যে প্রশ্নের জবাব খালেদাকে দিতে হবে
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের পর বিএনপির নেতারা বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ রায় দেওয়া হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সরকার বিএনপির নেতা খালেদা জিয়ার রাজনীতিকে ধ্বংস করতে চায়। তাঁরা বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারেরও অভিযোগ এনেছেন। আমরা মনে করি, সত্যের খাতিরে বিএনপির নেতাদের এসব অভিযোগের ময়নাতদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে আইন প্রয়োগকারী তদন্ত সংস্থা ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করবে, এটি মেনে নেওয়া যায় না। তবে বিএনপির নেতাদের এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার আগে তাঁদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন রাখা জরুরি বলে মনে করছি। সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা ব্যবহার করছে—তাঁদের এই অভিযোগ যদি সত্যও হয়, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল জেটি ঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটকের ঘটনাটি তো মিথ্যা নয়। সে সময় আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন না। আমাদের অবশ্যই জানতে হবে, সেই ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি কোথা থেকে এসেছিল,
কারা পাঠিয়েছিল, কোথায় পাঠাচ্ছিল; এর প্রেরক ও প্রাপকের নাম কী? সেই প্রাপক ও প্রেরক যদি বিদেশি হয়ে থাকে, বাংলাদেশের কারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, কারা তাদের সহায়তা করেছে; সেসব প্রশ্নের জবাবও বিএনপির নেতৃত্ব, আরও নির্দিষ্ট করে বললে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দিতে হবে। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রায় দেওয়া হয়েছে বলে দায় এড়ানো যাবে না। তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই যে বর্তমান সরকার মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। কিন্তু বিএনপি তথা চারদলীয় জোট সরকার সেই সুযোগটি কেন আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিল? ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ঘটনাটি ঘটেছে; এর পরও বিএনপি প্রায় আড়াই বছর ক্ষমতায় ছিল। ওই সময়ে কেন তারা এ ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করল না? কেন অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হলো না? কেন আটককারী দুজন নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্যকে তদন্তের নামে হয়রানি ও নির্যাতন করা হলো? এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলে বিএনপি সম্পর্কে মানুষের মনে যে সন্দেহ ও সংশয়, সেটাই আরও ঘনীভূত হবে। মনে রাখা দরকার, এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জড়িত। দেশের বা দেশের বাইরে যারাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক না কেন, তারা বাংলাদেশের বন্ধু নয়; বরং শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। বিএনপি সরকারের উচিত ছিল সেই শত্রুদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা। বিএনপির কোনো কোনো নেতা ও শুভানুধ্যায়ী বলতে চেষ্টা করেছেন যে তাঁরা যা করেছেন তা জাতীয় স্বার্থে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের জাতীয় স্বার্থের সংঘাত হলে সেটি মীমাংসা করার আন্তর্জাতিক আইন আছে। সে আইন কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশী বা অন্য কোনো দেশ যেমন তাদের জাতীয় স্বার্থে এমন কিছু করতে পারে না, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থে আঘাত করে।
তেমনি আমরাও জাতীয় স্বার্থে এমন কিছু করতে পারি না, যাতে অন্য কোনো দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। বিএনপির নেতৃত্বকে এও মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কাশ্মীর সমস্যা নেই যে এর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ‘যুদ্ধ’ জিইয়ে রাখতে হবে। আমরা যুদ্ধ জিইয়ে রাখলে প্রতিপক্ষও যুদ্ধ জিইয়ে রাখবে। তার পরিণাম কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। এর পাশাপশি আমরা স্মরণ করতে পারি, ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যার দায়ে বিএনপি সরকারই শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইসহ সাত জঙ্গিকে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল (যদিও সেই দণ্ড কার্যকর হয়েছিল পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে)। বিএনপি সরকার সেটি করতে চেয়েছিল বলেই হয়েছে এবং সে জন্য তারা দেশে-বিদেশে প্রশংসাও পেয়েছে। কিন্তু ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা, কিবরিয়া হত্যা মামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরীর ওপর হামলা, যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা, পল্টনে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলা কিংবা পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বোমা হামলা মামলাগুলোর ব্যাপারে তারা কেন নিশ্চুপ ছিল, সেই প্রশ্নের জবাব নেই। এ ঘটনাগুলো হয় আগের আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে অথবা বিএনপি সরকারের আমলেই ঘটেছে। এসব অঘটনের হোতা হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তাঁর সহযোগীরা।
সেই সহযোগীদের সঙ্গে বিএনপির কার কী সম্পর্ক ছিল, কোন মন্ত্রী বা মেয়র বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করেছেন, বিএনপির নেতৃত্বের কাছে দেশবাসী সেসব প্রশ্নেরও জবাব চাইবে। হরকাতুল জিহাদ বা জেএমবি ঘোষিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন। তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। কিন্তু বিএনপি তো একটি গণতান্ত্রিক দল। তাদের নেতা-কর্মীরা কীভাবে এই ভয়ংকর সংগঠনের সঙ্গে হাত মেলান, এসব অঘটনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন? সাম্প্রতিক কালে নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন সফল না হওয়া বা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারার কারণ নিশ্চয়ই বিএনপির বিজ্ঞ নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। জনগণ তাঁদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি সমর্থন করলেও সেই দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াওকে সমর্থন করেনি। তাহলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের মতো ঘটনাকে কীভাবে জনগণ অনুমোদন দেবে? এ ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি বিচারিক, আরেকটি রাজনৈতিক। বিচারিক দায়িত্ব বিএনপি সরকার সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারও কিবরিয়া হত্যাসহ অনেক হত্যা মামলার বিচার করতে পারেনি। সেটি তাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা। কিন্তু সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিএনপি নিজেদের বিযুক্ত করতে না পারা বিএপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলে মনে করি। একজন লুৎফুজ্জামান বাবর কিংবা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পাপ দলটির গায়ে স্থায়ী কালিমা লেপন করে দিয়েছে। সন্ত্রাসী ও নাশকতার ঘটনার সঙ্গে বিএনপির যেসব নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ বা উপদেষ্টা জড়িত বলে খবর বের হয়েছিল, বিএনপি নেতৃত্ব তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, তদন্ত পর্যন্ত করেননি।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবেই বিএনপিকে দেখতে চাই। গণতান্ত্রিক আচরণই তার কাছে প্রত্যাশিত। ক্ষমতায় থাকতে কারা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল, কারা দলীয় নেতৃত্বকে কুপরামর্শ দিয়েছে, সেটি বিএনপির স্বার্থেই খুঁজে বের করা দরকার। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের মতো দেশের দুটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সংস্থার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা উল্লিখিত আসামিগণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রেখে উলফাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালানের মাধ্যমে আনয়নপূর্বক এই মামলার ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। এতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহ-অবস্থানের ব্যত্যয় ঘটার আশঙ্কার প্রতি উল্লিখিত আসামিগণ কোনো গুরুত্বই দেননি। তাঁদের এরূপ আচরণে এটাই প্রতীয়মান হয় যে ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের অব্যাহত সুসম্পর্ককে বিনষ্ট করার দুরভিসন্ধি নিয়েই উক্ত আসামিগণ উলফা নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।’ আদালত আরও বলেছেন, ‘এই মামলার ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে তাঁরা উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ অন্যান্য আসামির সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মামলার ঘটনা সংঘটনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
তা না হলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে (বেগম খালেদা জিয়া) পিডব্লিউ-৩৭ মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি ডিজিএফআইয়ের প্রধান হিসেবে এই মামলাসংক্রান্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের ঘটনা টেলিফোনে অবহিত করলে তিনি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ঘটনাটি অবগত আছেন এবং একটি কমিটি করে দেবেন বলে পিডব্লিউ-৩৭-কে জানান। এত বড় একটি ঘটনার বিষয়ে অবহিত হয়ে কোনোরূপ কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে তৎকালীন সরকারপ্রধানের এরূপ নীরব ভূমিকা পালনও রহস্যজনক বলে প্রতীয়মান হয়। একইভাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ঘটনার প্রায় এক বছর পর ঘটনাস্থলের চাক্ষুষ সাক্ষী পিডব্লিউ-৯ সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ও পিডব্লিউ-১০ সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিনকে অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছেন বলে তাঁরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন।’ এতে বলা হয় ‘দোষ স্বীকারোক্তি প্রদানকারী আসামি এনএসআইয়ের কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তিতে এসব তথ্যও বেরিয়ে এসেছে যে তাঁরা আরও কিছু দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে হাজার হাজার ডলার ও আকর্ষণীয় উপহারসামগ্রী গ্রহণ করেছেন এবং উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ অন্য দেশের আতিথেয়তা গ্রহণপূর্বক দেশ-বিদেশে একাধিক গোপন মিটিংয়ে উপস্থিত থেকেছেন।
তাঁদের এসব উক্তি থেকে বোঝা যায় যে তাঁরা নিজ দেশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে গোটা জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাই সামরিক-বেসামরিক এসব বিপথগামী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণকে অবশ্যই তাঁদের কৃত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করাই সমীচীন হবে।’ ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের এই পর্যবেক্ষণ সর্বাংশে সঠিক না-ও হতে পারে। যে আইনে এই মামলা হয়েছে, তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, মানি। কিন্তু যাঁরা অপরাধ সংঘটিত করেছেন এবং যাঁরা জেনেও প্রতিকার করেননি, তাঁদের সবার অপরাধ সমান নয়; যদিও একই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতে কেউ নিজেকে লঘু অপরাধী প্রমাণ করতে পারলে তাঁর শাস্তি লঘু হবে। কেউ নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে তিনি বেকসুর খালাসও পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি এবং সেই দলের নেতা হিসেবে খালেদা জিয়াকে অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর মনে রাখা দরকার, একজন সিরাজ সিকদারের মৃত্যু এখনো আওয়ামী লীগকে তাড়া করে ফিরছে। তাহলে এতগুলো সন্ত্রাসী ঘটনা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেন বিএনপিকে ছাড় দেবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments