গোবর থেকে গাড়ির জ্বালানি! by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
মিটার দেখাচ্ছেন আবদুস সালাম। যেখানে সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ বোঝা যায় -প্রথম আলো |
গরুর
গোবর থেকে জৈব সার, কেঁচো সার, কীটনাশক ও বায়োগ্যাস উৎপাদন করছেন অনেক
দিন ধরেই। এবার বায়োগ্যাস সংকুচিত করে মোটরগাড়ির জ্বালানি হিসেবে
পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করেছেন আবদুস সালাম।
শুধু নিজের গাড়ির জন্যই নয়, এই জ্বালানির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভাংড়া গ্রামের বাসিন্দা ডিপ্লোমা প্রকৌশলী আবদুস সালাম (৫১)। তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাজশাহী সার্কেলের নকশাকার হিসেবে কর্মরত। ভাংড়া গ্রামে ১ একর ৬৯ শতাংশ জমির ওপর ‘স্বস্তি ডেইরি’ খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। অফিস থেকে ফিরে বাকি সময়টা এই খামারেই ব্যয় করেন।
শুরুর কথা: ২০০৮ সালে ১২টি গরু নিয়ে খামার শুরু করেন। বর্তমানে গরুর সংখ্যা ৬৫টি। আবদুস সালাম জানালেন, এই খামার থেকে একে একে জৈব সার, কেঁচো সার, কীটনাশক ও বায়োগ্যাস উৎপাদন শুরু করেন। এরপর সংকুচিত বায়োগ্যাসের (সিবিজি) ধারণাটি মাথায় আসে তাঁর। মূলত খামারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ২০১৩ সালে সংকুচিত বায়োগ্যাসের বিষয়টি জানতে পারেন। ইন্টারনেটেই এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছেন। অন্য দেশে যাঁরা এটা নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করেন। তাঁদের পরামর্শেই যন্ত্রপাতি কিনে সংকুচিত বায়োগ্যাসের উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
সিবিজির উৎপাদন প্রক্রিয়া: সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা, সাজানো, বসানো—সবকিছু নিজেই করেছেন বলে জানালেন সালাম। উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধাপগুলো আর প্রয়োজনীয় উপাদানের বর্ণনা দিলেন তিনি। খামারের গরুর প্রতিদিনের গোবরের সঙ্গে বাইরে থেকে কিনে নেওয়া আরও দুই টন গোবর যোগ করে প্রায় সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে সেই মিশ্রণ ডাইজেস্টরে (মাটির নিচে স্থাপিত কনটেইনার) দেওয়া হয়। এই ডাইজেস্টরে গ্যাস তৈরি হয়। পাইপের মাধ্যমে তা খামারের পরিশোধন (রিফাইনার) যন্ত্রে যায়। সেখান থেকে ‘কম্প্রেসর’ যন্ত্রের মাধ্যমে সংকুচিত করে গ্যাস সিলিন্ডারে নেওয়া হয়।
আবদুস সালামের হিসাবমতে, বর্তমানে তিনি ১০০ থেকে ১২৫ ঘনমিটার সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে পারেন। জানালেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এই গ্যাস প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি হিউম্যান হলারে দেওয়া সম্ভব। তবে এ জন্য থ্রি-ফেজ বিদ্যুৎ লাইন প্রয়োজন। এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতির প্রয়োজন। থ্রি-ফেজ লাইনের জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করেছেন। আবেদন করেছেন বিস্ফোরক অধিদপ্তরেও।
আবদুস সালামের আবেদন প্রসঙ্গে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের পরিদর্শক আসাদুল ইসলাম বলেন, দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এভাবে সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমতি দেওয়া না-দেওয়ার কোনো নীতিমালাও নেই। তাই স্থানীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাঁকে সদর দপ্তরে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি আবেদনও করেছেন। সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এই সংকুচিত বায়োগ্যাস পরীক্ষামূলকভাবে সালাম নিজের গাড়িতে ব্যবহার করেছেন। সরকার এক ঘনমিটার গ্যাস ৩০ টাকা করে বিক্রি করছে। তিনি আশা করছেন, বেসরকারিভাবে এই গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৪৫ টাকা করে রাখা যাবে।
ভাংড়া গ্রামের হিউম্যান হলারচালক দবির উদ্দিন (৫০) বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে তিনি স্বস্তি ডেইরি থেকে একদিন গ্যাস নিয়ে পাবনায় গেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। সিএনজির মতোই মনে হয়েছে। তিনি বলেন, এরা যদি গ্যাস দিতে পারে তাহলে পাঁচ-দশ টাকা করে বেশি নিলেও মানুষের উপকার হবে। গ্যাস আনার জন্য পাবনা বা বগুড়ায় যেতে হবে না।
সরেজমিনে একদিন: সম্প্রতি ওই খামারে গিয়ে দেখা যায়, খামারের ভেতরে একটি ঘরে গরুর জন্য যন্ত্রের সাহায্যে খড় কাটা হচ্ছে। একজন শ্রমিক দুধ মোড়কজাত করছেন। একটি ঘরের ভেতরে বস্তায় জৈব সার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এক পাশে কেঁচো সার পলিথিনের এক থেকে দুই কেজির প্যাকেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
সিবিজির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দেখা গেল, গরুর ঘর থেকে একটি নালা দিয়ে গোবর মিশ্রিত পানি খানিকটা দূরে একটি গর্তে গিয়ে জমা হয়েছে। সেখান থেকে তুলে তা ডাইজেস্টরে দেওয়ার জন্য একটি কুয়ায় ঢালা হচ্ছে। একটি বিরাট চৌচালা খড়ের ঘরের ভেতরে মাটির নিচে স্থাপন করা হয়েছে ডাইজেস্টর। সেখানে গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। ডাইজেস্টরের ওপরে গ্যাসের চাপ মাপার জন্য একটি মিটার লাগানো রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ডাইজেস্টর থেকে ‘স্লারি’ পার্শ্বে একটি কুয়ায় গিয়ে জমা হচ্ছে। সেখানেই শ্রমিকেরা কীটনাশক আলাদা করছেন। আর ডাইজেস্টর থেকে গ্যাস পাইপের মাধ্যমে পরিশোধন (রিফাইনার) যন্ত্রে চলে আসছে। সেখান থেকে গ্যাস সংকোচন যন্ত্রের মাধ্যমে সংকুচিত করে সিলিন্ডারে ভরা হচ্ছে। সংকুচিত গ্যাস মজুতের জন্য কক্ষের বাইরে একটি বড় সিলিন্ডার বসানো হয়েছে।
সিবিজির পাশাপাশি জৈব সার ও কীটনাশক: ডাইজেস্টরে দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর গোবর-পানির যে মিশ্রণ পাওয়া যায়—সেটাই ‘স্লারি’। স্লারি থেকে পানি আলাদা করা হয়। এই পানিটাই উৎকৃষ্ট মানের কীটনাশক, জানালেন সালাম। এই কীটনাশক প্রতিদিন পাঁচ শ লিটার করে উৎপাদিত হচ্ছে। তা এক টাকা লিটার দরে কিনে নিচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা।
পুঠিয়ার বেলপুকুরে সবজি চাষ করেন রাশিদুল ইসলাম। তিনি বললেন, স্লারি নিয়ে বেগুন ও মরিচের জমিতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছেন তিনি।
স্লারি থেকে পানি আলাদা করার পরে যে উচ্ছিষ্ট থাকছে, তা পচনক্রিয়া শেষে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সারে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন খামারে এক টন জৈব সার তৈরি হচ্ছে। সাড়ে সাত টাকা কেজি হিসাবে খামার থেকে চাষিরা কিনে নিয়ে ব্যবহার করছেন শাকসবজির খেত, পেয়ারা বাগান, আম বাগান, ধান ও পাট খেতে।
পুঠিয়ার বিড়ালদহ গ্রামের রনি আহাম্মেদ ১০ বিঘা জমিতে পেয়ারার বাগান করেছেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি পেয়ারায় পচন ও পোকার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে স্বস্তি ডেইরি থেকে কীটনাশক কিনে পেয়ারা গাছে স্প্রে করেছেন। একবার ব্যবহার করার পরে ১৫ দিনেও কোনো পোকার আক্রমণ দেখা যায়নি। অথচ বাজারের রাসায়নিক কীটনাশক সাত দিন পরপর ব্যবহার করেও সুফল পাওয়া যায় না।
সালামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্লারি ও জৈব সার উৎপাদন ছাড়াও মিশ্রণের কিছু উচ্ছিষ্ট কেঁচোর খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। গড়ে ২০ দিন পরে তা কেঁচো সারে পরিণত হচ্ছে। এই সার প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে কৃষকেরা কিনে নিচ্ছেন। প্রতি মাসে খামারে দুই টন কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া এই খামার থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যাচ্ছে। স্বস্তি ডেইরির প্যাকেটজাত তরল দুধ রাজশাহী শহরে বাজারজাত হচ্ছে।
বায়োগ্যাস নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) ভাইস প্রেসিডেন্ট (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) নাজমুল হক বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তিনি বলেন, যেহেতু গ্যাস উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে ভরাতে হয়, তাই যথাযথ যন্ত্রপাতি না হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এর আগে বান্দরবানে এক ব্যক্তি এ ধরনের প্রকল্প করেছিলেন। নাজমুল হকের মতে, ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর উৎপাদন আপাতত সম্ভব নয়। কারণ এ জন্য বড় আকারের বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি দরকার।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দীন বলেন, তিনি ওই খামার পরিদর্শন করেছেন। যে সার-কীটনাশক উৎপাদিত হচ্ছে, তা মানসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব।
সালাম জানালেন, খামারে তাঁর ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। পারিশ্রমিক গড়ে ২৫০ টাকা করে। এর বাইরেও সব খরচ তিনি হিসাব করে দেখেছেন প্রকল্পটি বেশ লাভজনক। বললেন, সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি প্রকল্পটি বড় করতে পারেন। প্রতিটি উপজেলায় এ রকম খামার করা হলে দেশের ভূগর্ভস্থ গ্যাসের ওপর চাপ অনেকটা কমবে। উৎসাহী কোনো ব্যক্তি চাইলে স্বল্প পারিশ্রমিকে কারিগরি সহায়তা দিতেও প্রস্তুত তিনি।
শুধু নিজের গাড়ির জন্যই নয়, এই জ্বালানির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ভাংড়া গ্রামের বাসিন্দা ডিপ্লোমা প্রকৌশলী আবদুস সালাম (৫১)। তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাজশাহী সার্কেলের নকশাকার হিসেবে কর্মরত। ভাংড়া গ্রামে ১ একর ৬৯ শতাংশ জমির ওপর ‘স্বস্তি ডেইরি’ খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। অফিস থেকে ফিরে বাকি সময়টা এই খামারেই ব্যয় করেন।
শুরুর কথা: ২০০৮ সালে ১২টি গরু নিয়ে খামার শুরু করেন। বর্তমানে গরুর সংখ্যা ৬৫টি। আবদুস সালাম জানালেন, এই খামার থেকে একে একে জৈব সার, কেঁচো সার, কীটনাশক ও বায়োগ্যাস উৎপাদন শুরু করেন। এরপর সংকুচিত বায়োগ্যাসের (সিবিজি) ধারণাটি মাথায় আসে তাঁর। মূলত খামারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ২০১৩ সালে সংকুচিত বায়োগ্যাসের বিষয়টি জানতে পারেন। ইন্টারনেটেই এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছেন। অন্য দেশে যাঁরা এটা নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করেন। তাঁদের পরামর্শেই যন্ত্রপাতি কিনে সংকুচিত বায়োগ্যাসের উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
সিবিজির উৎপাদন প্রক্রিয়া: সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা, সাজানো, বসানো—সবকিছু নিজেই করেছেন বলে জানালেন সালাম। উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধাপগুলো আর প্রয়োজনীয় উপাদানের বর্ণনা দিলেন তিনি। খামারের গরুর প্রতিদিনের গোবরের সঙ্গে বাইরে থেকে কিনে নেওয়া আরও দুই টন গোবর যোগ করে প্রায় সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে সেই মিশ্রণ ডাইজেস্টরে (মাটির নিচে স্থাপিত কনটেইনার) দেওয়া হয়। এই ডাইজেস্টরে গ্যাস তৈরি হয়। পাইপের মাধ্যমে তা খামারের পরিশোধন (রিফাইনার) যন্ত্রে যায়। সেখান থেকে ‘কম্প্রেসর’ যন্ত্রের মাধ্যমে সংকুচিত করে গ্যাস সিলিন্ডারে নেওয়া হয়।
আবদুস সালামের হিসাবমতে, বর্তমানে তিনি ১০০ থেকে ১২৫ ঘনমিটার সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে পারেন। জানালেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এই গ্যাস প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি হিউম্যান হলারে দেওয়া সম্ভব। তবে এ জন্য থ্রি-ফেজ বিদ্যুৎ লাইন প্রয়োজন। এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতির প্রয়োজন। থ্রি-ফেজ লাইনের জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করেছেন। আবেদন করেছেন বিস্ফোরক অধিদপ্তরেও।
আবদুস সালামের আবেদন প্রসঙ্গে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের পরিদর্শক আসাদুল ইসলাম বলেন, দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এভাবে সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমতি দেওয়া না-দেওয়ার কোনো নীতিমালাও নেই। তাই স্থানীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাঁকে সদর দপ্তরে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি আবেদনও করেছেন। সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এই সংকুচিত বায়োগ্যাস পরীক্ষামূলকভাবে সালাম নিজের গাড়িতে ব্যবহার করেছেন। সরকার এক ঘনমিটার গ্যাস ৩০ টাকা করে বিক্রি করছে। তিনি আশা করছেন, বেসরকারিভাবে এই গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৪৫ টাকা করে রাখা যাবে।
ভাংড়া গ্রামের হিউম্যান হলারচালক দবির উদ্দিন (৫০) বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে তিনি স্বস্তি ডেইরি থেকে একদিন গ্যাস নিয়ে পাবনায় গেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। সিএনজির মতোই মনে হয়েছে। তিনি বলেন, এরা যদি গ্যাস দিতে পারে তাহলে পাঁচ-দশ টাকা করে বেশি নিলেও মানুষের উপকার হবে। গ্যাস আনার জন্য পাবনা বা বগুড়ায় যেতে হবে না।
সরেজমিনে একদিন: সম্প্রতি ওই খামারে গিয়ে দেখা যায়, খামারের ভেতরে একটি ঘরে গরুর জন্য যন্ত্রের সাহায্যে খড় কাটা হচ্ছে। একজন শ্রমিক দুধ মোড়কজাত করছেন। একটি ঘরের ভেতরে বস্তায় জৈব সার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এক পাশে কেঁচো সার পলিথিনের এক থেকে দুই কেজির প্যাকেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
সিবিজির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দেখা গেল, গরুর ঘর থেকে একটি নালা দিয়ে গোবর মিশ্রিত পানি খানিকটা দূরে একটি গর্তে গিয়ে জমা হয়েছে। সেখান থেকে তুলে তা ডাইজেস্টরে দেওয়ার জন্য একটি কুয়ায় ঢালা হচ্ছে। একটি বিরাট চৌচালা খড়ের ঘরের ভেতরে মাটির নিচে স্থাপন করা হয়েছে ডাইজেস্টর। সেখানে গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। ডাইজেস্টরের ওপরে গ্যাসের চাপ মাপার জন্য একটি মিটার লাগানো রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ডাইজেস্টর থেকে ‘স্লারি’ পার্শ্বে একটি কুয়ায় গিয়ে জমা হচ্ছে। সেখানেই শ্রমিকেরা কীটনাশক আলাদা করছেন। আর ডাইজেস্টর থেকে গ্যাস পাইপের মাধ্যমে পরিশোধন (রিফাইনার) যন্ত্রে চলে আসছে। সেখান থেকে গ্যাস সংকোচন যন্ত্রের মাধ্যমে সংকুচিত করে সিলিন্ডারে ভরা হচ্ছে। সংকুচিত গ্যাস মজুতের জন্য কক্ষের বাইরে একটি বড় সিলিন্ডার বসানো হয়েছে।
সিবিজির পাশাপাশি জৈব সার ও কীটনাশক: ডাইজেস্টরে দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর গোবর-পানির যে মিশ্রণ পাওয়া যায়—সেটাই ‘স্লারি’। স্লারি থেকে পানি আলাদা করা হয়। এই পানিটাই উৎকৃষ্ট মানের কীটনাশক, জানালেন সালাম। এই কীটনাশক প্রতিদিন পাঁচ শ লিটার করে উৎপাদিত হচ্ছে। তা এক টাকা লিটার দরে কিনে নিচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা।
পুঠিয়ার বেলপুকুরে সবজি চাষ করেন রাশিদুল ইসলাম। তিনি বললেন, স্লারি নিয়ে বেগুন ও মরিচের জমিতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছেন তিনি।
স্লারি থেকে পানি আলাদা করার পরে যে উচ্ছিষ্ট থাকছে, তা পচনক্রিয়া শেষে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সারে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন খামারে এক টন জৈব সার তৈরি হচ্ছে। সাড়ে সাত টাকা কেজি হিসাবে খামার থেকে চাষিরা কিনে নিয়ে ব্যবহার করছেন শাকসবজির খেত, পেয়ারা বাগান, আম বাগান, ধান ও পাট খেতে।
পুঠিয়ার বিড়ালদহ গ্রামের রনি আহাম্মেদ ১০ বিঘা জমিতে পেয়ারার বাগান করেছেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি পেয়ারায় পচন ও পোকার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে স্বস্তি ডেইরি থেকে কীটনাশক কিনে পেয়ারা গাছে স্প্রে করেছেন। একবার ব্যবহার করার পরে ১৫ দিনেও কোনো পোকার আক্রমণ দেখা যায়নি। অথচ বাজারের রাসায়নিক কীটনাশক সাত দিন পরপর ব্যবহার করেও সুফল পাওয়া যায় না।
সালামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্লারি ও জৈব সার উৎপাদন ছাড়াও মিশ্রণের কিছু উচ্ছিষ্ট কেঁচোর খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। গড়ে ২০ দিন পরে তা কেঁচো সারে পরিণত হচ্ছে। এই সার প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে কৃষকেরা কিনে নিচ্ছেন। প্রতি মাসে খামারে দুই টন কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া এই খামার থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যাচ্ছে। স্বস্তি ডেইরির প্যাকেটজাত তরল দুধ রাজশাহী শহরে বাজারজাত হচ্ছে।
বায়োগ্যাস নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) ভাইস প্রেসিডেন্ট (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) নাজমুল হক বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংকুচিত বায়োগ্যাস উৎপাদনের ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তিনি বলেন, যেহেতু গ্যাস উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে ভরাতে হয়, তাই যথাযথ যন্ত্রপাতি না হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এর আগে বান্দরবানে এক ব্যক্তি এ ধরনের প্রকল্প করেছিলেন। নাজমুল হকের মতে, ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর উৎপাদন আপাতত সম্ভব নয়। কারণ এ জন্য বড় আকারের বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি দরকার।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দীন বলেন, তিনি ওই খামার পরিদর্শন করেছেন। যে সার-কীটনাশক উৎপাদিত হচ্ছে, তা মানসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব।
সালাম জানালেন, খামারে তাঁর ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। পারিশ্রমিক গড়ে ২৫০ টাকা করে। এর বাইরেও সব খরচ তিনি হিসাব করে দেখেছেন প্রকল্পটি বেশ লাভজনক। বললেন, সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি প্রকল্পটি বড় করতে পারেন। প্রতিটি উপজেলায় এ রকম খামার করা হলে দেশের ভূগর্ভস্থ গ্যাসের ওপর চাপ অনেকটা কমবে। উৎসাহী কোনো ব্যক্তি চাইলে স্বল্প পারিশ্রমিকে কারিগরি সহায়তা দিতেও প্রস্তুত তিনি।
No comments