হরতাল নয়, প্রয়োজন সংলাপ ও সমঝোতা by বদিউল আলম মজুমদার
৭
নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে
সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত গত সাত দশকে—১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত—আমাদের দেশে
ডাকা হরতালের একটি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তাঁর সংগৃহীত তথ্যগুলো মূল্যবান। এ
জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
অজয় দাশগুপ্তর সন্নিবেশিত তথ্যগুলো এখনো বিশ্লেষণের অপেক্ষায় আছে, যে কাজটি তিনি করবেন বলে উপস্থিত শ্রোতাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে সন্নিবেশিত ‘র’ বা কাঁচা তথ্যগুলো, গভীর বিশ্লেষণের আগেই আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসের, বিশেষত রাজনৈতিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।
অনেকেই অবগত আছেন যে হরতালের জনক মহাত্মা গান্ধী। তিনি ১৯১৯ সালে প্রথম হরতাল ডাকেন ভারতে ব্রিটিশদের একটি নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে নীরব ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হিসেবে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এই হরতালের আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও গান্ধীর হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, তবে এই অভিনব প্রতিবাদ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হরতাল আর অহিংস থাকেনি, এটি বহুলাংশে তার কার্যকারিতাও হারিয়ে ফেলেছে এবং রাজনীতিবিদদের একটি আয়েশি কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। এখন অনেকেই হরতালকে ‘না’ বলার দাবি তুলছেন।
গবেষক দেখিয়েছেন যে ১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতীয়ভাবে মোট ৬০৫টি হরতাল ডাকা হয়। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুতে মোট ৪৭টি হরতাল পালিত হয়। জাতীয় হরতালের সঙ্গে আঞ্চলিকভাবেও অনেকগুলো হরতাল ডাকা হয়। মূলত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এসব হরতাল আহ্বান করে। তবে এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, সর্বশেষ হরতাল ডাকে গণজাগরণ মঞ্চ, ৩ নভেম্বর তারিখে ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার প্রতিবাদে।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম হরতাল পালিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সচিবালয়ের কর্মচারীরা ওই হরতালটি ডেকেছিলেন কিছু দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে এবং পাকিস্তানি মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা না লেখার প্রতিবাদে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই হরতালের মাধ্যমেই সম্ভবত পাকিস্তানের বিলুপ্তির প্রথম বীজ রোপিত হয়।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে ১৯৭১ সালে একমাত্র হরতাল ডাকা হয় ৩ ডিসেম্বর তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশের প্রতিবাদে। জামায়াতে ইসলামী এই হরতালের ডাক দেয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাতীয়ভাবে ৫৫৭ দিন হরতাল ডাকা হয়। এর মধ্যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ দিন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত ছয় দিন, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ দিন, ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৮১ দিন, ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ৫৯ দিন, ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৯১ দিন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৮৩ দিন হরতাল ডাকা হয়। অর্থাৎ হরতালের সংখ্যা একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দিন দিন বেড়েছে।
হরতালের এই তথ্য-উপাত্তগুলোকে গবেষক ভিন্ন সময়কালের ভিত্তিতেও উপস্থাপন করেন। তাঁর উপস্থাপনা থেকে দেখা যায় যে জাতীয়ভাবে মার্চ ১৯৮২ সাল থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত ৭২ দিন, ৭ ডিসেম্বর থেকে ডিসেম্বর ২০০০ পর্যন্ত ১৩০ দিন এবং ২০০১ সাল থেকে জুন ২০১৫ পর্যন্ত ৩৩৩ দিন হরতাল ডাকা হয়। এভাবে দেখলেও হরতালের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে এসব হরতালের কারণে ১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬৫৫ জন নিহত, প্রায় ২৫ হাজার ব্যক্তি আহত এবং ১৭ হাজার জন গ্রেপ্তার হন। এ ছাড়া প্রতিবেদনে হরতালের আর্থিক ক্ষতির তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে, যদিও এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন মত রয়েছে।
রাজনৈতিক হানাহানি ও দমন-পীড়ন সংকটকে আরও ঘনীভূতই করবে, যা জঙ্গিবাদের বিস্তৃতির জন্য উর্বর ক্ষেত্র বিস্তার করবে এবং জাতিকে বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেবে বলে আমাদের আশঙ্কা অজয় দাশগুপ্তর উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে এটি সুস্পষ্ট যে হরতালের ইতিহাস মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস। এ ছাড়া এগুলো বাংলাদেশের আগত দিনেরই ইতিহাসের ইঙ্গিত বাহকও। চলমান রাজনৈতিক বিরোধ, খুনখারাবি এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি, যা ভবিষ্যতে আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। বস্তুত হরতালের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি আমরা যে ক্রমাগতভাবে এই সংকটের গহ্বরে প্রবেশ করছি, তারই সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ বার্তা বহন করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বেশি বেশি হরতাল আমাদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিরোধ নিয়মতান্ত্রিকভাবে মীমাংসায় অপারগতা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি চলমান অসহিষ্ণুতারই প্রতিফলন, আর এ অসহিষ্ণুতাই আমাদের সংকটকে দিন দিন আরও ঘনীভূত করে তুলছে।
এটি সুস্পষ্ট যে নীরব প্রতিবাদের পরিবর্তে হরতাল ক্রমাগতভাবে আমাদের দেশে রাজপথে জোর করে সমস্যা সমাধানের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নিচ্ছে। রাজনৈতিক ও অন্যান্য জাতীয় সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম, বহু পরীক্ষিত ও টেকসই পন্থা হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে মতের আদান-প্রদান, সংলাপ ও সমঝোতা। রাজপথের লড়াকু আন্দোলন, তার প্রতিক্রিয়ায় দমন-পীড়ন ও সহিংসতা সমস্যার সমাধান তো করেই না; বরং সমস্যাকে আরও প্রকট, জটিল ও বেসামাল করে। মনে হয়, বাংলাদেশে আজ যেন আমরা এমনই জটিল একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি।
গবেষকের উপস্থাপিত হরতালের সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি থেকে এটি আরও সুস্পষ্ট যে আমাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পন্থা ও দায়িত্বশীলতার আশ্রয় নিইনি। আমরা সংসদকে কার্যকর ও সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করিনি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধতার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করিনি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা করিনি। জনগণের মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করিনি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধাগুলো দূর করিনি। প্রদর্শন করিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি প্রয়োজনীয় শ্রদ্ধাশীলতা। সর্বোপরি সংলাপের মাধ্যমে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলিনি। বরং সংসদীয় ‘টিরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র কাজে লাগিয়ে কিংবা হরতাল-অবরোধসহ অজয় দাশগুপ্তর উপস্থাপিত তথ্যমতে, রাজপথে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে মতৈক্যের ক্ষেত্রগুলোকে আরও সংকুচিত করেছি। প্রসঙ্গত, ১৯৭২-এর সংবিধান ছিল আমাদের জাতীয় মতৈক্যের এক অনন্য উদাহরণ, যা কতগুলো হীন স্বার্থে গৃহীত সংশোধনী এবং আদালতের বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে আমরা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছি। অনেকের মতে, আমাদের বর্তমান সংকট এসব পাপেরই মাশুল।
দুর্ভাগ্যবশত অতীতের এসব ভুল থেকে আমরা যেন এখনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি। আমরা এখনো ‘মেজরিটারিয়ান’ বা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়ে এবং মূলত বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমাদের আশঙ্কা যে বর্তমান সংকট শুধু আইনশৃঙ্খলা-সম্পর্কিত বিষয়ই নয়, যদিও যারা খুনখারাবি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে এবং মতৈক্য গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতেই সম্মিলিতভাবে জঙ্গিদের আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, জঙ্গি কারও বন্ধু নয় এবং বন্ধু হতেও পারে না। রাজনৈতিক হানাহানি ও দমন-পীড়ন সংকটকে আরও ঘনীভূতই করবে, যা জঙ্গিবাদের বিস্তৃতির জন্য উর্বর ক্ষেত্র বিস্তার করবে এবং জাতিকে বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেবে বলে আমাদের আশঙ্কা। এটাই আমরা মনে করি অজয় দাশগুপ্তর গবেষণার অন্তর্নিহিত বার্তা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
অজয় দাশগুপ্তর সন্নিবেশিত তথ্যগুলো এখনো বিশ্লেষণের অপেক্ষায় আছে, যে কাজটি তিনি করবেন বলে উপস্থিত শ্রোতাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে সন্নিবেশিত ‘র’ বা কাঁচা তথ্যগুলো, গভীর বিশ্লেষণের আগেই আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসের, বিশেষত রাজনৈতিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।
অনেকেই অবগত আছেন যে হরতালের জনক মহাত্মা গান্ধী। তিনি ১৯১৯ সালে প্রথম হরতাল ডাকেন ভারতে ব্রিটিশদের একটি নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে নীরব ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হিসেবে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এই হরতালের আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও গান্ধীর হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, তবে এই অভিনব প্রতিবাদ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হরতাল আর অহিংস থাকেনি, এটি বহুলাংশে তার কার্যকারিতাও হারিয়ে ফেলেছে এবং রাজনীতিবিদদের একটি আয়েশি কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। এখন অনেকেই হরতালকে ‘না’ বলার দাবি তুলছেন।
গবেষক দেখিয়েছেন যে ১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতীয়ভাবে মোট ৬০৫টি হরতাল ডাকা হয়। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুতে মোট ৪৭টি হরতাল পালিত হয়। জাতীয় হরতালের সঙ্গে আঞ্চলিকভাবেও অনেকগুলো হরতাল ডাকা হয়। মূলত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এসব হরতাল আহ্বান করে। তবে এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, সর্বশেষ হরতাল ডাকে গণজাগরণ মঞ্চ, ৩ নভেম্বর তারিখে ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার প্রতিবাদে।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম হরতাল পালিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সচিবালয়ের কর্মচারীরা ওই হরতালটি ডেকেছিলেন কিছু দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে এবং পাকিস্তানি মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা না লেখার প্রতিবাদে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই হরতালের মাধ্যমেই সম্ভবত পাকিস্তানের বিলুপ্তির প্রথম বীজ রোপিত হয়।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে ১৯৭১ সালে একমাত্র হরতাল ডাকা হয় ৩ ডিসেম্বর তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশের প্রতিবাদে। জামায়াতে ইসলামী এই হরতালের ডাক দেয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাতীয়ভাবে ৫৫৭ দিন হরতাল ডাকা হয়। এর মধ্যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ দিন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত ছয় দিন, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ দিন, ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৮১ দিন, ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ৫৯ দিন, ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৯১ দিন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৮৩ দিন হরতাল ডাকা হয়। অর্থাৎ হরতালের সংখ্যা একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দিন দিন বেড়েছে।
হরতালের এই তথ্য-উপাত্তগুলোকে গবেষক ভিন্ন সময়কালের ভিত্তিতেও উপস্থাপন করেন। তাঁর উপস্থাপনা থেকে দেখা যায় যে জাতীয়ভাবে মার্চ ১৯৮২ সাল থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত ৭২ দিন, ৭ ডিসেম্বর থেকে ডিসেম্বর ২০০০ পর্যন্ত ১৩০ দিন এবং ২০০১ সাল থেকে জুন ২০১৫ পর্যন্ত ৩৩৩ দিন হরতাল ডাকা হয়। এভাবে দেখলেও হরতালের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে এসব হরতালের কারণে ১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬৫৫ জন নিহত, প্রায় ২৫ হাজার ব্যক্তি আহত এবং ১৭ হাজার জন গ্রেপ্তার হন। এ ছাড়া প্রতিবেদনে হরতালের আর্থিক ক্ষতির তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে, যদিও এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন মত রয়েছে।
রাজনৈতিক হানাহানি ও দমন-পীড়ন সংকটকে আরও ঘনীভূতই করবে, যা জঙ্গিবাদের বিস্তৃতির জন্য উর্বর ক্ষেত্র বিস্তার করবে এবং জাতিকে বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেবে বলে আমাদের আশঙ্কা অজয় দাশগুপ্তর উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে এটি সুস্পষ্ট যে হরতালের ইতিহাস মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস। এ ছাড়া এগুলো বাংলাদেশের আগত দিনেরই ইতিহাসের ইঙ্গিত বাহকও। চলমান রাজনৈতিক বিরোধ, খুনখারাবি এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি, যা ভবিষ্যতে আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। বস্তুত হরতালের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি আমরা যে ক্রমাগতভাবে এই সংকটের গহ্বরে প্রবেশ করছি, তারই সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ বার্তা বহন করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বেশি বেশি হরতাল আমাদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিরোধ নিয়মতান্ত্রিকভাবে মীমাংসায় অপারগতা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি চলমান অসহিষ্ণুতারই প্রতিফলন, আর এ অসহিষ্ণুতাই আমাদের সংকটকে দিন দিন আরও ঘনীভূত করে তুলছে।
এটি সুস্পষ্ট যে নীরব প্রতিবাদের পরিবর্তে হরতাল ক্রমাগতভাবে আমাদের দেশে রাজপথে জোর করে সমস্যা সমাধানের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নিচ্ছে। রাজনৈতিক ও অন্যান্য জাতীয় সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম, বহু পরীক্ষিত ও টেকসই পন্থা হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে মতের আদান-প্রদান, সংলাপ ও সমঝোতা। রাজপথের লড়াকু আন্দোলন, তার প্রতিক্রিয়ায় দমন-পীড়ন ও সহিংসতা সমস্যার সমাধান তো করেই না; বরং সমস্যাকে আরও প্রকট, জটিল ও বেসামাল করে। মনে হয়, বাংলাদেশে আজ যেন আমরা এমনই জটিল একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি।
গবেষকের উপস্থাপিত হরতালের সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি থেকে এটি আরও সুস্পষ্ট যে আমাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পন্থা ও দায়িত্বশীলতার আশ্রয় নিইনি। আমরা সংসদকে কার্যকর ও সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করিনি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধতার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করিনি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা করিনি। জনগণের মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করিনি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধাগুলো দূর করিনি। প্রদর্শন করিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি প্রয়োজনীয় শ্রদ্ধাশীলতা। সর্বোপরি সংলাপের মাধ্যমে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলিনি। বরং সংসদীয় ‘টিরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র কাজে লাগিয়ে কিংবা হরতাল-অবরোধসহ অজয় দাশগুপ্তর উপস্থাপিত তথ্যমতে, রাজপথে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে মতৈক্যের ক্ষেত্রগুলোকে আরও সংকুচিত করেছি। প্রসঙ্গত, ১৯৭২-এর সংবিধান ছিল আমাদের জাতীয় মতৈক্যের এক অনন্য উদাহরণ, যা কতগুলো হীন স্বার্থে গৃহীত সংশোধনী এবং আদালতের বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে আমরা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছি। অনেকের মতে, আমাদের বর্তমান সংকট এসব পাপেরই মাশুল।
দুর্ভাগ্যবশত অতীতের এসব ভুল থেকে আমরা যেন এখনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি। আমরা এখনো ‘মেজরিটারিয়ান’ বা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়ে এবং মূলত বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমাদের আশঙ্কা যে বর্তমান সংকট শুধু আইনশৃঙ্খলা-সম্পর্কিত বিষয়ই নয়, যদিও যারা খুনখারাবি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে এবং মতৈক্য গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতেই সম্মিলিতভাবে জঙ্গিদের আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, জঙ্গি কারও বন্ধু নয় এবং বন্ধু হতেও পারে না। রাজনৈতিক হানাহানি ও দমন-পীড়ন সংকটকে আরও ঘনীভূতই করবে, যা জঙ্গিবাদের বিস্তৃতির জন্য উর্বর ক্ষেত্র বিস্তার করবে এবং জাতিকে বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেবে বলে আমাদের আশঙ্কা। এটাই আমরা মনে করি অজয় দাশগুপ্তর গবেষণার অন্তর্নিহিত বার্তা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments