তবু আলোচনায় বসুন by আসিফ নজরুল

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শালীনতা ও শ্রদ্ধাবোধের অভাব নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে। এ দেশে যাঁরা শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ আছেন, তাঁদের অনেকে তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষ দলের প্রধানদের চরিত্রহীন, খুনি, অশিক্ষিত, দুর্নীতিবাজ, চোর-বাটপারসহ নানা বিশেষণে অভিহিত করেছেন। এসব গালাগালিতে আমরা এখন আর তাই চমকে উঠি না।
সমস্যা হচ্ছে, যখন এসব বলে কাউকে বর্জন করার চেষ্টা হয় এবং জাতীয় সংকটের কোনো বিষয়ে আলোচনা-সমঝোতার সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করা হয়। আমাদের মনে করার কারণ রয়েছে যে দেশ বর্তমানে এ ধরনের একটি সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে একের পর এক বিদেশি হত্যা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য একটি অভাবিত বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, এসবের সঙ্গে আইএস জড়িত আছে—এই প্রচারণা চালিয়ে সিরিয়া বা লিবিয়ার মতো আক্রমণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার যড়যন্ত্র রয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মহলের এতে জড়িত থাকার সন্দেহের কথাও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা বোঝার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের কাছে না থাকলেও এটি উদ্বেগজনক।
এ ধরনের আশঙ্কা তিনি বা তাঁর দলের নেতারা বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের সফর বর্জনের পর থেকেই প্রকাশ করেছেন। এমন এক সময়ে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানানো তাই অনেকের কাছেই স্বস্তিকর মনে হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর যে উত্তর দিয়েছেন, তা বর্জনের রাজনীতির পরিচায়ক। তিনি খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, কোনো ‘খুনির’ সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসবেন না। এ ধরনের বক্তব্যে তাঁর শক্তিমত্তা ও আত্মবিশ্বাস প্রকাশ হতে পারে। দলের কট্টরপন্থীদের তা আরও চাঙা করে তুলতে পারে। কিন্তু কোনো স্বাভাবিক চিন্তার মানুষকে তা আশ্বস্ত করতে পারে না। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদকের কথায়ও। তিনি পরদিনই বলেছেন, রাজনীতিতে আলোচনার দুয়ার কখনো বন্ধ থাকতে পারে না। তিনি খালেদা জিয়াকে গঠনমূলক রাজনীতির পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এটি করা হলে আলোচনা বা সংলাপের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হবে।
সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ এবং আশাব্যঞ্জক। আমরা যদি জাতীয় সংকটের চরিত্র, সংকট উত্তরণে বিরোধী দলের ভূমিকা ও অতীত অভিজ্ঞতার নির্মোহ মূল্যায়ন করি, তাহলে বোঝা যাবে সংলাপ না হোক একটি সহনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজ কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
২.
আমাদের বর্তমান সংকটের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের সীমাবদ্ধতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জনগণের বৃহত্তর একটি অংশ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে ছিটকে পড়েছে। অতীতে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালেও এ ধরনের সংকট হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনগুলোর পর নির্বাচন বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত ছিল। বর্জনকারী রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশ, বাক্স্বাধীনতা চর্চা, হরতালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পেরেছিল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ স্বাধীনভাবে তাদের ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল এবং দেশের বিচার বিভাগ মোটামুটি স্বাধীনভাবে তার কাজ পরিচালনা করতে পেরেছিল।
বাংলাদেশে এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বিএনপি দূরের কথা, অন্য কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দলই তার স্বাভাবিক কর্মসূচি এখন পরিচালনা করতে পারছে না। মাত্র কিছুদিন আগে বাম মোর্চার কর্মীরা পরিবেশবিনাশী রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ পথযাত্রা কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক হামলার শিকার হয়েছেন। দেশের গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণও আগের তুলনায় বেড়েছে। নিম্ন আদালতে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জামিনের আবেদন বাতিল হচ্ছে, অন্যদিকে বিনা প্ররোচনায় শিশুর পায়ে গুলিবর্ষণকারী আওয়ামী লীগের সাংসদের জামিন মঞ্জুর হয়েছে।
সংসদ এবং সংসদের বাইরে সরকারের এমন একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এ দেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পরে বা সামরিক শাসন ছাড়া আর কখনো ছিল না। বিরোধী রাজনীতির চর্চা ও মুক্তভাবে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ এভাবে রুদ্ধ থাকলে যড়যন্ত্রের রাজনীতি ডালপালা মেলতে থাকে, জঙ্গি বা উগ্রপন্থার বিকাশ ঘটে, দেশের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশের স্বার্থান্বেষী মহলও এর সুযোগ গ্রহণের পরিবেশ পেয়ে যায়। বাংলাদেশে, দক্ষিণ এশিয়ায়, সারা বিশ্ব এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে, আরও ঘটার আশঙ্কা থাকাও তাই স্বাভাবিক হতে পারে।
সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি (সভা, সমাবেশ, ভিন্নমত ও সমালোচনার অধিকার) করার এবং অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ থাকলে দেশের ভেতরে কোনো মহল নাশকতা বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, এমন নজির পৃথিবীতে খুবই বিরল। এমন পরিস্থিতি থাকলে এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ন্যূনতম ঐক্য থাকলে বিদেশি কোনো মহল দেশের ভেতর কোনো যড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, এমন নজিরও নেই বললে চলে। ইয়েমেন বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাই বিদেশি যড়যন্ত্র যতটা সহজ, ভারত বা ইরানের বিরুদ্ধে তা কখনো সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রীর কথামতো যড়যন্ত্রের তথ্য বা আশঙ্কা সত্যি থাকলে তাই এটি নস্যাৎ করার জন্য হলেও দেশে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। ‘লিবিয়া বা সিরিয়া’ বানানোর মতো কোনো আশঙ্কা সত্যি থাকলে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বরং আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক রাজনীতি ও সমাজচিন্তা চর্চার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে একমত যে বিরোধী দলকে গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে এবং সব সহিংসতা থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু আমরা এও যুক্ত করতে চাই যে গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা দেশে অবাধে করা যাবে এবং ভবিষ্যতে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিরা দেশ চালানোর সুযোগ পাবেন—এমন আত্মবিশ্বাস বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে ২০১৪ সালেও বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে অনেকগুলো বড় জনসভা করেছে এবং স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। অনেকেই মনে করতে পারেন যে ২০১৫ সালে পেট্রলবোমা-নির্ভর বর্বরোচিত আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে অনেকাংশে দলটির সমাবেশ করার অধিকারকে পুলিশ আর দলীয় মাস্তানের মাধ্যমে ধূলিসাৎ করার মধ্য দিয়ে।
পেট্রলবোমার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচার করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু তাই বলে এ জন্য হুকুমের আসামির নামে বিএনপির সব স্তরের নেতাদের গণহারে গ্রেপ্তার এবং জামিন নাকচ করে কারাবন্দী রাখা এবং বিএনপিসহ সব প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করা কোনো সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে না। দেশে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের পথ একেবারে রুদ্ধ—এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে যড়যন্ত্র, হঠকারিতা ও উগ্র রাজনীতি বরং ক্রমেই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
৩.
প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বা সমঝোতা দেশের সংকটকালে কতটা জরুরি, তার বহু নজির আমাদের আশপাশে রয়েছে। বিহারে সাম্প্রতিক নির্বাচনে এই সমঝোতার জোরে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উগ্র জোয়ার ঠেকিয়ে দেওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর প্রভাবে ভবিষ্যতে আসাম, উত্তর প্রদেশ বা পশ্চিমবঙ্গেও ঐক্যের রাজনীতির বিজয় দেখা যাবে। পাকিস্তানে সামরিক শাসন এবং বৈদেশিক প্রভাব এড়াতে পিপিপি ও মুসলিম লিগ একে অপরকে সমর্থন করেছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের খবরদারি বা এর হুমকির জবাবে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন বা তার সঙ্গে একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকলে বাংলাদেশের দুই দলকেও তাই গোপন বা প্রকাশ্যে আলোচনা করতে হবে।
তা ছাড়া, ‘খুনি’ বলে মূল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করারও কোনো যুক্তি নেই। নরেন্দ্র মোদি একসময় গুজরাটের কসাই, আসিফ আলী জারদারি মিস্টার টেন পার্সেন্ট এবং অং সান সু চি বিদেশি গুপ্তচর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নানা অভিযোগ উঠেছিল। এঁদের সবাইকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মহলগুলো অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিতে মেনে নিতে বা তাতে ফিরে আসতে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
‘খুনি’ কেউ হয়ে থাকলে তাঁর বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক সুবিধাবাদী চিন্তা থেকে কাউকে বা কোনো দলকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার চেষ্টা হলে এবং বিরোধীদের ওপর অবাধে দমন আর নিপীড়ন চললে দেশ বিভাজিত হয়, দেশের জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ক্ষয় ঘটে এবং দেশের ভবিষ্যৎ যড়যন্ত্রকারীদের কালো জালে বন্দী হয়ে পড়ে।
আমাদের দুই প্রধান দলকে সৎভাবে চিন্তা করতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বীর বিনাশের চেয়ে দেশ বাঁচানোর চিন্তা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.