জঙ্গিবাদ- বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ? by নুরুজ্জামান লাবু

দেশে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে জঙ্গিবাদ। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো শুরু করেছে তাদের গোপন সাংগঠনিক কার্যক্রম। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কর্মী সংগ্রহ করছে তারা। বিভিন্ন উপায়ে সমৃদ্ধ করছে অর্থ-তহবিলও। গত কয়েক মাসে জঙ্গিরা একাধিক হামলায় নিজেদের অস্তিত্ব নতুন করে জানান দিয়েছে। চলতি বছরেই অন্তত ৫ জন ব্লগার, লেখক-প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। হামলা চলছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপরও। রাজধানী ঢাকায় শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। বগুড়ায় শিয়া মসজিদে বোমা হামলা হয়েছে। রাজধানীর গাবতলী ও আশুলিয়ায় পুলিশের চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনাতেই পাওয়া গেছে জঙ্গি সম্পৃক্ততা। ঢাকার গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথা না বললেও রংপুরের জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিরা সম্পৃক্ত বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া পাবনায় গির্জার যাজকের ওপর হামলায় জঙ্গিরা জড়িত বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে দিনাজপুরের ইসক্‌ন মন্দিরে হামলার ঘটনাতেও। এ ছাড়া একের পর এক হামলা ও হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটেই চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে অন্তত ১০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব হামলার বেশ কয়েকটির দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। এমনকি তাদের প্রকাশনা ‘দাবিক’ বাংলাদেশে কার্যক্রম এসব নিয়ে বিশেষ ‘আর্টিকেল’ও ছাপা হয়েছে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রধানত আল-কায়েদার অনুসারী ছিল; কিন্তু আল-কায়েদার প্রভাব কমে যাওয়া এবং আইএসের তৎ?পরতা দৃশ্যমান হওয়ায় এখানকার জঙ্গিরা আইএসমুখী হওয়ার চেষ্টা করছে।’ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিরিয়া এবং ইরাকে আইএসের তৎ?পরতা এখানকার জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করছে। এখন ‘লিডার লেস’ জিহাদ শুরু হয়েছে। ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিরসন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়াতে হবে।’ পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে শুধু জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করবে এমন কোনো ইউনিট নেই। বহুদিন ধরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কথা বলা হলেও তা হয়নি। যার ফলে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট হলে সেখানে যারা থাকবে তারা মাসের পর মাস শুধু জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করবে এবং জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভের কারণগুলোও অনুসন্ধান করবে। এতে কিছু সফল পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের তৎ?পরতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের নতুন ছক গড়ে ওঠায় বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে। ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে এখানকার জঙ্গিরা নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। আগে আল-কায়েদার অনুসারী ছিল জঙ্গিরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জঙ্গিদের সঙ্গেও বাংলাদেশের জঙ্গিদের সম্পর্ক অনেক পাকাপোক্ত। গত বছরের শেষদিকে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে এক বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশের জেএমবির অনেক সদস্য পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে থেকে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। এ ঘটনার পর কয়েক দফা ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ) কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জঙ্গিদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তথ্যবিনিময় করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের ভারতীয় জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখন অস্বীকার করা হলেও এর আগে অন্তত ১৪ জঙ্গি ধরা পড়েছে, যারা কোনো না কোনোভাবে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। তারা বিভিন্ন উপায়ে সিরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এ ছাড়া কয়েকজন এরই মধ্যে আইএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলেও গোয়েন্দা তথ্য বলছে। এমনকি কয়েকজনকে তুরস্ক বা সিরিয়া থেকে ফেরত আনা হয়েছে। মাস ছয়েক আগে ঢাকায় সামিউন ওরফে ইবনে হামদান নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক বৃটিশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। যে আইএসের জন্য জিহাদি রিক্রুট করতে বাংলাদেশে এসেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে ১০০ জিহাদি সিরিয়ায় পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল তার। এর আগে আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী তানজিল নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা ‘জিহাদে’ অংশ নিতে তুরস্ক ও সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে মূলত ৯০ দশকের শুরুতে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন ব্যক্তির হাত ধরে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয়। এরাই পরে হরকাতুল জিহাদ অব বাংলাদেশ (হুজিবি) নামে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করে। এরপর হুজির নেতারাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করে। ১৯৯৯ সালে যশোরের উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা হয়। ওই ঘটনাটিই মূলত জঙ্গি হামলার প্রথম ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। যদিও রাজনৈতিক টানাপড়েনে এ মামলার তদন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিকে মোড় ঘুরে গেছে। এরপর ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল রমনার বটমূলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়ে হুজি জঙ্গি তৎপরতার জানান দেয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে একাধিক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশেও গ্রেনেড হামলা করা হয়। ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এর পরেও সারা দেশে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তাসহ অন্তত ৩৩ জন জনকে হত্যা করে জেএমবি। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে অর্ধশত জঙ্গি গ্রুপ নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে হিযবুত তাহ্‌রীর, শাহাদাত-ই-আল হিকমা, জামা’আতে মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি)- এ পাঁচটি সংগঠনকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকায় নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সর্বশেষ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
নিরাপত্তা-বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে তা ভবিষ্যতের জন্য খুবই ‘অ্যালার্মিং’। এক কথায় বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের উর্বর-ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। জঙ্গিবাদ বিস্তৃত হওয়ার বিষয়টি সার্বিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে এখনই থামাতে হবে।’ তিনি বলেন, মাঝখানে কিছুদিন জঙ্গিবাদ একটু কমে এসেছিল। এখন আবার তারা রি-অর্গানাইজড হয়ে মাঠে নেমেছে। নতুন নতুন রিক্রুট হচ্ছে, নতুন কৌশল নিয়ে কাজ করছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেলে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করছে। এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জঙ্গিরা এখন ‘রিফরমেটিভ’ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। অর্থাৎ নতুন করে ছোট ছোট ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যে তারা বড় ঘটনা ঘটাবে না তা বলা যাবে না।
নিরাপত্তা বিষয়ে খোঁজখবর রাখা এ বিশ্লেষক বলেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জঙ্গিবাদ ঠেকানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব হয়। সেজন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি। একই সঙ্গে ইন্টেলেকচুয়াল ব্যক্তিবর্গ ও সিভিল সোসাইটিকে এক করে লংটার্ম পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে শুধু তাৎক্ষণিক ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু গোপনে গোপনে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করবেই। এম সাখাওয়াত মনে করেন, এখন মাদরাসার ছাত্রদের চেয়ে অনেক উচ্চশিক্ষিত আধুনিক তরুণ জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ছে। টেকনোলজি জানা তরুণরা জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ছে। কেন তারা জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং কারণগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই জঙ্গিবাদ ঠেকানো যাবে।

No comments

Powered by Blogger.