আমরা সবাই ফরাসি কখনও সিরীয়, ইরাকি বা লেবানিজ নই by ডেভিড সোয়ানসন
আমরা সবাই ফরাসি। দৃশ্যত। কিন্তু আমরা কখনোই লেবানিজ, সিরীয় বা ইরাকি হতে
পারিনি কিছু কারণে। আমেরিকার যুদ্ধে ভিন্ন বর্ণের ও সংস্কৃতির মানুষের
মৃত্যু ঘটছে বলেই এ যুদ্ধ মেনে নেয়া বা উদযাপন করা হচ্ছে, এমনটা বিশ্বাস
করতে বলা হয় না আমাদের। কিন্তু সত্যি বলতে কি, শ্বেতাঙ্গ, খ্রিস্টান,
যুদ্ধংদেহী সরকার অধিষ্ঠিত পশ্চিম ইউরোপের কোন এক দেশের অল্প সংখ্যক
বাসিন্দা খুন হলেও, সহানুভূতির ফুলঝুরি ছোটান যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম প্যারিস হামলা নিয়ে বলেছেন, ‘এটা ফরাসি
জনগণের ওপর আঘাত নয় কেবল। এটা মানব শালীনতা ও আমাদের সব প্রিয় জিনিসের ওপর
হামলা’। আমি নিশ্চিত নই, সিনেটর গ্রাহাম যেসব জিনিসকে প্রিয় জ্ঞান করেন,
আমিও তেমন করি কি না। কিন্তু আমি মনে করি, তিনি সঠিক। ফ্রান্সে গণহারে
হত্যাযজ্ঞের পর এ সহানুভূতির প্রকাশ দিনের কার্যসূচি হিসেবে খুবই ভালো।
আমি শুধু মনে করি, একই কথা প্রযোজ্য হওয়া উচিত বিশ্বের অন্য যে কোন স্থানের মানুষের জন্য। সামপ্রতিক যুদ্ধগুলোতে মারা যাওয়া বেশির ভাগ মানুষই বেসামরিক। মার্কিন গণমাধ্যমকে কখনই দেখা যায় না, ইয়েমেন, পাকিস্তান বা ফিলিস্তিনে মানুষের মৃত্যুকে আমাদের সাধারণ মানবতার ওপর আঘাত হিসেবে ঘোষণা করতে।
আমি সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে উপরে ‘যুদ্ধংদেহী সরকার’ থাকার কথা উল্লেখ করেছি। কারণ, আমি ২০০৩ সালের একটি ঘটনা মনে করতে পারি। সেদিন আমিই বরং চিৎকার করছিলাম, ‘আমরা সবাই ফ্রান্স’। অপরদিকে আমেরিকার যুদ্ধপন্থি নেতারা তখন ফ্রান্সের নিন্দা জানিয়ে আসছিল। কারণ, ফ্রান্স তখন ইরাক যুদ্ধে সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল। ফ্রান্স তখন নিশ্চিত করে বলে আসছিল, মার্কিন যুদ্ধ হবে হিতে-বিপরীত, বয়ে আনবে সর্বনাশা বিপদ। ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছিল ফ্রান্স। কিন্তু ফ্রান্স সেদিন আমেরিকাকে পরামর্শ দিয়েছিল, ওই হামলার বিপরীতে বিবেচনাবোধ, শালীনতা ও সততার পরিচয় দিতে। জবাবে ফ্রান্সকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, জাহান্নামে যাও। এমনকি ফ্রান্সকে অপমান করতে, মার্কিন কংগ্রেসের বেশ কয়েকটি ভবনের নাম পাল্টে রাখা হয়েছিল ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ’।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ১৪ বছরের বৈশ্বিক যুদ্ধে কেবল নতুন করে সন্ত্রাসেরই জন্ম হয়েছে। ১৪ বছর আগের ফ্রান্স পাল্টে গেছে। এখনকার ফ্রান্স অনেক উৎসাহী এক দখলদার, দস্যু, বোমাবাজ ও বিদ্বেষপূর্ণ গোঁড়ামির প্রচারক। ‘সমতা ও স্বাধীনতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত’ সৌদি আরবের কাছে আজ ফ্রান্স লাখো কোটি ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করে। অনেক সৌদি যে পশ্চিমা-বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন করে আসছে, সে ব্যাপারে চোখ বুজে আছে ফ্রান্স।
মার্কিন সমরাস্ত্রবাদ ৯/১১ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমি তখন ভেবেছিলাম, এর ফলে আমেরিকার সমরাস্ত্রবাদ খর্ব হবে। কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। কয়েকদিন আগে যখন রাশিয়ার বেসামরিক বিমান বিধ্বস্ত হলো, তখন আমি এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য ভাবলাম, আমেরিকার করা ভুল থেকে শিক্ষা নেবে রাশিয়া। যখন ফ্রান্সে শত মানুষ খুন হলো, তখন আমি একবারও কল্পনা করি নি, ফ্রান্স নিজের বোধবুদ্ধিতে ফিরে আসবে। কারণ, দেশটির ‘সমাজতন্ত্রী’ প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বুশের মতোই বলে গেছেন সব।
তিনি বললেন, ‘এ নিষ্ঠুর জিনিস যারা দেখেছেন, তাদের সবাইকে বলছি। আমি বলতে চাই, আমরা এমন এক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেব, যা হবে ‘মায়াহীন’। কারণ, যখন সন্ত্রাসীরা এ ধরনের নৃশংসতা চালানোর সামর্থ্য রাখে, তখন তারা নিশ্চয়ই আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ ফ্রান্সকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে’।
ওই ভিডিওতে প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া ওঁলাদকে বুশের মতো মনে হয়নি। সত্যি বলতে কি, যে ফরাসি শব্দ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, সেটার অর্থ ‘যুদ্ধ’ নয়, ওয়াশিংটন পোস্ট বললেও নয়। ওই শব্দ বুঝিয়ে থাকতে পারে, অন্য ধরনের এক লড়াই। কিন্তু এই অন্য ধরনের লড়াই জিনিসটা কি? আমি নিশ্চিত নই। এ হামলার জন্য কারও বিচার করাটাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত বিষয়। কিন্তু কোন ফৌজদারি বিচার কাঠামোই ‘মায়াহীন’ হতে পারে না। যুদ্ধই কেবল মায়াহীন হতে পারে এবং যুদ্ধের ফলে আরও নিশ্চিত হামলা হবে কেবল। এই যুদ্ধটাই ফ্রান্স মাত্র শুরু করলো।
আলবার্ট কামুস বলেছিলেন, চিন্তক মানুষদের কাজ হলো, জল্লাদদের পক্ষালম্বন না করা। ফ্রান্স, দয়া করে আগের মতো চিন্তক হও। আমরা তোমাকে ভালোবাসি। তোমাদের প্রতি আমাদের শুভকামনা। একই সঙ্গে তোমাদের কল্যাণকর প্রবণতার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রভাবের জন্য আমরাও দুঃখিত।
(লেখক: ডেভিড সোয়ানসন ২০১৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি লেখক ও সাংবাদিক। তার এ নিবন্ধটি কাউন্টারকারেন্টস.অর্গে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
আমি শুধু মনে করি, একই কথা প্রযোজ্য হওয়া উচিত বিশ্বের অন্য যে কোন স্থানের মানুষের জন্য। সামপ্রতিক যুদ্ধগুলোতে মারা যাওয়া বেশির ভাগ মানুষই বেসামরিক। মার্কিন গণমাধ্যমকে কখনই দেখা যায় না, ইয়েমেন, পাকিস্তান বা ফিলিস্তিনে মানুষের মৃত্যুকে আমাদের সাধারণ মানবতার ওপর আঘাত হিসেবে ঘোষণা করতে।
আমি সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে উপরে ‘যুদ্ধংদেহী সরকার’ থাকার কথা উল্লেখ করেছি। কারণ, আমি ২০০৩ সালের একটি ঘটনা মনে করতে পারি। সেদিন আমিই বরং চিৎকার করছিলাম, ‘আমরা সবাই ফ্রান্স’। অপরদিকে আমেরিকার যুদ্ধপন্থি নেতারা তখন ফ্রান্সের নিন্দা জানিয়ে আসছিল। কারণ, ফ্রান্স তখন ইরাক যুদ্ধে সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল। ফ্রান্স তখন নিশ্চিত করে বলে আসছিল, মার্কিন যুদ্ধ হবে হিতে-বিপরীত, বয়ে আনবে সর্বনাশা বিপদ। ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছিল ফ্রান্স। কিন্তু ফ্রান্স সেদিন আমেরিকাকে পরামর্শ দিয়েছিল, ওই হামলার বিপরীতে বিবেচনাবোধ, শালীনতা ও সততার পরিচয় দিতে। জবাবে ফ্রান্সকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, জাহান্নামে যাও। এমনকি ফ্রান্সকে অপমান করতে, মার্কিন কংগ্রেসের বেশ কয়েকটি ভবনের নাম পাল্টে রাখা হয়েছিল ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ’।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ১৪ বছরের বৈশ্বিক যুদ্ধে কেবল নতুন করে সন্ত্রাসেরই জন্ম হয়েছে। ১৪ বছর আগের ফ্রান্স পাল্টে গেছে। এখনকার ফ্রান্স অনেক উৎসাহী এক দখলদার, দস্যু, বোমাবাজ ও বিদ্বেষপূর্ণ গোঁড়ামির প্রচারক। ‘সমতা ও স্বাধীনতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত’ সৌদি আরবের কাছে আজ ফ্রান্স লাখো কোটি ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করে। অনেক সৌদি যে পশ্চিমা-বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন করে আসছে, সে ব্যাপারে চোখ বুজে আছে ফ্রান্স।
মার্কিন সমরাস্ত্রবাদ ৯/১১ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমি তখন ভেবেছিলাম, এর ফলে আমেরিকার সমরাস্ত্রবাদ খর্ব হবে। কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। কয়েকদিন আগে যখন রাশিয়ার বেসামরিক বিমান বিধ্বস্ত হলো, তখন আমি এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য ভাবলাম, আমেরিকার করা ভুল থেকে শিক্ষা নেবে রাশিয়া। যখন ফ্রান্সে শত মানুষ খুন হলো, তখন আমি একবারও কল্পনা করি নি, ফ্রান্স নিজের বোধবুদ্ধিতে ফিরে আসবে। কারণ, দেশটির ‘সমাজতন্ত্রী’ প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বুশের মতোই বলে গেছেন সব।
তিনি বললেন, ‘এ নিষ্ঠুর জিনিস যারা দেখেছেন, তাদের সবাইকে বলছি। আমি বলতে চাই, আমরা এমন এক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেব, যা হবে ‘মায়াহীন’। কারণ, যখন সন্ত্রাসীরা এ ধরনের নৃশংসতা চালানোর সামর্থ্য রাখে, তখন তারা নিশ্চয়ই আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ ফ্রান্সকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে’।
ওই ভিডিওতে প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া ওঁলাদকে বুশের মতো মনে হয়নি। সত্যি বলতে কি, যে ফরাসি শব্দ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, সেটার অর্থ ‘যুদ্ধ’ নয়, ওয়াশিংটন পোস্ট বললেও নয়। ওই শব্দ বুঝিয়ে থাকতে পারে, অন্য ধরনের এক লড়াই। কিন্তু এই অন্য ধরনের লড়াই জিনিসটা কি? আমি নিশ্চিত নই। এ হামলার জন্য কারও বিচার করাটাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত বিষয়। কিন্তু কোন ফৌজদারি বিচার কাঠামোই ‘মায়াহীন’ হতে পারে না। যুদ্ধই কেবল মায়াহীন হতে পারে এবং যুদ্ধের ফলে আরও নিশ্চিত হামলা হবে কেবল। এই যুদ্ধটাই ফ্রান্স মাত্র শুরু করলো।
আলবার্ট কামুস বলেছিলেন, চিন্তক মানুষদের কাজ হলো, জল্লাদদের পক্ষালম্বন না করা। ফ্রান্স, দয়া করে আগের মতো চিন্তক হও। আমরা তোমাকে ভালোবাসি। তোমাদের প্রতি আমাদের শুভকামনা। একই সঙ্গে তোমাদের কল্যাণকর প্রবণতার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রভাবের জন্য আমরাও দুঃখিত।
(লেখক: ডেভিড সোয়ানসন ২০১৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি লেখক ও সাংবাদিক। তার এ নিবন্ধটি কাউন্টারকারেন্টস.অর্গে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
No comments