৩০ হাজারে রফার নাটক নির্যাতনকারীর
দেশের
বিভিন্ন স্থানে শিশু নির্যাতনের আরো একটি ঘটনা। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার
বিনবিনার চরে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র রাকিবুল ইসলামকে চুরির অপবাদ দিয়ে
অমানবিক নির্যাতন করেছে স্থানীয় প্রভাবশালী কাজী তালেব মাস্টার ও তার
ছেলেরা। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাকিবুল এখন
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। রাকিবুলকে নির্যা্তনের বিচার-সালিশে বেরিয়ে আসছে
গা শিউড়ে ওঠা সব তথ্য। রশি দিয়ে বেঁধে লোহার রট দিয়ে মারধর, ইজকেশন দিযে
অজ্ঞান করাসহ গরম পানি দিয়ে গায়ে ডলুনি, সূর্যের দিকে চোখ দিয়ে রাখার মতো
নির্যাতন করা হয়েছে তাকে। অভিযোগ উঠেছে, পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ
দেয়া হলেও পুলিশ ও মাতবররা ৩০ হাজার টাকায় মীমাংসার নাটক বানানোয় আটক কাজী
তালেবকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শিশুটির উন্নত চিকিৎসা ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। নির্যাতিত রাকিবুলের মা আদুরী বেগম
বলেন, “গত ২৮ জুলাই বিয়ে খেতে যাই আমি। কিন্তু ছেলে রাকিবুল সেদিন স্কুল
যায়নি। স্কুল কামাই করার কারণে বাবার ধমক খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দিনমান
ঘোরাফেরা শেষে আবুলিয়া বাজারে যায় রাকিবুল। সেখানে রাতে আশ্রয় নেয় কাজী
তালেব মাস্টারের গালামালের দোকান বসুনিয়া ভ্যারাইটিজ স্টোরে। ভোরবেলা
দারোয়ান টের পেয়ে খবর দেয় মালিককে। শুরু হয় চুরির অপবাদে অমানুষিক
নির্যাতন। রাকিবুল চুরির জন্য দোকানে ঢুকেছে অপবাদ দিয়ে তালেব কাজি, আসাদ,
মিঠু, দুখু, সামাদ নামের ৫ যুবক তাকে রড দিয়ে পা, পেট, পিঠ, কোমরে
নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে ইনজেনকশন দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে পেটানো হয়। এতে
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাকিবুল।” আদুরী বেগম জানান, সকালে এ নিয়ে বসে সালিশ।
তালেব কাজি দাবি করেন ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা দোকান থেকে চুরি হয়েছে। সেখানে
রাকিবুলের বাবা আশরাফ আলী হলে তাকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। দিনমজুর
আশরাফ ছেলেকে তালেব কাজির হাতে তুলে দিয়ে দয়া ভিক্ষা চান। তালেব কাজি আবার
রাকিবুলকে বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন চালান। বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত
রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন চালানো হয় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। হাতে রশি
বেঁধে মাটিতে শুইয়ে গায়ে গরম পানি দিয়ে ডলুনি দেয়া হয়। সূর্যের দিকে মুখ
করিয়ে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ। এতে শিশুটি অজ্ঞান হয়ে পড়লে তালেব কাজীর স্ত্রী
তাতে বাধা দেয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।”
আদুরি বেগম বলেন, সেখানকার চিকিৎসকরা রাকিবুলকে ভর্তি না নিলে তাকে ফিরিয়ে
আনা হয় আবুলিয়া বাজারে। ইতিমধ্যে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে এলাকার মানুষ
বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্থানীয় ইউপি মেম্বার বাকের আলীর নেতৃত্বে আবার সালিশ
বসে। প্রত্যক্ষদর্শী আমিনুর রহমান বলেন, “ছেলেটিকে যখন চোর সন্দেহে মারা হয়
তখন আমি হাসের খামারে ছিলাম। দৌড়ে গিয়ে দেখি আসাদ, মিঠু, দুখু তাকে লাঠি
দিয়ে খুব মারছে। আমি তাদের বারণ করি। তিন-তিনবার আমি তাদের কাছে থেকে
বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিই। কিন্তু তারা বারণ মানেনি। একপর্যায়ে আসাদ শিশু
রাকিবুলকে মাটিয়ে শুইয়ে তার বুকের ওপর পা রাখলে আমি আসাদকে সতর্ক করে দিই।”
বিষয়টি কেন পুলিশকে জানালেন না, জানতে চাইলে আমিনুর জানান, বাচ্চাটিকে
এতটাই মারা হয়েছিল যে, আমি দিকজ্ঞান হারিয়ে ফেলে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা
করছিলাম। রাকিবুলের চাচাতো ভাই দুলু মিয়া জানান, “সকালে মোবাইল ফোনে জানতে
পেরে আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখি রাকিবুলকে অমানুষিক নির্যাতন করা
হয়েছে। এখন রাবিকুলের অবস্থা খারাপ। আমরা তার উন্নত চিকিসা এবং দোষীদের
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।” তিনি জানান, সব জানাজানি হওয়ার পর
নির্যাকতনকারীরা ৩০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করেছে। টাকাটি এখনো
পায়নি রাকিবুলেল বাবা। দিনমজুর বাবা খুব কষ্ট করে তার চিকিৎসা চালাচ্ছে।”
ইউপি সদস্য বাকের আলী বলেন, “শিশুটিকে আনা হলে দেখা যায় তার ওপর অমানুষিক
নির্যাতন করা হয়েছে। সালিশে স্থানীয়রা সকালের বিচারের তীব্র প্রতিবাদ করেন।
তারা আগের বিচার বাতিল করে শিশুটির চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার টাকা তালেব
কাজির জরিমানা করা হয়।” ইউপি সদস্য জানান, টাকাটা সাথে সাথে নেয়া হয়।
কিন্তু শিশুটিকে তখনো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। নির্যাতিত শিশুর
চাচা আতাউর রহমান জানান, “রাকিবুলকে উদ্ধার করতে না পেরে আমি সন্ধায় নদী
পার হয়ে গিয়ে কম্পিউটার কম্পোজ করে থানায় মামলার জন্য একটি লিখিত অভিযোগ
দায়ের করি। সঙ্গে সঙ্গে এসআই ফজলু কনস্টেবলসহ গিয়ে রাকিবুলকে উদ্ধার করে
গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করায়। এরই মধ্যে রাকিবুলের
অবস্থার অবনতি হলে তাকে আমরা রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের
অর্থোপ্যাডিক বিভাগে ভর্তি করি। আমরা সালিশের কোনো টাকা পাইনি।” আতাউর
রহমান আরো বলেন, “আমি রাকিবুলকে রংপুরে হাসপাতালে ভর্তি করে নদী পার না হয়ে
কোলকোন্দে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি। কোলকোন্দ থেকে আমাকে তালেব কাজির ছেলে
নাইম, ফারুক, আমিনসহ ৪/৫ জন জোর করে থানায় নিয়ে যায়। পরে এসআই ফজলু আমাকে
ওসির কাছে নিয়ে গেলে সেখানে দেখি তালেব কাজি ও মেম্বার বাকেরও আছেন। এ সময়
ওসি সাহেব বলেন, তুমি কী করবে। মামলা করবে কি না। তখন আমি বলি, “স্যার আমি
তো রাকিবুলের চাচা। ওর বাবা মেডিক্যালে আছে। ওদের সাথে কথা বলতে হবে। তখন
ওসি বলে, ঠিক আছে বিষয়টি যেহেতু মীমাংসা হয়েছে তাই দুটি কাগজে সই করো। আর
চিকিৎসা করার জন্য যা টাকা লাগবে তা তালেব কাজি দেবে।” এরপর তারা আমার কোনো
কথা কানে না নিয়ে আমাকে জোর করে সই নিয়ে বলে মীমাংসা হয়ে গেছে।” এ
ব্যাপারে ইউপি সদস্য বাকের আলী বলেন, “কাজী তালেবকে যখন থানায় আটক করা হয়
তখন আমাকে ফোন দেয়া হয়। সেখানে গিয়ে আতাউর ও কাজী দুটি কাগজে সই করে।
সেখানে আরও ৫ হাজার টাকা দেয়া হয়।” এ প্রসঙ্গে রাকিবুলের চাচা আতাউর রহমান
বলেন, “আমাদের কোনো টাকা দেয়া হয়নি। তারা দালালকে টাকা দিয়েছে।” বিষয়টি
থানায় ওসির সামনে অভিযুক্ত কাজী তালেবও স্বীকার করেন। গঙ্গাচড়া থানার
অফিসার ইনচার্জ আব্দুল কাদের জানান, “আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ দেয়া
হয়নি। আমরা সেলফোনে বিষয়টি জেনে এসআই ফজুলকে পাঠিয়ে ছেলেটিকে প্রথমে
গঙ্গাচড়া ও পরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাই। তাদের কাছ থেকে
অভিযোগ চাই, কিন্তু কেউ অভিযোগ না করায় এসআই ফজলু নিজেই বাদী হয়ে একটি
সুয়োমুটো মামলা করেছে। খোঁজ খবর রাখছি। তদন্ত চলছে। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া
হবে।” তবে পুলিশের ভাষ্যকে সঠিক নয় বলে দাবি করছে পরিবারের লোকজন।
রাকিবুলের চাচা আতাউর রহমান জানান, “আমি নিজেই কম্পিউটার কম্পোজ করে থানায়
লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এখন পুলিশ বলছে আমরা নাকি অভিযোগ দেইনি।” এ ব্যাপারে
হাসান নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, “আমিও আতাউর রহমানের সাথে ছিলাম
অভিযোগ দায়েরের সময়। পরে কয়েক দিন মামলা রেকর্ড করার জন্য যোগাযোগ করি।
কিন্তু পুলিশ আমাদের কোনো কথা শোনেনি।” এদিকে বিনবিনারচর সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র রাকিবুলের ওপর নির্যাছতনের ঘটনায় ও তার
করুণ অবস্থা দেখে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। তারা শনিবার বিকালে ওই এলাকায়
মানববন্ধন করে শিশু নির্যাতনকারীদের বিচার দাবি করে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালের অর্থোপ্যাডিক্স বিভাগে চিকিৎসাধীন শিশু রাকিবুলের উন্নত ও
সুচিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রভাবশালী তালেব কাজি ও তার লোকজনের
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন এলাকাবাসী। রাকিবুলের বাবা আশরাফ আলী
বলেন, “নির্যাসতনের কারণে আমার ছেলে খুব অসুস্থ। তার উন্নত চিকিৎসা দরকরা।
আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এর বিচার দাবি করছি। আমি আবার আমার
ছেলেকে সুস্থ দেখতে চাই। নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
আরডিআরএসের মানবাধিকারকর্মী বিলকিস বেগম বলেন, “রাকিবুলের ওপর নির্যাতনের
বিষয়ে পুলিশের কাছে বিচার না পেয়ে তার পরিবার আমাদের জানায়। আমরা তদন্ত করে
দেখেছি বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা পুলিশকে বলেছি রাকিবুলকে
সেফ হোমে রাখার জন্য “ তিনি বলেন, “আমরা সব ধরনের সহযোগিতা দেব রাকিবুলের
পরিবারকে।” রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপ্যাডিক্স বিভাগের
প্রধান ডা. শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিচ্ছি
শিশুটিকে। শিশুটির পায়ে, কোমরে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, তা অমানবিক।
আমরা চেষ্টা করছি তাকে সারিয়ে তোলার জন্য। তবে সময় লাগবে।”
No comments