‘প্রক্সি ওয়ার’, জাতীয় স্বার্থ ও সীমান্ত চুক্তি by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি
ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি
সর্বসম্মতিক্রমে অনুসমর্থিত হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির
সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষকে বিভাজিত করে
পাকিস্তান ও ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের সময় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার
নিয়োজিত র্যাডক্লিফ কমিশনের খামখেয়ালিপনা ও তাড়াহুড়ার মধ্যে নিষ্পত্তিকৃত
সীমান্ত নির্ধারণী রোয়েদাদের ফসল ছিল ১৬২টি ছিটমহল (ভারতের অভ্যন্তরে
পূর্ববঙ্গের ৫১টি এবং পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি) ও দুই দেশের
অপদখলীয় সীমান্তকে ঘিরে সৃষ্ট এই সমস্যা, যা স্বাধীন বাংলাদেশ উত্তরাধিকার
সূত্রে পেয়েছে।
১৯৪৭ সাল থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত জনগণ প্রায় সব ধরনের নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন—এ ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে ৬৮ বছর ধরে বঞ্চিত এসব কৃষিপ্রধান এলাকার হাজার হাজার মানুষের আহাজারি ওই দুই রাষ্ট্রের আজন্ম বৈরিতার কারণে বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। ১৯৫৭-৫৮ সালে স্বল্প মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মালিক ফিরোজ খান নুন তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে ওই ছিটমহলগুলো বিনিময়ের ব্যাপারে সফল আলাপ-আলোচনা সম্পন্ন করে ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর একটি চুক্তি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দু-দুটো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ইসকান্দার মির্জা (৭ অক্টোবর) ও আইয়ুব খান (২৭ অক্টোবর) ওই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো গরজ দেখাননি। আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে ক্ষণে ক্ষণে যুধ্যমান ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নুন-নেহরু স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনার পরিবেশই ছিল না, বলাবাহুল্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ওই চুক্তিকে ভিত্তি ধরে আবার স্থলসীমান্ত চুক্তির আলোচনা শুরু করে এবং ১৯৫৮ সালের চুক্তিকে প্রায় অপরিবর্তিত রেখে তারা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সই করে, যেটা এখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হিসেবে পরিচিত। ওই চুক্তি সইয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের সংসদে চুক্তিটি অনুসমর্থিত হয়, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির জটিল আবর্তে পড়ে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিষয়টি আটকে যায়। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক এবং সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে বোধগম্য কারণেই সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ভারত তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। জিয়াউর রহমান বরং ভারতবিরোধী রাজনীতিকেই তাঁর সরকারের জন্য বেশি ফলদায়ক সাব্যস্ত করেছিলেন। বিশেষত, তিনি সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান-পসন্দ্ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাঁর শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৈরিতাপূর্ণ অবস্থানে চলে যায়। তবু বলতে হবে, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধে গত ৪১ বছর দুই প্রতিবেশী দেশের কোনো সরকারই প্রকাশ্য অবস্থান নেয়নি।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫-১৯৯৬ পর্বে ভারতীয় পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থন নিয়ে প্রচুর প্রোপাগান্ডা হলেও অনুসমর্থনের জন্য ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের দুরূহ কাজটি প্রায় অসম্ভব বিবেচিত হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের ব্যাপারে ভারতীয় রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ অতিক্রম করতে সমর্থ হয়নি তদানীন্তন ভারতীয় সরকার। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার ভারত সফরের মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যে ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন ঘটে, তার ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে বিরোধী দল বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস সহযোগিতা না করায় সংবিধান সংশোধনী বিলটি পার্লামেন্টে উত্থাপিত হলেও অনুমোদন করানো যায়নি। এখন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে সফল আলোচনার মাধ্যমে এই ইস্যুতে ভারতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে সমর্থ হওয়ায় রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়েছে।
দীর্ঘ ৬৮ বছর পর স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধানের পথ খুলে যাওয়ায় ছিটমহলের অবরুদ্ধ ৫৫ হাজার মানুষের মধ্যে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার বইছে এখন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে মোবারকবাদ জানিয়েছেন পিতার আরব্ধ কাজটি কন্যার হাতে সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা বলে। শেখ হাসিনাও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভারতের সরকারি ও বিরোধী সব দলকে তথা ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এই সাফল্যের জন্য শেখ হাসিনার কোনো কৃতিত্ব আছে বলে মনে করেন না। ভারতের বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে তিনি ধন্যবাদ জানালেন, কিন্তু কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং ওই সরকারের সবাইকে সমালোচনা করলেন আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানোর অভিযোগে। এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক বলে মনে করি। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে অপারগ হলেও এভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণিয়ে বেগম জিয়া নিজের সংকীর্ণ মন-মানসিকতার যে প্রতিফলন ঘটালেন, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের জনগণের কাছে তিনি অনেকটা ছোট হয়ে গেলেন এই বাক্যবাণগুলোর কারণে! কোনো সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কৃতিত্ব পাওনা হলে তা ঔদার্যের সঙ্গে প্রদান করাই রাজনৈতিক শিষ্টাচার।
এ পর্যায়ে প্রতিবেশী ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতির যে দোষারোপের প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, সে ব্যাপারেও কিছু আলোচনা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন। কোনো দেশ তার প্রতিবেশী কোন দেশ হবে, তা নিজ পছন্দ মোতাবেক বাছাই করতে পারে না। প্রতিবেশীকে শত্রু বানাবে নাকি বন্ধু বানাবে, সেটা রাষ্ট্রের শাসকেরা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেন। ভারত প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে তিন দিক থেকেই বেষ্টন করে রয়েছে এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় এই দেশটি আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার থেকে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ভৌগোলিক সীমানার বিচারে ছোট দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা করলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে ‘রিজিওনাল স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হওয়ার বিশাল সম্ভাবনা ধারণ করছে। সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবাতাস বইছে বাংলাদেশে; এ দেশকে ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার দিন ফুরিয়ে গেছে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া বাংলাদেশের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে গণচীন ও ভারতের অংশগ্রহণে আঞ্চলিক সহযোগিতার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য এখন স্বর্ণ-সম্ভাবনাময় একটা সুযোগ। চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও এ দুটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ–সহযোগিতার ক্ষেত্র দ্রুত প্রসারিত করে চলেছে। বাংলাদেশ তার অবস্থানগত গুরুত্বকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে এ দুই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির সঙ্গে উইন-উইন সহযোগিতার ডাইমেনশনগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজের উন্নয়নের ধারাকে বেগবান করতে পারে।
অতএব, এ দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর সাফল্য প্রশংসার দাবিদার। বিএনপির অর্জন এ ক্ষেত্রে প্রায় শূন্য। বিএনপি ও জামায়াত এখনো পাকিস্তান–প্রীতিতে আচ্ছন্ন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে দেশটি। বাংলাদেশের কিছুই শিক্ষণীয় নেই পাকিস্তান থেকে, একমাত্র ওই দেশের মারাত্মক ভুলগুলো পরিহার করার শিক্ষা ছাড়া। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ও গতি-প্রকৃতি পাকিস্তানের অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশি আশাপ্রদ ও ইতিবাচক। জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার যতবারই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন ছিল, ততবারই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে বৈরী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে কি বাংলাদেশের কোনো ফায়দা হয়েছে? পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ‘সেভেন সিস্টারস’ রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে লালন-পালন ও সশস্ত্র পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের কোনো সরকার যখন এই সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় দেয় কিংবা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও স্থলভাগকে এই সংগঠনগুলোর অস্ত্র পরিবহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়, সেটা কার স্বার্থ হাসিল করে? পাকিস্তানের না বাংলাদেশের? আসামের উলফার ট্রেনিং সেন্টার বাংলাদেশে কেন থাকবে? দশ ট্রাক অস্ত্রের যে চালানটি ধরা পড়েছে, তার নেপথ্য কুশীলব কারা ছিল, সেটিও নিশ্চয়ই একদিন বেরিয়ে আসবে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা এই ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ থেকে বাংলাদেশকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এটা একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপহার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের জনগণের জন্য। এর উপযুক্ত প্রতিদান কি ভারত দেবে না? এটা তো সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে একটি মাইলফলক ঘটনা। ভারত নিশ্চয়ই এর গুরুত্বকে কখনোই খাটো করে দেখবে না। ভারতের ক্ষমতায় বিজেপি থাকুক কি কংগ্রেস থাকুক, এ জন্য শেখ হাসিনার সরকার উভয় দলের কাছেই আদরণীয় থাকবে। বেগম জিয়া বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে তোষামোদ আর অকারণে কংগ্রেসকে গালমন্দ করেও কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারবেন বলে মনে হয় না। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে যথোপযুক্ত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন, সে জন্য তাঁকে অভিনন্দন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৪৭ সাল থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত জনগণ প্রায় সব ধরনের নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন—এ ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে ৬৮ বছর ধরে বঞ্চিত এসব কৃষিপ্রধান এলাকার হাজার হাজার মানুষের আহাজারি ওই দুই রাষ্ট্রের আজন্ম বৈরিতার কারণে বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। ১৯৫৭-৫৮ সালে স্বল্প মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মালিক ফিরোজ খান নুন তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে ওই ছিটমহলগুলো বিনিময়ের ব্যাপারে সফল আলাপ-আলোচনা সম্পন্ন করে ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর একটি চুক্তি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দু-দুটো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ইসকান্দার মির্জা (৭ অক্টোবর) ও আইয়ুব খান (২৭ অক্টোবর) ওই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো গরজ দেখাননি। আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে ক্ষণে ক্ষণে যুধ্যমান ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নুন-নেহরু স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনার পরিবেশই ছিল না, বলাবাহুল্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ওই চুক্তিকে ভিত্তি ধরে আবার স্থলসীমান্ত চুক্তির আলোচনা শুরু করে এবং ১৯৫৮ সালের চুক্তিকে প্রায় অপরিবর্তিত রেখে তারা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সই করে, যেটা এখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হিসেবে পরিচিত। ওই চুক্তি সইয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের সংসদে চুক্তিটি অনুসমর্থিত হয়, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির জটিল আবর্তে পড়ে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিষয়টি আটকে যায়। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক এবং সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে বোধগম্য কারণেই সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ভারত তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। জিয়াউর রহমান বরং ভারতবিরোধী রাজনীতিকেই তাঁর সরকারের জন্য বেশি ফলদায়ক সাব্যস্ত করেছিলেন। বিশেষত, তিনি সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান-পসন্দ্ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাঁর শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৈরিতাপূর্ণ অবস্থানে চলে যায়। তবু বলতে হবে, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধে গত ৪১ বছর দুই প্রতিবেশী দেশের কোনো সরকারই প্রকাশ্য অবস্থান নেয়নি।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫-১৯৯৬ পর্বে ভারতীয় পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থন নিয়ে প্রচুর প্রোপাগান্ডা হলেও অনুসমর্থনের জন্য ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের দুরূহ কাজটি প্রায় অসম্ভব বিবেচিত হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের ব্যাপারে ভারতীয় রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ অতিক্রম করতে সমর্থ হয়নি তদানীন্তন ভারতীয় সরকার। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার ভারত সফরের মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যে ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন ঘটে, তার ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে বিরোধী দল বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস সহযোগিতা না করায় সংবিধান সংশোধনী বিলটি পার্লামেন্টে উত্থাপিত হলেও অনুমোদন করানো যায়নি। এখন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে সফল আলোচনার মাধ্যমে এই ইস্যুতে ভারতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে সমর্থ হওয়ায় রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়েছে।
দীর্ঘ ৬৮ বছর পর স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধানের পথ খুলে যাওয়ায় ছিটমহলের অবরুদ্ধ ৫৫ হাজার মানুষের মধ্যে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার বইছে এখন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে মোবারকবাদ জানিয়েছেন পিতার আরব্ধ কাজটি কন্যার হাতে সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা বলে। শেখ হাসিনাও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভারতের সরকারি ও বিরোধী সব দলকে তথা ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এই সাফল্যের জন্য শেখ হাসিনার কোনো কৃতিত্ব আছে বলে মনে করেন না। ভারতের বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে তিনি ধন্যবাদ জানালেন, কিন্তু কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং ওই সরকারের সবাইকে সমালোচনা করলেন আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানোর অভিযোগে। এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক বলে মনে করি। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে অপারগ হলেও এভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণিয়ে বেগম জিয়া নিজের সংকীর্ণ মন-মানসিকতার যে প্রতিফলন ঘটালেন, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের জনগণের কাছে তিনি অনেকটা ছোট হয়ে গেলেন এই বাক্যবাণগুলোর কারণে! কোনো সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কৃতিত্ব পাওনা হলে তা ঔদার্যের সঙ্গে প্রদান করাই রাজনৈতিক শিষ্টাচার।
এ পর্যায়ে প্রতিবেশী ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতির যে দোষারোপের প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, সে ব্যাপারেও কিছু আলোচনা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন। কোনো দেশ তার প্রতিবেশী কোন দেশ হবে, তা নিজ পছন্দ মোতাবেক বাছাই করতে পারে না। প্রতিবেশীকে শত্রু বানাবে নাকি বন্ধু বানাবে, সেটা রাষ্ট্রের শাসকেরা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেন। ভারত প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে তিন দিক থেকেই বেষ্টন করে রয়েছে এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় এই দেশটি আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার থেকে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ভৌগোলিক সীমানার বিচারে ছোট দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা করলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে ‘রিজিওনাল স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হওয়ার বিশাল সম্ভাবনা ধারণ করছে। সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবাতাস বইছে বাংলাদেশে; এ দেশকে ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার দিন ফুরিয়ে গেছে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া বাংলাদেশের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে গণচীন ও ভারতের অংশগ্রহণে আঞ্চলিক সহযোগিতার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য এখন স্বর্ণ-সম্ভাবনাময় একটা সুযোগ। চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও এ দুটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ–সহযোগিতার ক্ষেত্র দ্রুত প্রসারিত করে চলেছে। বাংলাদেশ তার অবস্থানগত গুরুত্বকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে এ দুই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির সঙ্গে উইন-উইন সহযোগিতার ডাইমেনশনগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজের উন্নয়নের ধারাকে বেগবান করতে পারে।
অতএব, এ দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর সাফল্য প্রশংসার দাবিদার। বিএনপির অর্জন এ ক্ষেত্রে প্রায় শূন্য। বিএনপি ও জামায়াত এখনো পাকিস্তান–প্রীতিতে আচ্ছন্ন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে দেশটি। বাংলাদেশের কিছুই শিক্ষণীয় নেই পাকিস্তান থেকে, একমাত্র ওই দেশের মারাত্মক ভুলগুলো পরিহার করার শিক্ষা ছাড়া। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ও গতি-প্রকৃতি পাকিস্তানের অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশি আশাপ্রদ ও ইতিবাচক। জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার যতবারই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন ছিল, ততবারই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে বৈরী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে কি বাংলাদেশের কোনো ফায়দা হয়েছে? পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ‘সেভেন সিস্টারস’ রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে লালন-পালন ও সশস্ত্র পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের কোনো সরকার যখন এই সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় দেয় কিংবা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও স্থলভাগকে এই সংগঠনগুলোর অস্ত্র পরিবহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়, সেটা কার স্বার্থ হাসিল করে? পাকিস্তানের না বাংলাদেশের? আসামের উলফার ট্রেনিং সেন্টার বাংলাদেশে কেন থাকবে? দশ ট্রাক অস্ত্রের যে চালানটি ধরা পড়েছে, তার নেপথ্য কুশীলব কারা ছিল, সেটিও নিশ্চয়ই একদিন বেরিয়ে আসবে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা এই ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ থেকে বাংলাদেশকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এটা একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপহার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের জনগণের জন্য। এর উপযুক্ত প্রতিদান কি ভারত দেবে না? এটা তো সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে একটি মাইলফলক ঘটনা। ভারত নিশ্চয়ই এর গুরুত্বকে কখনোই খাটো করে দেখবে না। ভারতের ক্ষমতায় বিজেপি থাকুক কি কংগ্রেস থাকুক, এ জন্য শেখ হাসিনার সরকার উভয় দলের কাছেই আদরণীয় থাকবে। বেগম জিয়া বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে তোষামোদ আর অকারণে কংগ্রেসকে গালমন্দ করেও কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারবেন বলে মনে হয় না। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে যথোপযুক্ত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন, সে জন্য তাঁকে অভিনন্দন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments