প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয় by হাসান ফেরদৌস
আজকাল
সবাই প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি বলে মাথা গরম করছে। প্রবৃদ্ধির হিসাবে বাংলাদেশ
গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ অর্জন করে চলেছে, অতএব দেশের উন্নতি শনৈঃ শনৈঃ। দেশের
মন্ত্রী ও আমলারা তো রয়েছেনই। ভারত থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদি এসেছিলেন,
তিনিও আমাদের পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে গেলেন—বেশ করছ তোমরা।
সমস্যা হলো, এক প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের উন্নতির হিসাব অনেকটা শুভংকরের ফাঁকি। দেশের মোট সম্পদ বাড়লে একদল লোকের পকেট ভারী হয় বটে, কিন্তু সেই সম্পদ যদি অধিক ন্যায়সংগতভাবে বণ্টন না করা যায়, তাহলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ তার সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। বাংলাদেশে ঠিক সেই ব্যাপারটাই ঘটে চলেছে।
মুদ্রাস্ফীতির হিসাব বাদ দিয়েও যদি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হিসাব ধরি, মানতেই হবে আমাদের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালের পর বিশ্বজুড়ে যে মহা মন্দাবস্থা ছড়িয়ে পড়ে, বাংলাদেশ তা ভালোভাবেই এড়াতে পেরেছে। মাসের পর মাসজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, তা-ও বাংলাদেশ উতরে গেছে। অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ইতিবাচক। এমনকি মানব উন্নয়নের নিরিখেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের তুলনায় ভালো করেছে। অথচ তারপরও দেশের এক বৃহৎ মানবগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে।
চলতি হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। অন্য কথায়, সেখানে প্রতি তিনজনের একজন মানুষের দৈনিক আয় মাথাপিছু দুই ডলারেরও কম। মাথাপিছু আয় যে হারে বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যের বিচারে, বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। ফলে অতিদরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ার বদলে কমেছে। খাওয়া-পড়ার খরচটাই সাধারণ মানুষের প্রধান খরচ। সেটাই যখন বেড়ে যায়, তখন অন্য খাতে যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মনোরঞ্জন—খরচ করার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই অসাম্য যত দীর্ঘ সময় ধরে চলে, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ ততই ক্রমে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
এই হিসাবটা যদি পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করি, তাহলে ছবিটা আরও পরিষ্কার হবে। সাম্প্রতিক যে পরিসংখ্যান মিলেছে, তা অনুসারে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে পরিবারপ্রতি মাসিক আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এই সময়ে পরিবারপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। গ্রাম ও শহরের মধ্যে অথবা অঞ্চলভেদে আয়-ব্যয়ের এই তারতম্য আরও বেশি। আয়-ব্যয়ের এই ফারাকের মূল কারণ আয় বৃদ্ধির তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয়ভার, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর দাম, বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি। ফলে পরিসংখ্যানের হিসাবে মোট দারিদ্র্য কমলেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসাম্য বেড়েই চলেছে।
দেশের মোট আয় বাড়ছে, কিন্তু অর্থনৈতিক অসাম্য কমছে না—এ কথার এক অর্থ হচ্ছে, দেশের উপার্জিত সম্পদ সুষমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। যারা ধনী, তারা আরও ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে গরিব হচ্ছে আরও গরিব। সবাই মানেন, মোট সম্পদের হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনিক গোষ্ঠী আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখনো অধিক ধনী। শুধু তা-ই নয়, তারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক দ্রুত হারেও ধনী হচ্ছে। শুধু একটা হিসাব দিই। ২০১০ সালের হিসাবে দেখেছি, দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে দেশের মোট সম্পদের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ বা প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অন্যদিকে, সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ সম্পদ। মোট আয়ের হিসাবে এমন আকাশ-পাতাল বৈষম্য পৃথিবীর খুব বেশি দেশে নেই।
এ তো গেল মোট আয়ের হিসাবে। কয়েক বছর আগে জাতিসংঘ একই দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্যের হিসাবে প্রকৃত বৈষম্য বোঝাতে গরিব ও কার্যকরভাবে গরিব—ইংরেজিতে ইনকাম পুওর ও ক্যাপাবিলিটি পুওর—এই অভিনব ধারণাটি চালু করে। আপনি আয়ের হিসাবে হয়তো একদম গরিব নন, কিন্তু আপনি যদি গ্রামে থাকেন অথবা অনুন্নত কোনো অঞ্চলে বাস করেন, তাহলে পকেটে পয়সা থাকলেও আপনার সঙ্গে অতি নিঃস্বর বড় ধরনের ফারাক নেই। চিকিৎসক বা হাসপাতাল না থাকলে পকেটে পয়সা থেকেও আপনি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন না, প্রসূতির বা শিশুর যথোপযুক্ত পরিচর্যায় সক্ষম হবেন না।
অমর্ত্য সেন বা জন রলসের মতো অর্থনীতিবিদেরা দরিদ্র ও কার্যকর দরিদ্র—এই ধারণাটিকে আরও সম্প্রসারিত করে যে ‘সুবিচারতত্ত্ব’ (থিওরি অব জাস্টিস) উপহার দিয়েছেন, তাতে দারিদ্র্য বিচারের ক্ষেত্রে আয়, সম্পদ ও সুযোগের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার, এমনকি আত্মসম্মানের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কোনো দাঁড়িপাল্লা নেই, যা দিয়ে এই সূচকগুলো নির্ণয় করা যাবে, কিন্তু আমরা খালি চোখেই তো বুঝতে পারি আমাদের মতো দেশে ধনী-দরিদ্রের এই ফারাকটা কত বিশাল। আয়ের তারতম্য থেকেই ঘটে অর্থনৈতিক অসাম্য। এই অসাম্যের কারণে রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের মানুষের মতামতের কোনো দাম নেই, তাদের কোনো কার্যকর অংশগ্রহণও নেই।
অমর্ত্য সেন আমাদের আরও একটা জিনিসের দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে কার কী আয় বা কার নিয়ন্ত্রণে কত সম্পদ আছে, শুধু সেই হিসাব দিয়ে ধনী-দরিদ্রের প্রকৃত ফারাক বোঝা অসম্ভব। অন্যান্য মোদ্দা অর্জনের (বা সাবসট্যান্টিভ অ্যাচিভমেন্ট) কথাও মাথায় রাখা দরকার। একজন প্রতিবন্ধী মানুষের কথা ভাবুন। সমাজ চাইলে একজন প্রতিবন্ধীকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে পারে। কিন্তু সেই অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তার বিস্তর ধনসম্পদ থাকলেও একজন সুঠাম ব্যক্তির তুলনায় সে বহুলাংশে দরিদ্র রয়ে যাবে। একই কথা বৃদ্ধ বা নারীর বেলায়। অনেক দেশেই খুব মৌলিক মানবাধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত, যদিও অর্থ বা উপার্জনের হিসাবে তাঁরা হয়তো মোটেই দরিদ্র নন।
ধনী-দরিদ্রের এই যে বৈষম্য, তা যে স্বতঃসিদ্ধ, এমন নয়। পরিকল্পিত ও নীতিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোনো দেশ শুধু যে জনপ্রতি আয়ের বৈষম্য কমাতে পারে তা-ই নয়, তাদের কার্যকর দারিদ্র্যের ফারাকও কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু সে জন্য দরকার বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব দেশের মোট সম্পদের অধিক ন্যায়সংগত বণ্টন এবং নাগরিক অধিকার ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার অধিক ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেই ফারাক কমিয়ে আনা।
একসময় ভাবা হতো যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পদ উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অর্জনের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ ও অধিক ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ক্লাসিক্যাল সমাজতন্ত্র ব্যর্থ—এ কথা অনেকে বলেন, এখন সেই তর্কে আমরা যাব না। কিন্তু প্রথাগত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও অধিক ন্যায়সংগত সমাজব্যবস্থা গঠন সম্ভব। পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো দেশ, যেমন নরওয়ে বা ফিনল্যান্ড ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার অর্জনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমি উদাহরণ হিসেবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশের কথা বলতে চাই। দেশটির নাম ব্রাজিল।
শুধু প্রবৃদ্ধির হিসাবে ব্রাজিলের সেরা সময় ছিল সত্তরের দশক, যখন সেখানে চলছিল কঠোর সামরিক শাসন। বছরপ্রতি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি। অথচ মোট সম্পদ বৃদ্ধি পেলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ যে শুধু আয়ের দিক দিয়েই গরিব ছিল তা নয়, মৌলিক অধিকারের দিক দিয়েও ছিল হতবঞ্চিত। অবস্থাটা বদলাতে শুরু করল ২০০২ সাল থেকে, শ্রমিকনেতা লুলা দা সিলভা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর। সরকার চাইলে সম্পদ নির্মাণে যেমন নেতৃত্ব দিতে পারে, তেমনি সেই সম্পদের ন্যায়সংগত পুনর্বণ্টনেও হস্তক্ষেপ করতে পারে—এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর সময় শ্রমিকদের ঘণ্টাপ্রতি বেতন বাড়ল, বেকারত্ব কমল, মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগও সম্প্রসারিত হলো। এমনকি বিনিয়োগগের ক্ষেত্রেও সুযোগ-সুবিধার অধিক সমতা অর্জিত হলো। লুলার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের সময়েও এই নীতি অব্যাহত থাকার ফলে গত ১৫ বছরে ব্রাজিল তার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছে।
শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাবটা ধরলেই স্পষ্ট হবে পরিকল্পিত হস্তক্ষেপের ফলে বৈষম্য কীভাবে কমে আসে। ২০০০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ব্রাজিলে নামিক বা নমিনাল অর্থে সর্বনিম্ন আয় বেড়েছে ২১১ শতাংশ। এমনকি মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিয়েও এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৬ শতাংশ। এই সময়ে গরিবি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। মধ্যবিত্তের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও চার কোটি মানুষ।
তাহলে মোদ্দাকথা হলো, শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়াই যথেষ্ট নয়। ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত যে সম্পদ অর্জিত হলো, তা থেকে দেশের আরও কত মানুষ লাভবান হলো, সেটাই আসল কথা। অধিকতর মোট সম্পদ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ সক্ষম, গত ২০ বছরে সেই প্রমাণ আমরা রেখেছি। এখন যা দরকার তা হলো, সেই সম্পদ থেকে যাতে দেশের সব মানুষ, বিশেষ করে যারা অধিকারবঞ্চিত, তারা যাতে লাভবান হয়, সেদিকে নজর দেওয়া। এই কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ব্রাজিল পারলে আমরাই বা পারব না কেন?
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
সমস্যা হলো, এক প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের উন্নতির হিসাব অনেকটা শুভংকরের ফাঁকি। দেশের মোট সম্পদ বাড়লে একদল লোকের পকেট ভারী হয় বটে, কিন্তু সেই সম্পদ যদি অধিক ন্যায়সংগতভাবে বণ্টন না করা যায়, তাহলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ তার সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। বাংলাদেশে ঠিক সেই ব্যাপারটাই ঘটে চলেছে।
মুদ্রাস্ফীতির হিসাব বাদ দিয়েও যদি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হিসাব ধরি, মানতেই হবে আমাদের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালের পর বিশ্বজুড়ে যে মহা মন্দাবস্থা ছড়িয়ে পড়ে, বাংলাদেশ তা ভালোভাবেই এড়াতে পেরেছে। মাসের পর মাসজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, তা-ও বাংলাদেশ উতরে গেছে। অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ইতিবাচক। এমনকি মানব উন্নয়নের নিরিখেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের তুলনায় ভালো করেছে। অথচ তারপরও দেশের এক বৃহৎ মানবগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে।
চলতি হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। অন্য কথায়, সেখানে প্রতি তিনজনের একজন মানুষের দৈনিক আয় মাথাপিছু দুই ডলারেরও কম। মাথাপিছু আয় যে হারে বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যের বিচারে, বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। ফলে অতিদরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ার বদলে কমেছে। খাওয়া-পড়ার খরচটাই সাধারণ মানুষের প্রধান খরচ। সেটাই যখন বেড়ে যায়, তখন অন্য খাতে যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মনোরঞ্জন—খরচ করার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই অসাম্য যত দীর্ঘ সময় ধরে চলে, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ ততই ক্রমে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
এই হিসাবটা যদি পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করি, তাহলে ছবিটা আরও পরিষ্কার হবে। সাম্প্রতিক যে পরিসংখ্যান মিলেছে, তা অনুসারে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে পরিবারপ্রতি মাসিক আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এই সময়ে পরিবারপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। গ্রাম ও শহরের মধ্যে অথবা অঞ্চলভেদে আয়-ব্যয়ের এই তারতম্য আরও বেশি। আয়-ব্যয়ের এই ফারাকের মূল কারণ আয় বৃদ্ধির তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয়ভার, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর দাম, বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি। ফলে পরিসংখ্যানের হিসাবে মোট দারিদ্র্য কমলেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসাম্য বেড়েই চলেছে।
দেশের মোট আয় বাড়ছে, কিন্তু অর্থনৈতিক অসাম্য কমছে না—এ কথার এক অর্থ হচ্ছে, দেশের উপার্জিত সম্পদ সুষমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। যারা ধনী, তারা আরও ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে গরিব হচ্ছে আরও গরিব। সবাই মানেন, মোট সম্পদের হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনিক গোষ্ঠী আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখনো অধিক ধনী। শুধু তা-ই নয়, তারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক দ্রুত হারেও ধনী হচ্ছে। শুধু একটা হিসাব দিই। ২০১০ সালের হিসাবে দেখেছি, দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে দেশের মোট সম্পদের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ বা প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অন্যদিকে, সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ সম্পদ। মোট আয়ের হিসাবে এমন আকাশ-পাতাল বৈষম্য পৃথিবীর খুব বেশি দেশে নেই।
এ তো গেল মোট আয়ের হিসাবে। কয়েক বছর আগে জাতিসংঘ একই দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্যের হিসাবে প্রকৃত বৈষম্য বোঝাতে গরিব ও কার্যকরভাবে গরিব—ইংরেজিতে ইনকাম পুওর ও ক্যাপাবিলিটি পুওর—এই অভিনব ধারণাটি চালু করে। আপনি আয়ের হিসাবে হয়তো একদম গরিব নন, কিন্তু আপনি যদি গ্রামে থাকেন অথবা অনুন্নত কোনো অঞ্চলে বাস করেন, তাহলে পকেটে পয়সা থাকলেও আপনার সঙ্গে অতি নিঃস্বর বড় ধরনের ফারাক নেই। চিকিৎসক বা হাসপাতাল না থাকলে পকেটে পয়সা থেকেও আপনি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন না, প্রসূতির বা শিশুর যথোপযুক্ত পরিচর্যায় সক্ষম হবেন না।
অমর্ত্য সেন বা জন রলসের মতো অর্থনীতিবিদেরা দরিদ্র ও কার্যকর দরিদ্র—এই ধারণাটিকে আরও সম্প্রসারিত করে যে ‘সুবিচারতত্ত্ব’ (থিওরি অব জাস্টিস) উপহার দিয়েছেন, তাতে দারিদ্র্য বিচারের ক্ষেত্রে আয়, সম্পদ ও সুযোগের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার, এমনকি আত্মসম্মানের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কোনো দাঁড়িপাল্লা নেই, যা দিয়ে এই সূচকগুলো নির্ণয় করা যাবে, কিন্তু আমরা খালি চোখেই তো বুঝতে পারি আমাদের মতো দেশে ধনী-দরিদ্রের এই ফারাকটা কত বিশাল। আয়ের তারতম্য থেকেই ঘটে অর্থনৈতিক অসাম্য। এই অসাম্যের কারণে রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের মানুষের মতামতের কোনো দাম নেই, তাদের কোনো কার্যকর অংশগ্রহণও নেই।
অমর্ত্য সেন আমাদের আরও একটা জিনিসের দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে কার কী আয় বা কার নিয়ন্ত্রণে কত সম্পদ আছে, শুধু সেই হিসাব দিয়ে ধনী-দরিদ্রের প্রকৃত ফারাক বোঝা অসম্ভব। অন্যান্য মোদ্দা অর্জনের (বা সাবসট্যান্টিভ অ্যাচিভমেন্ট) কথাও মাথায় রাখা দরকার। একজন প্রতিবন্ধী মানুষের কথা ভাবুন। সমাজ চাইলে একজন প্রতিবন্ধীকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে পারে। কিন্তু সেই অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তার বিস্তর ধনসম্পদ থাকলেও একজন সুঠাম ব্যক্তির তুলনায় সে বহুলাংশে দরিদ্র রয়ে যাবে। একই কথা বৃদ্ধ বা নারীর বেলায়। অনেক দেশেই খুব মৌলিক মানবাধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত, যদিও অর্থ বা উপার্জনের হিসাবে তাঁরা হয়তো মোটেই দরিদ্র নন।
ধনী-দরিদ্রের এই যে বৈষম্য, তা যে স্বতঃসিদ্ধ, এমন নয়। পরিকল্পিত ও নীতিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোনো দেশ শুধু যে জনপ্রতি আয়ের বৈষম্য কমাতে পারে তা-ই নয়, তাদের কার্যকর দারিদ্র্যের ফারাকও কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু সে জন্য দরকার বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব দেশের মোট সম্পদের অধিক ন্যায়সংগত বণ্টন এবং নাগরিক অধিকার ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার অধিক ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেই ফারাক কমিয়ে আনা।
একসময় ভাবা হতো যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পদ উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অর্জনের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ ও অধিক ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ক্লাসিক্যাল সমাজতন্ত্র ব্যর্থ—এ কথা অনেকে বলেন, এখন সেই তর্কে আমরা যাব না। কিন্তু প্রথাগত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও অধিক ন্যায়সংগত সমাজব্যবস্থা গঠন সম্ভব। পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো দেশ, যেমন নরওয়ে বা ফিনল্যান্ড ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার অর্জনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমি উদাহরণ হিসেবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশের কথা বলতে চাই। দেশটির নাম ব্রাজিল।
শুধু প্রবৃদ্ধির হিসাবে ব্রাজিলের সেরা সময় ছিল সত্তরের দশক, যখন সেখানে চলছিল কঠোর সামরিক শাসন। বছরপ্রতি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি। অথচ মোট সম্পদ বৃদ্ধি পেলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ যে শুধু আয়ের দিক দিয়েই গরিব ছিল তা নয়, মৌলিক অধিকারের দিক দিয়েও ছিল হতবঞ্চিত। অবস্থাটা বদলাতে শুরু করল ২০০২ সাল থেকে, শ্রমিকনেতা লুলা দা সিলভা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর। সরকার চাইলে সম্পদ নির্মাণে যেমন নেতৃত্ব দিতে পারে, তেমনি সেই সম্পদের ন্যায়সংগত পুনর্বণ্টনেও হস্তক্ষেপ করতে পারে—এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর সময় শ্রমিকদের ঘণ্টাপ্রতি বেতন বাড়ল, বেকারত্ব কমল, মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগও সম্প্রসারিত হলো। এমনকি বিনিয়োগগের ক্ষেত্রেও সুযোগ-সুবিধার অধিক সমতা অর্জিত হলো। লুলার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের সময়েও এই নীতি অব্যাহত থাকার ফলে গত ১৫ বছরে ব্রাজিল তার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছে।
শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাবটা ধরলেই স্পষ্ট হবে পরিকল্পিত হস্তক্ষেপের ফলে বৈষম্য কীভাবে কমে আসে। ২০০০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ব্রাজিলে নামিক বা নমিনাল অর্থে সর্বনিম্ন আয় বেড়েছে ২১১ শতাংশ। এমনকি মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিয়েও এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৬ শতাংশ। এই সময়ে গরিবি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। মধ্যবিত্তের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও চার কোটি মানুষ।
তাহলে মোদ্দাকথা হলো, শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়াই যথেষ্ট নয়। ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত যে সম্পদ অর্জিত হলো, তা থেকে দেশের আরও কত মানুষ লাভবান হলো, সেটাই আসল কথা। অধিকতর মোট সম্পদ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ সক্ষম, গত ২০ বছরে সেই প্রমাণ আমরা রেখেছি। এখন যা দরকার তা হলো, সেই সম্পদ থেকে যাতে দেশের সব মানুষ, বিশেষ করে যারা অধিকারবঞ্চিত, তারা যাতে লাভবান হয়, সেদিকে নজর দেওয়া। এই কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ব্রাজিল পারলে আমরাই বা পারব না কেন?
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments