সহজিয়া কড়চা- সৌজন্যবোধ ও বাঙালির কথাবার্তার কথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বনে-জঙ্গলে বাস করলে আলাদা কথা, কিন্তু সংসারে বাস করলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করতেই হয়, এমনকি কখনো শত্রুর সঙ্গেও।
সমঝোতা
হোক বা না হোক, শত্রুর সঙ্গেও সৌজন্যমূলক আচরণ মনুষ্যত্বের পরিচয়।
শত্রুকে ছলে-বলে-কৌশলে পরাজিত করা এক কথা, আর তাকে অপমান করা আরেক কথা।
শত্রুকে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করার মধ্যে বাহাদুরি তো নেই-ই, নিজের নিচুতারই
প্রকাশ ঘটে। পুরো পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই বাসের মধ্যে লেখা
দেখেছি ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’, যদিও বাংলাদেশেই বাসের মধ্যে যাত্রীদের
সঙ্গে বাস কন্ডাক্টরের বচসা শুধু নয়, মারামারি পর্যন্ত হয়। ভাড়া নিয়ে
মারামারি হওয়া খুব স্বাভাবিক। পা মাড়ানো নিয়ে তর্ক করতে করতেও হাত চলে।
কার আগে কে বসবে, তা নিয়ে ধস্তাধস্তি ও ঘুষাঘুষি। ঘুমের আবেশে পাশের
যাত্রীর ঘাড়ের ওপর ঢলে পড়া নিয়ে ধাক্কাধাক্কি ও অশ্লীল বাক্যবিনিময়।
যেখানে দশজন বঙ্গসন্তান আছে, সেখানে কথাবার্তা হবে না, তা ভাবাই যায় না।
এবং বাংলা ভাষাভাষী কথা বলতে গেলে শরীরের নিচের অংশের যেসব অঙ্গ গোপনীয়,
যেসব প্রত্যঙ্গের উল্লেখ খুবই লজ্জার, সেগুলোর নাম না নিলে তার শান্তি নেই।
তা ছাড়া বাঙালি কথায় কথায় অবাঞ্ছিত কেশ (উর্দু ও হিন্দিতে চুলকে যা বলা
হয়) চাঁছতে বা ছিঁড়তে চায়। স্ল্যাং—পশ্চিমের, বিশেষ করে আমেরিকার
মানুষও খুবই ব্যবহার করে। তবে তারা বাঙালিকে হারাতে পারেনি।
মানুষ নানাভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে। মুখে সামনাসামনি সংলাপে, লিখে চিঠিপত্রে, টেলিফোনে এবং বর্তমানে স্কাইপে-আইফোনে। দশ হাজার বছর বাঙালি মুখে কথা বলে বিপত্তি ঘটিয়েছে। তিন-চার শ বছর যাবৎ চিঠি লেখালেখি করছে। প্রথম লিখেছে সংস্কৃত ও ফারসিতে। ওই দুই বনেদি ভাষায় অশ্লীলতা নেই বললেই চলে। আঠারো শতক থেকে মাতৃভাষা বাংলায় চিঠি লেখা শুরু করে। বাঙালির চিঠির ভাষাও যে কত জঘন্য ও বিপজ্জনক হতে পারে, তা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানে। চিঠির কারণে কত সংসার ভেঙেছে, কতজন খুন হয়েছে, কত রকম বিপত্তি ঘটেছে, তার হিসাব নেই। উগ্র রাজনৈতিক চিঠি চালাচালির কারণে ভারতবর্ষের মতো একটি প্রকাণ্ড জিনিস ভেঙে তিন টুকরা হয়। তবে সেকালের মানুষের ভাষা যদি কঠোরও হয়ে থাকে, অশ্রাব্য ও অভব্য ছিল না।
সেকালের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিবাদ—তা ব্যক্তিগত কারণেই হোক বা নীতিগত কারণেই হোক, কিছুমাত্র কম ছিল না। গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষ বসুর ব্যক্তিগত ও নীতিগত দূরত্ব ছিল। তা খুব খারাপ পর্যায়ে যায়। এমন সময় গান্ধীজি বাংলায় সফরে আসেন। নেতাজিপন্থীরা তাঁকে অসম্মান করতে চান। নেতাজি তাঁদের প্রতিহত করেন এবং কাগজে বিবৃতি দিয়ে বলেন, গান্ধীজিকে যেন কোনো রকম অমর্যাদা করা না হয়।
ব্যক্তিগত সৌজন্যের বহু দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের রাজনীতিকদের জীবনে পাওয়া যাবে। আইয়ুব খান ছিলেন একনায়ক। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি। তিনি পাঞ্জাবি ছিলেন না, জাতিতে ছিলেন পাঠান। উচ্চশিক্ষা খুব বেশি ছিল, তা বলা যাবে না। আলীগড়ে পড়াশোনা করেছেন। বিলেতেও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সুশিক্ষা পেয়েছেন। পাকিস্তান যদি প্রতিষ্ঠিত না হতো এবং ব্রিটিশ সরকার যদি আরও দশ বছর থাকত, তা হলেও তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেল হয়ে অবসর নিতেন। ভারতের সঙ্গে দুটি যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেন: একটিতে সেনাবাহিনীপ্রধান হিসেবে, অন্যটিতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল কারিয়াপ্পা একসময় ছিলেন আইয়ুবের বস। পাক-ভারত যুদ্ধে জেনারেল কারিয়াপ্পার ছেলে পাকিস্তানি সৈনিকদের হাতে বন্দী হন। পাকিস্তানি সেনারা খুব খুশি। কিন্তু কথাটি আইয়ুবের কানে যাওয়া মাত্র তিনি নির্দেশ দেন, কারিয়াপ্পার ছেলের যেন কোনো অমর্যাদা না হয় এবং অতিসত্বর তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। আইয়ুব উপলব্ধি করে থাকবেন, যুদ্ধ হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে, ব্যক্তির মধ্যে নয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানে মুজিব মুক্তি পান। তারপর আইয়ুবের আমন্ত্রণেই বঙ্গবন্ধু ইসলামাবাদ যান। শুধু গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া নয়; এক সন্ধ্যায় তাঁরা রাতের খাবার একত্রে খান। প্রেসিডেন্ট হাউসের বারান্দার এক কোণে তাঁরা বসে একান্তে কথা বলেন। রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তিগত কথাই বেশি। তথ্যসচিব আলতাফ গওহর কথাবার্তার সময় আশপাশে থাকতে চেয়েছিলেন। আইয়ুব তাঁকে বলেন, তোমার থাকার দরকার নেই। বাড়িতে চলে যাও।
প্রবল রক্তস্রোতের ওপর দিয়ে ভারতবর্ষ ভাগ হয়। কংগ্রেস ও লীগে মারামারি। হিন্দু-মুসলমান-শিখে হানাহানি। পাঞ্জাবে যে রক্তবন্যা বয়ে যায়, মানবজাতির ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। আজন্ম শত্রুতা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত ও পাকিস্তান। মধ্যপ্রদেশের মানুষ লিয়াকত আলী খান, উত্তর প্রদেশের জওহরলাল নেহরু। নেহরুর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকার সময় তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে নানা বিষয়ে। খুবই তিক্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে অর্থ বরাদ্দ প্রভৃতি নিয়ে। মুসলমান হওয়ার কারণে লিয়াকত আলীর ভাগ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদটি জোটে। তিনি সেই পদে যোগ দিতে করাচি যাবেন চিরকালের জন্য তাঁর জন্মভূমিকে ফেলে। যাওয়ার আগের দিন ঘটা করে নয়, লোক দেখিয়ে নয়, সাংবাদিকদের জানান দিয়ে নয়—একান্তে তাঁরা একসঙ্গে খান। সম্ভবত সেদিন কোনো রাজনৈতিক কথাবার্তা নয়, ব্যক্তিগত কথাবার্তাই হয়ে থাকবে। নতুন দুই স্বাধীন দেশের সরকারপ্রধানদের সেই খাওয়াদাওয়ার খবর সাংবাদিকেরা জানতেই পারেননি। পরদিন কোনো কোনো দৈনিকে একটি বাক্যে খবরটি বেরিয়েছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দুই দেশের দেনা-পাওনা প্রভৃতি নিয়ে বিতর্ক ছিলই, তার মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিন্তু তার পরেও নেহরু-লিয়াকত শুধু নন, ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয়েছে বহু তিক্ত বিষয়ে, তাতে দুই পক্ষই অসামান্য সৌজন্য দেখিয়েছে। সেই অপ্রকাশিত চিঠিপত্র কিছু পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে।
অতীতকালের অনেক নেতার কথাই এখন উপকথার মতো মনে হয়। এমনকি মাত্র ৪০ বছর আগে নিজের চোখে যা দেখেছি, নিজের কানে যা শুনেছি, তা আমার কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। আজ হিংসায় জাতি এতটা উন্মত্ত যে, আমার কথা অন্যের বিশ্বাস করা তো দূরের কথা, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, মিথ্যা কথা বলছি। মুসলিম লীগের নেতা আবদুস সবুর খান একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী ছিলেন। সাতচল্লিশের পর থেকে ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনীতির একেবারে বিপরীত মেরুর। বাহাত্তরে দালাল আইনে জেলে যান। ’৭৩-এ বঙ্গবন্ধু সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে মুক্তি পান। ’৭৪-এর প্রথম দিকে তিনি সম্ভবত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যেতে চেয়েছিলেন। সে জন্য পাসপোর্ট করা প্রয়োজন। তাঁর কোনো এক লোক সেই তদবিরে খুলনা থেকে বেইলি রোডে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সিঁড়ির কাছে লোকটি সালাম জানিয়ে কথা বলেন। তাঁর কথা শুনে বঙ্গবন্ধু একজন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেন, ‘সবুর ভাই পাঠিয়েছেন, হোমে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বলে দাও।’ ঘটনাটি অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু আমার কানে বাজল ‘সবুর ভাই’ সম্বোধনটি। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে সবুর খান যখন বিরোধী দলের নেতা, তিনি শেখ মুজিব সম্পর্কে সৌজন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আর একটি ঘটনা, এখন যাঁদের বয়স ৬০-এর নিচে, তাঁদের মাথায় বাড়ি মারলেও বিশ্বাস করবেন না। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ডাক্তার আবদুল মোত্তালেব মালিককে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করে। ডা. মালিককে যাঁরা জানতেন, তাঁরা জানেন ওই পদে তিনি গিয়েছিলেন সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। জান্তা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনকে একটি বেসামরিক রূপ দিতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে অতি অল্পসংখ্যক মুসলমান পরিবারে রবীন্দ্রসংগীত নিষ্ঠার সঙ্গে চর্চা হতো, মালিক পরিবার তার একটি। তাঁর নিজের মেয়ে এবং ভাতিজি ফরিদা মালিক রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, ডা. মালিক ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর প্রীতিভাজন এবং গান্ধী-অনুরাগী। যা হোক, পাকিস্তান সরকারের সহযোগী হিসেবে স্বাধীনতার পরে বিশেষ আদালতে তাঁর বিচার হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমায় ’৭৪-এ মুক্তি পান। ওই বছরই চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন যান। তাঁকে পাসপোর্ট করে দেওয়া এবং লন্ডনে যাওয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু নিজে কীভাবে সাহায্য করেছিলেন, তার আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সে কাহিনি লিখলে লেখা অনেক বড় হবে।
সৌজন্য প্রকাশের আরেকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। রেসকোর্সের মাঠে জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়াজি যখন চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তখন ডা. মালিক ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (রূপসী বাংলা)। পরে তাঁকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের (তাঁর জার্মান পত্নী ও মেয়ে) গাড়ি থেকে নামানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল বা ব্রিগেডিয়ার সালাম জানিয়ে এগিয়ে আসেন। বাগান থেকে ছেঁড়া একটি বড় লাল গোলাপ ছিল তাঁর হাতে। সেটি ডা. মালিকের হাতে দেন। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার ওই সৌজন্যে বিস্মিত হন ডা. মালিক। দশ-বারো দিন পরে আমি ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এবং কর্নেল ব্রার-এর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে যাই। ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ আমার পরবর্তী কোনো লেখায় থাকবে।
ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের একটি কাহিনি। দিগ্বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। পশ্চিম ভারতের পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন পুরু। ঝিলন নদীর তীরে যুদ্ধে পুরু পরাজিত হয়ে বন্দী হন। পুরুকে যখন আলেকজান্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি আমার কাছে কেমন আচরণ আশা করেন?’ পুরু বলেন, একজন রাজা আর একজন রাজার থেকে যেমন ব্যবহার পেয়ে থাকেন, তেমনটিই। আলেকজান্ডার তাঁর সৎ সাহসে মুগ্ধ হয়ে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে মুক্তি দেন। শুধু মুক্তিই নয়, ইতিহাসে পড়েছি, তাঁর রাজ্যও তাঁকে ফিরিয়ে দেন। অত কাল আগের কাহিনির সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সাধ্য নেই। কিন্তু আমাদের স্বল্পকাল জীবনেও কম দেখলাম না সৌজন্য প্রকাশের ঘটনা।
অদূরদর্শী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এমন এক যন্ত্র চালু করে দিয়ে গেছেন যে তা ডেড থাকলেই ভালো, ভালো থাকলেই বিপত্তি। বহু সংসার ভেঙেছে। এখন তাঁর ওই যন্ত্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় চলছে। লাখ লাখ টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। শক্তিশালী দেশগুলোর শাসকদের ফোন পর্যন্ত রেকর্ড হচ্ছে। তা করছে তাদেরই বড় বন্ধু দেশটি, শত্রুরা কেউ নয়। তবে কখনো কখনো একটি ফোনকলের জন্যও দেশবাসী উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করে। কোনো কোনো প্রত্যাশিত ফোনকলের বক্তব্যে মানুষের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জো!
একাত্তরের ২২ মার্চ আমরা শুনলাম, চট্টগ্রাম থেকে মওলানা ভাসানী ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন। ৩২ নম্বর ঝিলের পাড় তখন লোকে লোকারণ্য। একপর্যায়ে ফোন এল। মওলানা ছিলেন ন্যাপের নেতা বজলুস সাত্তারের বাড়িতে। ফোনে কী কথা হয়, তা দুই নেতাই জানেন, আর জানেন তাঁদের ঘনিষ্ঠ দু-একজন। দুই তরফ থেকেই জানানো হয়, আর আপস নয়। চট্টগ্রামে ভাসানী এক সভায় বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, মাউন্টব্যাটেন যেমন নেহরু-জিন্নাহর কাছে টেবিলে বসে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সসম্মানে গিয়েছিলেন, আপনিও মুজিবরের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ইসলামাবাদ চলে যান। সংঘাতের পথে যাবেন না। স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ আর কিছু চায় না। আমরা আপনাকে সসম্মানে প্লেনে তুলে দিয়ে বিদায় জানাব। সেকালে ফোন রেকর্ড করার এন্তেজাম বোধ হয় ছিল না। থাকলে ভালোই হতো। দুই নেতার ঐতিহাসিক সংলাপ জানা যেত। একালেই বরং ফোনের কথাবার্তা রেকর্ডের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ বেঁচে যেত।
বছর খানেক যাবৎ বিজ্ঞজনদের বড়ই আশা, একটি ফোনকল হোক—সামনাসামনি সংলাপ পরে। মাত্র একটি ফোনই ডেড ছিল, কিন্তু ভেবে দেখলাম, বাংলাদেশের সবগুলো ফোনই অচল থাকলে ভালো হতো। দেশবাসীর মনোবাসনা পূরণ করে ফোনকলটি হলো। তবে যখন ফোনকলটি হলো, তখন সরকারি দলের নেতাদের মতো তা উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি জনগণের। মানুষ প্রাথমিকভাবে উপভোগ করেছে মিনিট তিনেক। কিন্তু পরে যখন ৩৭ মিনিটের পুরো কথাবার্তাই শোনার সুযোগ করে দেয় আমাদের তথ্য বিভাগ ও টেলিফোন বিভাগ, তখন তাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। হায়, আজ একি শুনি প্রিয় নেতাদের মুখে? মন্ত্রী মহোদয় বলে দিয়েছেন, নেতাদের মুখনিঃসৃত বাণী নাকি ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’।
দুজনের কথা শোনার আকাঙ্ক্ষা বা হাউস হয়েছিল নাগরিক নেতাদের, রাজনীতি বিষয়ে অব্যাহত মতদানকারীদের, বণিক সমাজের শীর্ষ কর্তাদের, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত গৃহকর্তা ও গৃহিণীদের। তাঁরা ভেবেছিলেন, মিনিট চার-পাঁচেক কথা হবে, তারপর হবে অন্য নেতাদের মধ্যে সংলাপ। তাঁদের এমনই সৌভাগ্য যে তাঁরা শুনেছেন ৩৭ মিনিট কথাবার্তা। তাঁদের কথা শোনার সাধ হয়েছিল। সেই সাধ মিটে গেছে। পারস্পরিক সৌজন্যবোধ কী জিনিস, তা বাংলার বালক-বালিকাও এবার শিখে গেল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments