পানামা রায়- পাকিস্তানের গন্তব্য কোথায়? by সালমান রাফি
৭০
বছর বয়সে এসে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি অবশেষে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ায় আরোহণ করতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী
রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত এ কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে আজ যখন একজন
নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন অভিযোগে দায়িত্ব পালনের অযোগ্য
ঘোষিত হলেন। এটা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন, নয়
কি?
অযোগ্যতা!
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ২৫ পৃষ্ঠার এক সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রীর আসনে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এই রায়ের পর পাকিস্তানে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এখন সংসদ ভেঙে দেয়া হবে, নাকি আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পথে দেশ এগিয়ে যাবে তা নিয়ে জনগণের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়। তবে সময় মতো এই আশঙ্কার জবাব দেয়ার জন্য মুসলিম লীগ-নওয়াজকে ধন্যবাদ। দলটির নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করবে এবং সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সময়ে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদের একজন শক্তি প্রার্থী হলেন নওয়াজ শরীফের ছোটভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। এটা হলে সরকার ও দলের ওপর শরীফ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত নিশ্চুপ। এই মামলায় প্রত্যক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ না করে সুপ্রিম কোর্ট ও অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে দিয়েছে। ফলে আর কোনো সেনা অভ্যুত্থানের গুজব অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। তবে, প্রধানমন্ত্রীকে তার পদে অযোগ্য ঘোষণা করা একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের উপর এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এরই প্রেক্ষাপটে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হলো: এই অযোগ্যতার ঘোষণা পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যাবে?
রায়ের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কি হবে?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানে কোনো দায়িত্বপালনরত প্রধানমন্ত্রীকে এই প্রথমবারের মতো অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। ২০১২ সালের ১৯শে জুন আদালত অবমাননার অভিযোগ মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানীকে সরে যেতে হয়েছিলো। পাকিস্তানের ছককাটা রাজনীতিতে সিটিং প্রধানমন্ত্রীদের অযোগ্য ঘোষণা করা একটি নতুন প্রবণতা। ১৯৯০’র দশকে (‘গণতন্ত্রের দশক’ ও পরোক্ষ সেনা হস্তক্ষেপের যুগ) দেখা গেছে মোটামুটি প্রতি দুই বছরে একবার করে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। । কিছু মানুষ পর্দার আড়ালে থেকে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের সহজ ও নতুন উপায় হিসেবে প্রধানমন্ত্রীদের অযোগ্য ঘোষণা করার এই ‘নতুন চর্চা’ শুরু করেছে।
পাকিস্তানে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই রায় যতটা না বিচার ব্যবস্থার উচ্চস্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ, তারচেয়ে বেশি একটি ‘বিচারিক অভ্যুত্থান’। এ রকম সংশয় থাকার পরও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আর কোনো প্রধানমন্ত্রী এমন কি কোনো এলিট রাজনীতিককে নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের মতো এমন উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনিক ও বিচারিক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের সম্মুখিন হতে হয়নি।
নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে এই রায়ের প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে, সে কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। নওয়াজ শরীফই প্রথম অযোগ্য ঘোষিত কোনো প্রধানমন্ত্রী না হলেও এখন কেউ আর এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে (কেন্দ্রীয় পাঞ্জাব) যার শেকড় সেই রাজনীতিককেও ক্ষমতা ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে হয়। গিলানিকে যখন ঘরে ফিরে যেতে হয়েছিল তখন তার সিরাইকি (পশ্চিম পাঞ্জাবের ক্ষুদ্র একটি সমপ্রদায়) পরিচিতির কারণে এমন ধারণা হয়েছিল যে, ক্ষুদ্র প্রদেশ বা পাঞ্জাবের তুলনামূলক পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর কাউকেই শুধু অযোগ্য ঘোষণা, পরিবর্তন বা সরসরি বরখাস্ত করা সম্ভব। এমন ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান রায়টি শুধু ঐতিহাসিকই নয়, এর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তাও রয়েছে। আর সেই বার্তাটি হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাঞ্জাবের আধিপত্য নিয়ে। এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পাঞ্জাবের প্রভাবের মধ্যে ফাটল ধরেছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি রাজনীতির গতানুগতিক প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আসছে এই রায়ের মধ্য দিয়ে তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন, এই মামলা ও এ নিয়ে যে পরিমাণ প্রচারণা হয়েছে তাতে নির্ধারিত হয়ে গেছে যে, পাকিস্তানে যেসব রাজনীতিক নিজেদেরকে ‘সাধারণ মানুষের চেয়ে কিছুটা ওপরে’ বলে ভাবছেন এবং কোনো জ্ঞাত সম্পদ ও বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন তাদের আর আগের রাজনীতির ধারা বজায় রাখা চলবে না। অন্তত সেই নির্লজ্জ চালচলন পরিত্যাগ করতে হবে।
তবে, ১৯৯০ দশকের চেয়ে ২০১৭ সাল অনেক দিক দিয়ে আলাদা হলেও এই দুই যুগের মধ্যে এখনো অনেক কিছুর মিল রয়ে গেছে।
যেমন, এমন রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যা তাকেও আক্রান্ত করবে সেই আশঙ্কা থাকার পরও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। একই সঙ্গে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে তার সক্ষমতা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছে। এরপরও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করার ভার এখনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর রয়ে গেছে।
আর তাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো: শরীফের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার মানে কি পাকিস্তানে গণতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। শুক্রবারের রায়ের পর থেকে মিডিয়ায় যে আলোচনা চলছে, যে গণ উৎসব চলছে, আগামী কয়েকদিন ধরে যা চলবে ঠিক একই পরিস্থিতি ১৯৯০’র দশকেও দেখা গিয়েছিলো। তখন বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফ দু’জনকেই দু’বার করে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। পাকিস্তানের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক অসিম সাজ্জাদ আখতার বলেন, জনসাধারণের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ও গণতন্ত্র সুসংহত হচ্ছে বলে আশাবাদ দেখা যাচ্ছে ১৯৭০’র দশকেও তা দেখা গিয়েছিলো যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বরখাস্ত এবং পরে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। আখতার আরো বলেন, এ ধরনের বারবার বরখাস্তের ঘটনা ও গণতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে বলে অতিমাত্রায় আশাবাদ শুধু একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিকাশে পাকিস্তানের অক্ষমতা নিয়ে হতাশাকেই জোরদার করছে। এই হতাশা এবং সত্যিকারের কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের অভাব থেকে বুঝা যায় গত ৭০ বছর ধরে বহু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এতসব উদাহরণ থাকার পরও পাকিস্তানে জবাবদিহিতা ও যাচাই প্রক্রিয়া কখনোই ‘অভিশপ্ত রাজনীতিকদের’ বাইরে বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
আবারো বলছি, এই অযোগ্যতার ঘোষণা যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো: এর ফলে পাকিস্তানের জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া টেকসই হবে কি না এবং অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে কিনা। সাংবিধানিকভাবে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেই সেগুলোর কাজের জন্য জবাবদিহি করা যায়। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাস বলে এই প্রক্রিয়া এযাবৎকাল শুধু সরকারের নির্বাহী বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
একজন প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণার কারণে গণতন্ত্র নিজেই হুমকির মুখে পড়ছে সে কথা বলা না গেলেও এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আবার দেখিয়ে দিলো যে, পাকিস্তানে জবাবদিহিতা ধারণার প্রয়োগ এখনো অত্যন্ত সংকীর্ণ ও সীমিত পর্যায়ে।
ফলে, এখানে যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠবে এবং যার উত্তর পেতে হবে তাহলো: এই জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া কি পাকিস্তানের অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত ক্ষেত্রগুলোতেও প্রয়োগ করা হবে? এই প্রক্রিয়া আগামীতেও সীমিত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে তা পাকিস্তানের ক্ষমতার মূলকেন্দ্রগুলোতে তেমন কোনো আঘাত হানা ও সেগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবে না। এতে পাকিস্তানের গণতন্ত্র গুণগতভাবে অগণতান্ত্রিক হিসেবেই রয়ে যাবে।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
অযোগ্যতা!
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ২৫ পৃষ্ঠার এক সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রীর আসনে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এই রায়ের পর পাকিস্তানে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এখন সংসদ ভেঙে দেয়া হবে, নাকি আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পথে দেশ এগিয়ে যাবে তা নিয়ে জনগণের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়। তবে সময় মতো এই আশঙ্কার জবাব দেয়ার জন্য মুসলিম লীগ-নওয়াজকে ধন্যবাদ। দলটির নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করবে এবং সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সময়ে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদের একজন শক্তি প্রার্থী হলেন নওয়াজ শরীফের ছোটভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। এটা হলে সরকার ও দলের ওপর শরীফ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত নিশ্চুপ। এই মামলায় প্রত্যক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ না করে সুপ্রিম কোর্ট ও অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে দিয়েছে। ফলে আর কোনো সেনা অভ্যুত্থানের গুজব অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। তবে, প্রধানমন্ত্রীকে তার পদে অযোগ্য ঘোষণা করা একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের উপর এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এরই প্রেক্ষাপটে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হলো: এই অযোগ্যতার ঘোষণা পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যাবে?
রায়ের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কি হবে?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানে কোনো দায়িত্বপালনরত প্রধানমন্ত্রীকে এই প্রথমবারের মতো অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। ২০১২ সালের ১৯শে জুন আদালত অবমাননার অভিযোগ মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানীকে সরে যেতে হয়েছিলো। পাকিস্তানের ছককাটা রাজনীতিতে সিটিং প্রধানমন্ত্রীদের অযোগ্য ঘোষণা করা একটি নতুন প্রবণতা। ১৯৯০’র দশকে (‘গণতন্ত্রের দশক’ ও পরোক্ষ সেনা হস্তক্ষেপের যুগ) দেখা গেছে মোটামুটি প্রতি দুই বছরে একবার করে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। । কিছু মানুষ পর্দার আড়ালে থেকে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের সহজ ও নতুন উপায় হিসেবে প্রধানমন্ত্রীদের অযোগ্য ঘোষণা করার এই ‘নতুন চর্চা’ শুরু করেছে।
পাকিস্তানে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই রায় যতটা না বিচার ব্যবস্থার উচ্চস্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ, তারচেয়ে বেশি একটি ‘বিচারিক অভ্যুত্থান’। এ রকম সংশয় থাকার পরও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আর কোনো প্রধানমন্ত্রী এমন কি কোনো এলিট রাজনীতিককে নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের মতো এমন উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনিক ও বিচারিক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের সম্মুখিন হতে হয়নি।
নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে এই রায়ের প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে, সে কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। নওয়াজ শরীফই প্রথম অযোগ্য ঘোষিত কোনো প্রধানমন্ত্রী না হলেও এখন কেউ আর এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে (কেন্দ্রীয় পাঞ্জাব) যার শেকড় সেই রাজনীতিককেও ক্ষমতা ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে হয়। গিলানিকে যখন ঘরে ফিরে যেতে হয়েছিল তখন তার সিরাইকি (পশ্চিম পাঞ্জাবের ক্ষুদ্র একটি সমপ্রদায়) পরিচিতির কারণে এমন ধারণা হয়েছিল যে, ক্ষুদ্র প্রদেশ বা পাঞ্জাবের তুলনামূলক পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর কাউকেই শুধু অযোগ্য ঘোষণা, পরিবর্তন বা সরসরি বরখাস্ত করা সম্ভব। এমন ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান রায়টি শুধু ঐতিহাসিকই নয়, এর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তাও রয়েছে। আর সেই বার্তাটি হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাঞ্জাবের আধিপত্য নিয়ে। এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পাঞ্জাবের প্রভাবের মধ্যে ফাটল ধরেছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি রাজনীতির গতানুগতিক প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আসছে এই রায়ের মধ্য দিয়ে তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন, এই মামলা ও এ নিয়ে যে পরিমাণ প্রচারণা হয়েছে তাতে নির্ধারিত হয়ে গেছে যে, পাকিস্তানে যেসব রাজনীতিক নিজেদেরকে ‘সাধারণ মানুষের চেয়ে কিছুটা ওপরে’ বলে ভাবছেন এবং কোনো জ্ঞাত সম্পদ ও বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন তাদের আর আগের রাজনীতির ধারা বজায় রাখা চলবে না। অন্তত সেই নির্লজ্জ চালচলন পরিত্যাগ করতে হবে।
তবে, ১৯৯০ দশকের চেয়ে ২০১৭ সাল অনেক দিক দিয়ে আলাদা হলেও এই দুই যুগের মধ্যে এখনো অনেক কিছুর মিল রয়ে গেছে।
যেমন, এমন রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যা তাকেও আক্রান্ত করবে সেই আশঙ্কা থাকার পরও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। একই সঙ্গে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে তার সক্ষমতা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছে। এরপরও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করার ভার এখনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর রয়ে গেছে।
আর তাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো: শরীফের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার মানে কি পাকিস্তানে গণতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। শুক্রবারের রায়ের পর থেকে মিডিয়ায় যে আলোচনা চলছে, যে গণ উৎসব চলছে, আগামী কয়েকদিন ধরে যা চলবে ঠিক একই পরিস্থিতি ১৯৯০’র দশকেও দেখা গিয়েছিলো। তখন বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফ দু’জনকেই দু’বার করে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। পাকিস্তানের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক অসিম সাজ্জাদ আখতার বলেন, জনসাধারণের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ও গণতন্ত্র সুসংহত হচ্ছে বলে আশাবাদ দেখা যাচ্ছে ১৯৭০’র দশকেও তা দেখা গিয়েছিলো যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বরখাস্ত এবং পরে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। আখতার আরো বলেন, এ ধরনের বারবার বরখাস্তের ঘটনা ও গণতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে বলে অতিমাত্রায় আশাবাদ শুধু একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিকাশে পাকিস্তানের অক্ষমতা নিয়ে হতাশাকেই জোরদার করছে। এই হতাশা এবং সত্যিকারের কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের অভাব থেকে বুঝা যায় গত ৭০ বছর ধরে বহু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এতসব উদাহরণ থাকার পরও পাকিস্তানে জবাবদিহিতা ও যাচাই প্রক্রিয়া কখনোই ‘অভিশপ্ত রাজনীতিকদের’ বাইরে বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
আবারো বলছি, এই অযোগ্যতার ঘোষণা যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো: এর ফলে পাকিস্তানের জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া টেকসই হবে কি না এবং অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে কিনা। সাংবিধানিকভাবে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেই সেগুলোর কাজের জন্য জবাবদিহি করা যায়। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাস বলে এই প্রক্রিয়া এযাবৎকাল শুধু সরকারের নির্বাহী বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
একজন প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণার কারণে গণতন্ত্র নিজেই হুমকির মুখে পড়ছে সে কথা বলা না গেলেও এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আবার দেখিয়ে দিলো যে, পাকিস্তানে জবাবদিহিতা ধারণার প্রয়োগ এখনো অত্যন্ত সংকীর্ণ ও সীমিত পর্যায়ে।
ফলে, এখানে যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠবে এবং যার উত্তর পেতে হবে তাহলো: এই জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া কি পাকিস্তানের অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত ক্ষেত্রগুলোতেও প্রয়োগ করা হবে? এই প্রক্রিয়া আগামীতেও সীমিত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে তা পাকিস্তানের ক্ষমতার মূলকেন্দ্রগুলোতে তেমন কোনো আঘাত হানা ও সেগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবে না। এতে পাকিস্তানের গণতন্ত্র গুণগতভাবে অগণতান্ত্রিক হিসেবেই রয়ে যাবে।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
No comments