সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি ও বাস্তব চিত্র by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
জনগণই
যে ক্ষমতার মালিক তা কেবল গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পাওয়া দেশগুলোতেই
দৃষ্টিগোচর হয় না, গণতান্ত্রিক হতে সচেষ্ট উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও বিষয়টি
প্রমাণিত হয়; যদিও এসব দেশে শাসনকারী কর্তৃপক্ষ প্রায়শই গণদাবি পাশ কাটিয়ে
দলীয় স্বার্থ চরিতার্থে সচেষ্ট থাকে। এসব দেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন
হওয়ার পর জনস্বার্থের কথা ভুলে যায়; ভুলে যায় জনগণকে দেয়া প্রতিশ্র“তির
কথা। পরিবর্তে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে সরকার অগণতান্ত্রিক পথে যেতে
দ্বিধা করে না। তবে নির্বাচন নিকটবর্তী হলে এসব দেশে সরকার নিজেদের
গণতান্ত্রিক দাবি করে জনগণের মুখাপেক্ষী হয়। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার
লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দল তখন নিজেদের ব্যর্থতা চেপে গিয়ে সরকারের সাফল্যের
দিকগুলো বড় করে দেখাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টা করলেও সরকার নিজ
ব্যর্থতার দিকগুলো নাগরিকদের চোখ থেকে আড়াল করতে পারে না। বিরোধী দল, সুশীল
সমাজ এবং সচেতন গণমাধ্যমের কারণে নাগরিক সম্প্রদায় সরকারের ব্যর্থতার
দিকগুলোও অনুধাবন করতে পারেন।
বাংলাদেশে সরকারি দলের অবস্থা উপরের চিত্র থেকে ভিন্ন নয়। বিশেষ করে দশম সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ার পর মহাজোট সরকার এখন অনেকটাই জনগণের মনোরঞ্জনে মনোযোগী। গত পৌনে পাঁচ বছর এ সরকার যেসব কাজ করেছে, তা জনগণের মতামত নিয়ে করেছে বলা যায় না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে বা অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। তবে সরকার কর্তৃক গণইচ্ছাকে পদদলিত করার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হল জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে যুগপৎ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করা। সরকার জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে এ কাজটি করায় নাগরিক সম্প্রদায় বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। বিরোধী দলগুলোও দলীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। সরকারের দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এবং নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে বিরোধী দলগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় সরকার বুঝেছে যে, হ্রাসকৃত জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে পরাজয় সুনিশ্চিত। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবির পর সরকারের এ ধারণা আরও সুনিশ্চিত হয়। এ কারণে সরকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, গণমাধ্যম ব্যবহার, দেশবাসীর কাছে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পরিকল্পনা গ্রহণ এবং নির্বাচন আসার অনেক আগ থেকে প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ করে নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে শুরু করেন। সে সঙ্গে শুরু হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফিতা কাটা এবং প্রকল্প উদ্বোধনের রাজনীতি। একই সঙ্গে রাতারাতি রাজধানীর বিলবোর্ডগুলো ব্যবহার করে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বাহারি বর্ণনা দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সরকারি দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে আরও দু-একটি বিভাগীয় শহরে এ কার্যক্রম শুরু করে সরকার যখন বুঝতে পারে যে, এভাবে দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন এ পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। তবে সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা তাদের বক্তৃতায় সরকারের উন্নয়নের দীর্ঘ বয়ান প্রদান অব্যাহত রাখেন। তাদের বক্তৃতা শুনলে মনে হয়, মহাজোট সরকারের আমলে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে আর কোনো সরকারের আমলে এত উন্নয়ন হয়নি। এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য মহাজোট নেতারা নাগরিকদের তাদের আবারও সরকার গঠনের সুযোগ দিতে অনুরোধ করেন।
সরকারি নেতা-মন্ত্রীদের এ দাবি কতটা যৌক্তিক, তা বিশ্লেষণ করতে হলে একটি পৃথক লেখা তৈরি করতে হবে। তবে এ কথা বলা যায়, উন্নয়ন যতটা হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, জেলাপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি। প্রতিটি সাংবিধানিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে নৈরাজ্য, অনিয়ম, বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের কোনঠাসা করার প্রবণতা, ওএসডিকরণ এবং নিয়োগ ও পদোন্নতিতে চরম নৈরাজ্য এবং পেশাদারিত্বের অভাব। দুর্নীতি ও আর্থিক লুটপাটের কারণে ব্যাংক ও অর্থ প্রশাসনে নৈরাজ্য ও ধস নেমেছে।
মহাজোট সরকারের চারদিকে যখন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চিত্র প্রকটাকারে প্রকাশিত, এমন সময়ে নির্বাচন আসন্ন হয়ে ওঠায় সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা উন্নয়ন ও সাফল্যের ফিরিস্তি প্রদান অব্যাহত রেখে প্রমাণ করতে চান, তারা পাঁচ বছরে অনেক ভালো কাজ করেছেন। তবে তাদের এ দাবি নাগরিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে না। এ জন্য তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সরকারদলীয় প্রার্থীদের পছন্দ না করে পরিবর্তনের পক্ষে রায় প্রদান করেছেন। বিরোধী দলের প্রতি সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণও যে নাগরিক সম্প্রদায় পছন্দ করেননি তাও বোঝা যায়। পাঁচ বছরে বিরোধী দলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে নির্বাচন সন্নিকটে আসার পর তাদের সঙ্গে আলোচনা করার সরকারি উদ্যোগের আন্তরিকতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। বড় বড় পদে অযোগ্যদের বসিয়ে সরকার একদিকে প্রশাসনের বারোটা বাজিয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রায় সব সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা দুর্নীতি করে আখের গুছিয়েছেন, তারা এখন সরকারের মেয়াদান্তে এসে দীর্ঘ মেয়াদের ছুটি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এহেন নৈরাজ্যের মধ্যেও সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা তাদের শাসনামলকে সফল দাবি করে বলতে চেষ্টা করছেন যে, অন্য কোনো সরকার আমলে এত উন্নয়ন হয়নি। তারা আরও দাবি করছেন, এ সরকার যেমন ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছে, তেমনি সরকার পরিচালনার ব্যবস্থাপনায়ও দেখিয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য।
সরকার পরিচালনায় মহাজোট সরকারের ব্যবস্থাপনা সাফল্য উপস্থাপনের জন্য একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য যখন সবাই ব্যাকুল, যখন বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত, যখন বড় দুটি দলের মধ্যে এ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আলোচনার জন্য উভয় পক্ষের ওপর যুগপৎ স্বদেশী সুশীল সমাজ ও বিদেশী কূটনীতিকদের চাপ অব্যাহত, বিরোধী দল যখন চলমান অহিংস সভা-সমাবেশ থেকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার জন্য প্রস্তুতিরত, এমন গুরুত্বপূর্ণ সময় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করার কথা বলা হয়। এ ছোট সংবাদটি উত্তপ্ত সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশে কিছুটা আশাবাদের সঞ্চার করে। সাধারণ মানুষ ভাবেন, এবার হয়তো কোনো সমঝোতার দুয়ার খুলতে পারে। এমনটা ভাবতেই সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ ভালোবাসেন। কারণ, তারা সংঘাত, সহিংসতা ও নৈরাজ্য চান না। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য ফোনকল করার ঘোষণাটি যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আলোচ্য ফোনকল করার কথা বলার কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করে তার সঙ্গে ৩৭ মিনিট কথা বলেন। এর আগে ওই দিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে লাল টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) পারফরম্যান্স ও ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বিটিসিএল কর্মকর্তারা এতই করিৎকর্মা ও দায়িত্বশীল(?) যে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করবেন ঘোষণা দেয়ার কয়েক দিন পরও তিনি বিটিসিএলের লাল টেলিফোনে কথা বলতে পারলেন না। তাকে তার একজন এডিসির এবং বিরোধীদলীয় নেতাকে তার একজন একান্ত সহকারীর মোবাইল ফোনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে হল। আলোচ্য ফোনালাপে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হোক বা না হোক, টেলিফোন বিভাগের যোগ্যতা, দায়িত্বপরায়ণতা ও পেশাদারিত্বের মান কোন পর্যায়ে রয়েছে, সে বিষয়টি দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
বলা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য ফোনকলটি একটি সাধারণ ফোনকল ছিল না। এটি ছিল সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতা এড়িয়ে দেশকে একটি স্বস্তিময় ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়ার পরিবেশ তৈরির জন্য বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান নেতার মধ্যে কথোপকথনের জন্য সরকারপ্রধানের করা ফোনকল। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি টেলিফোন করা হবে জেনেও এবং হাতে দু-তিন দিন সময় পেয়েও বিটিসিএলের করিৎকর্মা(?) কর্মকর্তারা বিষয়টিকে এতই গুরুত্ব দিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী লাল টেলিফোনে নিজে ফোন করে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হলেন। এতে প্রকাশ পেল, বিরোধীদলীয় নেতার লাল টেলিফোনটি কয়েক মাস ধরে বিকল হয়ে রয়েছে। টেলিফোন বিভাগের মতো সরকারের অন্যান্য বিভাগের অভ্যন্তরীণ চিত্রও প্রায় কমবেশি একই রকম। প্রশাসনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে বড় বড় উচ্চপদে যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের প্রাধান্য দেয়ায় সর্বক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ভেঙে পড়ে দেখা দিয়েছে চরম ব্যবস্থাপনা, ব্যর্থতা। প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতার বাস্তব চিত্রের নমুনা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, লাল টেলিফোন কেবল দেশের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং ভিভিআইপিদের দেয়া হয়। এ টেলিফোনের সেবাদান উন্নত করতে রয়েছে একটি বিশেষ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও এর রক্ষণাবেক্ষণের মানও বিশেষ মানের হওয়ার কথা। এ অবস্থায় দেশের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার লাল টেলিফোন যদি মাসের পর মাস বিকল হয়ে থাকে, তাহলে তা থেকে বিটিসিএলের পেশাদারিত্ব ও ব্যবস্থাপনা যোগ্যতার নমুনা পাওয়া যায়। আর এমন একটি ফোনে স্বয়ং সরকারপ্রধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোনকল করবেন জানার পর দু-তিন দিন সময় পেয়েও টেলিফোন বিভাগ স্বয়ং সরকারপ্রধানকেই সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ হলে প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগ থেকে সাধারণ মানুষ কতটা সেবা পাচ্ছেন, তা অনুমান করা যায়। কাজেই মহাজোট সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং এ সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তৃতায় প্রদত্ত সাফল্যের বর্ণনায় বিভ্রান্ত হলে সরকারি পারফরম্যান্সের প্রকৃত চিত্র ও প্রশাসনের সেবাদান কার্যক্রমের পেশাদারিত্ব এবং এর ব্যবস্থাপনা যোগ্যতার বাস্তব চিত্র যথার্থভাবে অনুধাবন করা যাবে না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে সরকারি দলের অবস্থা উপরের চিত্র থেকে ভিন্ন নয়। বিশেষ করে দশম সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ার পর মহাজোট সরকার এখন অনেকটাই জনগণের মনোরঞ্জনে মনোযোগী। গত পৌনে পাঁচ বছর এ সরকার যেসব কাজ করেছে, তা জনগণের মতামত নিয়ে করেছে বলা যায় না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে বা অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। তবে সরকার কর্তৃক গণইচ্ছাকে পদদলিত করার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হল জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে যুগপৎ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করা। সরকার জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে এ কাজটি করায় নাগরিক সম্প্রদায় বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। বিরোধী দলগুলোও দলীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। সরকারের দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এবং নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে বিরোধী দলগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় সরকার বুঝেছে যে, হ্রাসকৃত জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে পরাজয় সুনিশ্চিত। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবির পর সরকারের এ ধারণা আরও সুনিশ্চিত হয়। এ কারণে সরকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, গণমাধ্যম ব্যবহার, দেশবাসীর কাছে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পরিকল্পনা গ্রহণ এবং নির্বাচন আসার অনেক আগ থেকে প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ করে নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে শুরু করেন। সে সঙ্গে শুরু হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফিতা কাটা এবং প্রকল্প উদ্বোধনের রাজনীতি। একই সঙ্গে রাতারাতি রাজধানীর বিলবোর্ডগুলো ব্যবহার করে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বাহারি বর্ণনা দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সরকারি দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে আরও দু-একটি বিভাগীয় শহরে এ কার্যক্রম শুরু করে সরকার যখন বুঝতে পারে যে, এভাবে দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন এ পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। তবে সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা তাদের বক্তৃতায় সরকারের উন্নয়নের দীর্ঘ বয়ান প্রদান অব্যাহত রাখেন। তাদের বক্তৃতা শুনলে মনে হয়, মহাজোট সরকারের আমলে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে আর কোনো সরকারের আমলে এত উন্নয়ন হয়নি। এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য মহাজোট নেতারা নাগরিকদের তাদের আবারও সরকার গঠনের সুযোগ দিতে অনুরোধ করেন।
সরকারি নেতা-মন্ত্রীদের এ দাবি কতটা যৌক্তিক, তা বিশ্লেষণ করতে হলে একটি পৃথক লেখা তৈরি করতে হবে। তবে এ কথা বলা যায়, উন্নয়ন যতটা হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, জেলাপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি। প্রতিটি সাংবিধানিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে নৈরাজ্য, অনিয়ম, বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের কোনঠাসা করার প্রবণতা, ওএসডিকরণ এবং নিয়োগ ও পদোন্নতিতে চরম নৈরাজ্য এবং পেশাদারিত্বের অভাব। দুর্নীতি ও আর্থিক লুটপাটের কারণে ব্যাংক ও অর্থ প্রশাসনে নৈরাজ্য ও ধস নেমেছে।
মহাজোট সরকারের চারদিকে যখন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চিত্র প্রকটাকারে প্রকাশিত, এমন সময়ে নির্বাচন আসন্ন হয়ে ওঠায় সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা উন্নয়ন ও সাফল্যের ফিরিস্তি প্রদান অব্যাহত রেখে প্রমাণ করতে চান, তারা পাঁচ বছরে অনেক ভালো কাজ করেছেন। তবে তাদের এ দাবি নাগরিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে না। এ জন্য তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সরকারদলীয় প্রার্থীদের পছন্দ না করে পরিবর্তনের পক্ষে রায় প্রদান করেছেন। বিরোধী দলের প্রতি সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণও যে নাগরিক সম্প্রদায় পছন্দ করেননি তাও বোঝা যায়। পাঁচ বছরে বিরোধী দলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে নির্বাচন সন্নিকটে আসার পর তাদের সঙ্গে আলোচনা করার সরকারি উদ্যোগের আন্তরিকতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। বড় বড় পদে অযোগ্যদের বসিয়ে সরকার একদিকে প্রশাসনের বারোটা বাজিয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রায় সব সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা দুর্নীতি করে আখের গুছিয়েছেন, তারা এখন সরকারের মেয়াদান্তে এসে দীর্ঘ মেয়াদের ছুটি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এহেন নৈরাজ্যের মধ্যেও সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা তাদের শাসনামলকে সফল দাবি করে বলতে চেষ্টা করছেন যে, অন্য কোনো সরকার আমলে এত উন্নয়ন হয়নি। তারা আরও দাবি করছেন, এ সরকার যেমন ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছে, তেমনি সরকার পরিচালনার ব্যবস্থাপনায়ও দেখিয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য।
সরকার পরিচালনায় মহাজোট সরকারের ব্যবস্থাপনা সাফল্য উপস্থাপনের জন্য একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য যখন সবাই ব্যাকুল, যখন বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত, যখন বড় দুটি দলের মধ্যে এ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আলোচনার জন্য উভয় পক্ষের ওপর যুগপৎ স্বদেশী সুশীল সমাজ ও বিদেশী কূটনীতিকদের চাপ অব্যাহত, বিরোধী দল যখন চলমান অহিংস সভা-সমাবেশ থেকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার জন্য প্রস্তুতিরত, এমন গুরুত্বপূর্ণ সময় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করার কথা বলা হয়। এ ছোট সংবাদটি উত্তপ্ত সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশে কিছুটা আশাবাদের সঞ্চার করে। সাধারণ মানুষ ভাবেন, এবার হয়তো কোনো সমঝোতার দুয়ার খুলতে পারে। এমনটা ভাবতেই সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ ভালোবাসেন। কারণ, তারা সংঘাত, সহিংসতা ও নৈরাজ্য চান না। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য ফোনকল করার ঘোষণাটি যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আলোচ্য ফোনকল করার কথা বলার কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করে তার সঙ্গে ৩৭ মিনিট কথা বলেন। এর আগে ওই দিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে লাল টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) পারফরম্যান্স ও ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বিটিসিএল কর্মকর্তারা এতই করিৎকর্মা ও দায়িত্বশীল(?) যে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করবেন ঘোষণা দেয়ার কয়েক দিন পরও তিনি বিটিসিএলের লাল টেলিফোনে কথা বলতে পারলেন না। তাকে তার একজন এডিসির এবং বিরোধীদলীয় নেতাকে তার একজন একান্ত সহকারীর মোবাইল ফোনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে হল। আলোচ্য ফোনালাপে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হোক বা না হোক, টেলিফোন বিভাগের যোগ্যতা, দায়িত্বপরায়ণতা ও পেশাদারিত্বের মান কোন পর্যায়ে রয়েছে, সে বিষয়টি দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
বলা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য ফোনকলটি একটি সাধারণ ফোনকল ছিল না। এটি ছিল সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতা এড়িয়ে দেশকে একটি স্বস্তিময় ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়ার পরিবেশ তৈরির জন্য বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান নেতার মধ্যে কথোপকথনের জন্য সরকারপ্রধানের করা ফোনকল। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি টেলিফোন করা হবে জেনেও এবং হাতে দু-তিন দিন সময় পেয়েও বিটিসিএলের করিৎকর্মা(?) কর্মকর্তারা বিষয়টিকে এতই গুরুত্ব দিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী লাল টেলিফোনে নিজে ফোন করে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হলেন। এতে প্রকাশ পেল, বিরোধীদলীয় নেতার লাল টেলিফোনটি কয়েক মাস ধরে বিকল হয়ে রয়েছে। টেলিফোন বিভাগের মতো সরকারের অন্যান্য বিভাগের অভ্যন্তরীণ চিত্রও প্রায় কমবেশি একই রকম। প্রশাসনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে বড় বড় উচ্চপদে যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের প্রাধান্য দেয়ায় সর্বক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ভেঙে পড়ে দেখা দিয়েছে চরম ব্যবস্থাপনা, ব্যর্থতা। প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতার বাস্তব চিত্রের নমুনা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, লাল টেলিফোন কেবল দেশের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং ভিভিআইপিদের দেয়া হয়। এ টেলিফোনের সেবাদান উন্নত করতে রয়েছে একটি বিশেষ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও এর রক্ষণাবেক্ষণের মানও বিশেষ মানের হওয়ার কথা। এ অবস্থায় দেশের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার লাল টেলিফোন যদি মাসের পর মাস বিকল হয়ে থাকে, তাহলে তা থেকে বিটিসিএলের পেশাদারিত্ব ও ব্যবস্থাপনা যোগ্যতার নমুনা পাওয়া যায়। আর এমন একটি ফোনে স্বয়ং সরকারপ্রধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোনকল করবেন জানার পর দু-তিন দিন সময় পেয়েও টেলিফোন বিভাগ স্বয়ং সরকারপ্রধানকেই সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ হলে প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগ থেকে সাধারণ মানুষ কতটা সেবা পাচ্ছেন, তা অনুমান করা যায়। কাজেই মহাজোট সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং এ সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তৃতায় প্রদত্ত সাফল্যের বর্ণনায় বিভ্রান্ত হলে সরকারি পারফরম্যান্সের প্রকৃত চিত্র ও প্রশাসনের সেবাদান কার্যক্রমের পেশাদারিত্ব এবং এর ব্যবস্থাপনা যোগ্যতার বাস্তব চিত্র যথার্থভাবে অনুধাবন করা যাবে না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments