তিনি কি রাজবন্দী, নাকি কেবলই অভিযুক্ত! by গোলাম মাওলা রনি
বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বয়স ৬৮ বছর পার হতে চলল।
জন্মতারিখের হিসাবে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় সমবয়স্ক।
বাংলাদেশের জাতীয় শোকের মাসের এক তারিখে তিনি যখন জন্মেছিলেন, তখন
পাক-ভারতে ব্রিটিশরাজের অন্তিম অবস্থা। তার জন্মের কয়েক দিন পরই পাকিস্তান
রাষ্ট্র কায়েম হয়। ফলে তিনি ব্রিটিশদের অন্যায়-অত্যাচার সম্পর্কে শুনেছেন
কিন্তু বাস্তবে দেখেননি। তবে পাকিস্তান জমানার রাষ্ট্রশক্তির তাণ্ডব বেশ
কাছে থেকেই দেখেছেন এবং ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের পাদপীঠ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণঝরা ইতিহাসে তারও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে তৎকালীন
ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির একজন নেতা হিসেবে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং জাতীয়
নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তির আন্দোলনে তার কতটুকু ভূমিকা, তা
সমকালীন ব্যক্তিদের অনেকের জানা। সম্প্রতি ঘোষিত এবং জাতীয়ভাবে উদযাপিত
শোকের মাসের এক তারিখে মির্জা সাহেবের জন্মসংক্রান্ত দুর্ভোগের আদিঅন্ত
নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব।
এত দিন পর নতুন করে মির্জা সাহেবের জন্মতারিখ মনে পড়ল একটি কারণে। বিএনপিদলীয় হাতেগোনা যে দু-একজন লোককে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভদ্রলোক বলে জানে, তাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল সবার আগে। ক্ষমতাসীন দলের হোমরাচোমরা লোকজন তো বটেই- দলের তৃণমূলপর্যায়ের কট্টর বিএনপিবিরোধী লোকজনও তার ব্যাপারে নমনীয়। তার সৌম্যশান্ত মূর্তি, স্পষ্ট এবং শুদ্ধ-সাবলীল উচ্চারণ, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা এবং দুর্নীতিমুক্ত ভাবমর্র্যাদার কারণে সব মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত ভালো ইমেজের জন্য তিনি বিএনপির ঘোরতর শত্রু মহলেও সম্মানিত ব্যক্তি। এর বাইরে সরকারি দলের লোকজনের যেসব বিএনপি নেতার প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, সেসব নেতা তাদের ইচ্ছামাফিক যে মির্জা সাহেবকে পরিচালিত করতে পারেন না- এর কিছু অকাট্য দলিলও সরকারের হাতে রয়েছে। কাজেই ‘গণিতের সূত্র মতে’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারি রোষানলে পড়বেন না- এটাই ছিল কাম্য ও স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত চার-পাঁচ বছরে তিনি এতবার জেলে গিয়েছেন যে, রাজনীতির গণিতের সব সূত্র উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। এ কারণেই আমার মনে তার জন্মতারিখটির কুলক্ষণ নিয়ে নানা সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমানে জেলে রয়েছেন। যেদিন তিনি ঢাকার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন এবং তার জেল-হাজতের আদেশ হলো, সেদিন তিনি বড়ই বিরস বদনে এবং আনত নয়নে ধীরে ধীরে প্রিজনভ্যানের দিকে এগিয়ে গেলেন। ৬৮ বছরের জরাজীর্ণ দেহটি তুলে দিলেন প্রিজনভ্যানের মধ্যে এবং উদাস দৃষ্টিতে চার দিকে তাকালেন। ভক্ত-সমর্থকদের দিকে হাত নাড়লেন বটে, কিন্তু তার বদনে চিন্তার ভাঁজ এবং অপমানবোধের চিহ্নগুলো গোপন করতে পারলেন না। প্রিজনভ্যানের নোংরা প্রকোষ্ঠে বসে তিনি হয়তো ভাবছিলেন তার ছাত্রজীবনের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির কৃতী ছাত্র হিসেবে সম্মানিত গুরুজনদের কাছ থেকে কত নীতিকথাই তাকে শুনতে হয়েছে। পরে ঢাকা কলেজ এবং ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তিনিও তো ছাত্র-ছাত্রীদের কম নীতিকথা শোনাননি। তার সেসব নীতিকথার সবচেয়ে বড় শ্রোতা হলেন তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী হওয়ার গৌরব থাকা সত্ত্বেও যিনি সারাটি জীবন শুধু শুনেই গেছেন; কোনো দিন আগবাড়িয়ে লোকারণ্যে চলে এসে একবারও বলেননিÑ মির্জা সাহেব, কোথায় আপনার নীতিকথা! রাজধানী ঢাকার কোলাহল পার হয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রিজনভ্যানটি এগিয়ে চলল গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের দিকে। সারা দিনের ক্লান্তি, ক্ষুধা, পিপাসা এবং গাড়ির ভেতরকার মবিল পোড়া গন্ধ তাকে অস্থির করে তুলল। শরীরের রোগবালাই, মনের গভীরের অসংখ্য বেদনা এবং না বলা কথামালা তাকে আরো চেপে ধরল অক্টোপাসের মতো। তিনি বেদনায় নীল হয়ে চোখ বুজে প্রিয়তম কোনো মুখাবয়ব মনে করে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজতে লাগলেন। প্রিয় কন্যা সামারুহ ও সাফারুহকে যতœ করে তিনি তার বিষণœ দু’টি চোখের পাতায় বসিয়ে দিলেন এবং ভাবতে লাগলেন বড়টি এখন পিএইচডি করছে অস্ট্রেলিয়ায় আর ছোটটি শিক্ষকতা করছে ঢাকায়। দুটো মেয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী ছিল এবং বড়টি তো সেখানকার শিক্ষক হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিল। তার সারা জীবনের নীতি-আদর্শ তিনি আসলে কতটুকু বিশ্বাস করেছেন, তার বাস্তব নমুনা খোঁজার চেষ্টা করলেন ঔরসজাত কন্যা দু’টির মধ্যে। এরপর তিনি কী মনে করে যেন হাসলেন এবং হালকা তন্দ্রার কবলে পড়ে কী সব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করলেন!
সম্মানিত পাঠক! মির্জা সাহেব হয়তো সহসাই তন্দ্রামুক্ত হবেন এবং আরো কিছু সময় পরে জেলগেটে গিয়ে পৌঁছবেন। তারপর ঢুকে পড়বেন জেলের অভ্যন্তরে। আমরা সেদিকে না গিয়ে বরং লোকারণ্যে ফিরে আসি এবং বাস্তব কিছু ঘটনা পর্যালোচনা করে শিরোনামের বিষয়বস্তুর দিকে এগোতে আরম্ভ করি। নিবন্ধের শুরুতে মির্জা আলমগীর সম্পর্কে সামান্য একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলাম এ কারণে যে, অপরাধ বিজ্ঞান এবং রাজনীতির চিরায়ত সূত্রগুলো ২০১৫ সালে বঙ্গদেশে কেমন যেন আলুভর্তা হয়ে গেছে। গত ২০০ বছরের ইতিহাসে রাজনীতিবিদ ও অপরাধীকে একই নিক্তিতে পরিমাপ করতে দেখা যায়নি, যেমনটি আমরা দেখে আসছি গত ২৫ বছরের ইতিহাসে। অপরাধ বিজ্ঞানের সূত্র মতে, ভালো মানুষ মন্দ কাজ করেন না, সম্মানিত মানুষ মন্দ চিন্তা করতে পারেন না এবং শ্রদ্ধেয়জনেরা ভুলেও অন্যের অনিষ্ট করেন না। অন্য দিকে, অপরাধী সম্পর্কে অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষ্য হলো- এক শ্রেণীর অপরাধী রয়েছে যাদের বলা হয় By born criminal. অর্থাৎ জন্মগতভাবেই অপরাধী। এই শ্রেণীর লোকেরা ভালো চিন্তা করে না, ভালো কাজের কাছ দিয়েও হাঁটে না। এরা কথাবার্তা, আচার-আচরণ, অঙ্গভঙ্গি, পোশাক-আশাক এমনকি খাদ্য গ্রহণ, নিদ্রা এবং প্রাকৃতিক কর্মেও নিজেদের অপরাধপ্রবণতার স্বাক্ষর রেখে যায়।
কিছু মানুষ রয়েছে যাদের বলা হয় By change criminal. এরা জন্মগত অপরাধীদের মতো সারাক্ষণ অপরাধ করে বেড়ায় না বটে, তবে জীবনযাত্রার কোনো এক বাঁকে এরা যদি সামান্যতম সুযোগ পায় তবে অপরাধ না করে শূন্য হাতে ফেরে না। তৃতীয় ধাপের অপরাধীদের বলা হয় Criminal by opportunity. এরা বিশেষ সুযোগ কিংবা বিশেষ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই অর্থাৎ কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া অপরাধ করে বসে। চতুর্থ ধাপে রয়েছে Criminal by post & position. এই শ্রেণীর অপরাধীরা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সমাজব্যবস্থা, নিজেদের অবস্থান, পদ ও পদবির বদৌলতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পঞ্চম ধাপের অপরাধীদের বলা হয় Criminal by accident. অর্থাৎ ঘটনাক্রমে অপরাধী।
রাজনীতি সম্পর্কে বাংলা ব্যাকরণে বলা হয়েছে- এটি ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ অন্যান্য সামাজিকবিজ্ঞানে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদ সম্পর্কে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। আমরা রাজনীতিবিদদের সাধারণ কতগুলো বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাবো। রাজনীতিবিদ হলেন তারাই যাদের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলি থাকে। ফলে কোনো মানুষ ইচ্ছে করলেই নেতা হতে পারেন না। নেতার সহজাত গুণাবলির মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি কেবল নিজের চিন্তা করবেন না। তিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজ ও রাষ্ট্রের কথাও চিন্তা করবেন। নেতা কোনো দিন একা থাকতে পারেন না, একা খেতে পারেন না এবং একাকী ভোগ করতে পারেন না। জনগণই হলো নেতার প্রাণভোমরা। নেতা সব সময়ই ব্যতিক্রমী চিন্তা করেন এবং বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষের মতো নিরাশ হয়ে পড়েন না। যে কোনো সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের জন্য একজন উত্তম নেতা হলেন বিধাতার পক্ষ থেকে ওই সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য অতি উত্তম নিয়ামত এবং একটি শ্রেষ্ঠ উপহার। আর এ কারণেই সব ধর্ম ও মতাদর্শের সম্মানিত নেতাদের আলাদা মর্যাদার আসনে বসিয়ে বিশেষভাবে ইজ্জত করতে বলা হয়েছে।
পৃথিবীতে রাজ্য-রাজা-রাজধানী নিয়ে বিরোধ বহু পুরনো। রাজনীতির জন্য দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত এবং বিজয়ী পক্ষের দ্বারা পরাজিত পক্ষের ধ্বংস সাধনের বহু নজির রয়েছে। কিন্তু কোনো সম্মানিত নেতা কর্তৃক তার প্রতিপক্ষের সম্মানিত নেতাকে অপমান করার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। যুদ্ধের ময়দানে লক্ষ কোটি মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে বিজয়ী সম্রাট একবারের জন্যও প্রতিপক্ষের জীবিত সম্রাটকে অপমান করেননি। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাট প্রাণ হারালেও তার মৃতদেহের প্রতি রাজসিক সম্মান প্রদর্শন রীতিমতো আইনে পরিণত হয়েছিল। সম্রাট আলেক্সান্ডার কর্তৃক পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসের মৃতদেহের প্রতি সম্মান এবং পরাজিত সম্রাটের অন্তিম ইচ্ছাগুলোকে মর্যাদা দেয়ার কাহিনী আজো সোনার হরফে ইতিহাসে লেখা রয়েছে। পাক-ভারতের মহাবীর টিপু সুলতান যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলে তার লাশ রাজকীয় মর্যাদায় দাফন করেছিল ইংরেজরা। অন্য দিকে, যে ইয়াজিদকে ভারতবর্ষের মুসলমানেরা এত ঘৃণা করেন, সেই ইয়াজিদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে তার সৌজন্য ও মহানুভবতার কাহিনী শুনলে হাল আমলের দাম্ভিকেরা কিছুটা হলেও লজ্জা অনুভব করবেন, যদি তাদের মধ্যে খুব অল্পস্বল্প মনুষ্যত্বও অবশিষ্ট থেকে থাকে।
ব্রিটিশ জমানায় এবং পাকিস্তান আমলে যাদের রাজনৈতিক কারণে কারাগারে বন্দী অথবা গৃহবন্দী করা হতো, তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল রাজবন্দী। রাজনীতির অঙ্গনের জাতীয় নেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের কিশোর-যুবক ছাত্র-ছাত্রীরাও যদি রাজনৈতিক কারণে বন্দী হতেন, তাদের সবাইকে রাজবন্দী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হতো। আইয়ুব খান, মোনায়েম খান, টিক্কা খান কিংবা ইয়াহিয়ার জমানায় গ্রেফতারকৃত রাজবন্দীদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে অস্ত্র মামলা, প্লেট চুরি, গাড়ি পোড়ানো, হত্যা মামলা ইত্যাদিতে ফাঁসানো হয়েছে, এমন একটি নির্ভরযোগ্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য দিকে, বন্দী অবস্থায় রাজবন্দীদের সাথে জেলহাজত, থানা, কোর্ট-কাচারি ইত্যাদি স্থানগুলোতে অমর্যাদাকর আচরণের কোনো খবর আমরা পাইনি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে যে-কেউ সেই জমানার শাসককুলের দৃষ্টিভঙ্গি সহজে অনুমান করতে পারবেন।
পৃথিবীর চারটি প্রধান ধর্মের চারজন নেতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব, প্রচলিত রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় রাজনীতি আরো অধিক গৌরব ও মর্যাদার ইতিহাস রচনা করেছে প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। পৃথিবীর প্রাচীন যুগে হিন্দুদের রাজা রাম যুদ্ধ করেছেন রাবণের বিরুদ্ধে এবং বৌদ্ধদের রাজা অশোক যুদ্ধ করেছিলেন কলিঙ্গে। অন্য দিকে খ্রিষ্টানদের রাজা কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট তার নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে রোম দখল করেছিলেন। আর ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা:-এর মক্কা বিজয়ের ইতিহাস বিশ্বমানবতার এক অনন্য দলিল। এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিজয়ী পক্ষ কর্তৃক শত্রুপক্ষের সাথে ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে সমঝোতার দলিলই চিরদিন রাজনীতির আদর্শ হিসেবে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তবে তিনি রাজনীতিবিদ নন- একজন অপরাধী। রক্তের পরতে পরতে অপরাধের বীজ লুক্কায়িত না থাকলে কোনো মানুষ এতগুলো নিষ্ঠুর অপরাধ করতে পারে না। এ ধরনের অপরাধীরা নাবালক বয়স থেকেই অপরাধ শুরু করে এবং কিশোর বয়সে দক্ষ অপরাধীতে পরিণত হয়। কাজেই মির্জা সাহেবের অতীত জীবনের খতিয়ান যদি অপরাধে পরিপূর্ণ না থাকে তবে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো অপরাধবিজ্ঞানের সূত্রের মধ্যে পড়বে না।
সরকার বলছে- তাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এভাবে যদি হুকুমের আসামি করার রেওয়াজ চালু হয়, তবে বাংলাদেশের সব ডিসি, এসপি, আইজি, সচিব, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কেয়ামত পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে। যদি রাজনৈতিক কারণে তাকে একের পর এক ফৌজদারি মামলার জালে আবদ্ধ করা হয়ে থাকে তাহলে দু’টি মহাবিপদ আগামী দিনে এ দেশের অনেককেই গ্রাস করবে। প্রথমত, একজন সম্মানিত ভদ্রলোককে অভদ্র উপায়ে অসম্মানিত করার কারণে প্রকৃতির আইন লঙ্ঘন করার দায়ে একশ্রেণীর মানুষ প্রকৃতির প্রতিশোধের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সবকিছু ভুলতে পারে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অপমান ভুলতে পারে না। ফলে অপমানিত মির্জা ফখরুলের দীর্ঘশ্বাস, আত্মীয়স্বজনের অনাগত সুদিন এবং তার রাজনৈতিক দলটির ভবিষ্যৎ সাফল্য ক্ষমতাসীনদের জন্য এক ধরনের আজাব হিসেবে আবির্ভূত হবে।
এত দিন পর নতুন করে মির্জা সাহেবের জন্মতারিখ মনে পড়ল একটি কারণে। বিএনপিদলীয় হাতেগোনা যে দু-একজন লোককে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভদ্রলোক বলে জানে, তাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল সবার আগে। ক্ষমতাসীন দলের হোমরাচোমরা লোকজন তো বটেই- দলের তৃণমূলপর্যায়ের কট্টর বিএনপিবিরোধী লোকজনও তার ব্যাপারে নমনীয়। তার সৌম্যশান্ত মূর্তি, স্পষ্ট এবং শুদ্ধ-সাবলীল উচ্চারণ, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা এবং দুর্নীতিমুক্ত ভাবমর্র্যাদার কারণে সব মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত ভালো ইমেজের জন্য তিনি বিএনপির ঘোরতর শত্রু মহলেও সম্মানিত ব্যক্তি। এর বাইরে সরকারি দলের লোকজনের যেসব বিএনপি নেতার প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, সেসব নেতা তাদের ইচ্ছামাফিক যে মির্জা সাহেবকে পরিচালিত করতে পারেন না- এর কিছু অকাট্য দলিলও সরকারের হাতে রয়েছে। কাজেই ‘গণিতের সূত্র মতে’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারি রোষানলে পড়বেন না- এটাই ছিল কাম্য ও স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত চার-পাঁচ বছরে তিনি এতবার জেলে গিয়েছেন যে, রাজনীতির গণিতের সব সূত্র উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। এ কারণেই আমার মনে তার জন্মতারিখটির কুলক্ষণ নিয়ে নানা সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমানে জেলে রয়েছেন। যেদিন তিনি ঢাকার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন এবং তার জেল-হাজতের আদেশ হলো, সেদিন তিনি বড়ই বিরস বদনে এবং আনত নয়নে ধীরে ধীরে প্রিজনভ্যানের দিকে এগিয়ে গেলেন। ৬৮ বছরের জরাজীর্ণ দেহটি তুলে দিলেন প্রিজনভ্যানের মধ্যে এবং উদাস দৃষ্টিতে চার দিকে তাকালেন। ভক্ত-সমর্থকদের দিকে হাত নাড়লেন বটে, কিন্তু তার বদনে চিন্তার ভাঁজ এবং অপমানবোধের চিহ্নগুলো গোপন করতে পারলেন না। প্রিজনভ্যানের নোংরা প্রকোষ্ঠে বসে তিনি হয়তো ভাবছিলেন তার ছাত্রজীবনের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির কৃতী ছাত্র হিসেবে সম্মানিত গুরুজনদের কাছ থেকে কত নীতিকথাই তাকে শুনতে হয়েছে। পরে ঢাকা কলেজ এবং ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তিনিও তো ছাত্র-ছাত্রীদের কম নীতিকথা শোনাননি। তার সেসব নীতিকথার সবচেয়ে বড় শ্রোতা হলেন তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী হওয়ার গৌরব থাকা সত্ত্বেও যিনি সারাটি জীবন শুধু শুনেই গেছেন; কোনো দিন আগবাড়িয়ে লোকারণ্যে চলে এসে একবারও বলেননিÑ মির্জা সাহেব, কোথায় আপনার নীতিকথা! রাজধানী ঢাকার কোলাহল পার হয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রিজনভ্যানটি এগিয়ে চলল গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের দিকে। সারা দিনের ক্লান্তি, ক্ষুধা, পিপাসা এবং গাড়ির ভেতরকার মবিল পোড়া গন্ধ তাকে অস্থির করে তুলল। শরীরের রোগবালাই, মনের গভীরের অসংখ্য বেদনা এবং না বলা কথামালা তাকে আরো চেপে ধরল অক্টোপাসের মতো। তিনি বেদনায় নীল হয়ে চোখ বুজে প্রিয়তম কোনো মুখাবয়ব মনে করে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজতে লাগলেন। প্রিয় কন্যা সামারুহ ও সাফারুহকে যতœ করে তিনি তার বিষণœ দু’টি চোখের পাতায় বসিয়ে দিলেন এবং ভাবতে লাগলেন বড়টি এখন পিএইচডি করছে অস্ট্রেলিয়ায় আর ছোটটি শিক্ষকতা করছে ঢাকায়। দুটো মেয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী ছিল এবং বড়টি তো সেখানকার শিক্ষক হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিল। তার সারা জীবনের নীতি-আদর্শ তিনি আসলে কতটুকু বিশ্বাস করেছেন, তার বাস্তব নমুনা খোঁজার চেষ্টা করলেন ঔরসজাত কন্যা দু’টির মধ্যে। এরপর তিনি কী মনে করে যেন হাসলেন এবং হালকা তন্দ্রার কবলে পড়ে কী সব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করলেন!
সম্মানিত পাঠক! মির্জা সাহেব হয়তো সহসাই তন্দ্রামুক্ত হবেন এবং আরো কিছু সময় পরে জেলগেটে গিয়ে পৌঁছবেন। তারপর ঢুকে পড়বেন জেলের অভ্যন্তরে। আমরা সেদিকে না গিয়ে বরং লোকারণ্যে ফিরে আসি এবং বাস্তব কিছু ঘটনা পর্যালোচনা করে শিরোনামের বিষয়বস্তুর দিকে এগোতে আরম্ভ করি। নিবন্ধের শুরুতে মির্জা আলমগীর সম্পর্কে সামান্য একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলাম এ কারণে যে, অপরাধ বিজ্ঞান এবং রাজনীতির চিরায়ত সূত্রগুলো ২০১৫ সালে বঙ্গদেশে কেমন যেন আলুভর্তা হয়ে গেছে। গত ২০০ বছরের ইতিহাসে রাজনীতিবিদ ও অপরাধীকে একই নিক্তিতে পরিমাপ করতে দেখা যায়নি, যেমনটি আমরা দেখে আসছি গত ২৫ বছরের ইতিহাসে। অপরাধ বিজ্ঞানের সূত্র মতে, ভালো মানুষ মন্দ কাজ করেন না, সম্মানিত মানুষ মন্দ চিন্তা করতে পারেন না এবং শ্রদ্ধেয়জনেরা ভুলেও অন্যের অনিষ্ট করেন না। অন্য দিকে, অপরাধী সম্পর্কে অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষ্য হলো- এক শ্রেণীর অপরাধী রয়েছে যাদের বলা হয় By born criminal. অর্থাৎ জন্মগতভাবেই অপরাধী। এই শ্রেণীর লোকেরা ভালো চিন্তা করে না, ভালো কাজের কাছ দিয়েও হাঁটে না। এরা কথাবার্তা, আচার-আচরণ, অঙ্গভঙ্গি, পোশাক-আশাক এমনকি খাদ্য গ্রহণ, নিদ্রা এবং প্রাকৃতিক কর্মেও নিজেদের অপরাধপ্রবণতার স্বাক্ষর রেখে যায়।
কিছু মানুষ রয়েছে যাদের বলা হয় By change criminal. এরা জন্মগত অপরাধীদের মতো সারাক্ষণ অপরাধ করে বেড়ায় না বটে, তবে জীবনযাত্রার কোনো এক বাঁকে এরা যদি সামান্যতম সুযোগ পায় তবে অপরাধ না করে শূন্য হাতে ফেরে না। তৃতীয় ধাপের অপরাধীদের বলা হয় Criminal by opportunity. এরা বিশেষ সুযোগ কিংবা বিশেষ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই অর্থাৎ কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া অপরাধ করে বসে। চতুর্থ ধাপে রয়েছে Criminal by post & position. এই শ্রেণীর অপরাধীরা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সমাজব্যবস্থা, নিজেদের অবস্থান, পদ ও পদবির বদৌলতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পঞ্চম ধাপের অপরাধীদের বলা হয় Criminal by accident. অর্থাৎ ঘটনাক্রমে অপরাধী।
রাজনীতি সম্পর্কে বাংলা ব্যাকরণে বলা হয়েছে- এটি ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ অন্যান্য সামাজিকবিজ্ঞানে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদ সম্পর্কে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। আমরা রাজনীতিবিদদের সাধারণ কতগুলো বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাবো। রাজনীতিবিদ হলেন তারাই যাদের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলি থাকে। ফলে কোনো মানুষ ইচ্ছে করলেই নেতা হতে পারেন না। নেতার সহজাত গুণাবলির মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি কেবল নিজের চিন্তা করবেন না। তিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজ ও রাষ্ট্রের কথাও চিন্তা করবেন। নেতা কোনো দিন একা থাকতে পারেন না, একা খেতে পারেন না এবং একাকী ভোগ করতে পারেন না। জনগণই হলো নেতার প্রাণভোমরা। নেতা সব সময়ই ব্যতিক্রমী চিন্তা করেন এবং বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষের মতো নিরাশ হয়ে পড়েন না। যে কোনো সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের জন্য একজন উত্তম নেতা হলেন বিধাতার পক্ষ থেকে ওই সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য অতি উত্তম নিয়ামত এবং একটি শ্রেষ্ঠ উপহার। আর এ কারণেই সব ধর্ম ও মতাদর্শের সম্মানিত নেতাদের আলাদা মর্যাদার আসনে বসিয়ে বিশেষভাবে ইজ্জত করতে বলা হয়েছে।
পৃথিবীতে রাজ্য-রাজা-রাজধানী নিয়ে বিরোধ বহু পুরনো। রাজনীতির জন্য দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত এবং বিজয়ী পক্ষের দ্বারা পরাজিত পক্ষের ধ্বংস সাধনের বহু নজির রয়েছে। কিন্তু কোনো সম্মানিত নেতা কর্তৃক তার প্রতিপক্ষের সম্মানিত নেতাকে অপমান করার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। যুদ্ধের ময়দানে লক্ষ কোটি মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে বিজয়ী সম্রাট একবারের জন্যও প্রতিপক্ষের জীবিত সম্রাটকে অপমান করেননি। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাট প্রাণ হারালেও তার মৃতদেহের প্রতি রাজসিক সম্মান প্রদর্শন রীতিমতো আইনে পরিণত হয়েছিল। সম্রাট আলেক্সান্ডার কর্তৃক পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসের মৃতদেহের প্রতি সম্মান এবং পরাজিত সম্রাটের অন্তিম ইচ্ছাগুলোকে মর্যাদা দেয়ার কাহিনী আজো সোনার হরফে ইতিহাসে লেখা রয়েছে। পাক-ভারতের মহাবীর টিপু সুলতান যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলে তার লাশ রাজকীয় মর্যাদায় দাফন করেছিল ইংরেজরা। অন্য দিকে, যে ইয়াজিদকে ভারতবর্ষের মুসলমানেরা এত ঘৃণা করেন, সেই ইয়াজিদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে তার সৌজন্য ও মহানুভবতার কাহিনী শুনলে হাল আমলের দাম্ভিকেরা কিছুটা হলেও লজ্জা অনুভব করবেন, যদি তাদের মধ্যে খুব অল্পস্বল্প মনুষ্যত্বও অবশিষ্ট থেকে থাকে।
ব্রিটিশ জমানায় এবং পাকিস্তান আমলে যাদের রাজনৈতিক কারণে কারাগারে বন্দী অথবা গৃহবন্দী করা হতো, তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল রাজবন্দী। রাজনীতির অঙ্গনের জাতীয় নেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের কিশোর-যুবক ছাত্র-ছাত্রীরাও যদি রাজনৈতিক কারণে বন্দী হতেন, তাদের সবাইকে রাজবন্দী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হতো। আইয়ুব খান, মোনায়েম খান, টিক্কা খান কিংবা ইয়াহিয়ার জমানায় গ্রেফতারকৃত রাজবন্দীদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে অস্ত্র মামলা, প্লেট চুরি, গাড়ি পোড়ানো, হত্যা মামলা ইত্যাদিতে ফাঁসানো হয়েছে, এমন একটি নির্ভরযোগ্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য দিকে, বন্দী অবস্থায় রাজবন্দীদের সাথে জেলহাজত, থানা, কোর্ট-কাচারি ইত্যাদি স্থানগুলোতে অমর্যাদাকর আচরণের কোনো খবর আমরা পাইনি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে যে-কেউ সেই জমানার শাসককুলের দৃষ্টিভঙ্গি সহজে অনুমান করতে পারবেন।
পৃথিবীর চারটি প্রধান ধর্মের চারজন নেতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব, প্রচলিত রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় রাজনীতি আরো অধিক গৌরব ও মর্যাদার ইতিহাস রচনা করেছে প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। পৃথিবীর প্রাচীন যুগে হিন্দুদের রাজা রাম যুদ্ধ করেছেন রাবণের বিরুদ্ধে এবং বৌদ্ধদের রাজা অশোক যুদ্ধ করেছিলেন কলিঙ্গে। অন্য দিকে খ্রিষ্টানদের রাজা কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট তার নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে রোম দখল করেছিলেন। আর ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা:-এর মক্কা বিজয়ের ইতিহাস বিশ্বমানবতার এক অনন্য দলিল। এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিজয়ী পক্ষ কর্তৃক শত্রুপক্ষের সাথে ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে সমঝোতার দলিলই চিরদিন রাজনীতির আদর্শ হিসেবে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তবে তিনি রাজনীতিবিদ নন- একজন অপরাধী। রক্তের পরতে পরতে অপরাধের বীজ লুক্কায়িত না থাকলে কোনো মানুষ এতগুলো নিষ্ঠুর অপরাধ করতে পারে না। এ ধরনের অপরাধীরা নাবালক বয়স থেকেই অপরাধ শুরু করে এবং কিশোর বয়সে দক্ষ অপরাধীতে পরিণত হয়। কাজেই মির্জা সাহেবের অতীত জীবনের খতিয়ান যদি অপরাধে পরিপূর্ণ না থাকে তবে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো অপরাধবিজ্ঞানের সূত্রের মধ্যে পড়বে না।
সরকার বলছে- তাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এভাবে যদি হুকুমের আসামি করার রেওয়াজ চালু হয়, তবে বাংলাদেশের সব ডিসি, এসপি, আইজি, সচিব, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কেয়ামত পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে। যদি রাজনৈতিক কারণে তাকে একের পর এক ফৌজদারি মামলার জালে আবদ্ধ করা হয়ে থাকে তাহলে দু’টি মহাবিপদ আগামী দিনে এ দেশের অনেককেই গ্রাস করবে। প্রথমত, একজন সম্মানিত ভদ্রলোককে অভদ্র উপায়ে অসম্মানিত করার কারণে প্রকৃতির আইন লঙ্ঘন করার দায়ে একশ্রেণীর মানুষ প্রকৃতির প্রতিশোধের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সবকিছু ভুলতে পারে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অপমান ভুলতে পারে না। ফলে অপমানিত মির্জা ফখরুলের দীর্ঘশ্বাস, আত্মীয়স্বজনের অনাগত সুদিন এবং তার রাজনৈতিক দলটির ভবিষ্যৎ সাফল্য ক্ষমতাসীনদের জন্য এক ধরনের আজাব হিসেবে আবির্ভূত হবে।
No comments