প্রকল্প পরিচালক পাত্তা দেন না কাউকেই -একটি বাড়ি একটি খামার: অনুসন্ধান by শরিফুজ্জামান
‘কিস্তির
জ্বালা’ সিনেমা বানিয়ে তিনি নিজেই জ্বলছেন কিস্তির জ্বালা নামে একটি
চলচ্চিত্র তৈরি করে ফেঁসে গেছেন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের পরিচালক
প্রশান্ত কুমার রায়। বন্ধুকে দিয়ে নতুন চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান খুলে, অজ্ঞাত
সূত্রের টাকা বিনিয়োগ করে এবং নিজে অভিনয় করে এটি এখন আর সিনেমা হলে
দেখাতেও পারছেন না তিনি।
৮৩ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে ক্ষুদ্রঋণে জড়িত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে। তাদের আখ্যা দেওয়া হয়েছে নরপশু, কুচক্রী, শকুন, দেশবিরোধীসহ বিভিন্ন নেতিবাচক পরিচয়ে। এ ছাড়া নারীর প্রতি অবমাননা এবং পুলিশ বাহিনীকে হেয় করার মতো সংলাপ রয়েছে এতে।
প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তার নির্দেশে তা সিনেমা হলে দেখানো হচ্ছে না বলে জানা গেছে। তবে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, এমন কোনো নির্দেশ তিনি পাননি। তাহলে কেন হলে দেখানো হচ্ছে না? এর কোনো জবাব নেই তাঁর।
প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার: প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কথায় কথায় এমনকি অপ্রয়োজনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করে সব পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করেন প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্পের নিরীক্ষা আপত্তির জবাব দিতেও অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন অসংখ্যবার।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কয়েকজন প্রকল্প পরিচালকের বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়েছেন। ভোলা, পটুয়াখালীসহ ১৮ জন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অভিযোগও করেছেন তিনি।
জানতে চাইলে প্রশান্ত কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কাজকর্মে ঝামেলা সৃষ্টি হলে বা কেউ ঝামেলা করতে চাইলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ভয় না পেলে এ দেশে কাজ করানো কঠিন।
প্রতিমন্ত্রী ও সচিবকে পাত্তা দেন না: মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমানকে (রাঙ্গা) পাত্তা দেন না প্রকল্প পরিচালক।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ কাদের সরকারও শুধু সময় পার করছেন। তাঁর কাছে অসংখ্য অভিযোগ জমা হলেও তিনি এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেননি। জনপ্রশাসনে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি এই মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাঁর প্রত্যাশা ছিল আরও বড় মন্ত্রণালয় বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
এদিকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকা অবস্থায় প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁকেও বিভিন্ন সভায় ও আচার-অনুষ্ঠানে হেয় করার অভিযোগ রয়েছে প্রশান্ত কুমারের বিরুদ্ধে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এটুকু বলতে পারি, কারও অন্যায় দাবি বা আবদার শুনি না। কারও কাছে গিয়ে অপ্রয়োজনে বসে থাকি না। আর মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও প্রতিমন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে তাঁর কাজকর্ম খুব একটা নেই।’ দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষের ভুলভ্রান্তি থাকে। এগুলো সংশোধন করেই সামনে এগোবেন।
কিস্তির জ্বালা সিনেমা বানিয়ে জ্বলছেন: ইউটিউবে থাকা আট মিনিটের হাইলাইটস অনুযায়ী, চলচ্চিত্রটির দ্বিতীয় সংলাপে স্বামী বলছেন, ‘তুই মাইয়া মানুষ, আমার কামের কী বুঝবি?’
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারীর জন্য অবমাননাকর এই উক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
চলচ্চিত্রে ঋণ নিয়ে তা শোধ না করতে পারায় এক ঋণগ্রহীতার মেয়েকে ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়। কিস্তি আদায় করা ওই মাঠকর্মী তরুণীকে বলেন, ‘তোমার মুখের কথা আর রূপের বাহার দেখে আমাদের চলে না।’ ঋণের টাকা জোগাড় করতে আরেক বিত্তবানের কাছে গিয়ে ওই তরুণী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন।
ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোকে ‘তথাকথিত এনজিও’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ওরা কিস্তি নেয় না, সুদ নেয়। ওরা ঋণ দেয় না, বিষ দেয়।’ এর বিপরীতে প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এখানে কিস্তি আদায় করা হয় না, এখানে কেউ প্রদান করলে তা গ্রহণ করা হয়।’
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সূত্র জানায়, চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ডে অনুমোদন পাওয়ার পর আপত্তি তোলেন মিহির কান্তি মজুমদার। তাঁর আপত্তি তোয়াক্কা না করে চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা হয়।
জানতে চাইলে মিহির কান্তি মজুমদার এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। আর প্রশান্ত কুমার বলেন, চলচ্চিত্রে আপত্তিকর কিছু আছে বলে তাঁর মনে হয়নি। আর ছবির প্রযোজক এ বি সিদ্দিক বলেন, যেটি সত্য সেটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে অভিনয়ের ভঙ্গিতে বক্তব্য দেন প্রশান্ত কুমার রায়। চলচ্চিত্রটির সার্বিক তত্ত্বাবধানেও তাঁর নাম রয়েছে। তবে তিনি বলেছেন, ৮৩ লাখ টাকা প্রযোজকই জোগাড় করেছেন।
নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে এবং অলাভজনক জেনেও এমন একটি চলচ্চিত্রের পেছনে এত টাকা বিনিয়োগ করার যুক্তি দিতে পারেননি এ বি সিদ্দিক। তবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই সিনেমাটি করেছেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনকে (এফডিসি) পাওনা দেওয়ার লিখিত অঙ্গীকার করে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র নিয়েছেন প্রশান্ত কুমার। এফডিসি ১৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য প্রকল্প পরিচালককে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সিনেমাটি নিয়ে শুরু থেকেই ঝামেলা হয়েছে। তবে এফডিসি এই টাকা মওকুফ করার কথা বলেছে।
সদস্য নেওয়া বন্ধ, অযোগ্যরাই ঢুকছে: অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তৃণমূলে ৬০ সদস্যের সমিতিতে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই শর্ত অনুযায়ী সদস্য হওয়ার যোগ্য নন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে তথা উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে সচ্ছল অনেকেই সমিতিতে ঢুকে পড়েছেন।
গত ৩০ মার্চ প্রকল্পের জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভায় সাংসদ মাহাবুব আরা বেগম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালাবহির্ভূতভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এতে প্রকল্প সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সদস্যদের বের করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি (কার্যবিবরণী, ১৫ এপ্রিল ২০১৫)।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সদস্য নেওয়ার জন্য চাপ দিলে মাঠপর্যায়ে অযোগ্যদের নেওয়া শুরু হয়ে যায়, এ জন্য একপর্যায়ে সদস্য নেওয়া স্থগিত করতে হয়েছে।
খামারের চেয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ বেশি: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে থেকেই দেশের অধিকাংশ বাড়িতে খামার ছিল। বাড়ির আশপাশে পতিত বা আবাদি জমিতে মানুষ বিভিন্ন সবজি চাষ বা হাঁস-মুরগি পালন করত। তবে ঋণ পাওয়ায় হাঁস-মুরগি পালন, কৃষিকাজ, সবজির বাগান ও গরু-ছাগল পালন করা অনেকের জন্য সহজ হয়।
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঋণের বেশির ভাগ টাকাই বিনিয়োগ করা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এক খাত দেখিয়ে টাকা নিয়ে আরেক খাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এমনকি সব সদস্যের উপস্থিতিতে উঠানবৈঠক করে ঋণের টাকা বিতরণের নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় এখন এমন বৈঠক আর হচ্ছে না।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার আকস্মিক কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে উঠানবৈঠক না হওয়ার কথা জানতে পেরে ব্যাংকের বোর্ড সভায় অবহিত করেন এবং তা সভার সর্বশেষ কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, সমিতির কিছু সদস্য টাকা নিয়ে খামারের বদলে ব্যবসায় খাটাচ্ছেন, এটা সত্য। এই মনোভাব পরিবর্তন করারও চেষ্টা চলছে।
টাকাটা আসলে কার: প্রকল্পের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকার মালিক দরিদ্র মানুষ। প্রশান্ত কুমার বলেন, তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা তারাই বংশানুক্রমে ভোগ ও ব্যবহার করবে।
তাঁর এ দাবি প্রসঙ্গে কমপক্ষে ২০ জন সদস্যের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, এই টাকা তাঁদের বলা হলেও এর মালিক প্রকল্প ও উপজেলা প্রশাসন। তাদের মাধ্যমেই ঋণ বরাদ্দ, টাকা তোলা ও জমা দিতে হয়। তাই কার্যত প্রকল্পই সবকিছুর মালিক।
সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আরেকটি বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। তা হলো আবর্তক তহবিলের টাকা সমিতির সদস্যদের। কিন্তু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সমিতির সদস্যরা সঞ্চয় ও উৎসাহ বোনাসের টাকার মালিক। কিন্তু আবর্তক তহবিলের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা সরকারের। এটা সমিতিকে দেওয়া হলেও তারা ব্যবহার করবে, কিন্তু মালিক থাকবে সরকার।
প্রশান্ত কুমার বলেন, মাঠপর্যায়ে কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে আছে, এখন তা আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে সবার সহযোগিতা চান তিনি।
পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দেশ নিরক্ষরমুক্ত করতে (১৯৯৬-২০০০ মেয়াদে) জেলাভিত্তিক সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনের (টিএলএম) পেছনে ৭০০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছিল। এরপর বয়স্ক শিক্ষার নামে (২০০১-২০০৬) প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করে লুটপাটের কারণেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। আর এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এমনই দেখতে পাচ্ছি।’
যোগাযোগ করা হলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব এম কাদের সরকার বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালকের কাছে প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৮৩ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে ক্ষুদ্রঋণে জড়িত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে। তাদের আখ্যা দেওয়া হয়েছে নরপশু, কুচক্রী, শকুন, দেশবিরোধীসহ বিভিন্ন নেতিবাচক পরিচয়ে। এ ছাড়া নারীর প্রতি অবমাননা এবং পুলিশ বাহিনীকে হেয় করার মতো সংলাপ রয়েছে এতে।
প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তার নির্দেশে তা সিনেমা হলে দেখানো হচ্ছে না বলে জানা গেছে। তবে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, এমন কোনো নির্দেশ তিনি পাননি। তাহলে কেন হলে দেখানো হচ্ছে না? এর কোনো জবাব নেই তাঁর।
প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার: প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কথায় কথায় এমনকি অপ্রয়োজনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করে সব পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করেন প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্পের নিরীক্ষা আপত্তির জবাব দিতেও অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন অসংখ্যবার।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কয়েকজন প্রকল্প পরিচালকের বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়েছেন। ভোলা, পটুয়াখালীসহ ১৮ জন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অভিযোগও করেছেন তিনি।
জানতে চাইলে প্রশান্ত কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কাজকর্মে ঝামেলা সৃষ্টি হলে বা কেউ ঝামেলা করতে চাইলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ভয় না পেলে এ দেশে কাজ করানো কঠিন।
প্রতিমন্ত্রী ও সচিবকে পাত্তা দেন না: মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমানকে (রাঙ্গা) পাত্তা দেন না প্রকল্প পরিচালক।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ কাদের সরকারও শুধু সময় পার করছেন। তাঁর কাছে অসংখ্য অভিযোগ জমা হলেও তিনি এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেননি। জনপ্রশাসনে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি এই মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাঁর প্রত্যাশা ছিল আরও বড় মন্ত্রণালয় বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
এদিকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকা অবস্থায় প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁকেও বিভিন্ন সভায় ও আচার-অনুষ্ঠানে হেয় করার অভিযোগ রয়েছে প্রশান্ত কুমারের বিরুদ্ধে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এটুকু বলতে পারি, কারও অন্যায় দাবি বা আবদার শুনি না। কারও কাছে গিয়ে অপ্রয়োজনে বসে থাকি না। আর মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও প্রতিমন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে তাঁর কাজকর্ম খুব একটা নেই।’ দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষের ভুলভ্রান্তি থাকে। এগুলো সংশোধন করেই সামনে এগোবেন।
কিস্তির জ্বালা সিনেমা বানিয়ে জ্বলছেন: ইউটিউবে থাকা আট মিনিটের হাইলাইটস অনুযায়ী, চলচ্চিত্রটির দ্বিতীয় সংলাপে স্বামী বলছেন, ‘তুই মাইয়া মানুষ, আমার কামের কী বুঝবি?’
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারীর জন্য অবমাননাকর এই উক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
চলচ্চিত্রে ঋণ নিয়ে তা শোধ না করতে পারায় এক ঋণগ্রহীতার মেয়েকে ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়। কিস্তি আদায় করা ওই মাঠকর্মী তরুণীকে বলেন, ‘তোমার মুখের কথা আর রূপের বাহার দেখে আমাদের চলে না।’ ঋণের টাকা জোগাড় করতে আরেক বিত্তবানের কাছে গিয়ে ওই তরুণী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন।
ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোকে ‘তথাকথিত এনজিও’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ওরা কিস্তি নেয় না, সুদ নেয়। ওরা ঋণ দেয় না, বিষ দেয়।’ এর বিপরীতে প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এখানে কিস্তি আদায় করা হয় না, এখানে কেউ প্রদান করলে তা গ্রহণ করা হয়।’
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সূত্র জানায়, চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ডে অনুমোদন পাওয়ার পর আপত্তি তোলেন মিহির কান্তি মজুমদার। তাঁর আপত্তি তোয়াক্কা না করে চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা হয়।
জানতে চাইলে মিহির কান্তি মজুমদার এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। আর প্রশান্ত কুমার বলেন, চলচ্চিত্রে আপত্তিকর কিছু আছে বলে তাঁর মনে হয়নি। আর ছবির প্রযোজক এ বি সিদ্দিক বলেন, যেটি সত্য সেটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে অভিনয়ের ভঙ্গিতে বক্তব্য দেন প্রশান্ত কুমার রায়। চলচ্চিত্রটির সার্বিক তত্ত্বাবধানেও তাঁর নাম রয়েছে। তবে তিনি বলেছেন, ৮৩ লাখ টাকা প্রযোজকই জোগাড় করেছেন।
নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে এবং অলাভজনক জেনেও এমন একটি চলচ্চিত্রের পেছনে এত টাকা বিনিয়োগ করার যুক্তি দিতে পারেননি এ বি সিদ্দিক। তবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই সিনেমাটি করেছেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনকে (এফডিসি) পাওনা দেওয়ার লিখিত অঙ্গীকার করে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র নিয়েছেন প্রশান্ত কুমার। এফডিসি ১৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য প্রকল্প পরিচালককে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সিনেমাটি নিয়ে শুরু থেকেই ঝামেলা হয়েছে। তবে এফডিসি এই টাকা মওকুফ করার কথা বলেছে।
সদস্য নেওয়া বন্ধ, অযোগ্যরাই ঢুকছে: অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তৃণমূলে ৬০ সদস্যের সমিতিতে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই শর্ত অনুযায়ী সদস্য হওয়ার যোগ্য নন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে তথা উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে সচ্ছল অনেকেই সমিতিতে ঢুকে পড়েছেন।
গত ৩০ মার্চ প্রকল্পের জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভায় সাংসদ মাহাবুব আরা বেগম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালাবহির্ভূতভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এতে প্রকল্প সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সদস্যদের বের করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি (কার্যবিবরণী, ১৫ এপ্রিল ২০১৫)।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সদস্য নেওয়ার জন্য চাপ দিলে মাঠপর্যায়ে অযোগ্যদের নেওয়া শুরু হয়ে যায়, এ জন্য একপর্যায়ে সদস্য নেওয়া স্থগিত করতে হয়েছে।
খামারের চেয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ বেশি: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে থেকেই দেশের অধিকাংশ বাড়িতে খামার ছিল। বাড়ির আশপাশে পতিত বা আবাদি জমিতে মানুষ বিভিন্ন সবজি চাষ বা হাঁস-মুরগি পালন করত। তবে ঋণ পাওয়ায় হাঁস-মুরগি পালন, কৃষিকাজ, সবজির বাগান ও গরু-ছাগল পালন করা অনেকের জন্য সহজ হয়।
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঋণের বেশির ভাগ টাকাই বিনিয়োগ করা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এক খাত দেখিয়ে টাকা নিয়ে আরেক খাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এমনকি সব সদস্যের উপস্থিতিতে উঠানবৈঠক করে ঋণের টাকা বিতরণের নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় এখন এমন বৈঠক আর হচ্ছে না।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার আকস্মিক কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে উঠানবৈঠক না হওয়ার কথা জানতে পেরে ব্যাংকের বোর্ড সভায় অবহিত করেন এবং তা সভার সর্বশেষ কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, সমিতির কিছু সদস্য টাকা নিয়ে খামারের বদলে ব্যবসায় খাটাচ্ছেন, এটা সত্য। এই মনোভাব পরিবর্তন করারও চেষ্টা চলছে।
টাকাটা আসলে কার: প্রকল্পের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকার মালিক দরিদ্র মানুষ। প্রশান্ত কুমার বলেন, তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা তারাই বংশানুক্রমে ভোগ ও ব্যবহার করবে।
তাঁর এ দাবি প্রসঙ্গে কমপক্ষে ২০ জন সদস্যের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, এই টাকা তাঁদের বলা হলেও এর মালিক প্রকল্প ও উপজেলা প্রশাসন। তাদের মাধ্যমেই ঋণ বরাদ্দ, টাকা তোলা ও জমা দিতে হয়। তাই কার্যত প্রকল্পই সবকিছুর মালিক।
সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আরেকটি বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। তা হলো আবর্তক তহবিলের টাকা সমিতির সদস্যদের। কিন্তু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সমিতির সদস্যরা সঞ্চয় ও উৎসাহ বোনাসের টাকার মালিক। কিন্তু আবর্তক তহবিলের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা সরকারের। এটা সমিতিকে দেওয়া হলেও তারা ব্যবহার করবে, কিন্তু মালিক থাকবে সরকার।
প্রশান্ত কুমার বলেন, মাঠপর্যায়ে কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে আছে, এখন তা আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে সবার সহযোগিতা চান তিনি।
পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দেশ নিরক্ষরমুক্ত করতে (১৯৯৬-২০০০ মেয়াদে) জেলাভিত্তিক সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনের (টিএলএম) পেছনে ৭০০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছিল। এরপর বয়স্ক শিক্ষার নামে (২০০১-২০০৬) প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করে লুটপাটের কারণেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। আর এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এমনই দেখতে পাচ্ছি।’
যোগাযোগ করা হলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব এম কাদের সরকার বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালকের কাছে প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
No comments