গণতন্ত্র ছাড়া এগোনো যায় না by এম হুমায়ুন কবির
গণতন্ত্রের
জয় সব সময়ই আনন্দের, মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ
নেই। ৫০ বছর পর মিয়ানমারের জনগণ স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোট
দিল, ফলে দিনটি তাদের জাতীয় জীবনের খুবই স্মরণীয় একটি দিন।
মিয়ানমারের এই নির্বাচনের কিন্তু একটা পরিপ্রেক্ষিত আছে, এই নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা চার-পাঁচ বছর ধরেই চলছিল। ২০১১ সালে মিয়ানমারের তৎকালীন সরকারের উপলব্ধি হয়, অং সান সু চিকে বাইরে রেখে সরকার পরিচালনায় দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। সে কারণে তখন থেকেই তারা সু চির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি বেশ জটিল, সেখানে ১৫টি বিভিন্ন ভাষাভাষী বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। ফলে সেই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য তাদের একটা চেষ্টা ছিল। সে লক্ষ্যেই মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকার কিছুদিন আগে সাতটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে।
ওদিকে দারিদ্র্য আরেকটি বড় ব্যাপার। মিয়ানমারের সরকার বুঝতে পেরেছিল, দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া বেশি দূর এগোনো যাবে না। এসব কারণের সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
আমরা দেখলাম, এই নির্বাচনে মিয়ানমারের ৯০টি দল ও ৬ হাজার প্রার্থী ১ হাজার ৭০০ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ নির্বাচনে ভোটও দিল। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও সু চির দল এনএলডি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনী সেবার নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। তারা সু চিকে গৃহবন্দী করে। তখন থেকেই শুরু হয় সু চির সংগ্রাম।
তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। মিয়ানমারের সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে এটা এক বড় প্রতিবন্ধকতাই বটে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, তারা কীভাবে এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, নির্বাচনের প্রচারণার সময় মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের সংগঠন মাপাথা নির্বাচনের আগে ইয়াঙ্গুনে মিছিল করে সু চির দল এনএলডিকে মুসলিম পার্টি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলেছে, সু চির এনএলডি ক্ষমতায় এলে মিয়ানমার মুসলমানে ছেয়ে যাবে। এরপর আমরা দেখলাম, ১০০ মুসলমান প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হলো। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভোটই দিতে দেওয়া হলো না। এটা অত্যন্ত নেতিবাচক। কারণ, আর যা-ই হোক, একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না। ফলে নতুন সরকারকে ভেবে দেখতে হবে, কীভাবে এর সুরাহা করা যায়। মাপাথার মতো কট্টরপন্থী সংগঠন তো আছেই, তারা এনএলডিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করবে।
মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ, যাকে বলে একদম পাশের বাড়ির প্রতিবেশী। ফলে সেখানকার ঘটনাপ্রবাহ আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনেও প্রভাব ফেলে, সে কারণেই আমরা তাদের ব্যাপারে আগ্রহী।
আমাদের প্রথম ও প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। এমনিতেই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও টেকনাফে বসবাস করে। তারপর গত বছর মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা হামলার শিকার হয়ে দলে দলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ তাদের গ্রহণ করেনি। ফলে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। রোহিঙ্গারা যেহেতু বাংলাদেশেও আসে, সেহেতু আমাদের এ ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। আবার এই রোহিঙ্গাদের আমরা মাসের পর মাস ধরে সাগরে মানবেতর অবস্থায় ভেসে থাকতে দেখেছি, ফলে মানবিক কারণেও আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দাবি করা উচিত।
চীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত মিয়ানমারের ওপর দিয়েই চীনের সঙ্গে আমাদের সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের গুরুত্ব অপরিসীম। আর দেশটি গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হলে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বড় হবেই বলে আমরা ধারণা করতে পারি।
গুরুত্বের বিষয় হলো, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিয়ানমার আমাদের জানালার মতো। ফলে ভূরাজনীতির স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে।
এম হুমায়ুন কবির: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
মিয়ানমারের এই নির্বাচনের কিন্তু একটা পরিপ্রেক্ষিত আছে, এই নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা চার-পাঁচ বছর ধরেই চলছিল। ২০১১ সালে মিয়ানমারের তৎকালীন সরকারের উপলব্ধি হয়, অং সান সু চিকে বাইরে রেখে সরকার পরিচালনায় দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। সে কারণে তখন থেকেই তারা সু চির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি বেশ জটিল, সেখানে ১৫টি বিভিন্ন ভাষাভাষী বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। ফলে সেই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য তাদের একটা চেষ্টা ছিল। সে লক্ষ্যেই মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকার কিছুদিন আগে সাতটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে।
ওদিকে দারিদ্র্য আরেকটি বড় ব্যাপার। মিয়ানমারের সরকার বুঝতে পেরেছিল, দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া বেশি দূর এগোনো যাবে না। এসব কারণের সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
আমরা দেখলাম, এই নির্বাচনে মিয়ানমারের ৯০টি দল ও ৬ হাজার প্রার্থী ১ হাজার ৭০০ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ নির্বাচনে ভোটও দিল। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও সু চির দল এনএলডি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনী সেবার নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। তারা সু চিকে গৃহবন্দী করে। তখন থেকেই শুরু হয় সু চির সংগ্রাম।
তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। মিয়ানমারের সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে এটা এক বড় প্রতিবন্ধকতাই বটে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, তারা কীভাবে এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, নির্বাচনের প্রচারণার সময় মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের সংগঠন মাপাথা নির্বাচনের আগে ইয়াঙ্গুনে মিছিল করে সু চির দল এনএলডিকে মুসলিম পার্টি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলেছে, সু চির এনএলডি ক্ষমতায় এলে মিয়ানমার মুসলমানে ছেয়ে যাবে। এরপর আমরা দেখলাম, ১০০ মুসলমান প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হলো। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভোটই দিতে দেওয়া হলো না। এটা অত্যন্ত নেতিবাচক। কারণ, আর যা-ই হোক, একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না। ফলে নতুন সরকারকে ভেবে দেখতে হবে, কীভাবে এর সুরাহা করা যায়। মাপাথার মতো কট্টরপন্থী সংগঠন তো আছেই, তারা এনএলডিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করবে।
মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ, যাকে বলে একদম পাশের বাড়ির প্রতিবেশী। ফলে সেখানকার ঘটনাপ্রবাহ আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনেও প্রভাব ফেলে, সে কারণেই আমরা তাদের ব্যাপারে আগ্রহী।
আমাদের প্রথম ও প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। এমনিতেই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও টেকনাফে বসবাস করে। তারপর গত বছর মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা হামলার শিকার হয়ে দলে দলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ তাদের গ্রহণ করেনি। ফলে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। রোহিঙ্গারা যেহেতু বাংলাদেশেও আসে, সেহেতু আমাদের এ ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। আবার এই রোহিঙ্গাদের আমরা মাসের পর মাস ধরে সাগরে মানবেতর অবস্থায় ভেসে থাকতে দেখেছি, ফলে মানবিক কারণেও আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দাবি করা উচিত।
চীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত মিয়ানমারের ওপর দিয়েই চীনের সঙ্গে আমাদের সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের গুরুত্ব অপরিসীম। আর দেশটি গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হলে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বড় হবেই বলে আমরা ধারণা করতে পারি।
গুরুত্বের বিষয় হলো, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিয়ানমার আমাদের জানালার মতো। ফলে ভূরাজনীতির স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে।
এম হুমায়ুন কবির: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments