মানুষভেদী বহুরূপী কণাকে মুঠোয় আনার গল্প

নিউট্রিনো। এক রহস্যময় কণা। বিজ্ঞানীরা এতকাল যাকে ‘ভুতুড়ে কণা’ বলে এসেছেন। এই কণা স্রোতের মতো বয়ে চলে। প্রায় আলোর গতিতে তারা ছুটে বেড়ায়। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কণার স্রোত। অবিরাম বয়ে চলেছে সেই স্রোত। বয়ে চলার পথে মানুষকেও ভেদ করে চলেছে। কিন্তু মানুষ কিছুই বুঝতে পারে না। অনুভব করতেও পারে না। সেই কণার কিছু তৈরি হয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্ত- বিগ ব্যাঙের সময়ে। কিছু সৃষ্টি হয়েছে সুপারনোভার বিস্ফোরণ থেকে। কিছু পরমাণুর তেজস্ক্রিয়তা ক্ষয়ের সময়ে। মানবদেহে পটাসিয়ামের আইসোটোপের ক্ষয়ের সময়েও প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ হাজার এই কণা তৈরি হয়। সর্বব্যাপী এই কণার নাম নিউট্রিনো। কিন্তু তাদের ধরা বড় কঠিন।
আর তাদের ধরার কাজেই ব্যস্ত ছিল জাপান আর কানাডার দুই ডিটেকটর। সেখানেই মিলেছে বয়ে চলা নিউট্রিনোর রূপান্তরের প্রমাণ। যা পদার্থবিদ্যায় গভীর ছাপ ফেলেছে। যার জন্য এ বছরের নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলেছেন জাপানের তাকাকি কাজিতা এবং কানাডার আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড। পদার্থের অণুতে নিউট্রিনোর রূপ বদলের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে এই কণার ভর থাকার ইঙ্গিত পেয়েছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। নিউট্রিনো অসিলেশন নিয়ে কাজ করে তারা প্রমাণ করেন যে নিউট্রিনোর ভর রয়েছে। নিউট্রিনো পরমাণুর চেয়েও ছোট কণা, যার ভর প্রায় শূন্য এবং বলতে গেলে অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে এর মিথষ্ক্রিয়া ঘটে না। এ কারণে এদের নিয়ে গবেষণা করা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড জাপান ও কানাডায় যন্ত্র ব্যবহার করে এই কণার বৈশিষ্ট্য ও সুনির্দিষ্ট পরিমাপ নির্ধারণ করেন। নিউট্রিনোর রূপান্তর নিয়ে এ কাজের স্বীকৃতি পেলেন তারা। জাপান ও কানাডায় দুটি পৃথক নিউট্রিনো ডিটেকটরের অন্যতম বিজ্ঞানী এরা দু’জন। ডিটেকটরে ধরা পড়ার আগে নিউট্রিনো নিজেকে রূপান্তরিত করে ফেলে। জাপানের সুপার-কামিওকাদেতে মাটির গভীরে নিউট্রিনো ডিটেকটরে কর্মরত তাকাকি কাজিতা ১৯৯৮-এই প্রমাণ সামনে আনেন। প্রায় একই সময়ে কানাডার সদবুড়ি নিউট্রিনো অবজারভেটরিতে আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে একটি দল একই রূপান্তরের কথা প্রমাণ করে।
পদার্থের দুই নায়কের সাক্ষাৎকার
পদার্থের অণুতে নিউট্রিনোর রূপ বদলের স্বরূপ উন্মোচনে এ বছর পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের তাকাকি কাজিতা ও কানাডার আর্থর বি. ম্যাকডোনাল্ড। পুরস্কার ঘোষণার পর টেলিফোনে তাদের সাক্ষাৎকার নেন নোবেল কমিটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অ্যাডাম স্মিথ। এতে উঠে আসে দুই বিজ্ঞানীর মনোভাবনা।
খুশিতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছি : ম্যাকডোনাল্ড
নোবেল পাওয়ায় অভিনন্দন।
ধন্যবাদ।
আমি প্রথমে জানতে চাই, খবরটা আপনি কীভাবে শুনেছেন?
আমি এখানকার স্থানীয় সময় পাঁচটার দিকে একটি টেলিফোনে জানতে পেরেছি। সত্যিই খুব বিস্ময়কর সংবাদ নিয়ে জেগে উঠেছি।
শুনে আপনি কী করলেন?
খুশিতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছি। সেও ওই ফোনকলে জেগে উঠেছিল।
আপনি কেন বছরের পর বছর নিউট্রিনো গবেষণায় লেগে থাকলেন?
পদার্থের একেবারে ক্ষুদাতিক্ষুদ্র সীমায় অবস্থান করে ইলেক্ট্রন। এটা পদার্থবিদ্যার মৌলিক বিষয়।  কিন্তু  নিউট্রিনো শনাক্ত করা খুব কঠিন কাজ। এই কাজে লেগে থাকতে থাকতে ২০০২ সালে প্রথম জানতে পারি নিউট্রিনো এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় বদলে যায়।
আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আশা করছি ডিসেম্বরে স্টকহোমে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাব।
আমিও কথা বলতে পেরে খুশি। আপনি আমাকে একটা চমৎকার দিন উপহার দিলেন। ধন্যবাদ।
এই পুরস্কার অবিশ্বাস্য : তাকাকি কাজিতা
এ বছর পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
কখন আপনি খবরটি শুনেছেন?
এইমাত্র। আমি আমার ই-মেইল চেক করছিলাম।
ও। আপনি তবে অফিসে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
এটা সত্যিই বিস্ময়কর। আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।
আপনার আশপাশে সাড়াশব্দ নেই। কোনো লোকজন নেই মনে হচ্ছে...
হ্যাঁ। আসলে আমার রুমটা ছোট। একা আছি।
আপনি আপনার ক্যারিয়ার নিউট্রিনো গবেষণায় কাটিয়ে দিলেন। নিউট্রিনো কেন আপনাকে  এত আগ্রহী করে তুলল?
আসলে আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম কথিত কামিওকান্দে নিরীক্ষায়। সেটা ছিল প্রোটন নিয়ে। কিন্তু আমার থিসিস শেষ করার পর প্রোটনের উচ্চতর গবেষণার জন্য পার্শ্ববর্তী নিউট্রিনোর অধ্যয়ন জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ এটা প্রোটনের ব্যাকগ্রাউন্ড। তখন আমি লক্ষ্য করলাম, এখানে অদ্ভুত কিছু ঘটে চলেছে। এভাবেই নিউট্রিনো গবেষণা শুরু।
আপনি কি কখনও এই মুহূর্তের স্বপ্ন দেখেছিলেন?
আমি অনেক বছর এমন বাস্তবের স্বপ্ন দেখতাম। তবে অতটা সিরিয়াস ছিলাম না।
আপনি কি কখনও এই মুহূর্তের স্বপ্ন দেখেছিলেন?
আমি অনেক বছর এমন বাস্তবের স্বপ্ন দেখতাম। তবে অতটা সিরিয়াস ছিলাম না।
ধন্যবাদ। ডিসেম্বরে স্টকহোমে দেখা হবে।
ধন্যবাদ।
পদার্থবিজ্ঞান নোবেলের যত তথ্য (১৯০১-২০১৫)
* ১০৯ বার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে
* ২০১ জন এ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতেছেন
* ৪৭ জন নোবেল জিতেছেন স্বতন্ত্রভাবে
* ৩৩ জন নোবেল পেয়েছেন দু’জনের যৌথভাবে
* ৩০ বার নোবেল দেওয়া হয়েছে একসঙ্গে তিনজনকে
* ২ জন নারী পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন
* ২৫ বছর বয়সী লরেন্স ব্রাগ সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী। ১৯১৫ সালে তিনি তার বাবার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পান
* ৮৮ বছর বয়সী রেমন্ড ডেভিস বয়োজ্যেষ্ঠ নোবেলজয়ী। ২০০২ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন
* পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের গড় বয়স ৫৫ বছর (১৯০১-২০১৪)
পদার্থে যেসব বছর নোবেল দেয়া হয়নি
* এ পর্যন্ত ৬ বার চিকিৎসায় নোবেল দেয়া হয়নি। সেগুলো হচ্ছে- ১৯১৬, ১৯৩১, ১৯৩৪, ১৯৪০, ১৯৪১ ও ১৯৪২ সাল।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী নারীরা
১৯০৩ ম্যারি কুরি -ফ্রান্স
১৯৬৩ মারিয়া গোপার্ট মায়ার -যুক্তরাষ্ট্র

No comments

Powered by Blogger.