রানা প্লাজা ধস- শরীরে লাশের গন্ধ by আনোয়ার হোসেন
২৪ এপ্রিল আমার অবস্থান ছিল ধসে পড়া রানা প্লাজা থেকে এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে। আগের দিন রাতে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে।
২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন আমদানি করা ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করবেন। সেই অনুষ্ঠান কভার করার কথা ছিল। নাশতা সেরে প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় খবর আসে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার। একটা রিকশা নিয়ে ঘটনার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই ধসে পড়া ভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যাই।
২০০ গজ দূর থেকে দেখি চারদিক ধুলায় অন্ধকার। শুনতে পাই মানুষের চিৎকার-আহাজারি। আমার রিকশাটা ধসে পড়া ভবনের ১০০ গজের মধ্যে, রাজালাখ ফার্মের সামনে গেলে কয়েকজন যুবক চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ভাই, নেমে যান। আহতদের হাসপাতালে নিতে হবে।’ আহত একজন নারীশ্রমিককে নিয়ে আসা হলো। আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে একজন শ্রমিককে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দেওয়া হলো। রিকশাভাড়া দেওয়ার সময়ও পাইনি। রিকশাচালকও আমার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সময় নষ্ট করার চেয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করাকেই শ্রেয় মনে করে চলে যান। তিনি আমার মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেলেন।
সাংবাদিকতার সুবাদে অনেক হতাহতের ঘটনা দেখেছি। কিন্তু এত বড় ঘটনা, এত বড় ভবনের ধ্বংসাবশেষ, এত মানুষের আহাজারি দেখিনি। আমি যখন ধসে পড়া ভবনের গোড়ায়, তখন ঘড়িতে সকাল নয়টা পাঁচ কি ১০ মিনিট। তখনো অ্যাম্বুলেন্স আসেনি। ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতাও শুরু হয়নি। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ করছিলেন স্থানীয় কারখানার শ্রমিক, বাজারের দোকানি ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
এরই ফাঁকে আমাদের প্রধান প্রতিবেদক শরিফুজ্জামানকে ফোন করি। ঘটনার ভয়াবহতা শুনে তিনি আমাকে সেখানে থাকার নির্দেশ দেন। জানান আরও লোক পাঠাচ্ছেন। ফোন করেন প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি ও বার্তা সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী। তাঁরা নানা দিকনির্দেশনা দেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই আমাদের সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়কে একাধিকবার ফোন করি। নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না। পরে জানতে পারি, অরূপ রায়ও দুর্ঘটনার পর পরই সেখানে অবস্থান করছিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক সাহাদাত পারভেজকে দেখতে পাই। একপর্যায়ে সাভারের এনাম মেডিকেলের দিকে রওনা করি। সকাল সাড়ে ১০টার সময় যখন নিচতলার মর্গের সামনে আসি, তখন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। প্রথম দফায় ২৯টি মৃতদেহ গুনলাম। এরপর ৩৫, ৪০, ৫০ করে সংখ্যা বাড়তে থাকে। বেলা ১১টার মধ্যে মর্গ ভরে যাওয়ায় লাশগুলো রাখা শুরু হয় নির্মাণাধীন একটি গাড়ির শেডে। সংখ্যা বাড়ে আর অনলাইনের সেলিম খান (বার্তা সম্পাদক) তাড়া দিতে থাকেন আপডেট দেওয়ার জন্য। এ সময় বারবার অফিস থেকে ফোন আসতে থাকে। বিশেষ প্রতিনিধি টিপু সুলতান পরামর্শ দিলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আবেগ ধরে রাখা কঠিন। তার পরও ঘটনাগুলো যেন নোট করে রাখি।’
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা এসে পৌঁছান ঘটনাস্থলে। তাঁকে এনাম মেডিকেলসহ হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিতে বলে আমি ধসে পড়া ভবনের কাছে চলে যাই। যাওয়ার সময় এনাম মেডিকেলেই ৭৮টি নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি।
ধসে পড়া ভবনের সামনে দেখি বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন, অপরাধবিষয়ক সেলের প্রধান কামরুল হাসান, বিশেষ প্রতিনিধি আশীষ-উর-রহমান, সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়কে। প্রতিবেদন কী কী হতে পারে এর একটি তালিকা তৈরি করেন শওকত হোসেন। এর পর থেকে ১৪ মে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত ধসে পড়া ভবন, সাভার অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠ, বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছি।
ভবনের বিভিন্ন কোনায় জীবিত ও আহত অনেকের বাঁচার আকুতি দেখেছি। উদ্ধার করতে হলে বিম বা কলাম কাটতে হবে। এমনই একটি কলামের পাশে আটকা ছিলেন বগুড়ার সুরুজ। যেদিন উদ্ধার অভিযান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, তার আগের দিন অধর চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে এক বৃদ্ধাকে দেখি। ছেলের মৃতদেহ পাননি তিনি। নাম জানতে চাইলে একজন বলেন, ‘সুরুজ মিয়া, বাড়ি বগুড়ায়।’ আমি মুখ ফসকে বলে ফেলি, ‘সুরুজকে জীবিত আটকে থাকতে দেখেছিলাম’। তখনই সুরুজের মা আমাকে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। খুব মন খারাপ হয়েছিল আমার, আমি কি কথাটা বলে ভুল করলাম!
ভবনধসের পাঁচ-ছয় দিন পর যত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, তার কোনোটিরই চেহারা দেখে শনাক্ত করার অবস্থা ছিল না। সেনাবাহিনীর কর্মীরা মৃতদেহের পকেটে থাকা মুঠোফোন কিংবা পরিচয়পত্র দেখে লাশ শনাক্ত করতেন। এমনই একটি মৃতদেহের পকেটে থাকা মুঠোফোনের সিম খুলে অন্য ফোনে নিয়ে ‘মা’ নামে সেভ করা নম্বরে ফোন করেন সেনা কর্মকর্তা ফারহানা। ওপাশ থেকে ‘মা’ বলে ওঠেন, ‘আমি জানতাম, তুই বেঁচে আছিস।’ তখনই ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকেন সেনা কর্মকর্তাটি। পরে ফারহানা জানান, তিনি আর কোনো দিন মৃতদেহের সঙ্গে থাকা সিম থেকে ফোন করেননি। সেভ করা নম্বর নিয়ে অন্য সিম থেকে ফোন করেছেন।
একটি নারী মৃতদেহের সঙ্গে দুটি পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। একটিতে নাম মোমেনা, অন্যটিতে সাজেদা। সঙ্গে থাকা ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যায় একটি চিঠি। চিঠির ভাষায় মনে হয়, ওই নারী শ্রমিকের প্রিয়তম লিখেছে। চিঠির শেষে লেখা ‘আর প্লাস এম’। সবাই ধারণা করে, এম মানেই মোমেনা।
পচে-গলে যাওয়া লাশের দুর্গন্ধ একপর্যায়ে অসহনীয় হয়ে ওঠে। লাশের দুর্গন্ধ শরীরে নিয়ে বাসায় ফিরে খাবারে, ঘুমাতে গেলে বালিশে কিংবা কাপড়ে সেই দুর্গন্ধ পেতাম।
এই তিন সপ্তাহে আরও দুটি বড় ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। শাহীনা নামের এক নারীশ্রমিককে উদ্ধার করতে টানা ৩৫ ঘণ্টার অভিযানও ব্যর্থ হয়। ওই অভিযানটা কাছ থেকে দেখেছি। পরে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে এজাজউদ্দিন কায়কোবাদ মারাও যান। রবিন নামে শাহীনার ছোট্ট একটি ছেলে আছে। আমার ও অরূপ রায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয় ইংল্যান্ডপ্রবাসী এক দম্পতির। তাঁরা রবিনকে নিজের সন্তান হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাহীনার বাবা মেয়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে রবিনকে দেননি। জানি না, এখন রবিন কেমন আছে।
সর্বশেষ রেশমার উদ্ধার। ১৭ দিন পর রেশমাকে যে গর্ত থেকে বের করা হয়, সেই ঘটনা গর্তের মুখ থেকেই দেখেছি। উদ্ধারের পর রেশমাকে সাভার সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সিএমএইচে গেলে রেশমার সঙ্গে কথা বলা যাবে—এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেদিকে রওনা দিই। কিন্তু তখন কোনো যানবাহন পাইনি। হেঁটে, অন্য একজনের মোটরসাইকেলের সাহায্য নিয়ে সিএমএইচে গিয়ে রেশমার সঙ্গে কথা বলি উদ্ধারের এক ঘণ্টার মধ্যেই। অবশ্য এর জন্য অনেক কৌশল করতে হয়েছে।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনা আমার সাংবাদিক জীবনের এক মর্মান্তিক ঘটনা। সাংবাদিক হিসেবে রোমাঞ্চকর খবর পরিবেশন করার একটা আগ্রহ থাকে ঠিকই, কিন্তু শত শত লাশের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি না হওয়াই মঙ্গল।
আনোয়ার হোসেন: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
No comments