শিল্পের বিকাশে চাই শ্রমিকের আস্থা
মহান মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ থেকে ১২৭ বছর আগে খোদ মার্কিন মুলুকের হে মার্কেটে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর যে বিজয় হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় শ্রমঘণ্টা আট ঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর বিশ্বব্যাপী শ্রমিকেরা এই দিনটিকে বিজয়, উৎসব ও অনুপ্রেরণার দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। কিন্তু বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আজ এক ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে ধস নামার ফলে বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসী ভূমিকায় পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকশ্রেণী আক্রমণের সম্মুখীন।
এদিন এখন আবার সংগ্রামের দিবসে পরিণত হয়েছে। বিগত ১২৭ বছরে প্রযুক্তিবিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী ঘটেছে অভূতপূর্ব বিজয়। মানুষ উন্নত থেকে আরও উন্নততর জীবন যাপন করছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই চিত্রটা এখনো উল্টো। এখনো আমাদের শ্রমিক কর্মচারী তাঁর শ্রমের ন্যায্য মজুরি ও ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে দেশের বৃহৎ কলকারখানাগুলো আজ বন্ধ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী জুট মিল, এশিয়ার বৃহত্তম পেপার মিল খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলসহ বড় বড় রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ করার ফলে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাত একেবারে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে দেশের প্রায় সব কলকারখানা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আজ হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন এবং পরিবার-পরিজনসহ বসবাস করছেন এক অনিশ্চয়তায়। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা আজও বাঁচার মতো মজুরি, আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ মোতাবেক অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ অন্যান্য ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত। আমাদের দেশের সিংহভাগ নির্মাণ, চাতাল, পরিবহন ও গার্মেন্টসজাতীয় শিল্পে অসংগঠিত শ্রমিকদের দিয়ে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করানো হয়। তাঁদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না, তাঁদের কোনো ছুটির বিধান নেই, সমকাজে সমমজুরি দেওয়া হয় না, শহর-উপশহরগুলোতে বাড়িভাড়া দফায় দফায় বৃদ্ধি করার ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের আয়ের একটি বড় অংশ বাড়িভাড়া বাবদ পরিশোধ করতে হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য অযৌক্তিকভাবে দফায় দফায় বৃদ্ধি করার ফলে শ্রমিক-কর্মচারীরা আরও বিপাকে। প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও পুষ্টির অভাবে ন্যূনতম মানসম্মত খাবার খেতে না পারায় শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন রোগ ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
এর মধ্যে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশা এবং সরকারের ভ্রান্তনীতির ফলে বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ার জাঁতাকলে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি ও শিল্প পরিস্থিতি গুরুতর হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ায় জাতীয় শিল্প বিকাশের পরিবর্তে দেশ ক্রমে বি-শিল্পায়ন হচ্ছে। ফরমাল খাতের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইনফরমাল খাত। আমাদের দেশের শ্রমিকেরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আইএলও-স্বীকৃত ৮৭ ও ৯৮ ধারার কনভেনশন এবং প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী সংগঠন করতে চাইলে মালিক এবং সরকারি প্রশাসন মরিয়া হয়ে ওঠে তা ধ্বংস করতে। অথচ ইতিহাস বলে শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষিবিপ্লব হয়েছে। এই শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্ন সৃষ্টির নির্মাতা হিসেবে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তা আমাদের দেশের লুটেরা ধনিকেরা কোনোভাবেই বুঝতে চায় না। তাই শ্রমিকদের অনাস্থা নয় বরং আস্থায় নিয়েই শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ সম্ভব। আমাদের দেশের সাধারণ শ্রমিকেরা কাজে দক্ষতা এবং মেধার দিক থেকে অতুলনীয়। শ্রমিকেরা জানেন একটি শিল্পকারখানার সঙ্গে মানুষের রুটি-রুজির সম্পর্ক এক ও অভিন্ন। তাই কলকারখানার ক্ষতি কোনোভাবেই শ্রমিকেরা চান না। হাজারীবাগ ট্যানারিসহ যেখানে দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন আছে, সেখানে সেই প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত। জাতির প্রত্যাশা একজন দেশপ্রেমিক শিল্পোদ্যোক্তা অবশ্যই শিল্প, শ্রমিক এবং দেশের স্বার্থ দেখবেন। কিন্তু আমাদের দেশের মালিকেরা এই তিনটির একটির কথা কখনো ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন, কীভাবে তাঁরা তাঁদের মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলবেন।
তাই আমাদের দেশে শিল্প বিকাশের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে বিদেশি পণ্যের বাজার। অবশ্য এ জন্য মালিকদের বৈরী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সরকারের ভ্রান্তনীতিও সমভাবে দায়ী। এর পাশাপাশি এটাও ঠিক যে দেশে সুষ্ঠু ও দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়নের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে একধরনের দলবাজি ট্রেড ইউনিয়ন। এরা সব সময় মালিক বা সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। এরা শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত বন্ধু নয়। সাধারণ শ্রমিক ও দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন কোনো সময় শিল্প বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। তাই শ্রমিক-কর্মচারী তথা ট্রেড ইউনিয়নের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। প্রতিনিধিত্বমূলক এবং দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন কোনো সময় শিল্পবিকাশে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে না। কারণ, তারা জানে, এ শিল্পের ওপর শ্রমিক বা তাঁর পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। আমাদের দেশের অর্থনীতি, জাতীয় শিল্প এবং শ্রমশক্তিকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেম। দেশে যে জনশক্তি ও সম্পদ রয়েছে, সেটা পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। যে উন্নয়নে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষা হবে সেই কাজে শ্রমজীবী মানুষ তাঁর সর্বস্ব দিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। বিনিময়ে শ্রমিকেরা চান তাঁর ন্যায্য মজুরি, যার মাধ্যমে একজন শ্রমিক তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারেন। শ্রমিকেরা তাঁদের মৌলিক অধিকার ও সামাজিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি পান। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদানের মাধ্যমে শিল্প বিকাশ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমেই জাতীয় অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। তবেই শিল্প, শ্রমিক, দেশ ও জাতি সমৃদ্ধতর হবে।
ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
No comments