খুনের ৪৫ মিনিট আগেই অবস্থান নেয় ঘাতকরা by ওয়েছ খছরু
ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুনের ৪৫ মিনিট
আগেই এলাকায় অবস্থান নেয় ঘাতকরা। সকাল ৮টার দিকে একটি সাদা মাইক্রোবাস থেকে
নামে ৪ ঘাতক। এরপর দুজন দুজন করে দাঁড়িয়ে থাকে গলির দুপাশে। স্থানীয়রা
তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে মনে করেছিলেন। বাসের জন্য নেমেছে। তাদের
নামিয়ে দিয়েই মাইক্রোটি গলির ভেতর ঢুকে যায়। আর খুনের ঘটনায় অংশ নেয়া চার
ঘাতকই নুরানী দিঘিরপাড় পূর্বপাড় থেকে হেঁটে হেঁটে গিয়ে মাইক্রোতে উঠে
বিকল্প সড়ক দিয়ে চলে যায়। এভাবেই খুনের বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
অনন্ত বিজয় দাশ |
গতকাল নুরানী দিঘি এলাকায়
মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই। তারা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে
বলেন, খুনিরা চাইলে অনন্তকে সুবিদবাজার মূল রাস্তার গলির মুখেই খুন করতে
পারতো। কিন্তু ওই স্থান জনাকীর্ণ হওয়ায় তারা তা করেনি। নিজ বাসা থেকে বের
হয়ে যখন হেঁটে হেঁটে সুবিদবাজার পয়েন্টে যাচ্ছিলো তখন সামনে থেকে তাকে
ধাওয়া করে খুনিরা। ওখান থেকে ধাওয়ার পর নুরানী দিঘিরপাড়ের নির্জন স্থানে
এলে এলোপাতাড়ি কোপায়। এরপর ঘটনাস্থল থেকে তারা চলে যায়। কোপানোর সময় তারা
মুখে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর’ বলে। স্থানীয়রা জানান, ঘটনাস্থল থেকে
প্রায় ৩০০ ফুট দূরে অবস্থান করছিলো মাইক্রোবাসটি। ওই মাইক্রোবাসটি বিভিন্ন
স্থানে পার্কিং করার পর একটি বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এ সময় মাইক্রোবাসে
আরও ২-৩ জন বসা ছিলেন। তারা ‘ব্যাকআপ’ টিম হিসেবে মাইক্রোবাসেই বসা ছিল বলে
ধারণা করেন তারা। খুনিরা মাইক্রোতে ওঠার পর হাজীপাড়ার দিকে দ্রুত চলে যায়।
তারা বলেন, ঘটনাস্থল থেকে অনন্ত দাশের বাসার দূরত্ব বেশি না। হামলার সময় অনেকেই অনন্তকে চিনেছেন। এরপরও খুনিরা ফের ঘটনাস্থলে আসতে পারে- এই ভয়ে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়া অনন্তকে উদ্ধার করতে ছুটে যাননি। পওে বোনরা খবর পেয়ে এসে রক্তমাখা দেহ ধরে সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন। নিহত অনন্তের ভাই রত্নেশ্বর দাশ সহ পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, খুনিরা চলে যাওয়ার পর প্রায় ২৫ মিনিট অনন্তের রক্তমাখা দেহ রাস্তায় পড়েছিল। এসময় প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই থাকলেও তারা এগিয়ে আসেননি। ঘটনার পরপর অনন্তকে হাসপাতালে নেয়া হলে হয়তো বাঁচানো যেতো বলে মনে করেন তারা। তারা আরও বলেন, খুনিরা পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। খুনের সময় তাদের মুখে মুখোশ পরা ছিল। তবে, চলে যাওয়ার সময় তারা মুখোশ খুলেছে। এলাকার লোকজন তাদের দেখেছেন। তবে কেউ চিনতে পারেননি। তারা বলেন, ব্লগে লেখালেখি ও প্রগতিমনার কারণেই খুন করা হয়েছে অনন্তকে। ওদিকে, পুলিশও জানিয়েছে, খুনের ঘটনার অনেক আগেই খুনিরা এলাকায় অবস্থান করছিল। এর কারণ খুনিরা জানতো প্রতিদিনের মতো অনন্ত ওই রাস্তা দিয়ে বের হবে। তারা পরিকল্পিতভাবেই অনন্তকে খুন করেছে। আর খুনের ঘটনার পর তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পুলিশ জানায়, খুনিরা বাইরের না এলাকার সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। খুনিরা বাইরের হলেও এলাকার কেউ জড়িত আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনন্তর খুনিদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা যাচাই করা হচ্ছে। খুনের ঘটনার আগে ঘাতকরা বেশ কয়েকবার এলাকায় রেকি করতে পারে বলে ধারণা করেন তারা। এ কারণে খুনের ঘটনার পর শহরের একাধিক গলিময় এলাকা বনকলাপাড়া দিয়ে পালিয়েছে তারা।
সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার ওসি গৌসুল হোসেন বলেন, অনন্তের খুনিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, গতকাল বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানান তিনি। ওদিকে, ঘটনাস্থল ও অনন্তর বাসা থেকে উদ্ধারকৃত আলামত সহ আনুষঙ্গিক সকল বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি নুরুল আলম বলেন, খুনিদের শনাক্ত করতে প্রযুক্তি সহায়তা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য স্থানগুলোতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা হয়েছে। তিনি বলেন, অনন্তের খুনিরা ধরা পড়বে। এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। গতকাল এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, ব্লগার অনন্তের ওপর হামলার ঘটনার পরপরই এয়ারপোর্ট থানা পুলিশকে ঘটনাস্থল থেকে অবগত করেছেন অনেকেই। কিন্তু পুলিশও এলাকায় পৌঁছায় বিলম্বে। আর ঘটনার পর থেকে সুবিদবাজার, বনকলাপাড়া এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এতে করে পুলিশের ওপর এলাকাবাসীর ক্ষোভ রয়েছে। ব্লগার ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অনন্ত বিজয় দাশ খুনের ঘটনার পর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাড়ানো হয়েছে। এর কারণ, বিভাগীয় শহর সিলেটে এর আগে কোন ব্লগারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি। আনসার উল্লাহ বাংলা টিম-৮ এর সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা সেটি নিয়েই গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকায় গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে ৮৪ জনের যে তালিকা পাওয়া গিয়েছিলো সেটিতে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের নাম ছিল প্রথম ১০ জনের মধ্যে। গণজাগরণ কর্মী হিসেবে কোন তালিকায় তার নাম ছিল না। সিলেটের গোয়েন্দারা অনেক আগেই আশংকা করেছিলেন, গণজাগরণ কর্মীদের ওপর হামলার বিষয়টি। এ কারণে গণজাগরণ কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে তাদের সুপারিশও ছিল উপর মহলে। কিন্তু রাজনৈতিক কঠিন সময়ে সিলেটে কারও ওপর কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি। দু’একটি বিচ্ছিন্ন মোবাইল ম্যাসেজের মাধ্যমে গণজাগরণ কর্মী, সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ওই সময় সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী সহ অনেক নেতার বাসায় ককটেল ও হাতবোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি শান্ত। কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। এ অবস্থায় হামলা হতে পারে সেটি ছিল ধারণার বাইরে।
হরতাল পালন: গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, যুক্তি সম্পাদক, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার প্রতিবাদে সিলেট মহানগর এলাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছে। বুধবার সকালে নগরীর কোর্ট পয়েন্টে গণজাগরণ মঞ্চ, প্রগতিশীল ছাত্রজোটসহ অন্য প্রগতিশীল সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত হন। পরে সকাল পৌনে ৮টায় সেখান থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ কওে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেয়। এরপর সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে অবিলম্বে খুনিদেও গ্রেপ্তারের দাবি জানান হরতাল সমর্থকরা। হরতালে বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। সকাল ১০টার দিকে পিকেটাররা কোর্ট পয়েন্টে দুইটি অটোরিকশা ভাঙচুর করে। হরতালে নগরীতে যান চলাচল কিছুটা কম ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট খুলতে শুরু করে। বাড়ে নাগরিক ব্যস্ততাও। শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে গণজাগরণ সংগঠক রজত কান্তি গুপ্ত, দেবাশীষ দেবু সহ সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রাখেন।
মামলা, আসামি চার মুখোশধারী: যুক্তি সম্পাদক, মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এয়ারপোর্ট থানার ওসি তদন্ত নুরুল আলম। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে নিহতের বড় ভাই বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার পর রাতে বিমানবন্দর থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানান তিনি। ওসি গৌসুল হোসেন বলেন, অজ্ঞাতনামা চারজনকে এজাহারে আসামি করা হয়েছে। রাতেই মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। ওসি তদন্ত নুরুল আলমকে এ মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রহমত উল্লাহ জানান, অনন্তের হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালানো হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। চারজন মুখোশধারী এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। পুলিশ তাদের ধরার চেষ্টা করছে।
জয়ের স্টেটমেন্ট মৌলবাদীদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল-জাফর ইকবাল: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, যুুক্তি পত্রিকার সম্পাদক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার প্রতিবাদে এবং দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব’। হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বুুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধনে অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সমাবেশ। অনন্ত দাশ হত্যা সরকারের ব্যর্থতা উল্লেখ করে সমাবেশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, তোমরা স্বীকার করে নাও সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কিছু পাবে না। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডকে স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা মৌলবাদীদের জন্য একটা গ্রিন সিগন্যাল। জয়ের মন্তব্যে মনে হচ্ছে ‘তোমরা এভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাও সরকার কিছুই করবো না’। একজন একজন করে মারা হবে সরকার কিছুই করবে না। সরকার যেটা করেছে এবং জয় যেটা বলেছে সেটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বাংলাদেশে প্রত্যেকটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হত্যাকারীদের প্রশাসন ধরতে পারছে না সেটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা সরকারের ব্যর্থতা। তিনি আরও বলেন, তোমরা যারা সত্যি কথা বলো তোমাদের যেকোন সময় মেওে ফেলা হবে, আমাদের মেরে ফেলা হবে, সরকার কিছুই করবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হবে। প্রেস ক্লাবের দপ্তর সম্পাদক জাবেদ ইকবালের পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইয়াসমীন হক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শরীফ মো. শরাফ উদ্দিন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শাবি শাখার কমিটি সদস্য ইসরাত রাহি রিশতা এবং সম্মিলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক-স্বেচ্ছাসেবী ও ক্রীড়া জোটের আহ্বায়ক গিয়াস বাবু।
এলাকায় মানববন্ধন: নিহত ব্লগার অনন্ত দাশ খুনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। দুপুরে নগরীর ৭ নং ওয়ার্ডবাসীর উদ্যোগে খুনের ঘটনাস্থল নুরানী দিঘি এলাকায় স্থানীয়রা মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা খুনিদের গ্রেপ্তার দাবি করে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে পাড়ার ভেতর ঢুকে খুনের ঘটনা বিরল। খুনিরা পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা করে এই খুন করে। আর এই খুনের ঘটনায় এলাকায় সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, খুনিদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত না করলে মানুষের মনে শান্তি হবে না। আন্দোলনও চলবে। এ সময় সিলেট সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখেন।
সংহতি সমাবেশ শুক্রবার: সিলেটে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুনের ঘটনায় আগামী শুক্রবার সিলেটে সংহতি সমাবেশের ডাক দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। গতকাল আধা বেলা হরতাল কর্মসূচি পালন শেষে এই সংহতি সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। শুক্রবার বিকাল ৪টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এ সংহতি সমাবেশে সিলেটের প্রগতিশীল সহ সমমনারা উপস্থিত থাকবেন। সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু জানিয়েছেন, অনন্তর খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। পরে আরও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
তারা বলেন, ঘটনাস্থল থেকে অনন্ত দাশের বাসার দূরত্ব বেশি না। হামলার সময় অনেকেই অনন্তকে চিনেছেন। এরপরও খুনিরা ফের ঘটনাস্থলে আসতে পারে- এই ভয়ে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়া অনন্তকে উদ্ধার করতে ছুটে যাননি। পওে বোনরা খবর পেয়ে এসে রক্তমাখা দেহ ধরে সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন। নিহত অনন্তের ভাই রত্নেশ্বর দাশ সহ পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, খুনিরা চলে যাওয়ার পর প্রায় ২৫ মিনিট অনন্তের রক্তমাখা দেহ রাস্তায় পড়েছিল। এসময় প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই থাকলেও তারা এগিয়ে আসেননি। ঘটনার পরপর অনন্তকে হাসপাতালে নেয়া হলে হয়তো বাঁচানো যেতো বলে মনে করেন তারা। তারা আরও বলেন, খুনিরা পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। খুনের সময় তাদের মুখে মুখোশ পরা ছিল। তবে, চলে যাওয়ার সময় তারা মুখোশ খুলেছে। এলাকার লোকজন তাদের দেখেছেন। তবে কেউ চিনতে পারেননি। তারা বলেন, ব্লগে লেখালেখি ও প্রগতিমনার কারণেই খুন করা হয়েছে অনন্তকে। ওদিকে, পুলিশও জানিয়েছে, খুনের ঘটনার অনেক আগেই খুনিরা এলাকায় অবস্থান করছিল। এর কারণ খুনিরা জানতো প্রতিদিনের মতো অনন্ত ওই রাস্তা দিয়ে বের হবে। তারা পরিকল্পিতভাবেই অনন্তকে খুন করেছে। আর খুনের ঘটনার পর তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পুলিশ জানায়, খুনিরা বাইরের না এলাকার সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। খুনিরা বাইরের হলেও এলাকার কেউ জড়িত আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনন্তর খুনিদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা যাচাই করা হচ্ছে। খুনের ঘটনার আগে ঘাতকরা বেশ কয়েকবার এলাকায় রেকি করতে পারে বলে ধারণা করেন তারা। এ কারণে খুনের ঘটনার পর শহরের একাধিক গলিময় এলাকা বনকলাপাড়া দিয়ে পালিয়েছে তারা।
সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার ওসি গৌসুল হোসেন বলেন, অনন্তের খুনিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, গতকাল বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানান তিনি। ওদিকে, ঘটনাস্থল ও অনন্তর বাসা থেকে উদ্ধারকৃত আলামত সহ আনুষঙ্গিক সকল বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি নুরুল আলম বলেন, খুনিদের শনাক্ত করতে প্রযুক্তি সহায়তা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য স্থানগুলোতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা হয়েছে। তিনি বলেন, অনন্তের খুনিরা ধরা পড়বে। এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। গতকাল এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, ব্লগার অনন্তের ওপর হামলার ঘটনার পরপরই এয়ারপোর্ট থানা পুলিশকে ঘটনাস্থল থেকে অবগত করেছেন অনেকেই। কিন্তু পুলিশও এলাকায় পৌঁছায় বিলম্বে। আর ঘটনার পর থেকে সুবিদবাজার, বনকলাপাড়া এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এতে করে পুলিশের ওপর এলাকাবাসীর ক্ষোভ রয়েছে। ব্লগার ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অনন্ত বিজয় দাশ খুনের ঘটনার পর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাড়ানো হয়েছে। এর কারণ, বিভাগীয় শহর সিলেটে এর আগে কোন ব্লগারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি। আনসার উল্লাহ বাংলা টিম-৮ এর সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা সেটি নিয়েই গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকায় গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে ৮৪ জনের যে তালিকা পাওয়া গিয়েছিলো সেটিতে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের নাম ছিল প্রথম ১০ জনের মধ্যে। গণজাগরণ কর্মী হিসেবে কোন তালিকায় তার নাম ছিল না। সিলেটের গোয়েন্দারা অনেক আগেই আশংকা করেছিলেন, গণজাগরণ কর্মীদের ওপর হামলার বিষয়টি। এ কারণে গণজাগরণ কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে তাদের সুপারিশও ছিল উপর মহলে। কিন্তু রাজনৈতিক কঠিন সময়ে সিলেটে কারও ওপর কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি। দু’একটি বিচ্ছিন্ন মোবাইল ম্যাসেজের মাধ্যমে গণজাগরণ কর্মী, সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ওই সময় সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী সহ অনেক নেতার বাসায় ককটেল ও হাতবোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি শান্ত। কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। এ অবস্থায় হামলা হতে পারে সেটি ছিল ধারণার বাইরে।
হরতাল পালন: গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, যুক্তি সম্পাদক, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার প্রতিবাদে সিলেট মহানগর এলাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছে। বুধবার সকালে নগরীর কোর্ট পয়েন্টে গণজাগরণ মঞ্চ, প্রগতিশীল ছাত্রজোটসহ অন্য প্রগতিশীল সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত হন। পরে সকাল পৌনে ৮টায় সেখান থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ কওে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেয়। এরপর সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে অবিলম্বে খুনিদেও গ্রেপ্তারের দাবি জানান হরতাল সমর্থকরা। হরতালে বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। সকাল ১০টার দিকে পিকেটাররা কোর্ট পয়েন্টে দুইটি অটোরিকশা ভাঙচুর করে। হরতালে নগরীতে যান চলাচল কিছুটা কম ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট খুলতে শুরু করে। বাড়ে নাগরিক ব্যস্ততাও। শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে গণজাগরণ সংগঠক রজত কান্তি গুপ্ত, দেবাশীষ দেবু সহ সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রাখেন।
মামলা, আসামি চার মুখোশধারী: যুক্তি সম্পাদক, মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এয়ারপোর্ট থানার ওসি তদন্ত নুরুল আলম। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে নিহতের বড় ভাই বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার পর রাতে বিমানবন্দর থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানান তিনি। ওসি গৌসুল হোসেন বলেন, অজ্ঞাতনামা চারজনকে এজাহারে আসামি করা হয়েছে। রাতেই মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। ওসি তদন্ত নুরুল আলমকে এ মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রহমত উল্লাহ জানান, অনন্তের হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালানো হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। চারজন মুখোশধারী এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। পুলিশ তাদের ধরার চেষ্টা করছে।
জয়ের স্টেটমেন্ট মৌলবাদীদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল-জাফর ইকবাল: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, যুুক্তি পত্রিকার সম্পাদক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার প্রতিবাদে এবং দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব’। হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বুুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধনে অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সমাবেশ। অনন্ত দাশ হত্যা সরকারের ব্যর্থতা উল্লেখ করে সমাবেশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, তোমরা স্বীকার করে নাও সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কিছু পাবে না। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডকে স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা মৌলবাদীদের জন্য একটা গ্রিন সিগন্যাল। জয়ের মন্তব্যে মনে হচ্ছে ‘তোমরা এভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাও সরকার কিছুই করবো না’। একজন একজন করে মারা হবে সরকার কিছুই করবে না। সরকার যেটা করেছে এবং জয় যেটা বলেছে সেটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বাংলাদেশে প্রত্যেকটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হত্যাকারীদের প্রশাসন ধরতে পারছে না সেটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা সরকারের ব্যর্থতা। তিনি আরও বলেন, তোমরা যারা সত্যি কথা বলো তোমাদের যেকোন সময় মেওে ফেলা হবে, আমাদের মেরে ফেলা হবে, সরকার কিছুই করবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হবে। প্রেস ক্লাবের দপ্তর সম্পাদক জাবেদ ইকবালের পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইয়াসমীন হক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শরীফ মো. শরাফ উদ্দিন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শাবি শাখার কমিটি সদস্য ইসরাত রাহি রিশতা এবং সম্মিলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক-স্বেচ্ছাসেবী ও ক্রীড়া জোটের আহ্বায়ক গিয়াস বাবু।
এলাকায় মানববন্ধন: নিহত ব্লগার অনন্ত দাশ খুনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। দুপুরে নগরীর ৭ নং ওয়ার্ডবাসীর উদ্যোগে খুনের ঘটনাস্থল নুরানী দিঘি এলাকায় স্থানীয়রা মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা খুনিদের গ্রেপ্তার দাবি করে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে পাড়ার ভেতর ঢুকে খুনের ঘটনা বিরল। খুনিরা পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা করে এই খুন করে। আর এই খুনের ঘটনায় এলাকায় সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, খুনিদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত না করলে মানুষের মনে শান্তি হবে না। আন্দোলনও চলবে। এ সময় সিলেট সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখেন।
সংহতি সমাবেশ শুক্রবার: সিলেটে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুনের ঘটনায় আগামী শুক্রবার সিলেটে সংহতি সমাবেশের ডাক দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। গতকাল আধা বেলা হরতাল কর্মসূচি পালন শেষে এই সংহতি সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। শুক্রবার বিকাল ৪টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এ সংহতি সমাবেশে সিলেটের প্রগতিশীল সহ সমমনারা উপস্থিত থাকবেন। সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু জানিয়েছেন, অনন্তর খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। পরে আরও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
No comments