ভারতে সালাহ উদ্দিনের বিচার কাম্য নয় by মিজানুর রহমান খান
ভারতের শিলং সিভিল হাসপাতালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ |
সালাহ
উদ্দিন আহমদকে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাদানুবাদের চেয়ে
সবচেয়ে জরুরি, তাঁকে অবিলম্বে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা
করা। প্রশ্ন উঠেছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আলোচিত আসামি নূর
হোসেনের প্রত্যর্পণ যেভাবে ঝুলে গেছে, সালাহ উদ্দিনের পরিণতিও সে রকম হয় কি
না।
কিন্তু আমার ধারণা, ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সালাহ উদ্দিনকে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ছাড়াই দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব। গতকাল একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি যুক্তি দেখান, সীমান্ত এলাকায় হলে বিএসএফ তাঁকে পুশব্যাক করতে পারত। কিন্তু এখন যেহেতু ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা হয়েছে, তাই ভারত সরকার চাইলেও আর তাঁকে তুলে দিতে পারবে না। এখন তাঁর বিচার হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি তাঁর সাজা খাটার পরেই কেবল ফিরতে পারেন। আমার মনে হয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে তাঁর ফেরা ত্বরান্বিত হতে পারে।
ভিন্ন কোনো গোয়েন্দা তথ্য না থাকলে সালাহ উদ্দিন আহমদের বক্তব্য ভারত সরকার বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। একটি সরল প্রশ্ন, কোনো ব্যক্তি যদি ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ কোনো রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে যায়, তাহলে তাকে পাসপোর্ট আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতেই হবে, এটা কোনো সভ্য দেশের ব্যবস্থা হতে পারে কি না। ভারতীয় আইনের চোখে তিনি কোনো সন্দেহভাজন ফেরার বা জঙ্গি নন। ক্ষমতাসীন দলের অভিযোগমতে, তিনি ভিন্নমতাবলম্বী। একজন রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীর প্রতি ভারত কী আচরণ করে, সেটা দেখার বিষয়।
ক্ষমসতাসীন দলের বক্তব্য চূড়ান্ত কথা হলে ভারত সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে হয়তো অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো আচরণ করতে পারে। অরবিন্দরা ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি ও ফেরার। অন্যদিকে সালাহ উদ্দিন হাইকোর্টের আদেশমতে কোনো ফেরার বা পলাতক ব্যক্তি নন। বরং তাঁকে খুঁজে বের করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ারই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন আমাদের বিচার বিভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের মতে, আওয়ামী লীগের বৈধ সরকার অপসারণে তিনি পেট্রলবোমা মারার কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিএনপি সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধান প্রশ্নে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর কী করছে বা করবে, তার থেকে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর অবস্থানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সালাহউদ্দিন অবিলম্বে দেশে ফিরতে বা রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে যে স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরে যেতে চাওয়া তাঁর মৌলিক মানবাধিকার। ব্রিটিশ সরকারের একটি সেন্ট্রাল ভলান্টারি ডিপার্চারস টিম আছে। এর ওয়েবসাইট বলছে, ‘ব্রিটেনে আপনার থাকা যদি আইনানুগ না হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরে যেতে হবে।’ আর এতে সহায়তা দেওয়া ওই টিমের ২৪ ঘণ্টার কাজ। তবে স্বেচ্ছায় যেতে চাইলেও আবেদনকারীর জন্য আট ধরনের অযোগ্যতা রয়েছে, যার কোনোটিতেই সালাহ উদ্দিন পড়েন না।
ভারত সরকারের উচিত হবে তদন্ত করে দেখা, সালাহ উদ্দিন স্বেচ্ছায় না জবরদস্তিমূলক শিলং গেছেন। কেবল পাসপোর্ট নেই বলে তাঁর বিচার করার যুক্তি ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। ভারত তার বন্ধু সরকারকে বিব্রত করবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। কারণ, তদন্তে যদি প্রকাশ পায় যে তিনি জবরদস্তি পাচার বা অপহরণের কবলে পড়েছেন, তাহলে সরকার বিব্রত হবে। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ‘প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী শিলংয়ের মারুতি জিপসি এলাকায় অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীরা তাঁকে ফেলে দিয়েছে।’ ভারতের উচিত হবে নিরপেক্ষ তদন্তের ফলাফল যাই হোক, তা প্রকাশ করা। এটা দীর্ঘ মেয়াদে তার জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে যাবে। ভারতকে বিবেচনা করতে হবে, এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুই দেশের জনগণ শেষ বিচারে কী চোখে দেখবে।
আমরা খুশি হব অনতিবিলম্বে সালাহ উদ্দিনকে ফিরে পেলে। বাংলাদেশের আইনের আপন গতির সঙ্গে ভারতের আইনের আপন গতির একটি মৌলিক পার্থক্য দেখতে চাই। ফরেনার্স অ্যাক্টে তাঁর বিচার না করে তাঁকে সসম্মানে ফেরত দিলে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
গতকাল আসাম ট্রিবিউন লিখেছে, ‘মেঘালয়ের সঙ্গে দেশটির ৪৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের নিরাপত্তায় যে ফাটল রয়েছে, নিরাপত্তা প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ভারতে তাঁর প্রবেশের ঘটনায় তা প্রমাণিত হলো।’ খালেদা জিয়ার তরফে হঠাৎ নির্দিষ্টভাবে র্যাবের কাছে সালাহ উদ্দিনকে ফেরত চাওয়া এবং তাঁর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শিলংয়ে তাঁর উপস্থিতি এবং সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালকের দ্বারা সালাহ উদ্দিনের বিচারের ঘোষণার সংকল্প ব্যক্ত করার মধ্যে কী ধরনের যোগসূত্র থাকতে পারে, তা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। এই রহস্য আদৌ উদ্ঘাটিত হবে কি না, জানি না। তবে সব ছাপিয়ে সালাহ উদ্দিনের অসহায় স্ত্রীর যে দৃশ্যমান ছোটাছুটি, এর যে মানবিক দিক, তা সব থেকে দামি। আর ভারতের সংবিধানও একজন বিদেশি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে। তিনি সেখানে অপহরণকারীর কবলে বা স্বেচ্ছায় যেভাবেই যান, তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর অনিচ্ছাকৃত অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং বাড়ি ফিরতে আগ্রহী।
এখানে রাজনৈতিক ইচ্ছাটাই বড়, আইন বাধা দেবে না। চণ্ডীগড়ভিত্তিক আইনজীবী অনিল মালহোত্রা ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দ্য হিন্দু পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন। তাঁর বক্তব্য সুপ্রিম কোর্ট–সমর্থিত। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৯২০ সালের পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইন্ডিয়া) এন্ট্রি অ্যাক্ট এবং ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্ট যুগপৎ কার্যকর থাকার কারণে যেকোনো বিদেশি নাগরিককে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই ভারত থেকে বহিষ্কার ও সরাসরি প্রত্যর্পণে সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ এবং অসীম ক্ষমতা রয়েছে।’ তাঁর আরও মন্তব্য: ‘কোনো বিদেশিকে ফেরত পাঠাতে কেন্দ্রীয় সরকারকে অন্য আর কোনো ফোরামে যাওয়ার দরকার নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জাতীয়তা নির্ধারণ বা এই প্রক্রিয়ায় তাঁকে কোনো সংবিধিবদ্ধ অধিকার দেওয়ারও কোনো দায় তার নেই। এই মুহূর্তে এসব প্রশ্নের সুরাহা দিতে কোনো ট্রাইব্যুনালের অস্তিত্ব নেই। সাত খুনের আসামি নূর হোসেন থেকে সালাহ উদ্দিনের ঘটনা আলাদা। তাই এটা বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ আছে। ১৯২০ ও ১৯৪৬ সালের ওই দুটি আইন একই ঔপনিবেশিক আছর নিয়ে বাংলাদেশেও টিকে আছে।
এই প্রশ্ন বিবেচনার যোগ্য এ কারণে যে সামনের দিনগুলোতে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহারের একটি প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সেটা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে চলতে দেওয়া সমীচীন কি না—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিকভাবেও প্রাসঙ্গিক মনে করি। কারণ, কোনো একটি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের শর্তেই কি তার কোনো নাগরিককে ফেরত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্র আগ্রহী থাকবে?
একটি উদাহরণ দিই। ১৯৫৯ সালে নৌকায় করে বারনার্ডো নামে এক ব্যক্তি শ্রীলঙ্কা থেকে জেনোয়ায় যাচ্ছিলেন। পথে নৌকা ভিড়ল কোচিনে। পাসপোর্ট না নিয়ে প্রবেশের জন্য ভারতের শুল্ক কর্মকর্তারা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন। তাঁর আইনজীবী আব্রাহাম কেরালা হাইকোর্টে মামলা ঠুকলেন। বারনার্ডো বললেন, ‘আমি তো ইচ্ছায় ঢুকিনি। তাই এ আইনে আমার বিচার হতে পারে না। কারণ, এ আইন শুধু যারা স্বেচ্ছায় ভারতে ঢুকেছে, তাদের জন্য প্রযোজ্য।’ অ্যাডভোকেট জেনারেল বললেন, এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়। ভারতের আকাশসীমায় যদি বিমান ভেঙে পড়ে, তাহলে তো জীবিত বিদেশিদের জন্য এ আইন খাটানো যাবে না। কেরালা হাইকোর্টের এক সদস্যবিশিষ্ট বিচারপতি সি এ ভায়ডিয়ালিঙ্গম এই যুক্তিই মেনে নিলেন। কিন্তু ওই রায় পুরো ঠিক ছিল বলে মানা যায় না। আবার ওই আইনের যে ব্যাখ্যা আজও অপরিবর্তিত, সেখানে তো এটাই পরিষ্কার যে আদালতসহ কোনো কর্তৃপক্ষের দিকে তাকাতে হবে না। মোদিজির মন্ত্রিসভার ইচ্ছাই চূড়ান্ত। বারনার্ডোর ঘটনা থেকেও সালাহ উদ্দিনের বিষয়টি আলাদা। বিমান ভেঙে না পড়লেও অন্তত ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি-সমর্থিত দল বিএনপির স্বীকৃত মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন হয়তো দেশটিতে অনিচ্ছায়ই পতিত হয়েছেন। তাহলে ভারত তাঁকে কেন সসম্মানে ফেরত দেবে না?
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় উল্লিখিত তদন্ত নির্ভরযোগ্য ধরে নিই। তাই বলি, টেকনিক্যাল দিকে বেশি জোর দিয়ে একজন মামুলি অপরাধী হিসেবে সালাহ উদ্দিনের বিচার করা হলে তা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য গৌরবজনক হবে না। দালাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে বহাল তবিয়তে আছেন মার্কিন জাতীয় শত্রু জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। অপরাধী বিবেচনায় সালাহ উদ্দিনের মাপের একজন মানুষের বিচার বাংলাদেশি রাজনীতিকদের জন্য ভালো উদাহরণ হবে না। আওয়ামী লীগের উচিত ভারতকে সহায়তা দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত হবে সালাহ উদ্দিনের স্ত্রীর মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়া। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা দেওয়া। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঠিকই বলেছিলেন, ‘তাঁর অন্তর্ধান সব রাজনীতিকের জন্য একটি অশনিসংকেত।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
কিন্তু আমার ধারণা, ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সালাহ উদ্দিনকে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ছাড়াই দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব। গতকাল একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি যুক্তি দেখান, সীমান্ত এলাকায় হলে বিএসএফ তাঁকে পুশব্যাক করতে পারত। কিন্তু এখন যেহেতু ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা হয়েছে, তাই ভারত সরকার চাইলেও আর তাঁকে তুলে দিতে পারবে না। এখন তাঁর বিচার হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি তাঁর সাজা খাটার পরেই কেবল ফিরতে পারেন। আমার মনে হয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে তাঁর ফেরা ত্বরান্বিত হতে পারে।
ভিন্ন কোনো গোয়েন্দা তথ্য না থাকলে সালাহ উদ্দিন আহমদের বক্তব্য ভারত সরকার বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। একটি সরল প্রশ্ন, কোনো ব্যক্তি যদি ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ কোনো রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে যায়, তাহলে তাকে পাসপোর্ট আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতেই হবে, এটা কোনো সভ্য দেশের ব্যবস্থা হতে পারে কি না। ভারতীয় আইনের চোখে তিনি কোনো সন্দেহভাজন ফেরার বা জঙ্গি নন। ক্ষমতাসীন দলের অভিযোগমতে, তিনি ভিন্নমতাবলম্বী। একজন রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীর প্রতি ভারত কী আচরণ করে, সেটা দেখার বিষয়।
ক্ষমসতাসীন দলের বক্তব্য চূড়ান্ত কথা হলে ভারত সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে হয়তো অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো আচরণ করতে পারে। অরবিন্দরা ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি ও ফেরার। অন্যদিকে সালাহ উদ্দিন হাইকোর্টের আদেশমতে কোনো ফেরার বা পলাতক ব্যক্তি নন। বরং তাঁকে খুঁজে বের করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ারই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন আমাদের বিচার বিভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের মতে, আওয়ামী লীগের বৈধ সরকার অপসারণে তিনি পেট্রলবোমা মারার কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিএনপি সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধান প্রশ্নে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর কী করছে বা করবে, তার থেকে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর অবস্থানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সালাহউদ্দিন অবিলম্বে দেশে ফিরতে বা রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে যে স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরে যেতে চাওয়া তাঁর মৌলিক মানবাধিকার। ব্রিটিশ সরকারের একটি সেন্ট্রাল ভলান্টারি ডিপার্চারস টিম আছে। এর ওয়েবসাইট বলছে, ‘ব্রিটেনে আপনার থাকা যদি আইনানুগ না হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরে যেতে হবে।’ আর এতে সহায়তা দেওয়া ওই টিমের ২৪ ঘণ্টার কাজ। তবে স্বেচ্ছায় যেতে চাইলেও আবেদনকারীর জন্য আট ধরনের অযোগ্যতা রয়েছে, যার কোনোটিতেই সালাহ উদ্দিন পড়েন না।
ভারত সরকারের উচিত হবে তদন্ত করে দেখা, সালাহ উদ্দিন স্বেচ্ছায় না জবরদস্তিমূলক শিলং গেছেন। কেবল পাসপোর্ট নেই বলে তাঁর বিচার করার যুক্তি ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। ভারত তার বন্ধু সরকারকে বিব্রত করবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। কারণ, তদন্তে যদি প্রকাশ পায় যে তিনি জবরদস্তি পাচার বা অপহরণের কবলে পড়েছেন, তাহলে সরকার বিব্রত হবে। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ‘প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী শিলংয়ের মারুতি জিপসি এলাকায় অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীরা তাঁকে ফেলে দিয়েছে।’ ভারতের উচিত হবে নিরপেক্ষ তদন্তের ফলাফল যাই হোক, তা প্রকাশ করা। এটা দীর্ঘ মেয়াদে তার জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে যাবে। ভারতকে বিবেচনা করতে হবে, এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুই দেশের জনগণ শেষ বিচারে কী চোখে দেখবে।
আমরা খুশি হব অনতিবিলম্বে সালাহ উদ্দিনকে ফিরে পেলে। বাংলাদেশের আইনের আপন গতির সঙ্গে ভারতের আইনের আপন গতির একটি মৌলিক পার্থক্য দেখতে চাই। ফরেনার্স অ্যাক্টে তাঁর বিচার না করে তাঁকে সসম্মানে ফেরত দিলে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
গতকাল আসাম ট্রিবিউন লিখেছে, ‘মেঘালয়ের সঙ্গে দেশটির ৪৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের নিরাপত্তায় যে ফাটল রয়েছে, নিরাপত্তা প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ভারতে তাঁর প্রবেশের ঘটনায় তা প্রমাণিত হলো।’ খালেদা জিয়ার তরফে হঠাৎ নির্দিষ্টভাবে র্যাবের কাছে সালাহ উদ্দিনকে ফেরত চাওয়া এবং তাঁর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শিলংয়ে তাঁর উপস্থিতি এবং সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালকের দ্বারা সালাহ উদ্দিনের বিচারের ঘোষণার সংকল্প ব্যক্ত করার মধ্যে কী ধরনের যোগসূত্র থাকতে পারে, তা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। এই রহস্য আদৌ উদ্ঘাটিত হবে কি না, জানি না। তবে সব ছাপিয়ে সালাহ উদ্দিনের অসহায় স্ত্রীর যে দৃশ্যমান ছোটাছুটি, এর যে মানবিক দিক, তা সব থেকে দামি। আর ভারতের সংবিধানও একজন বিদেশি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে। তিনি সেখানে অপহরণকারীর কবলে বা স্বেচ্ছায় যেভাবেই যান, তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর অনিচ্ছাকৃত অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং বাড়ি ফিরতে আগ্রহী।
এখানে রাজনৈতিক ইচ্ছাটাই বড়, আইন বাধা দেবে না। চণ্ডীগড়ভিত্তিক আইনজীবী অনিল মালহোত্রা ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দ্য হিন্দু পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন। তাঁর বক্তব্য সুপ্রিম কোর্ট–সমর্থিত। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৯২০ সালের পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইন্ডিয়া) এন্ট্রি অ্যাক্ট এবং ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্ট যুগপৎ কার্যকর থাকার কারণে যেকোনো বিদেশি নাগরিককে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই ভারত থেকে বহিষ্কার ও সরাসরি প্রত্যর্পণে সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ এবং অসীম ক্ষমতা রয়েছে।’ তাঁর আরও মন্তব্য: ‘কোনো বিদেশিকে ফেরত পাঠাতে কেন্দ্রীয় সরকারকে অন্য আর কোনো ফোরামে যাওয়ার দরকার নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জাতীয়তা নির্ধারণ বা এই প্রক্রিয়ায় তাঁকে কোনো সংবিধিবদ্ধ অধিকার দেওয়ারও কোনো দায় তার নেই। এই মুহূর্তে এসব প্রশ্নের সুরাহা দিতে কোনো ট্রাইব্যুনালের অস্তিত্ব নেই। সাত খুনের আসামি নূর হোসেন থেকে সালাহ উদ্দিনের ঘটনা আলাদা। তাই এটা বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ আছে। ১৯২০ ও ১৯৪৬ সালের ওই দুটি আইন একই ঔপনিবেশিক আছর নিয়ে বাংলাদেশেও টিকে আছে।
এই প্রশ্ন বিবেচনার যোগ্য এ কারণে যে সামনের দিনগুলোতে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহারের একটি প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সেটা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে চলতে দেওয়া সমীচীন কি না—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিকভাবেও প্রাসঙ্গিক মনে করি। কারণ, কোনো একটি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের শর্তেই কি তার কোনো নাগরিককে ফেরত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্র আগ্রহী থাকবে?
একটি উদাহরণ দিই। ১৯৫৯ সালে নৌকায় করে বারনার্ডো নামে এক ব্যক্তি শ্রীলঙ্কা থেকে জেনোয়ায় যাচ্ছিলেন। পথে নৌকা ভিড়ল কোচিনে। পাসপোর্ট না নিয়ে প্রবেশের জন্য ভারতের শুল্ক কর্মকর্তারা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন। তাঁর আইনজীবী আব্রাহাম কেরালা হাইকোর্টে মামলা ঠুকলেন। বারনার্ডো বললেন, ‘আমি তো ইচ্ছায় ঢুকিনি। তাই এ আইনে আমার বিচার হতে পারে না। কারণ, এ আইন শুধু যারা স্বেচ্ছায় ভারতে ঢুকেছে, তাদের জন্য প্রযোজ্য।’ অ্যাডভোকেট জেনারেল বললেন, এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়। ভারতের আকাশসীমায় যদি বিমান ভেঙে পড়ে, তাহলে তো জীবিত বিদেশিদের জন্য এ আইন খাটানো যাবে না। কেরালা হাইকোর্টের এক সদস্যবিশিষ্ট বিচারপতি সি এ ভায়ডিয়ালিঙ্গম এই যুক্তিই মেনে নিলেন। কিন্তু ওই রায় পুরো ঠিক ছিল বলে মানা যায় না। আবার ওই আইনের যে ব্যাখ্যা আজও অপরিবর্তিত, সেখানে তো এটাই পরিষ্কার যে আদালতসহ কোনো কর্তৃপক্ষের দিকে তাকাতে হবে না। মোদিজির মন্ত্রিসভার ইচ্ছাই চূড়ান্ত। বারনার্ডোর ঘটনা থেকেও সালাহ উদ্দিনের বিষয়টি আলাদা। বিমান ভেঙে না পড়লেও অন্তত ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি-সমর্থিত দল বিএনপির স্বীকৃত মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন হয়তো দেশটিতে অনিচ্ছায়ই পতিত হয়েছেন। তাহলে ভারত তাঁকে কেন সসম্মানে ফেরত দেবে না?
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় উল্লিখিত তদন্ত নির্ভরযোগ্য ধরে নিই। তাই বলি, টেকনিক্যাল দিকে বেশি জোর দিয়ে একজন মামুলি অপরাধী হিসেবে সালাহ উদ্দিনের বিচার করা হলে তা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য গৌরবজনক হবে না। দালাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে বহাল তবিয়তে আছেন মার্কিন জাতীয় শত্রু জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। অপরাধী বিবেচনায় সালাহ উদ্দিনের মাপের একজন মানুষের বিচার বাংলাদেশি রাজনীতিকদের জন্য ভালো উদাহরণ হবে না। আওয়ামী লীগের উচিত ভারতকে সহায়তা দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত হবে সালাহ উদ্দিনের স্ত্রীর মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়া। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা দেওয়া। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঠিকই বলেছিলেন, ‘তাঁর অন্তর্ধান সব রাজনীতিকের জন্য একটি অশনিসংকেত।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments