দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও উগ্রবাদের দৌরাত্ম্য by বদিউল আলম মজুমদার
দুর্নীতি
ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে লাভবান হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাধর কিছু ব্যক্তি
উপকৃত হলেও বৃহত্তর সমাজের জন্য তা চরম ক্ষতিকর। অর্থনীতিবিদদের মতে,
দুর্নীতির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের
দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে সম্প্রতি সারা চেইস তাঁর
Thieves of State: Why Corruption Threatens Global Security (W. W.
Norton, 2015) নামক বহুল জনপ্রিয় বইয়ে দেখিয়েছেন যে দুর্নীতির মতো অতি
পুরোনো সমস্যা সরকারের স্থিতিশীলতা ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জাতীয়
নিরাপত্তার জন্য সর্বাধিক হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে কার্নেগি এন্ডাওমেন্ট
ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এ কর্মরত সারা চেইস ছিলেন একজন সাংবাদিক, পরে যিনি
ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোর্স (আইসাফ) ও মার্কিন জয়েন্ট
চিফ অব স্টাফের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বইটিতে তিনি মূলত
আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের সঙ্গে দেশটির ‘গভর্নেন্স ফেইলিউর’ বা
অপশাসনের যোগসূত্র খুঁজে বের করেছেন। তবে এতে মিসর, তিউনিসিয়া,
উজবেকিস্তান, নাইজেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ
ছাড়া বইটিতে মধ্যযুগের ও রেনেসাঁ আমলের শাসকদের জন্য উপদেশমূলক লেখনীও,
যেগুলোকে ‘মিরর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, আলোচিত হয়। এমনকি এতে একাদশ
শতাব্দীর পারসিয়ান ব্যক্তিত্ব নিজাম-উল-মুলকের সতর্কবাণী তুলে ধরা হয়: একটি
সরকারের অস্তিত্ব নির্ভর করে তার ন্যায়বিচার ও কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা
নিশ্চিত করার ওপর।
সারা চেইস তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বইতে দেখিয়েছেন যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি শুধু সমাজকে অধঃপতনের দিকেই ঠেলে দেয় না, একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক সহিংস উগ্রবাদেরও বিস্তার ঘটায়। তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে যেখানে আইনের শাসন ও সম্পত্তির অধিকারের নিশ্চয়তা অনুপস্থিত, সেখানে নগণ্য আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার পথে অগ্রসর হয়, যা তাদের উগ্রবাদের দিকে ধাবিত করে। তিনি দেখিয়েছেন যে আফ্রিকা, এশিয়া, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশেই মাফিয়ার মতো পদ্ধতি বিরাজমান, যে পদ্ধতিতে অর্থ ওপরের, অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের দিকে প্রবাহিত হয়। তিনি দাবি করেন, এসব দেশে ‘উন্নয়নকাজে বরাদ্দকৃত সম্পদ দুর্বৃত্তায়িত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে বিরাজমান পদ্ধতিকে অর্থ দিয়ে শুধু শক্তিশালীই করে না, এর মাধ্যমে মানুষের বঞ্চনার চেতনাও জাগ্রত হয়, যা তাদের সহিংস প্রতিরোধের দিকে ঠেলে দেয়।’
অন্য যেসব দেশের বিষয়ে চেইস তাঁর বইতে লিখেছেন, সেসব দেশেও ‘ক্লেপটোক্রেসি’ বা চৌর্যবৃত্তির একই ধরনের পদ্ধতি বিরাজমান, যদিও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোতে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন, মিসরের পদ্ধতিতে তিনি সামরিক চৌর্যবৃত্তির কমপ্লেক্স, তিউনেসিয়ার পদ্ধতিকে আমলাতান্ত্রিক চৌর্যবৃত্তি, উজবেকিস্তানের পদ্ধতিকে সোভিয়েত-পরবর্তী চৌর্যবৃত্তি এবং নাইজেরিয়ার পদ্ধতিকে সম্পদ চৌর্যবৃত্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, আরব বসন্ত ছিল ‘চৌর্যবৃত্তিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ’। বইটিতে তিনি মিসরের হোসনি মোবারকের ছেলে গামালের মতো ব্যক্তিকে, যে দেশব্যাপী জনঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল, বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, গামাল ও তার সহযোগীরা মিসরীয় রাষ্ট্রকে ‘ছিনতাই’ করে নিয়ে ‘আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফায়দাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ভূমি ও অন্যান্য সরকারি সম্পদের মালিক বানিয়েছে।’ আর এ ধরনের চৌর্যবৃত্তির ফলাফলই ধর্মীয় উগ্রবাদ। চেইসের মতে, সরকারি অঙ্গনের বাইরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সর্বব্যাপী বিস্তারের কারণে নাইজেরিয়ান খ্রিষ্টান ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত আচরণে অধিক ধার্মিকতার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। উজবেকিস্তানে বয়োবৃদ্ধ স্বৈরশাসকের জ্যেষ্ঠ কন্যা ভুয়া সাহায্য সংস্থা, টেলিকমিউনিকেশন খাতের ঘুষ-দুর্নীতি এবং সম্ভবত নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত এবং এগুলো দেখে অনেক মানুষই হতাশাগ্রস্ত হয়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
সারা চেইসের মতে, ‘আফগান সরকারকে একটি সরকারের পরিবর্তে “ভার্টিক্যালি ইন্টিগ্রেটেড” বা খাড়াভাবে সমন্বিত একটি দুর্বৃত্তায়িত প্রতিষ্ঠান বলাই সংগত, যে প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন নয়, বরং ব্যক্তিগত লাভের লক্ষ্যে সম্পদ হস্তগতকরণ।’ ফলে চেইসের উদ্ধৃত একজন স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘জনগণ সরকারের কার্যক্রমে হতাশ হয়ে আরও ধর্মভীরু হচ্ছে। তারা প্রতিকারের জন্য সৃষ্টিকর্তার দিকে ঝুঁকছে।’
এ ধরনের বিরাজমান চৌর্যবৃত্তিক অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে চেইস আইসাফ ও মার্কিন জয়েন্ট চিফের কর্মকর্তাদের কাছে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললে তাঁরা উত্তর দেন, ‘প্রথমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তার পরে অপশাসনের বিষয়ে ভাবা যাবে।’ কিন্তু চেইসের মতে, আফগানিস্তানের নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে চেইস দাবি করেন যে তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘আমরা যদি তালেবানের উত্থানের পেছনের চালিকাশক্তি সম্পর্কে ব্যবস্থা না নিই, তাহলে যত তালেবানকেই আমরা হত্যা করি না কেন, আমরা কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না।’
একই সাক্ষাৎকারে চেইস ২০১০ সালে জার্মানিতে একটি সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, যে বক্তব্যে তিনি আফগান সরকারকে খাড়াভাবে সমন্বিত একটি অপরাধী প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর বক্তব্যকালে শ্রোতারা তাঁকে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দেন বা দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। শ্রোতাদের মধ্যে ৪৫টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য শেষে বেশ কয়েকজন চেইসের কাছে এসে বলেন, ‘আপনি আমার দেশের বর্ণনাই দিয়েছেন।’ চেইসের মতে, যেসব ব্যক্তি তাঁকে এ কথা বলেন, তাঁদের সবার দেশেই ধর্মীয় উগ্রবাদের সমস্যা রয়েছে।
চেইস তাঁর বইয়ে দাবি করেন যে পাতানো নির্বাচনও মানুষকে ক্ষুব্ধ করতে এবং সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাঁর মতে, আফগানিস্তানের ২০০৯ সালের কারচুপির নির্বাচনও, যা বহু মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে, তালেবানদের সহিংস প্রতিরোধের পেছনে শক্তি জুগিয়েছে।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, সারা চেইসের বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। গ্রন্থটি ধর্মভিত্তিক সহিংস উগ্রবাদের কারণ সম্পর্কে পাঠকদের ধারণাকে আরও স্পষ্ট করেছে। তাঁর মতে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতাবদলের অস্বচ্ছ পদ্ধতিই আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশেও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা সর্বগ্রাসী এবং এর দ্বারা আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সাধারণ মানুষ, যাদের আর্থিক সংগতি সীমিত এবং যাদের জন্য সাধারণত তদবির করার কেউ থাকে না, তারা ঘুষ-উৎকোচের মতো ‘পেটি’ বা ছোটখাটো দুর্নীতির দ্বারা অধিক এবং সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘মেগা’ বা বড় দুর্নীতি অবশ্য তাদের পেটে লাথি মারে ও তাদের দারিদ্র্যকে স্থায়িত্ব দেয়। আর এ কারণে তাদের অনেককে নিজের সন্তানদের অনেক ক্ষেত্রে উগ্রবাদের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে হয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের সমস্যাও আমাদের দেশে বিরাজমান।
আমাদের আশঙ্কা যে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ী চক্রের অব্যাহত চুরি-জোচ্চুরি এবং সাম্প্রতিক বিতর্কিত নির্বাচন তৃণমূলের জনগণকে ক্রমাগতভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলছে, যা আমাদের দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ বিস্তারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। আমাদের আরও আশঙ্কা যে এ সত্য যদি আমরা দ্রুত উপলব্ধি না করি এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমরা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারি। আশা করি, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবিলম্বে বোধোদয় হবে।
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সারা চেইস তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বইতে দেখিয়েছেন যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি শুধু সমাজকে অধঃপতনের দিকেই ঠেলে দেয় না, একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক সহিংস উগ্রবাদেরও বিস্তার ঘটায়। তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে যেখানে আইনের শাসন ও সম্পত্তির অধিকারের নিশ্চয়তা অনুপস্থিত, সেখানে নগণ্য আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার পথে অগ্রসর হয়, যা তাদের উগ্রবাদের দিকে ধাবিত করে। তিনি দেখিয়েছেন যে আফ্রিকা, এশিয়া, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশেই মাফিয়ার মতো পদ্ধতি বিরাজমান, যে পদ্ধতিতে অর্থ ওপরের, অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের দিকে প্রবাহিত হয়। তিনি দাবি করেন, এসব দেশে ‘উন্নয়নকাজে বরাদ্দকৃত সম্পদ দুর্বৃত্তায়িত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে বিরাজমান পদ্ধতিকে অর্থ দিয়ে শুধু শক্তিশালীই করে না, এর মাধ্যমে মানুষের বঞ্চনার চেতনাও জাগ্রত হয়, যা তাদের সহিংস প্রতিরোধের দিকে ঠেলে দেয়।’
অন্য যেসব দেশের বিষয়ে চেইস তাঁর বইতে লিখেছেন, সেসব দেশেও ‘ক্লেপটোক্রেসি’ বা চৌর্যবৃত্তির একই ধরনের পদ্ধতি বিরাজমান, যদিও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোতে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন, মিসরের পদ্ধতিতে তিনি সামরিক চৌর্যবৃত্তির কমপ্লেক্স, তিউনেসিয়ার পদ্ধতিকে আমলাতান্ত্রিক চৌর্যবৃত্তি, উজবেকিস্তানের পদ্ধতিকে সোভিয়েত-পরবর্তী চৌর্যবৃত্তি এবং নাইজেরিয়ার পদ্ধতিকে সম্পদ চৌর্যবৃত্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, আরব বসন্ত ছিল ‘চৌর্যবৃত্তিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ’। বইটিতে তিনি মিসরের হোসনি মোবারকের ছেলে গামালের মতো ব্যক্তিকে, যে দেশব্যাপী জনঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল, বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, গামাল ও তার সহযোগীরা মিসরীয় রাষ্ট্রকে ‘ছিনতাই’ করে নিয়ে ‘আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফায়দাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ভূমি ও অন্যান্য সরকারি সম্পদের মালিক বানিয়েছে।’ আর এ ধরনের চৌর্যবৃত্তির ফলাফলই ধর্মীয় উগ্রবাদ। চেইসের মতে, সরকারি অঙ্গনের বাইরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সর্বব্যাপী বিস্তারের কারণে নাইজেরিয়ান খ্রিষ্টান ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত আচরণে অধিক ধার্মিকতার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। উজবেকিস্তানে বয়োবৃদ্ধ স্বৈরশাসকের জ্যেষ্ঠ কন্যা ভুয়া সাহায্য সংস্থা, টেলিকমিউনিকেশন খাতের ঘুষ-দুর্নীতি এবং সম্ভবত নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত এবং এগুলো দেখে অনেক মানুষই হতাশাগ্রস্ত হয়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
সারা চেইসের মতে, ‘আফগান সরকারকে একটি সরকারের পরিবর্তে “ভার্টিক্যালি ইন্টিগ্রেটেড” বা খাড়াভাবে সমন্বিত একটি দুর্বৃত্তায়িত প্রতিষ্ঠান বলাই সংগত, যে প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন নয়, বরং ব্যক্তিগত লাভের লক্ষ্যে সম্পদ হস্তগতকরণ।’ ফলে চেইসের উদ্ধৃত একজন স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘জনগণ সরকারের কার্যক্রমে হতাশ হয়ে আরও ধর্মভীরু হচ্ছে। তারা প্রতিকারের জন্য সৃষ্টিকর্তার দিকে ঝুঁকছে।’
এ ধরনের বিরাজমান চৌর্যবৃত্তিক অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে চেইস আইসাফ ও মার্কিন জয়েন্ট চিফের কর্মকর্তাদের কাছে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললে তাঁরা উত্তর দেন, ‘প্রথমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তার পরে অপশাসনের বিষয়ে ভাবা যাবে।’ কিন্তু চেইসের মতে, আফগানিস্তানের নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে চেইস দাবি করেন যে তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘আমরা যদি তালেবানের উত্থানের পেছনের চালিকাশক্তি সম্পর্কে ব্যবস্থা না নিই, তাহলে যত তালেবানকেই আমরা হত্যা করি না কেন, আমরা কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না।’
একই সাক্ষাৎকারে চেইস ২০১০ সালে জার্মানিতে একটি সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, যে বক্তব্যে তিনি আফগান সরকারকে খাড়াভাবে সমন্বিত একটি অপরাধী প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর বক্তব্যকালে শ্রোতারা তাঁকে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দেন বা দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। শ্রোতাদের মধ্যে ৪৫টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য শেষে বেশ কয়েকজন চেইসের কাছে এসে বলেন, ‘আপনি আমার দেশের বর্ণনাই দিয়েছেন।’ চেইসের মতে, যেসব ব্যক্তি তাঁকে এ কথা বলেন, তাঁদের সবার দেশেই ধর্মীয় উগ্রবাদের সমস্যা রয়েছে।
চেইস তাঁর বইয়ে দাবি করেন যে পাতানো নির্বাচনও মানুষকে ক্ষুব্ধ করতে এবং সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাঁর মতে, আফগানিস্তানের ২০০৯ সালের কারচুপির নির্বাচনও, যা বহু মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে, তালেবানদের সহিংস প্রতিরোধের পেছনে শক্তি জুগিয়েছে।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, সারা চেইসের বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। গ্রন্থটি ধর্মভিত্তিক সহিংস উগ্রবাদের কারণ সম্পর্কে পাঠকদের ধারণাকে আরও স্পষ্ট করেছে। তাঁর মতে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতাবদলের অস্বচ্ছ পদ্ধতিই আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশেও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা সর্বগ্রাসী এবং এর দ্বারা আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সাধারণ মানুষ, যাদের আর্থিক সংগতি সীমিত এবং যাদের জন্য সাধারণত তদবির করার কেউ থাকে না, তারা ঘুষ-উৎকোচের মতো ‘পেটি’ বা ছোটখাটো দুর্নীতির দ্বারা অধিক এবং সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘মেগা’ বা বড় দুর্নীতি অবশ্য তাদের পেটে লাথি মারে ও তাদের দারিদ্র্যকে স্থায়িত্ব দেয়। আর এ কারণে তাদের অনেককে নিজের সন্তানদের অনেক ক্ষেত্রে উগ্রবাদের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে হয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের সমস্যাও আমাদের দেশে বিরাজমান।
আমাদের আশঙ্কা যে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ী চক্রের অব্যাহত চুরি-জোচ্চুরি এবং সাম্প্রতিক বিতর্কিত নির্বাচন তৃণমূলের জনগণকে ক্রমাগতভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলছে, যা আমাদের দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ বিস্তারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। আমাদের আরও আশঙ্কা যে এ সত্য যদি আমরা দ্রুত উপলব্ধি না করি এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমরা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারি। আশা করি, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবিলম্বে বোধোদয় হবে।
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments