রাজীবরা মারা যায় কিছুই বদলায় না by মরিয়ম চম্পা
বেপরোয়া।
অসতর্ক। নিয়মের বালাই নেই। জীবনের দাম নগণ্য। যথারীতি সেই আগের মতোই।
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামানো-ওঠানো। একবাস আরেক বাসকে ইচ্ছাকৃত
ধাক্কা। সুযোগ পেলেই গতির লড়াই। কে কার আগে যাবে। একই কোম্পানির বাস হলেও
চিত্র বদলায় না। চালকদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে বড় প্রশ্ন। যাত্রীদের অনেকেও
নিয়ম মানতে নারাজ। যেখানে ইচ্ছা নামতে চান তারা। যেন পুরো রাজধানী একটি
বৃহৎ বাস স্ট্যান্ড। পথচারী পারাপারে নেই কোনো সতর্কতা। ফ্লাইওভারে উঠতে
অনীহা। এরই মধ্যে ফার্মগেটে শোনা গেল এক যাত্রীর চড়া গলা- ‘টান’। নেতা
বলছে, গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভার হওয়া যায়।
গত ৩রা এপ্রিল দুপুরে দুই বাসের রেশারেশিতে হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনায় তোলপাড় তৈরি হয়েছে সারা দেশে। নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাজীবের মৃত্যুর পর তৈরি হওয়া তোলপাড় কী পরিস্থিতির কোনো বদল ঘটাতে পেরেছে?
বৃহস্পতিবার দুপুর। ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজার। দেখা গেলো সেই একই দৃশ্য। ফার্মগেটে বাস দাঁড়াতেই একটির সঙ্গে অন্যটির ধাক্কাধাক্কি। কে কার আগে যাত্রী তুলবেন। তীব্র প্রতিযোগিতা। শিখর নামের একটি বাসের কন্ডাক্টর জানালেন, মূলত টার্গেটের টাকা পূরণ করতেই অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোর এই চেষ্টা। সড়কে চাঁদাবাজিকেও তিনি অন্যতম বড় সমস্যা মনে করেন। পাশেই যাত্রী পারাপারে ওভারব্রিজ থাকলেও অনেকেই নিচ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। পরে সোনারগাঁও সিগন্যালে দেখা গেল আরো ভীতিকর দৃশ্য। শাহবাগের দিক থেকে আসা কোনো বাসই ঠিকমতো থামছিল না। বলে রাখা ভালো, এখানে আবার বাস দাঁড়ানো নিষেধ। সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে উঠছিলেন। নারীদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল এভাবে বাসে উঠতে। কাওরান বাজার বা ফার্মগেট নয় কেবল, এটি পুরো রাজধানীরই সড়ক ব্যবস্থা। যানজটে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় দাঁড়াতে পারবে না। যাত্রীরা একহাতও হাঁটতে রাজি নন। যেখানে ইচ্ছা তারা বাসে উঠতে চান, যেখানে ইচ্ছা নামতে চান।
দুর্ঘটনাও থেমে নেই। রাজীবের হাত হারানোর ঘটনার আলোচনার মধ্যেই মেয়ে আহনাবকে নিয়ে রিকশায় করে ধানমন্ডির স্কুলে যাওয়ার পথে দুই বাসচালকের প্রতিযোগিতায় গুরুতর আহত হন আয়েশা খাতুন। তার কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে আছে। রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আয়েশাকে চিকিৎসকরা আরও কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখবেন বলে জানিয়েছেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্ট মাসুদ আনোয়ার বলেন, আয়েশা খাতুনের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। সেটা অস্ত্রোপচার করে ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু তার স্পাইনাল কর্ড ‘কমপ্লিটলি ড্যামেজ’ হয়ে গেছে। ওদিকে, গত ১১ই এপ্রিল রাজধানীর ফার্মগেটে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুনি আক্তারের (২৮) ডান পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তার ডান পায়ের হাঁটুসংলগ্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত এবং ওই স্থান থেকে মাংস ছিঁড়ে গেছে। তার পা রক্ষা পেয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। রুনির এ ব্যয়বহুল চিকিৎসায় প্রাথমিক পর্যায়েই লাগবে তিন লাখ টাকা। দুর্ঘটনার পরদিন রাত নয়টার দিকে রাজধানীর বেসরকারি ইবনে সিনা হসপিটালে রুনির অস্ত্রোপচার হয়। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে রুনির সহকর্মী আহমদ আলী বলেন, রুনির পায়ের আঘাত গুরুতর। তার পায়ের মাংসসহ চামড়া ছিঁড়ে গেছে। তিন ঘণ্টা ধরে তার অস্ত্রোপচার হয়। তার পা রক্ষা পেয়েছে। তিনি এখন আইসিইউতে আছেন। তার জ্ঞান ফিরেছে। তবে সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। রুনির চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রাথমিক পর্যায়ে তিন লাখ টাকা প্রয়োজন। অফিসের সহকর্মীরা মিলে কিছু টাকা জোগাড় করে খরচ চালানো হচ্ছে। রাজীব হোসেনের ডান হাত হারানোর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ডান হাত হারান চালকের সহকারী খালিদ হাসান হৃদয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০২ ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে শূন্য দৃষ্টি তাকিয়ে আছেন হৃদয়। গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের বেতগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ট্রাকের ধাক্কায় ডান হাত হারিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী যুবক হৃদয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, প্রধান সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা কমাতে সর্বপ্রথম যে বিষয়টা দরকার সেটা হচ্ছে চালকদের রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করা। দুর্ঘটনার ৩৭ ভাগের কারণ হচ্ছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও মাত্রাতিরিক্ত গতি। তাই চালকদের মানসিক হতাশা দূর করতে সরকারিভাবে যদি মেন্টাল ওরিয়েন্টেশন ও রিফ্রেশমেন্ট করা যায় তাহলে দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। তাই প্রধান সড়কগুলোতে গাড়ির গতির পরিমাণ কমাতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ ভাগই হয় শুধু রাজধানী ঢাকায়। তাই দেশে যে ভুঁইফোড় গাড়ি কোম্পানি রয়েছে তাদের নির্দিষ্ট কোম্পানির আওতায় আনতে হবে। বেশির ভাগ গাড়িই কম দামি। আবার তাদের মালিকদের ওপর রয়েছে মন্ত্রী আমলাদের আশীর্বাদের হাত। তাই দুর্ঘটনার বিচারের বিষয়টি খুব বেশিদূর গড়াতে পারে না। তাছাড়া দুর্ঘটনা রোধে নেই সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা। দুর্ঘটনার পর চালককে গ্রেপ্তার করা হলেও খুব অল্প সময়েই তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে আসেন। আবার তারাই চালকের আসনে বসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে সাধারণ জনগণ, বাস মালিক, পুলিশ ও বাস কেউ নিয়মের মধ্যে আসে না। এক কথায় সড়কে অরাকজতা চলছে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমরা একতরফা ভাবে ড্রাইভারদের দোষ দিতে পারি না। এখানে ড্রাইভার পথচারী প্রত্যেকেরই সচেতনতার অভাব রয়েছে। প্রথমত ৩৩ লাখ ড্রাইভারের অর্ধেকই হচ্ছে অশিক্ষিত। অধিকাংশ ড্রাইভারই কিছুদিন হেল্পারের কাজ করার পর সেখান থেকে বাস চালাতে চালাতে চালক হচ্ছে। সম্প্রতি রাজীব নামে এক শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পরপরই একজন হেল্পারের ডান হাত কাটার ঘটনা ঘটেছে। যেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। একজন হেল্পারের শুধু হাত কেন তার পুরো শরীরই কাটা পড়ার কথা। কারণ পাবালিক বাসের একজন হেল্পার বাস চলাকালে তার শরীরের অধিকাংশই বাইরে বের করে রেখে ড্রাইভারকে ‘ওস্তাদ বায়ে প্লাস্টিক’ বলে ডিরেকশন দিয়ে থাকে। অন্যদিকে অধিকাংশ গাড়ির মালিক কম দামে গাড়ি কিনে অধিক মুনাফার জন্য যেকোনো ড্রাইভারের হাতে রাস্তায় গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। তাই গাড়ির কোনো দুর্ঘটনা হলেও তাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা দায়বদ্ধতা থাকে না। এছাড়া গাড়ি প্রতি একজন ড্রাইভারকে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টাকা মালিককে জমা দিতে হয়। ফলে মালিকের জমার টাকা, হেল্পারের টাকা, ড্রাইভারের আয় সব মিলিয়ে কে কার আগে কত বেশি ট্রিপ দিতে পারে এটা নিয়ে যেন রাজপথে রীতিমতো পাগলামি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তাই একজন পাগল ড্রাইভার যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটাতেই পারে। লোকাল গাড়িগুলো কম দামি হওয়ায় মালিক পক্ষ ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি মাথায় নেন না। অথচ দেশের উন্নতমানের লাক্সারিয়াস কোচগুলো ব্যয়বহুল হওয়ায় ড্রাইভারদের দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষ করে এই হাত-পা কাটা কমাতে ড্রাইভারদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে সড়কে চলাচল করা সাধারণ জনগণকেও সচেতন হতে হবে। পথচারীর অধিকাংশই যখন রাস্তা পার হয় তখন তাদের ভাবখানা এমন যেন নিজের বাড়ির আঙিনা দিয়ে হাঁটছেন। প্রধান সড়কে যখন একজন পথচারী নিজের বাড়ি ভেবে পার হবেন বা গাড়ি থেকে নামবেন, তখন তো দুর্ঘটনা নিশ্চিত। এক্ষেত্রে দেশের সরকার, ট্রাফিক বিভাগ, ফিটনেসবিহীন গাড়িকে অবৈধ ঘোষণা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাস্তায় দুর্ঘটনার পরিমাণ কমানো সম্ভব।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ২০১৮ সালের গত তিন মাসের এক জরিপে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে ৪৯৯টি দুর্ঘটনায় ৫১৪ জন নিহত এবং ১৩৫৩ জন আহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৪৩৯টি দুর্ঘটনায় ৪৫৯ জন নিহত ও ১৫২১ জন আহত হয়েছে। মার্চে ৪৯১ দুর্ঘটনায় ৪৮৩ জন নিহত ও ১৫০৬ জন আহত হয়েছে।
গত ৩রা এপ্রিল দুপুরে দুই বাসের রেশারেশিতে হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনায় তোলপাড় তৈরি হয়েছে সারা দেশে। নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাজীবের মৃত্যুর পর তৈরি হওয়া তোলপাড় কী পরিস্থিতির কোনো বদল ঘটাতে পেরেছে?
বৃহস্পতিবার দুপুর। ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজার। দেখা গেলো সেই একই দৃশ্য। ফার্মগেটে বাস দাঁড়াতেই একটির সঙ্গে অন্যটির ধাক্কাধাক্কি। কে কার আগে যাত্রী তুলবেন। তীব্র প্রতিযোগিতা। শিখর নামের একটি বাসের কন্ডাক্টর জানালেন, মূলত টার্গেটের টাকা পূরণ করতেই অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোর এই চেষ্টা। সড়কে চাঁদাবাজিকেও তিনি অন্যতম বড় সমস্যা মনে করেন। পাশেই যাত্রী পারাপারে ওভারব্রিজ থাকলেও অনেকেই নিচ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। পরে সোনারগাঁও সিগন্যালে দেখা গেল আরো ভীতিকর দৃশ্য। শাহবাগের দিক থেকে আসা কোনো বাসই ঠিকমতো থামছিল না। বলে রাখা ভালো, এখানে আবার বাস দাঁড়ানো নিষেধ। সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে উঠছিলেন। নারীদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল এভাবে বাসে উঠতে। কাওরান বাজার বা ফার্মগেট নয় কেবল, এটি পুরো রাজধানীরই সড়ক ব্যবস্থা। যানজটে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় দাঁড়াতে পারবে না। যাত্রীরা একহাতও হাঁটতে রাজি নন। যেখানে ইচ্ছা তারা বাসে উঠতে চান, যেখানে ইচ্ছা নামতে চান।
দুর্ঘটনাও থেমে নেই। রাজীবের হাত হারানোর ঘটনার আলোচনার মধ্যেই মেয়ে আহনাবকে নিয়ে রিকশায় করে ধানমন্ডির স্কুলে যাওয়ার পথে দুই বাসচালকের প্রতিযোগিতায় গুরুতর আহত হন আয়েশা খাতুন। তার কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে আছে। রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আয়েশাকে চিকিৎসকরা আরও কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখবেন বলে জানিয়েছেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্ট মাসুদ আনোয়ার বলেন, আয়েশা খাতুনের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। সেটা অস্ত্রোপচার করে ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু তার স্পাইনাল কর্ড ‘কমপ্লিটলি ড্যামেজ’ হয়ে গেছে। ওদিকে, গত ১১ই এপ্রিল রাজধানীর ফার্মগেটে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুনি আক্তারের (২৮) ডান পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তার ডান পায়ের হাঁটুসংলগ্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত এবং ওই স্থান থেকে মাংস ছিঁড়ে গেছে। তার পা রক্ষা পেয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। রুনির এ ব্যয়বহুল চিকিৎসায় প্রাথমিক পর্যায়েই লাগবে তিন লাখ টাকা। দুর্ঘটনার পরদিন রাত নয়টার দিকে রাজধানীর বেসরকারি ইবনে সিনা হসপিটালে রুনির অস্ত্রোপচার হয়। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে রুনির সহকর্মী আহমদ আলী বলেন, রুনির পায়ের আঘাত গুরুতর। তার পায়ের মাংসসহ চামড়া ছিঁড়ে গেছে। তিন ঘণ্টা ধরে তার অস্ত্রোপচার হয়। তার পা রক্ষা পেয়েছে। তিনি এখন আইসিইউতে আছেন। তার জ্ঞান ফিরেছে। তবে সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। রুনির চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রাথমিক পর্যায়ে তিন লাখ টাকা প্রয়োজন। অফিসের সহকর্মীরা মিলে কিছু টাকা জোগাড় করে খরচ চালানো হচ্ছে। রাজীব হোসেনের ডান হাত হারানোর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ডান হাত হারান চালকের সহকারী খালিদ হাসান হৃদয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০২ ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে শূন্য দৃষ্টি তাকিয়ে আছেন হৃদয়। গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের বেতগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ট্রাকের ধাক্কায় ডান হাত হারিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী যুবক হৃদয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, প্রধান সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা কমাতে সর্বপ্রথম যে বিষয়টা দরকার সেটা হচ্ছে চালকদের রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করা। দুর্ঘটনার ৩৭ ভাগের কারণ হচ্ছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও মাত্রাতিরিক্ত গতি। তাই চালকদের মানসিক হতাশা দূর করতে সরকারিভাবে যদি মেন্টাল ওরিয়েন্টেশন ও রিফ্রেশমেন্ট করা যায় তাহলে দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। তাই প্রধান সড়কগুলোতে গাড়ির গতির পরিমাণ কমাতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ ভাগই হয় শুধু রাজধানী ঢাকায়। তাই দেশে যে ভুঁইফোড় গাড়ি কোম্পানি রয়েছে তাদের নির্দিষ্ট কোম্পানির আওতায় আনতে হবে। বেশির ভাগ গাড়িই কম দামি। আবার তাদের মালিকদের ওপর রয়েছে মন্ত্রী আমলাদের আশীর্বাদের হাত। তাই দুর্ঘটনার বিচারের বিষয়টি খুব বেশিদূর গড়াতে পারে না। তাছাড়া দুর্ঘটনা রোধে নেই সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা। দুর্ঘটনার পর চালককে গ্রেপ্তার করা হলেও খুব অল্প সময়েই তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে আসেন। আবার তারাই চালকের আসনে বসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে সাধারণ জনগণ, বাস মালিক, পুলিশ ও বাস কেউ নিয়মের মধ্যে আসে না। এক কথায় সড়কে অরাকজতা চলছে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমরা একতরফা ভাবে ড্রাইভারদের দোষ দিতে পারি না। এখানে ড্রাইভার পথচারী প্রত্যেকেরই সচেতনতার অভাব রয়েছে। প্রথমত ৩৩ লাখ ড্রাইভারের অর্ধেকই হচ্ছে অশিক্ষিত। অধিকাংশ ড্রাইভারই কিছুদিন হেল্পারের কাজ করার পর সেখান থেকে বাস চালাতে চালাতে চালক হচ্ছে। সম্প্রতি রাজীব নামে এক শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পরপরই একজন হেল্পারের ডান হাত কাটার ঘটনা ঘটেছে। যেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। একজন হেল্পারের শুধু হাত কেন তার পুরো শরীরই কাটা পড়ার কথা। কারণ পাবালিক বাসের একজন হেল্পার বাস চলাকালে তার শরীরের অধিকাংশই বাইরে বের করে রেখে ড্রাইভারকে ‘ওস্তাদ বায়ে প্লাস্টিক’ বলে ডিরেকশন দিয়ে থাকে। অন্যদিকে অধিকাংশ গাড়ির মালিক কম দামে গাড়ি কিনে অধিক মুনাফার জন্য যেকোনো ড্রাইভারের হাতে রাস্তায় গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। তাই গাড়ির কোনো দুর্ঘটনা হলেও তাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা দায়বদ্ধতা থাকে না। এছাড়া গাড়ি প্রতি একজন ড্রাইভারকে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টাকা মালিককে জমা দিতে হয়। ফলে মালিকের জমার টাকা, হেল্পারের টাকা, ড্রাইভারের আয় সব মিলিয়ে কে কার আগে কত বেশি ট্রিপ দিতে পারে এটা নিয়ে যেন রাজপথে রীতিমতো পাগলামি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তাই একজন পাগল ড্রাইভার যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটাতেই পারে। লোকাল গাড়িগুলো কম দামি হওয়ায় মালিক পক্ষ ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি মাথায় নেন না। অথচ দেশের উন্নতমানের লাক্সারিয়াস কোচগুলো ব্যয়বহুল হওয়ায় ড্রাইভারদের দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষ করে এই হাত-পা কাটা কমাতে ড্রাইভারদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে সড়কে চলাচল করা সাধারণ জনগণকেও সচেতন হতে হবে। পথচারীর অধিকাংশই যখন রাস্তা পার হয় তখন তাদের ভাবখানা এমন যেন নিজের বাড়ির আঙিনা দিয়ে হাঁটছেন। প্রধান সড়কে যখন একজন পথচারী নিজের বাড়ি ভেবে পার হবেন বা গাড়ি থেকে নামবেন, তখন তো দুর্ঘটনা নিশ্চিত। এক্ষেত্রে দেশের সরকার, ট্রাফিক বিভাগ, ফিটনেসবিহীন গাড়িকে অবৈধ ঘোষণা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাস্তায় দুর্ঘটনার পরিমাণ কমানো সম্ভব।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ২০১৮ সালের গত তিন মাসের এক জরিপে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে ৪৯৯টি দুর্ঘটনায় ৫১৪ জন নিহত এবং ১৩৫৩ জন আহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৪৩৯টি দুর্ঘটনায় ৪৫৯ জন নিহত ও ১৫২১ জন আহত হয়েছে। মার্চে ৪৯১ দুর্ঘটনায় ৪৮৩ জন নিহত ও ১৫০৬ জন আহত হয়েছে।
No comments