মোল্লা মনসুরের নেতৃত্বে তালেবান by কায়কোবাদ মিলন

মোল্লা মনসুরকে তালেবানদের নেতা হতে কম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়নি। আফগান তালেবানরা বলেছেন, মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মনসুরকে নেতা বানাতে যেসব মতানৈক্য ছিল তা তারা এখন সরিয়ে রেখেছেন এবং নতুন নেতাকে তারা অভিনন্দিত করেছেন। এই ঘোষণা আসতে অবশ্য কয়েক সপ্তাহ লেগেছে। সময়টা লেগেছে বিরোধীদের মোল্লা মনসুরের পক্ষে আনতে। আর এভাবেই তালেবানদের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের স্থলাভিষিক্ত হলেন মোল্লা মনসুর। গত জুলাই মাসে মোল্লা ওমরের মৃত্যুর ঘোষণা এলে মোল্লা মনসুর স্বল্পসময়ের মধ্যেই নতুন আমরিুল মুমেনিন অর্থাৎ বিশ্বাসীদের কমান্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থন হন।
নতুন আমিরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মোল্লা ওমরের ভাই ও মোল্লা ওমরের বড় ছেলে। অবশ্য এখনো জানা যাচ্ছে না, তাদের মধ্যে কে মোল্লা মনসুরের নিয়োগ যথাযথভাবে হয়নি বলে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যা হোক, তারা দু’জনই এখন মোল্লা মনসুরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। মোল্লা ওমরের ভাই হলেন মোল্লা ইয়াকুব। বাবা মোল্লা আবদুল মান্নান। তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ অতি সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, একটি জমকালো অনুষ্ঠানে মোল্লা ইয়াকুব মোল্লা মনসুরের আনুগত্য স্বীকার করেছেন। অনুষ্ঠানটি কোথায় হয়েছে তা অবশ্য তিনি বলেননি। তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, এখন আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে চলার সময়।
নতুন আমীর নিয়োগকে কেন্দ্র করে দলের ভাঙন রোধে কয়েক সপ্তাহ ধরে কয়েকশ’ তালেবান কমান্ডার, যোদ্ধা ও ইসলামি চিন্তাবিদ পাকিস্তানে ও পাকিস্তানের বাইরে সফর করেছেন। এজন্য তালেবানদের একটি সম্মেলন আয়োজন জরুরি হয়ে পড়ে। এ জন্য এমন একটি সম্মেলন স্থান প্রয়োজন যে এলাকায় তালেবান সমর্থক বেশি। কেননা সে এলাকার মসজিদ, মাদরাসা ও অধিবাসীদের বাড়িতে তালেবান নেতাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে যোগাযোগব্যবস্থা ও খাদ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন হতে হবে।
মোল্লা মনসুরকে আমিরুল মুমেনিন ঘোষণায় প্রথম দিকে ব্যাপকভাবে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। যেকোনো মূল্যে তালেবানদের ঐক্য ধরে রাখা জরুরি হয়ে দেখা দেয়। ওয়াহেদ মোজদা কাবুলভিত্তিক একজন বিশেষজ্ঞ এবং ২০০১ সালে কাবুলের ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। তার মতে, গ্রুপগুলো অনুধাবন করেছে যে, বাঁচতে হলে ঐক্য জরুরি। তার মতে, তালেবানদের দুশমনেরা অনেক বেশি শক্তিশালী। অনৈক্য থাকলে আর তাদের রক্ষা করা যাবে না। আফগানিস্তানবিষয়ক শীর্ষ মার্কিন বিশেষজ্ঞ বার্নেট রুবিন বলেছেন, অটলভাবে অনুগামী ও ঐক্যবদ্ধ থেকে আদর্শ প্রচার ও বাস্তবায়ন তালেবানদের জন্য একপ্রকার বাধ্যতামূলক। আর এই শিক্ষা ও মনোভাবই তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখবে। রুবিন আরো বলেছেন, তালেবানদের মধ্যে দলবাজির সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এটা তাদের অন্যতম মূলমন্ত্র। প্রত্যেকেই আমিরের আদেশ-নিষেধ মেনে চলেন। দলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু যারা দল থেকে চলে গেছেন কিংবা বহিষ্কৃত হয়েছেন তারা সব ধরনের প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়েছেন।
মোল্লা মনসুর আমির হয়ে দু’জন ডেপুটি নিয়োগের মাধ্যমে কঠোরতর হাতে প্রশাসন চালাচ্ছেন। এর মধ্যে একজন হলেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজ উদ্দিন হাক্কানি। আফগানিস্তানের ভেতরে বড় ধরনের কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনার জন্য তাকে দোষারোপ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র হাক্কানিকে গ্রেফতারে ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ঘোষণা করেছে। এর পরে রয়েছে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট রাহবারি শূরা। মোল্লা মনসুর অবশ্য সম্প্রতি এর সদস্য সংখ্যা ২১ করেছেন। পাকিস্তানি লেখক রহিমুল্লাহ ইউসুফ জাই বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই শূরার সদস্যদের বেশির ভাগই আফগানিস্তানের পশতুন জাতিগত সম্প্রদায়ের লোক। শুধু দু’জন সদস্য পশতুন নন। একজন তাজিক সম্প্রদায়ের অপরজন উত্তর আফগানিস্তানের উজবেক সম্প্রদায়ের। একই সাথে যে কথা উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো, রাহবারি শূরার বেশির ভাগ সদস্যই কান্দাহার, উরজুগান ও হেলমান্দ এলাকার। ওই তিন অঞ্চলকেই তালেবানদের জন্মস্থান এবং তালেবান আন্দোলনের সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে।
লিডারশিপ কাউন্সিল বা রাহবারি শূরা ডজনখানেক কমিশন ও তালিবান মন্ত্রিসভাকে কার্যকরভাবে তদারক করে থাকে। আফগানিস্তানের মর্যাদাপূর্ণ এনালিস্ট নেটওয়ার্কের বোরহান ওসমান জানিয়েছেন, সামরিক কমিশনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরাই যুদ্ধ পরিচালনা, আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। মিলিটারি কমিশনের প্রধান কোনো দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। বোরহান ওসমান আরো জানিয়েছেন, আঞ্চলিক কমান্ডার ও বিভিন্ন প্রদেশের ছায়া গভর্নরদের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হামলার পরিকল্পনা করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি তালেবান একটি রাজনৈতিক কমিশন পরিচালনা করে। কাতারেও এদের একটি অফিস রয়েছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কেন্দ্রবিন্দু এই কাতার অফিস। শান্তি চুক্তি বা শান্তি আলোচনাবিষয়ক কর্মকাণ্ডও কাতার থেকে পরিচালিত হয়।
তালেবান নেতৃত্বের যোগাযোগের ক্ষেত্র পাকিস্তানভিত্তিক এবং কমান্ডার ও যোদ্ধাদের ইউনিটগুলো আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থান থেকে পরিচালিত হয়। তবে আফগান তালেবানদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। বিবিসির উর্দু বিভাগের ইসলামাবাদের ব্যুরো চিফ হারুন রশীদ বলেছেন, তালেবানরা স্পর্শকাতর বার্তাগুলো খুবই সতর্কতার সাথে বিনিময় করে থাকে। তারা মনে করে সামনাসামনি নির্দেশ ও তথ্য বিনিময়ই তাদের সবার জন্য নিরাপদ। তবে চিঠির মাধ্যমেও তালেবানরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। উত্তর ওয়াজিরিস্তানের প্রধান শহর মিয়ানশাহে তিনি এমন কতকগুলো চিঠি দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। সেখানকার তালেবানরা স্বীকারও করেছে যে, চিঠির মাধ্যমে তথ্য ও নির্দেশাবলি আদান প্রদান সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি প্রক্রিয়া।
বোরহান ওসমান জানিয়েছেন, তালেবান নেতারা সমর্থক অথবা তাদের সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করে তথ্য বিনিময় বা সভা করে থাকেন। পরের দিন হয়তো আরেক শহরে গিয়ে তারা আবার বৈঠক করেন। হারুন রশীদ বলেন, তালেবানদের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সীমিত। তাদের নিশ্চিতভাবে কোনো কার্যালয় বা অফিস রয়েছে এমনটি মনে করা ভুল হবে। তালেবানদের সব সময়ই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াত করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্নেট রুবিনের ভাষ্য, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরেই কয়েকটি উৎস থেকে তালেবানরা অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। প্রধান আয়ের উৎস হলো চাঁদা ও মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা বাবদ অর্থ। রুবিনের তথ্যানুযায়ী, বেশ কয়েকজন তালেবান নেতার সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরবে নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও পারস্য উপসাগরে হাক্কানি গ্রুপের বিশাল ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক রয়েছে। এর মধ্যে আয়ের প্রধান উৎস হলো মধু বিক্রি। আফগানিস্তানের বিশাল ভূখণ্ড তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। এ সব জমিতে ব্যাপকভাবে পপি চাষ হয়। এই পপি রফতানিতে ব্যাপৃত অপরাপর ব্যবসায়ীদের সড়ক চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তালেবানদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দেয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোও তালেবানদের চাঁদা দেয়। সাবেক তালেবান নেতা ওয়াহেদ মোজডা বলেছেন, তালেবানদের নতুন আয়ের উৎস খনিজসম্পদ থেকে। গত বছর থেকে এই খাত চালু হয়েছে।
আফগান সরকার তালেবানদের সহযোগিতার জন্য বরাবরই পাকিস্তান সরকারকে দোষারোপ করে আসছে। ইসলামাবাদ বরাবরই যা অস্বীকার করে থাকে। পাকিস্তানের ভাষ্য হলো, আফগান তালেবানদের ওপর তাদের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই অনুরূপ সমস্যা বিদ্যমান। তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তানসহ (টিটিপি) আলকায়েদার সাথে সম্পৃক্ত কয়েকটি গ্রুপ পাকিস্তানের জন্য হুমকি। টিটিপি অবশ্য মোল্লা ওমরের অনুগত ছিল। এখন সেই আনুগত্য মোল্লা মনসুরের প্রতিও প্রদর্শিত হবে কি-না স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে বোরহান ওসমান বলেছেন, প্রথম থেকেই এই সংহতি আসলে প্রতীকী। টিটিপি সম্পূর্ণভাবেই একটি আলাদা সংগঠন। তাদের মতাদর্শও তালেবানদের থেকে পৃথক। তাদের লক্ষ্য ও মেকানিজমও ভিন্নতর। টিটিপি’র সাথে আলকায়েদার সম্পূর্ণ সাযুজ্য রয়েছে। যদিও তারা তালেবানদের বশ্যতা মানে কিন্তু এটা প্রতীকী মাত্র। অনেকে পাকিস্তানি তালেবানের সাথে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন।
আফগান তালেবানদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে আইএসপন্থী আরেকটি গ্রুপ। তারা বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে আফগানিস্তানে। তারা ইসলামিক স্টেট বা আইএসের প্রতি আনুগত্যও প্রকাশ করেছে। আফগানিস্তানের কয়েকটি এলাকায় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে বলেও তারা দাবি করে থাকে। কিন্তু পর্যবেক্ষকেরা এই দাবিকে অসার বলে মনে করেন। তাদের মতে, তালেবান নেতৃত্বের প্রতি বিরাগভাজন কিছু পাতি নেতা কিংবা তালেবানদের ক্ষুদ্র দলগুলোকে আবার গড়ে তুলতে ব্যর্থরা এখন আইএসে যোগদানের ধুয়া তুলছেন।
বোরহান ওসমান বলেছেন, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সত্ত্বেও তালেবানরা যে দুর্বল হয়ে পড়ছে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বোরহান স্বীকার করেছেন, সঙ্ঘাত চলছেই রণক্ষেত্রে এর কোনো ছায়া পড়ছে না- অন্তত এখন পর্যন্ত কিছু চোখে পড়েনি।
মোল্লা ওমর ও মোল্লা মনসুরের শাসনকালের মধ্যে কী তফাত বিদ্যমান? তালেবানদের মূল আয়ের উৎস মধু বিক্রি। সে উৎস এখনো বিদ্যমান। তবে মোল্লা মনসুরের আমলে তালেবানরা নকশায় প্রদর্শিত এলাকার বাইরে এসে তাদের প্রভাবের বিস্তার ঘটাচ্ছে। মোল্লা ওমর ছিলেন বরাবরই গুহাবাসী। মোল্লা মনসুর এখনো পর্যন্ত তা নন। তবে লক্ষ্যযোগ্য দিক হলো মোল্লা ওমর মৃত্যুর পরও তালেবানদের প্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলেন। অবশ্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান ছিলেন মোল্লা মনসুরই। তিনি মোল্লা ওমরের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
মোল্লা মনসুরের জন্ম কান্দাহারে, ১৯৬০ সালে। তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিনি এই প্রদেশের ছায়া সরকারের গভর্নর ছিলেন। আফগানিস্তানের তালেবান শাসনামলে মনসুর বেসামরিক বিমানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। আফগানিস্তানের সিনিয়র মিলিটারি কমান্ডার আবদুল কাইউম জাকিরের সাথে মোল্লা মনসুরের যুদ্ধ ও বিরোধের কথা সর্বজনবিদিত। শান্তি আলোচনার পথ ও পন্থা নিয়ে তাদের বিরোধ ছিল। এক ব্যক্তি জানান, সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সাথে মোল্লা মনসুরের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। ২০১০ সালের শান্তি আলোচনার সময় এই বৈঠক হয়। পরে জানা যায়, মোল্লা মনসুর ভুয়া পরিচয়ে ওই বৈঠকে শরিক হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র : বিবিসি
kaikobadmilon1955@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.