বিচ্ছিন্নতার ৭৫ বছর by নাহিদ হাসান

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও শিক্ষার ভিত্তি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও পরে দ্রুতই পশ্চিমের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। এবং তার ফল স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু বৈষম্যের এই ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তির যেন শেষ নেই! কুড়িগ্রাম জেলা তার একটি উদাহরণ। আজ কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের দরিদ্রতম। ১৯৫৪, ৫৬, ৬২, ৭০ ও ৭১ সালজুড়ে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংবিধানের আকাঙ্ক্ষায় এতগুলো সংগ্রাম; সেই সংবিধানে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ থাকার কথা ছিল।
২.
১৯ অক্টোবর ২০১২ তারিখে প্রথম আলোয় প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজি জানায়, ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আর বর্তমান চিলমারী নদীবন্দর হয়ে ভারতীয় জাহাজ প্রায় সারা বছর চলাচল করলেও ১৯৮৬ সালে ডাকাতি ও একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিলমারী-বাহাদুরাবাদ ফেরি চলাচল বন্ধ আছে। বিআইডব্লিউটিএ, চিলমারীর হেড পাইলট শফিকুল ইসলাম (৫৬) জানান, ‘নদ-নদীতে পানির গভীরতা ৫ ফুট থাকলেই জাহাজ চলাচল সম্ভব। সারা বছর এই রুটে ভারতীয় জাহাজ চলাচলের কারণ ভারতীয় জাহাজগুলো ৫ ফুট গভীরতার উপযোগী করে প্রস্তুতকৃত।’
১৯৪৭ সালের আগে তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহকুমায় (যখন লালমনিরহাট যুক্ত ছিল) বিমানবন্দর ছিল একটি, রেলওয়ে সদর দপ্তর ছিল একটি, জাহাজ তৈরির কারখানাসহ নৌবন্দর ছিল দুটি; সেখানে ২০১৫ সালে এসবের কিছুই নেই। ১৯৬৫ সালের আগে লালমনিরহাট-ভূরুঙ্গামারী সোনাহাট স্থলবন্দর পর্যন্ত রেলপথ ছিল; ১৯৯০ সালের আগে রমনা রুটে ট্রেন চলাচল করত চারটি ও ধরলা নদীর তীর পর্যন্ত রেলপথ বিস্তৃত ছিল, সেখানে ২০১৫ সালে রমনা রুটে ট্রেন চলাচল করছে একটি ও নতুন কুড়িগ্রাম থেকে ধরলা নদীর তীর পর্যন্ত রেলপথ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সর্বাধিক নদ-নদী ভাঙনকবলিত জেলা হওয়ায় ও কর্মসংস্থানের অভাবে কুড়িগ্রাম জেলা থেকে সর্বাধিক শ্রমিক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান। বর্তমানে বাংলাদেশে জেলাপ্রতি গড় পোশাক কারখানার সংখ্যা ৮৬টি, সেখানে কুড়িগ্রাম জেলায় ১টি; ২০০০-০১ সাল অনুযায়ী জেলাপ্রতি বড় ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যা যেখানে ৩৮৭টি, সেখানে কুড়িগ্রাম জেলায় মাত্র ১০টি; গত ১০ বছরে জেলাপ্রতি প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা যেখানে ৭৮ হাজার ৭১১ জন, সেখানে কুড়িগ্রামে মাত্র ৯ হাজার ২৪৩ জন; যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়+মেডিকেল কলেজ+প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়+কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়+বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জেলাপ্রতি গড়ে ১.৫টি, সেখানে কুড়িগ্রাম জেলায় একটিও নেই। ২০১৪-১৫ সালের জেলা বাজেটের যেখানে শুধু টাঙ্গাইল জেলাতে বরাদ্দ হয়েছে ২ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা, সেখানে পুরো রংপুর বিভাগের আট জেলার জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট ২ হাজার ৮ কোটি টাকা মাত্র। ১১ মার্চ ২০১৫ তারিখে দৈনিক আমাদের সময়-এ প্রকাশিত: নতুন ২৫ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। এখানেও কুড়িগ্রাম জেলার নাম নেই।
যেখানে নোয়াখালী জেলার জনগণের বাংলাদেশ ব্যাংকে মোট সঞ্চয় ১৪ হাজার কোটি টাকা, সেখানে কুড়িগ্রাম জেলাবাসীর সঞ্চয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এবং যেখানে বাংলাদেশের জেলাগুলোর গড় দারিদ্র্যের হার ৩০.৭ শতাংশ, সেখানে কুড়িগ্রামে সেই হার ৬৩.৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (৩৮.৭ শতাংশ) কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করে এই জেলাতেই।
কুড়িগ্রাম জেলা যেন অভিশপ্ত জনপদ, যা দেশভাগের আদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে যেন! অথবা যেন বাড়ির পাশের তিস্তা নদী, যার পানি উজানে দুটি বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে
৩.
কুড়িগ্রাম জেলা যেন অভিশপ্ত জনপদ, যা দেশভাগের আদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে যেন! অথবা যেন বাড়ির পাশের তিস্তা নদী, যার পানি উজানে দুটি বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি সরকার কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর বাজেট একনেকে পাস করেছে। যা বাস্তবায়িত হবে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের অধীনে, যা গাইবান্ধা অংশে পলাশবাড়ীতে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে যুক্ত হবে। ফলে কুড়িগ্রাম সদর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩০-৪০ কিলোমিটার কমবে। অথচ সরকার ইতিমধ্যে গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পয়েন্ট যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে বহুমুখী টানেলের ঘোষণা দিয়েছে। গণকমিটির প্রস্তাব, আপাতত দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর নকশায় রেলপথ যুক্ত করে সেতু নির্মাণপূর্বক বর্তমানে যেভাবে সংযোগ সড়ক নির্মাণ হওয়ার কথা সেভাবে হোক। আর ভবিষ্যতে যখন যমুনার তলদেশে টানেল সম্পন্ন হবে তখন নতুন করে রেলসেতু নির্মাণের দরকার হবে না। যদি চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টের তিস্তা সেতুতে রেলপথ যুক্ত করা হয়, ঢাকা থেকে চিলমারী রেলপথের দূরত্ব ৩৭৭ থেকে ২২৫ কিলোমিটারে নেমে আসবে। সর্বোপরি লালমনিরহাট-পার্বতীপুর-কুড়িগ্রাম-চিলমারী-গাইবান্ধা-জামালপুর–ঢাকা নামে একটি নতুন রুট তৈরি হবে। ফলে যমুনা সেতুর চাপ অর্ধেকে নেমে আসবে। অপর চিলমারী নদীবন্দর নেপাল ও ভুটানের ব্যবহারের মাধ্যমে হয়ে উঠবে আন্তমহাদেশীয় বন্দর, সোনাহাট স্থলবন্দর সাবালকত্ব অর্জন করবে। আর চিলমারীর খনিজ সম্পদ ও কুড়িগ্রামের সস্তা শ্রমে গড়ে উঠবে নতুন শিল্পাঞ্চল।
আর যত দিন তিস্তা সেতু হয়নি, তত দিন পর্যন্ত বর্তমান ঢাকা-তিস্তা-চিলমারী রুটে একটি আন্তনগর ট্রেন, ডেমুসহ কয়েকটি লোকাল ট্রেনের ব্যবস্থা করার যে দাবি গণকমিটির নেতৃত্বে জোরালো হয়ে উঠছে, তা পূরণে হাত লাগানো উচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বার্থে। ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার সিনেমার পাত্র-পাত্রীরা যেমন পদ্মার ওপারে রেললাইনের শেষ মাথায় জাহাজ ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে পূর্ব বাংলার মানুষ ট্রেন ধরে পশ্চিম বাংলায় আসে, সেই স্থানটিতে এসে হাহাকার নিয়ে যেমন চেয়ে থাকে; কুড়িগ্রাম জেলাবাসী যেন একই হাহাকার নিয়ে রমনা (চিলমারী) স্টেশনের রেললাইনের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন, এই লাইন কবে তিস্তা পার হয়ে ফুলছড়ি হয়ে বাহাদুরাবাদের সঙ্গে মিলবে! আর কবে শেষ হবে বিচ্ছিন্নতার পঁচাত্তর বছর?
নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
nahiduttar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.