ্যক্ষকে বলতে শোনা যায়, মোবাইল ফোন দিয়ে কী করছ? ছাত্রীদের বের করে দেয়ার ঘটনা জানাজানি হলে তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা। তারা ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক বলেন, আমরা খবর পেয়েছি, রাত ১১টার পরেও অনেক ছাত্রী হল থেকে বের হয়ে গেছেন। ছাত্রীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়েছিল। প্রাধ্যক্ষের কক্ষে অনেককে আটকে রাখা হয়েছিল। অভিভাবক ডেকে রাতের অন্ধকারে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কোনো অপরাধ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু ছাত্রীদের এভাবে বের করে কর্তৃপক্ষ ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তিনি পরদিন বিকাল ৪টায় সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঠেকাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবিদ আল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেন।
ভিসির ব্যাখ্যা: এদিকে কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় গতকাল তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, টোটাল চারজন। এটাও অনেক সংখ্যায় তাও কিন্তু নয়। এটাও একটা বিভ্রান্তি, বড় আকারের বিভ্রান্তি, অপতথ্য ছড়ানো হলো। মাত্র চারজন মেয়ে, যাদের সন্দেহ করা হলো। তাদের গতিবিধি এবং তারা ভুয়া, ফেক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ফেসবুকে অপতথ্য দিচ্ছে, হল-সংক্রান্ত, সরকারবিরোধী। আরো যেন কী কী। এগুলো সব আছে, তথ্য সংরক্ষিত। তখন হল প্রভোস্ট যেটা অভিভাবকসুলভ আচরণ করলেন, তিনি এই সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের রুমে ডেকে আনলেন। তিনি বললেন, বাবা তোমাদের মোবাইলগুলো দাও। কারণ, এটা সাইবার ক্রাইমে পড়তে পারে, আমরা দেখি। এগুলো চেক করে দেখা গেল, যে এ ধরনের তথ্য আছে। তখন তাদের বলা হলো, বাবা এগুলা যদি তোমরা করো, তাহলে তো হল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এটা সুফিয়া কামাল হল, হাজার হাজার মেয়ে এখানে আছে। টোটাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন অপশক্তির উত্থান ঘটছে। অপতথ্য, অপব্যাখ্যা যাচ্ছে। সুতরাং, তোমরা এগুলো করতে পারবে না, তোমাদের অভিভাবকদের আমরা ডাকছি। অভিভাবকদের ডাকা হলো।
ভিসি আরো বলেন, আপনারা শুনে খুশি হবেন, একজন অভিভাবক কেঁদে এসে বললো যে, আপনারা যে এই অসাধারণ কাজটি করলেন। সে অভিভাবক রাতে বসে উনাদের সঙ্গে খেলেন। একজন অভিভাবক আবার পুলিশে চাকরি করেন। তিনি বললেন যে, আমার চাকরিটি চলে যাবে। একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক পুলিশে চাকরি করে, আমাদের গুলশানে। মেয়েটির ভাই। সে বলছে, আমার চাকরিটি চলে যেত, যদি এই ধরনের অপতথ্য আমার বোন, গুজব ছড়ানোর কাজে জড়িত থাকে। তাহলে তো সাইবার ক্রাইমে পড়ে যাবে, আরেকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে। খুব ভালো হলো। এই বলে তিন জন শিক্ষার্থীকে তিন জন অভিভাবকের হাতে সোপর্দ করা হলো। ড. আখতারুজ্জামান বলেন, তাদের সবাই কর্মজীবনে। আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু হল প্রশাসন বসে রয়েছে রাতে। এটা বুঝতেই পারছেন, মেয়েদের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ, মেয়েদের নিরাপত্তা দেয়া, হাজার হাজার মেয়ে। কত একটা কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে পার হতে হয়েছিল তাদের। এর ভেতরে রিউমার ছড়াচ্ছে। সুতরাং সেগুলো সামাল দিয়ে, তাদের অভিভাবকদের ডেকে এনে বলা হলো, লিখিত নেয়া হলো, দেখানো হলো। তারা অত্যন্ত খুশি হলো যে, আপনারা এই কাজটি যে করেছেন। আমরা এই জন্য তো মেয়েদের পাঠাইনি। এবং তারা অনেকেই না কি খেলোয়াড়ও। তারা আজকে খেলতেও আসবে। শুধু বলা হলো, হলের ভেতর থেকে যখন এগুলো করবে, তাহলে তো হল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। অভিভাবকদের বলা হলো, তাদের আপনাদের কাছে নিয়ে যান। মধ্যরাতে ছাত্রীদের বের করা হয়নি বলে দাবি করেন ভিসি। তিনি বলেন, আরেকজনের বাবা, তিনি এলেন ধামরাই থেকে। ধামরাই থেকে তিনি একেবারেই খুবই সাধারণ পরিবারের মানুষ। তিনি আসতে একটু দেরি হয়েছে, বোধহয় কর্মজীবী মানুষ। তিনিও বারবার ফোন করেছেন প্রভোস্টকে যে আমি কিন্তু আসব, আপনারা কিন্তু থাকবেন। সবাই রয়েছি। আসতে দেরি হয়ে গেছে। সাড়ে ১১টা, ১২টা হয়ে গেছে ওনার। এইটাও হয়েছে অপব্যাখ্যা যে, মধ্যরাতে বের করে দিয়েছে। আসলে তারা কিন্তু বিকাল থেকেই এদেরকে নিয়ে অপেক্ষা করছে। শুধু গার্ডিয়ানদের আসতে আসতেই এই দেরিটা হয়ে গেল। এই জন্য হয়ে গেল মধ্যরাত।
প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি: কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে সাড়ে ৩টা থেকে ছাত্রলীগ অবস্থান নেয়ায় আন্দোলনকারীরা স্থান পরিবর্তন করে রাজু ভাস্কর্যের সামনে কর্মসূচি পালন করে। পরে সেখানেও ছাত্রলীগের একটি পক্ষ অবস্থান নেয়। সাড়ে ৪টার পর আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর, রাশেদ খানসহ ১০/১২ জন রাজু ভাস্কর্যের বেদিতে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আন্দোলনকারীরা স্লোগান শুরু করে। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আসতে শুরু করে। একপর্যায় বেদিতে থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সরে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে মিলন চত্বরের পাশে রাস্তায় অবস্থান নেয়। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করে। মিছিলে প্রায় সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। মিছিলটি রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ থানার সামনে দিয়ে ঘুরে আবারো রাজু ভাস্কর্য হয়ে নীলক্ষেত হয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ হয়। এ সময় যুগ্ম সমন্বয়ক রাশেদ খান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আন্দোলনকারীদের ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা দুই মাস আন্দোলন করেছি। কিন্তু যখনই আন্দোলন সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে, তখনই হুমকি দেয়া হচ্ছে। হলে হলে বাধা দেয়া হচ্ছে। আন্দোলনে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এখন আন্দোলন করতে গেলে বাধা আসে। প্রশাসনকে বলতে চাই, হেনস্থা করবেন না। হলে সুন্দরভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করুন। হল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিন। আজকে আমাদের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে মেয়েদের উপস্থিতি কম। কারণ তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর বলেন, ছাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। দ্রুত সম্মানের সঙ্গে ওই ছাত্রীদের হলে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। নয়তো ছাত্রসমাজ আবার রাজপথে নামবে। তিনি আরো বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাধ্যক্ষের একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দুই হাজার ছাত্রীকে বহিষ্কারের কথা বলেন। এ ঘটনার মাধ্যমে হল প্রশাসনের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলঙ্কিত ইতিহাস রচিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান রক্ষার্থে হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করে বলেন, ছাত্রসমাজের স্থান ক্লাসে, তাদের রাজপথে নামতে বাধ্য করবেন না।
মরিয়া ছাত্রলীগ: কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। গতকাল শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতে চাইলে সেখানে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয কমিটি। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, লাইব্রেরির সামনে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সেখানে সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন। যদিও তিনি বিসিএসের প্রিলি পরীক্ষা দিয়েছিলেন কি না জানা যায়নি। এ ছাড়া বিকাল সাড়ে ৩টার পর লাইব্রেরির সামনে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগের নেতারা বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আসতে নিষেধ করেছে বলেও জানা গেছে। সুফিয়া কামাল হলের সামনে যাওয়ায় এএফ রহমান হলের এক ছাত্রকে হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। এদিকে কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।
গত ১০ই এপ্রিল কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশার নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায় ছাত্রীরা। ছাত্রীদের দাবির মুখে এশাকে বিশ্ববিদ্যালয়, হল ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ছাত্রলীগ এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। একই সঙ্গে এশাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ২৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘গোপন তদন্তের’ মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া এবং এশাকে মারধর করার অভিযোগে ২৬ ছাত্রীকে চিহ্নিত করে। তবে ওই ২৬ জনের কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে তাদেরই হল থেকে বের করে দিয়েছে বলে ছাত্রীরা জানান। তারা বলেন, রাত ৯টা থেকে ছাত্রীদের বের করে দেয়া শুরু হয়। যাতে ঘটনা জানাজানি না হয় সেজন্য ১/২ জন করে বের করে দেয়া হচ্ছিল। রাত সাড়ে ১১টায় হলের গেটে গেলে দেখা যায়, হলের কর্মচারীরা গেটের ভেতরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে গুমোট পরিস্থিতি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে এক ছাত্রীকে তার অভিভাবকের সঙ্গে বের হতে দেখেন তারা। ১১টার দিকে বের হন আরেক ছাত্রী। তার সঙ্গেও অভিভাবক হিসেবে বাবা ছিলেন। সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরে বের করে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে বলতে নিষেধ করা হয়েছে। রাত ১২টা ১৫ মিনিটে আরেক ছাত্রী তার বাবাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত হল থেকে বের হয়ে যান। সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা বলেননি। সাড়ে ১২টায় হলের গেটে আসেন অপর এক ছাত্রীর বাবা ফারুক হোসেন। তার মেয়ে ফিজিক্সের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। হল প্রশাসন ফারুক হোসেনকে কল দিয়ে তার মেয়েকে হল থেকে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু বাইরে সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে হল প্রশাসন ওই ছাত্রীকে বের করে দেয়নি। পরে ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, মাঝরাতে এভাবে একটি মেয়েকে কোনো কারণ ছাড়াই হল থেকে বের করে দেয়া নিষ্ঠুর বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়। আমার মেয়েকে কি কারণে গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয়া হলো আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এর কারণ জানতে চাই। এদিকে হল থেকে বের করে দেয়ার সময় ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ জানায়। পরে হল প্রাধ্যক্ষ ড. সাবিতা রেজোয়ানা তাদের গোয়েন্দা নজরদারির ভয় দেখান। প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রীদের সেসময়ের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে শোনা যায়, ছাত্রীদের হুমকি দিচ্ছেন প্রাধ্যক্ষ। ছাত্রীদের উদ্দেশে সাবিতা রেজোয়ানা বলেন, অনেকে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেয়। ইনটেলিজেন্স সেল দেখবে যে কারা কারা বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিচ্ছে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট অ্যানি ইনভলভমেন্ট। এরপর এই হলে ছাত্রলীগ যদি গণ্ডগোল করে আমাকে বিচার দেবে। জেনারেল মেয়ে গণ্ডগোল করলে আমাকে বিচার দেবে। এখন থেকে সিট হল প্রশাসন দেবে। আর কোনো পয়েন্টে এর বাইরে আর কোনো সিট হবে না। হলে যদি আর কেউ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে বা তোমরা কোনো পোস্ট দেয়ার চেষ্টা করো হলকে বিভ্রান্ত করার জন্য, তাহলে কিন্তু আমরা সরকারকে বলব। আমার নলেজের বাইরে আমার ভিডিও যে আপলোড করে সেটা কিন্তু ক্রাইম। আজকে আমি বলে দিলাম সেটা কিন্তু সাইবার ক্রাইম। আই ওয়ান্ট টু বি লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। কারও কিছু প্রশ্ন আছে? জবাবে ছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ নেত্রী ইফফাত জাহানকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, তাতে হলের দুই হাজার ছাত্রী সম্পৃক্ত ছিল বলে উল্লেখ করেন। তখন সাবিতা রেজোয়ানা বলেন, দুই হাজার মেয়ে কিছু করেনি। আমার সিসিটিভি ফুটেজে আছে কারা কারা করেছে। দুই হাজার মেয়ে স্বাক্ষর দাও, আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেব। আমি দুই হাজার মেয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে দেব। আমার শিক্ষকেরা দেখেছে, আমার সিসিটিভি প্রমাণ আছে ওরা মেরেছে। তোমরা যদি মেরে থাক, নাম লেখ। ওই দিন যেটা হয়েছে, সেটা অপপ্রচার। ওই মেয়ে যার পা কেটেছে, সে নিজে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ওর শুধু পা-ই কাটা হয়েছে। এই মেয়েটাকে যে পরিমাণ মারা হয়েছে, সেটা কি বিচারে মারা হয়েছে? যে মেয়ে ভয় পেয়েছে, সে নিজে বলেছে। অডিওর শেষ দিকে প্রাধ্যক্ষকে বলতে শোনা যায়, মোবাইল ফোন দিয়ে কী করছ? ছাত্রীদের বের করে দেয়ার ঘটনা জানাজানি হলে তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা। তারা ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক বলেন, আমরা খবর পেয়েছি, রাত ১১টার পরেও অনেক ছাত্রী হল থেকে বের হয়ে গেছেন। ছাত্রীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়েছিল। প্রাধ্যক্ষের কক্ষে অনেককে আটকে রাখা হয়েছিল। অভিভাবক ডেকে রাতের অন্ধকারে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কোনো অপরাধ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু ছাত্রীদের এভাবে বের করে কর্তৃপক্ষ ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তিনি পরদিন বিকাল ৪টায় সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঠেকাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবিদ আল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেন।
ভিসির ব্যাখ্যা: এদিকে কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় গতকাল তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, টোটাল চারজন। এটাও অনেক সংখ্যায় তাও কিন্তু নয়। এটাও একটা বিভ্রান্তি, বড় আকারের বিভ্রান্তি, অপতথ্য ছড়ানো হলো। মাত্র চারজন মেয়ে, যাদের সন্দেহ করা হলো। তাদের গতিবিধি এবং তারা ভুয়া, ফেক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ফেসবুকে অপতথ্য দিচ্ছে, হল-সংক্রান্ত, সরকারবিরোধী। আরো যেন কী কী। এগুলো সব আছে, তথ্য সংরক্ষিত। তখন হল প্রভোস্ট যেটা অভিভাবকসুলভ আচরণ করলেন, তিনি এই সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের রুমে ডেকে আনলেন। তিনি বললেন, বাবা তোমাদের মোবাইলগুলো দাও। কারণ, এটা সাইবার ক্রাইমে পড়তে পারে, আমরা দেখি। এগুলো চেক করে দেখা গেল, যে এ ধরনের তথ্য আছে। তখন তাদের বলা হলো, বাবা এগুলা যদি তোমরা করো, তাহলে তো হল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এটা সুফিয়া কামাল হল, হাজার হাজার মেয়ে এখানে আছে। টোটাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন অপশক্তির উত্থান ঘটছে। অপতথ্য, অপব্যাখ্যা যাচ্ছে। সুতরাং, তোমরা এগুলো করতে পারবে না, তোমাদের অভিভাবকদের আমরা ডাকছি। অভিভাবকদের ডাকা হলো।
ভিসি আরো বলেন, আপনারা শুনে খুশি হবেন, একজন অভিভাবক কেঁদে এসে বললো যে, আপনারা যে এই অসাধারণ কাজটি করলেন। সে অভিভাবক রাতে বসে উনাদের সঙ্গে খেলেন। একজন অভিভাবক আবার পুলিশে চাকরি করেন। তিনি বললেন যে, আমার চাকরিটি চলে যাবে। একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক পুলিশে চাকরি করে, আমাদের গুলশানে। মেয়েটির ভাই। সে বলছে, আমার চাকরিটি চলে যেত, যদি এই ধরনের অপতথ্য আমার বোন, গুজব ছড়ানোর কাজে জড়িত থাকে। তাহলে তো সাইবার ক্রাইমে পড়ে যাবে, আরেকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে। খুব ভালো হলো। এই বলে তিন জন শিক্ষার্থীকে তিন জন অভিভাবকের হাতে সোপর্দ করা হলো। ড. আখতারুজ্জামান বলেন, তাদের সবাই কর্মজীবনে। আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু হল প্রশাসন বসে রয়েছে রাতে। এটা বুঝতেই পারছেন, মেয়েদের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ, মেয়েদের নিরাপত্তা দেয়া, হাজার হাজার মেয়ে। কত একটা কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে পার হতে হয়েছিল তাদের। এর ভেতরে রিউমার ছড়াচ্ছে। সুতরাং সেগুলো সামাল দিয়ে, তাদের অভিভাবকদের ডেকে এনে বলা হলো, লিখিত নেয়া হলো, দেখানো হলো। তারা অত্যন্ত খুশি হলো যে, আপনারা এই কাজটি যে করেছেন। আমরা এই জন্য তো মেয়েদের পাঠাইনি। এবং তারা অনেকেই না কি খেলোয়াড়ও। তারা আজকে খেলতেও আসবে। শুধু বলা হলো, হলের ভেতর থেকে যখন এগুলো করবে, তাহলে তো হল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। অভিভাবকদের বলা হলো, তাদের আপনাদের কাছে নিয়ে যান। মধ্যরাতে ছাত্রীদের বের করা হয়নি বলে দাবি করেন ভিসি। তিনি বলেন, আরেকজনের বাবা, তিনি এলেন ধামরাই থেকে। ধামরাই থেকে তিনি একেবারেই খুবই সাধারণ পরিবারের মানুষ। তিনি আসতে একটু দেরি হয়েছে, বোধহয় কর্মজীবী মানুষ। তিনিও বারবার ফোন করেছেন প্রভোস্টকে যে আমি কিন্তু আসব, আপনারা কিন্তু থাকবেন। সবাই রয়েছি। আসতে দেরি হয়ে গেছে। সাড়ে ১১টা, ১২টা হয়ে গেছে ওনার। এইটাও হয়েছে অপব্যাখ্যা যে, মধ্যরাতে বের করে দিয়েছে। আসলে তারা কিন্তু বিকাল থেকেই এদেরকে নিয়ে অপেক্ষা করছে। শুধু গার্ডিয়ানদের আসতে আসতেই এই দেরিটা হয়ে গেল। এই জন্য হয়ে গেল মধ্যরাত।
প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি: কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে সাড়ে ৩টা থেকে ছাত্রলীগ অবস্থান নেয়ায় আন্দোলনকারীরা স্থান পরিবর্তন করে রাজু ভাস্কর্যের সামনে কর্মসূচি পালন করে। পরে সেখানেও ছাত্রলীগের একটি পক্ষ অবস্থান নেয়। সাড়ে ৪টার পর আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর, রাশেদ খানসহ ১০/১২ জন রাজু ভাস্কর্যের বেদিতে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আন্দোলনকারীরা স্লোগান শুরু করে। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আসতে শুরু করে। একপর্যায় বেদিতে থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সরে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে মিলন চত্বরের পাশে রাস্তায় অবস্থান নেয়। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করে। মিছিলে প্রায় সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। মিছিলটি রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ থানার সামনে দিয়ে ঘুরে আবারো রাজু ভাস্কর্য হয়ে নীলক্ষেত হয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ হয়। এ সময় যুগ্ম সমন্বয়ক রাশেদ খান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আন্দোলনকারীদের ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা দুই মাস আন্দোলন করেছি। কিন্তু যখনই আন্দোলন সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে, তখনই হুমকি দেয়া হচ্ছে। হলে হলে বাধা দেয়া হচ্ছে। আন্দোলনে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এখন আন্দোলন করতে গেলে বাধা আসে। প্রশাসনকে বলতে চাই, হেনস্থা করবেন না। হলে সুন্দরভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করুন। হল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিন। আজকে আমাদের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে মেয়েদের উপস্থিতি কম। কারণ তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর বলেন, ছাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। দ্রুত সম্মানের সঙ্গে ওই ছাত্রীদের হলে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। নয়তো ছাত্রসমাজ আবার রাজপথে নামবে। তিনি আরো বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাধ্যক্ষের একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দুই হাজার ছাত্রীকে বহিষ্কারের কথা বলেন। এ ঘটনার মাধ্যমে হল প্রশাসনের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলঙ্কিত ইতিহাস রচিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান রক্ষার্থে হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করে বলেন, ছাত্রসমাজের স্থান ক্লাসে, তাদের রাজপথে নামতে বাধ্য করবেন না।
মরিয়া ছাত্রলীগ: কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। গতকাল শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতে চাইলে সেখানে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয কমিটি। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, লাইব্রেরির সামনে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সেখানে সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন। যদিও তিনি বিসিএসের প্রিলি পরীক্ষা দিয়েছিলেন কি না জানা যায়নি। এ ছাড়া বিকাল সাড়ে ৩টার পর লাইব্রেরির সামনে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগের নেতারা বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আসতে নিষেধ করেছে বলেও জানা গেছে। সুফিয়া কামাল হলের সামনে যাওয়ায় এএফ রহমান হলের এক ছাত্রকে হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। এদিকে কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।
No comments