‘মতাদর্শের জেরে একের পর এক খুন’ by নুরুজ্জামান লাবু ও রুদ্র মিজান
ধর্মীয়
মতাদর্শের জের ধরে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু খুনিদের ধরতে পারছে
না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীর গোপীবাগের ছয় খুন, রাজাবাজারে মাওলানা
ফারুকী হত্যা এবং সর্বশেষ বাড্ডায় খিজির খানের হত্যাকাণ্ডে ধর্মীয়
উগ্রবাদীরাই জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উগ্রপন্থি
ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা। কিন্তু
উগ্রপন্থিদের কোন দল এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তা চিহ্নিত করতে পারছেন
না। তদন্ত চলছে সন্দেহকে কেন্দ্র করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ বছরে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে মুক্তমনা ও ভিন্নমতাবলম্বী অন্তত ১৫ জন খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের ধরন ও উদ্দেশ্য একই বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো। তবে ঘটনার তদন্তে অসহায় পুলিশ। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়নি, গ্রেপ্তার হয়নি আসামি। তদন্তের অগ্রগতি বলতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থানা পুলিশের মামলা ডিবি পুলিশে এবং ডিবি পুলিশ থেকে মামলা সিআইডিতে স্থানান্তর হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, এসব হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। হত্যাকাণ্ডের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোন ধরনের ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। উগ্রপন্থিদের ছোট ছোট স্লিপার সেল এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত। কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা গেলেও অন্য হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ধরন ও উদ্দেশ্য একই। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেও মূল হোতাদের গ্রেপ্তার সম্ভব হচ্ছে না। উগ্রাবাদীদের তৎপরতা ও কৌশলের কাছে ব্যর্থ হচ্ছে গোয়েন্দা কৌশল। খুনের ঘটনায় যারা জড়িত থাকছেন স্লিপার সেলের ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৮ জন। কারও সঙ্গে কারও পরিচয় জানা থাকে না। শুধু পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় কোথায় কখন কাকে কিভাবে খুন করতে হবে। কীভাবে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে হবে, কীভাবে পালাতে হবে। এ কারণে কেউ ধরা পড়লেও বাকিদের ব্যাপারে গোয়েন্দারা পাচ্ছেন না কোন তথ্য।
খিজির খুনে গ্রেপ্তার নেই, ৩০ মিনিটের কিলিং মিশন: সময় তখন সন্ধ্যা প্রায় ৭টা। ছদ্মবেশে কিলাররা বাসায় ঢুকে। বাসায় ঢোকার আধা ঘণ্টার মধ্যেই কিলিং মিশন সম্পন্ন করে তারা। তারপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বের হয়ে যায়। সোমবার রাত ৮টার পর হত্যাকাণ্ডের খবর পায় পুলিশ। পরে মধ্যবাড্ডার নিজ বাসা থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও পীর মোহাম্মদ খিজির খানের লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটন করতে তৎপরতা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তদন্তে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। গ্রেপ্তার হয়নি কেউ।
কিলারদের এক পলক দেখেছেন খিজির খানের ছেলে ডা. আহমেদ উল্লাহ। তিনি তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। এ সময় প্রায় ছয়-সাতজনকে একসঙ্গে দেখে জানতে চান, আপনারা কারা? তখন তারা জানায় বাড়ির নিচতলার গোডাউন ভাড়ার জন্য হুজুরের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। খিজির খানকে তার ভক্তরা আব্বা হুজুর বলে সম্বোধন করেন। প্রতিবেশীদের কারও কাছে পীর কারও কাছে খিজির খান নামেই পরিচিত তিনি। আহমেদ জানান, বাড়ির দোতলায় রয়েছে রহমতিয়া খানকা শরীফ। খানকা শরিফ পরিচালনার কারণে তার পিতার কাছে দেশের বিভিন্ন এলাকার ভক্তরা আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু যুব বয়সের ছয়-সাতজনকে একসঙ্গে দেখে তিনি জানতে চেয়েছিলেন তারা কেন এসেছে। পরে চালককে নিয়ে গুলশানের শাহবুদ্দিন মেডিক্যালে চলে যান। এই হত্যাকান্ডের সময় অন্যদের মধ্যে বাসায় ছিলেন গৃহকর্মী আমিনা বেগম। আমিনা জানান, দু’তলার খানকা শরীফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন তিনি। এ সময় কয়েক যুবক ওই ঘরে প্রবেশ করে। এর মধ্যে খিজির খানের খোঁজে তৃতীয় তলায় তার বাসায় দরজায় নক করে দুই যুবক। তখন তাদের দ্বিতীয় তলার খানকা শরিফে বসার জন্য বলেন খিজির খান। তারা সবাই তখন খানকা শরিফের ভেতরে বসেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানকা শরিফে ঢুকেন খিজির খান। ঢোকার পরপরই মুখ চেপে ধরা হয় তার। বাধা হয় হাত ও চোখ। এ সময় কাঁধে রাখা ব্যাগ থেকে একটি ধারালো অস্ত্র বের করে এক যুবক। এ দৃশ্য চোখে পড়তেই ‘আম্মাগো’ বলে চিৎকার করেন আমিনা। তখন আমিনাকে ধরে হাত, পা, মুখ ও চোখ বাঁধা হয় পর্দার কাপড় দিয়ে। ততক্ষণে আমিনার চিৎকার শুনে দ্বিতীয় তলায় ছুটে যান খিজির খানের স্ত্রী রাহেলা রুবি ও বাসার গৃহকর্মী সাফিয়া। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে হাত, পা, চোখ ও মুখ বেঁধে আটকে রাখা হয়। ওই সময়ে কিলারদের কয়েকজন দ্রুত তৃতীয় তলার একটি কক্ষে খিজির খানের পুত্রবধূ ও দুই নাতিকে বেঁধে রাখে। পাশের কক্ষে খিজির খানের মেয়ে রৌশনকে বেঁধে রাখে কিলাররা। ততক্ষণে গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিক্যালে আহমেদকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরেন গাড়িচালক মোস্তফা। মোস্তফা জানান, বাসার প্রহরী মোখলেছ ঈদের ছুটিতে থাকায় বিদ্যুৎ বিলের কাগজ নিয়ে তৃতীয় তলায় যান মোস্তফা। দরজায় নক করার কিছু সময়ের মধ্যেই এক যুবক দরজা খুলে দেয়। ওই যুবক বলে, আমি মেহমান। হুজুর আপনাকে ভেতরে আসতে বলছেন। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক যুবক পিস্তল ঠেকিয়ে ভেতরের কক্ষে নিয়ে যায় মোস্তফাকে। ওই যুবক তাকে হুমকি দিয়ে বলে, কথা বললেই তোকে গুলি করে মেরে ফেলবো। কোন চালাকি করবি না। পরে একই কায়দায় তার হাত, পা ও মুখ বেঁধে খিজির খানের পুত্রবধূ ও নাতিদের সঙ্গে রাখা হয় তাকে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় তলায় ঘটে নৃশংস ঘটনাটি। টেনে হিঁচড়ে খানকা শরীফের ওযুখানায় নিয়ে যাওয়া হয় খিজির খানকে। আমিনা জানান, চোখ বাঁধা থাকায় কিছুই দেখা যায়নি। কিন্তু তাকে যে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা টের পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যেই একজন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কাজ শেষ করতে তাগিদ দেয়। একইভাবে নোয়াখালী ও কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় প্রয়োজনীয় কথা বলেছে কিলাররা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ শব্দ করে দুর্বৃত্তরা। একটা শব্দও হয়। আমিনা তখনই বুঝতে পেরেছেন খিজির খানকে হত্যা করা হয়েছে। ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ ধ্বনির পর হাঁটাহাঁটির শব্দ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আমিনার ধারণা কিলারা একজন, দুজন করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বের হয়েছে।
গতকাল পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের কোন ক্লু্ উদঘাটন হয়নি। এ বিষয়ে ডিবির এসি মাহফুজুল আলম রাসেল জানান, ডিবির কয়েক টিম বিভিন্নভাবে এ ঘটনার তদন্ত করছে। মোবাইল ট্র্যাকিংসহ প্রযুক্তি ব্যবহার ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠিক কি কারণে খিজির খানকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে কোন ধারণা নেই তার পরিবারের সদস্যদের। তবে ধর্মীয় মতবিরোধকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে গুলশান জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) এসএম মোস্তাক আহমেদ জানান, সম্পত্তি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও ধর্মীয় মতাদর্শে খিজির খানকে হত্যা করা হতে পারে। এই তিন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। মধ্যবাড্ডা এলাকার খিজির খানের বাড়ির আশপাশের বাসিন্দারা জানান, খিজির খান নূরিকম নামে একটি তরিকা অনুসরণ করতেন। কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে রয়েছে তাদের খানকা শরীফ। ঢাকায় নিজ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ছিল খানকা শরিফের ঢাকা শাখা। খিজির খানের শ্যালক আমানুর রহমান জানান, খানকাহ শরিফে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে উরস হতো। এতে জিকির ও দোয়া করতেন নারী-পুরুষরা। এ সময় খিজির খান বয়ান করতেন। তিনি ভাল কাজের পরামর্শ দিতেন। অশ্লীল কথা বলা থেকে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। এলাকাবাসী জানান, প্রায়ই তার ভক্তরা ওই বাসায় ভিড় করতো। রাতব্যাপী সেখানে খিজির খান তার তরিকা অনুসারে ইবাদত করতেন।
এদিকে খিজির খান খুনের ঘটনায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার ভক্ত ও পরিবারের সদস্যদের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তার ফিলিপনগর গ্রামের বাড়িতে চলছে দাফনের প্রস্তুতি। খানকা শরিফ সংলগ্ন খিজির খানের পিতা রহমতুল্লাহ মৌলভীর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। ঢাকা থেকে খিজির খানের মরদেহ দৌলতপুরে পৌঁছালে আজ বুধবার সকালে দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
মাওলানা ফারুকীর খুনিরা গ্রেপ্তার হয়নি: গত বছরের ২৭শে আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ঢুকে কয়েক যুবক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যা করে। এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের এই উপস্থাপক হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন হয়নি। তবে পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নিহতের ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ধর্মীয় মতাদর্শের বিরোধীরা তার বাবাকে খুন করেছে। এক বছরেও খুনিদের আটক করা তো দূরের কথা, তাদের শনাক্তই করতে পারল না ডিবি পুলিশ। তার অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় তদন্ত নিয়ে ডিবির আগ্রহ নেই। খুনি গ্রেপ্তারের আশাই তারা ছেড়ে দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ফারুকী হত্যা মামলার ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতে যে ছয়জনের বিরুদ্ধে নালিশি অভিযোগ করা হয়েছে তদন্তে হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিবিতে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশিক হোসেন জানান, মামলাটির রহস্য উদঘাটনে আন্তারিকতার সঙ্গে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনও ক্লু পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলার ডকেট সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গোপীবাগের ছয় খুন নিয়ে অন্ধকারে পুলিশ: ২০১৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর গোপীবাগের ৬৪/৬ নম্বর বাড়ির দোতলায় খুন হন কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক, অনুসারী মঞ্জুরুল আলম, মো. রাসেল, মো. শাহিন এবং মজিবুর সরকার। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ২২ মাস অতিবাহিত হলেও রহস্য উদঘাটনে অন্ধকারে পুলিশ। উগ্রপন্থি ধর্মীয় সংগঠন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন সন্দেহেই থমকে আছে মামলার তদন্ত। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছয় খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চার জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার মাহবুব আলম বলেন, রহস্য উদঘাটনে চেষ্টা চলছে। ক্লু না পাওয়ায় সময় লাগছে। মামলার বাদী ও নিহত লুৎফর রহমানের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, মামলার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নতুন তদন্ত কর্মকর্তা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। পুলিশের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাই নিজে থেকে আর মামলার ব্যাপারে খোঁজ রাখেন না। তিনি বলেন, এতদিনে যেহেতু কোন ক্লু উদঘাটন হয়নি, ভবিষ্যতে আর কী হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ বছরে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে মুক্তমনা ও ভিন্নমতাবলম্বী অন্তত ১৫ জন খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের ধরন ও উদ্দেশ্য একই বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো। তবে ঘটনার তদন্তে অসহায় পুলিশ। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়নি, গ্রেপ্তার হয়নি আসামি। তদন্তের অগ্রগতি বলতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থানা পুলিশের মামলা ডিবি পুলিশে এবং ডিবি পুলিশ থেকে মামলা সিআইডিতে স্থানান্তর হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, এসব হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। হত্যাকাণ্ডের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোন ধরনের ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। উগ্রপন্থিদের ছোট ছোট স্লিপার সেল এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত। কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা গেলেও অন্য হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ধরন ও উদ্দেশ্য একই। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেও মূল হোতাদের গ্রেপ্তার সম্ভব হচ্ছে না। উগ্রাবাদীদের তৎপরতা ও কৌশলের কাছে ব্যর্থ হচ্ছে গোয়েন্দা কৌশল। খুনের ঘটনায় যারা জড়িত থাকছেন স্লিপার সেলের ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৮ জন। কারও সঙ্গে কারও পরিচয় জানা থাকে না। শুধু পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় কোথায় কখন কাকে কিভাবে খুন করতে হবে। কীভাবে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে হবে, কীভাবে পালাতে হবে। এ কারণে কেউ ধরা পড়লেও বাকিদের ব্যাপারে গোয়েন্দারা পাচ্ছেন না কোন তথ্য।
খিজির খুনে গ্রেপ্তার নেই, ৩০ মিনিটের কিলিং মিশন: সময় তখন সন্ধ্যা প্রায় ৭টা। ছদ্মবেশে কিলাররা বাসায় ঢুকে। বাসায় ঢোকার আধা ঘণ্টার মধ্যেই কিলিং মিশন সম্পন্ন করে তারা। তারপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বের হয়ে যায়। সোমবার রাত ৮টার পর হত্যাকাণ্ডের খবর পায় পুলিশ। পরে মধ্যবাড্ডার নিজ বাসা থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও পীর মোহাম্মদ খিজির খানের লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটন করতে তৎপরতা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তদন্তে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। গ্রেপ্তার হয়নি কেউ।
কিলারদের এক পলক দেখেছেন খিজির খানের ছেলে ডা. আহমেদ উল্লাহ। তিনি তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। এ সময় প্রায় ছয়-সাতজনকে একসঙ্গে দেখে জানতে চান, আপনারা কারা? তখন তারা জানায় বাড়ির নিচতলার গোডাউন ভাড়ার জন্য হুজুরের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। খিজির খানকে তার ভক্তরা আব্বা হুজুর বলে সম্বোধন করেন। প্রতিবেশীদের কারও কাছে পীর কারও কাছে খিজির খান নামেই পরিচিত তিনি। আহমেদ জানান, বাড়ির দোতলায় রয়েছে রহমতিয়া খানকা শরীফ। খানকা শরিফ পরিচালনার কারণে তার পিতার কাছে দেশের বিভিন্ন এলাকার ভক্তরা আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু যুব বয়সের ছয়-সাতজনকে একসঙ্গে দেখে তিনি জানতে চেয়েছিলেন তারা কেন এসেছে। পরে চালককে নিয়ে গুলশানের শাহবুদ্দিন মেডিক্যালে চলে যান। এই হত্যাকান্ডের সময় অন্যদের মধ্যে বাসায় ছিলেন গৃহকর্মী আমিনা বেগম। আমিনা জানান, দু’তলার খানকা শরীফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন তিনি। এ সময় কয়েক যুবক ওই ঘরে প্রবেশ করে। এর মধ্যে খিজির খানের খোঁজে তৃতীয় তলায় তার বাসায় দরজায় নক করে দুই যুবক। তখন তাদের দ্বিতীয় তলার খানকা শরিফে বসার জন্য বলেন খিজির খান। তারা সবাই তখন খানকা শরিফের ভেতরে বসেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানকা শরিফে ঢুকেন খিজির খান। ঢোকার পরপরই মুখ চেপে ধরা হয় তার। বাধা হয় হাত ও চোখ। এ সময় কাঁধে রাখা ব্যাগ থেকে একটি ধারালো অস্ত্র বের করে এক যুবক। এ দৃশ্য চোখে পড়তেই ‘আম্মাগো’ বলে চিৎকার করেন আমিনা। তখন আমিনাকে ধরে হাত, পা, মুখ ও চোখ বাঁধা হয় পর্দার কাপড় দিয়ে। ততক্ষণে আমিনার চিৎকার শুনে দ্বিতীয় তলায় ছুটে যান খিজির খানের স্ত্রী রাহেলা রুবি ও বাসার গৃহকর্মী সাফিয়া। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে হাত, পা, চোখ ও মুখ বেঁধে আটকে রাখা হয়। ওই সময়ে কিলারদের কয়েকজন দ্রুত তৃতীয় তলার একটি কক্ষে খিজির খানের পুত্রবধূ ও দুই নাতিকে বেঁধে রাখে। পাশের কক্ষে খিজির খানের মেয়ে রৌশনকে বেঁধে রাখে কিলাররা। ততক্ষণে গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিক্যালে আহমেদকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরেন গাড়িচালক মোস্তফা। মোস্তফা জানান, বাসার প্রহরী মোখলেছ ঈদের ছুটিতে থাকায় বিদ্যুৎ বিলের কাগজ নিয়ে তৃতীয় তলায় যান মোস্তফা। দরজায় নক করার কিছু সময়ের মধ্যেই এক যুবক দরজা খুলে দেয়। ওই যুবক বলে, আমি মেহমান। হুজুর আপনাকে ভেতরে আসতে বলছেন। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক যুবক পিস্তল ঠেকিয়ে ভেতরের কক্ষে নিয়ে যায় মোস্তফাকে। ওই যুবক তাকে হুমকি দিয়ে বলে, কথা বললেই তোকে গুলি করে মেরে ফেলবো। কোন চালাকি করবি না। পরে একই কায়দায় তার হাত, পা ও মুখ বেঁধে খিজির খানের পুত্রবধূ ও নাতিদের সঙ্গে রাখা হয় তাকে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় তলায় ঘটে নৃশংস ঘটনাটি। টেনে হিঁচড়ে খানকা শরীফের ওযুখানায় নিয়ে যাওয়া হয় খিজির খানকে। আমিনা জানান, চোখ বাঁধা থাকায় কিছুই দেখা যায়নি। কিন্তু তাকে যে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা টের পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যেই একজন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কাজ শেষ করতে তাগিদ দেয়। একইভাবে নোয়াখালী ও কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় প্রয়োজনীয় কথা বলেছে কিলাররা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ শব্দ করে দুর্বৃত্তরা। একটা শব্দও হয়। আমিনা তখনই বুঝতে পেরেছেন খিজির খানকে হত্যা করা হয়েছে। ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ ধ্বনির পর হাঁটাহাঁটির শব্দ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আমিনার ধারণা কিলারা একজন, দুজন করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বের হয়েছে।
গতকাল পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের কোন ক্লু্ উদঘাটন হয়নি। এ বিষয়ে ডিবির এসি মাহফুজুল আলম রাসেল জানান, ডিবির কয়েক টিম বিভিন্নভাবে এ ঘটনার তদন্ত করছে। মোবাইল ট্র্যাকিংসহ প্রযুক্তি ব্যবহার ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠিক কি কারণে খিজির খানকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে কোন ধারণা নেই তার পরিবারের সদস্যদের। তবে ধর্মীয় মতবিরোধকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে গুলশান জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) এসএম মোস্তাক আহমেদ জানান, সম্পত্তি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও ধর্মীয় মতাদর্শে খিজির খানকে হত্যা করা হতে পারে। এই তিন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। মধ্যবাড্ডা এলাকার খিজির খানের বাড়ির আশপাশের বাসিন্দারা জানান, খিজির খান নূরিকম নামে একটি তরিকা অনুসরণ করতেন। কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে রয়েছে তাদের খানকা শরীফ। ঢাকায় নিজ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ছিল খানকা শরিফের ঢাকা শাখা। খিজির খানের শ্যালক আমানুর রহমান জানান, খানকাহ শরিফে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে উরস হতো। এতে জিকির ও দোয়া করতেন নারী-পুরুষরা। এ সময় খিজির খান বয়ান করতেন। তিনি ভাল কাজের পরামর্শ দিতেন। অশ্লীল কথা বলা থেকে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। এলাকাবাসী জানান, প্রায়ই তার ভক্তরা ওই বাসায় ভিড় করতো। রাতব্যাপী সেখানে খিজির খান তার তরিকা অনুসারে ইবাদত করতেন।
এদিকে খিজির খান খুনের ঘটনায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার ভক্ত ও পরিবারের সদস্যদের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তার ফিলিপনগর গ্রামের বাড়িতে চলছে দাফনের প্রস্তুতি। খানকা শরিফ সংলগ্ন খিজির খানের পিতা রহমতুল্লাহ মৌলভীর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। ঢাকা থেকে খিজির খানের মরদেহ দৌলতপুরে পৌঁছালে আজ বুধবার সকালে দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
মাওলানা ফারুকীর খুনিরা গ্রেপ্তার হয়নি: গত বছরের ২৭শে আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ঢুকে কয়েক যুবক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যা করে। এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের এই উপস্থাপক হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন হয়নি। তবে পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নিহতের ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ধর্মীয় মতাদর্শের বিরোধীরা তার বাবাকে খুন করেছে। এক বছরেও খুনিদের আটক করা তো দূরের কথা, তাদের শনাক্তই করতে পারল না ডিবি পুলিশ। তার অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় তদন্ত নিয়ে ডিবির আগ্রহ নেই। খুনি গ্রেপ্তারের আশাই তারা ছেড়ে দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ফারুকী হত্যা মামলার ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতে যে ছয়জনের বিরুদ্ধে নালিশি অভিযোগ করা হয়েছে তদন্তে হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিবিতে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশিক হোসেন জানান, মামলাটির রহস্য উদঘাটনে আন্তারিকতার সঙ্গে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনও ক্লু পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলার ডকেট সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গোপীবাগের ছয় খুন নিয়ে অন্ধকারে পুলিশ: ২০১৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর গোপীবাগের ৬৪/৬ নম্বর বাড়ির দোতলায় খুন হন কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক, অনুসারী মঞ্জুরুল আলম, মো. রাসেল, মো. শাহিন এবং মজিবুর সরকার। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ২২ মাস অতিবাহিত হলেও রহস্য উদঘাটনে অন্ধকারে পুলিশ। উগ্রপন্থি ধর্মীয় সংগঠন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন সন্দেহেই থমকে আছে মামলার তদন্ত। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছয় খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চার জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার মাহবুব আলম বলেন, রহস্য উদঘাটনে চেষ্টা চলছে। ক্লু না পাওয়ায় সময় লাগছে। মামলার বাদী ও নিহত লুৎফর রহমানের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, মামলার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নতুন তদন্ত কর্মকর্তা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। পুলিশের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাই নিজে থেকে আর মামলার ব্যাপারে খোঁজ রাখেন না। তিনি বলেন, এতদিনে যেহেতু কোন ক্লু উদঘাটন হয়নি, ভবিষ্যতে আর কী হবে।
No comments