সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার নির্বাচন কেন প্রয়োজন by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. একেএম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ
প্রতিদিন পত্রিকায় নতুন পদ্ধতির নির্বাচন চাই শিরোনামে প্রবন্ধে বাংলাদেশের
জন্য উপযোগী সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
এর আগে তিনি রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টির ওপর আলোকপাত
করেন। পরবর্তীকালে সিপিবি ও বাসদ এক সেমিনারে ওই রূপরেখার সমর্থনে বক্তব্য
দেয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় পিডিপির চেয়ারম্যান ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, বাংলাদেশ
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম,
মানবাধিকার সংগঠক রাশেদ চৌধুরী, কলাম লেখক ইকতেদার আহমেদ এবং বর্তমান
প্রবন্ধের লেখকরা জাতীয় সংসদের নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার করে প্রাপ্ত ভোটের
হারে আসন বণ্টনের ব্যবস্থা করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। শোনা যাচ্ছে,
জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু ৫ নভেম্বর
কার্যপ্রণালীর ৭১ বিধিতে সংসদে দলভিত্তিক সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব
ব্যবস্থার রূপরেখা উপস্থাপনের জন্য নোটিশ প্রদান করেছেন। সে অনুযায়ী সংসদের
শতকরা ৫০ ভাগ সাধারণ কোটা, ৩০ ভাগ মহিলা কোটা, ১০ ভাগ সংখ্যালঘু কোটা এবং
১০ ভাগ পেশাজীবী কোটার বিপরীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের প্রাপ্ত ভোটের
অনুপাতে পূরণ করার প্রস্তাব পেশ করা হবে। উল্লেখ্য, যে দল কাস্টিং ভোটের ৫০
ভাগ পাবে, সেই দল ১৫০টি আসন লাভ করবে এবং কোনো দল ১ শতাংশ ভোট পেলে সে দল
৩টি আসন পাবে। এখানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও তা
বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতিকালের ওপর আলোকপাত করা হবে।
দেশে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে পদ্ধতি চালু আছে তাকে বলা হয় এফপিটিপি। এর প্রধান ত্র“টি হল, কোনো দলের শতকরা হারে প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে সংসদীয় আসন লাভের ক্ষেত্রে গুরুতর অসামঞ্জস্যতা। এছাড়া এ ব্যবস্থায় কোনো আসনে দুয়ের অধিক প্রার্থী হলে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পেয়েই প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকে। এরশাদ ঠিকই বলেছেন, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০.৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসনে সর্বাধিক ছিল। কিন্তু শতকরা ৩৪ ভোট পেয়েও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল। সে সময় জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্যদের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে। আবার ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল ১৯৩টি। আর আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল মাত্র ৬২টি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ৪.২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে তারা ২১০টি আসন লাভ করে। অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। যেখানে আওয়ামী লীগ ২৩০টি এবং বিএনপি ৩০টি আসন লাভ করেছে।
বর্তমান যুগে যে কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল একটি অপরিহার্য উপাদান। রাজনৈতিক দল জনমত প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী বাহন। সমাজের অন্যান্য সংগঠিত গোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের জন্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করার জন্য জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মোটেই সুশৃংখল নয়। অধিকাংশ দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের যেমন খুব একটা চর্চা হয় না, তেমনি প্রার্থী মনোনয়নেও রয়েছে নানা অনিয়ম। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যথার্থই বলেছেন, এ পদ্ধতিতে মাস্তান, কালো টাকার মালিক, অর্থ ও বিত্তের জোরে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন কিংবা নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে ক্ষমতায় যেতে হলে আসন নিয়ে আসতে হবে। তার জন্য প্রথমেই খোঁজা হয় প্রার্থীর অর্থবিত্ত কী পরিমাণ আছে। তার পরের যোগ্যতা বাছাইপর্বে দেখা হয় প্রার্থীর জোর দাপট কেমন আছে। এলাকার মানুষ তাকে ভয় পায় কিনা। ভোটকেন্দ্র দখলে রাখতে পারবে কিনা। মাস্তানিই তার সম্পদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের এ বক্তব্যের সঙ্গে কারও দ্বিমত করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর শৃংখলা বিধান করতে সহায়তা করতে পারে। প্রথমত, দলতালিকা ব্যবস্থাকে নির্বাচন পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হলে প্রতি আসনভিত্তিক যে প্যানেল তৈরি হবে, সেখানকার ভোটারদের আকর্ষণ করার জন্য সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এক্ষেত্রে অর্থ, পেশিশক্তি বা প্রভাব-প্রতিপত্তির সুযোগ কমে আসবে। দ্বিতীয়ত, যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে এলে জাতীয় সংসদের কার্যক্রম গুণগতভাবে উন্নত হবে। সংসদ সদস্যরা গঠনমূলক বিতর্কে জড়িত হবেন বলে আশা করা যায়। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টির প্রস্তাব অনুযায়ী যদি কোটার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, তাহলে সংখ্যালঘু ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে যেসব প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে আসবেন তাতে বৈচিত্র্যময় কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, যা গণতন্ত্রের জন্য সুসংবাদ হিসেবে গণ্য হবে।
যে কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু বাংলাদেশে এক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে যে প্রধান চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, শুধু ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সরকারি ও বিরোধী দলের নিয়মিত অংশগ্রহণে কার্যকর জাতীয় সংসদ দেখা যায়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি দল বহাল হওয়ায় প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আচরণে অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়। এরশাদের অভিমত, নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারের পরিণতি আমরা ২০০৬-এ দেখেছি এবং এখনও দেখছি। অথচ ১৯৯১ সালের সরকার কিংবা ১৯৯৬ সালের সরকারের এ রকম করুণ অবস্থা ছিল না। যদি আনুপাতিক হারে ভোটের ভিত্তিতে কোনো দলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার বিধান থাকত, তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির আসন সংখ্যা হতো ১২১ এবং আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হতো ১২০। সেক্ষেত্রে অন্য ছোট দলের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হতো। অভিজ্ঞতা বলে, কোয়ালিশন সরকার সব সময় নমনীয় হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হলে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সব সময় পিছিয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এক্ষেত্রে গভর্নেন্স ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলে অভূতপূর্ব ফল পাওয়া যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলংকা ও নেপালে এই ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হল দল-তালিকা ব্যবস্থা বা পার্টি লিস্ট পিআর সিস্টেম যা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উপযোগী হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের সংখ্যালঘু, নারী-পুরুষ, পেশাজীবী, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে আরও সঙ্গতিপূর্ণ সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। আবার জাতীয় সংসদকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করা হলে এই ব্যবস্থাকে মিক্সড বা মিশ্র পিআর সিস্টেম হিসেবেও গঠন করা যায়। এজন্য সংসদ ও সংসদের বাইরে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। তাই আমরা মনে করি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ২০১৯/২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, সে জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এখন থেকেই মতামত গঠন করা জরুরি।
প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান : রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং মোশাররফ হোসেন মুসা : সদস্য, সিডিএলজি
দেশে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে পদ্ধতি চালু আছে তাকে বলা হয় এফপিটিপি। এর প্রধান ত্র“টি হল, কোনো দলের শতকরা হারে প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে সংসদীয় আসন লাভের ক্ষেত্রে গুরুতর অসামঞ্জস্যতা। এছাড়া এ ব্যবস্থায় কোনো আসনে দুয়ের অধিক প্রার্থী হলে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পেয়েই প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকে। এরশাদ ঠিকই বলেছেন, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০.৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসনে সর্বাধিক ছিল। কিন্তু শতকরা ৩৪ ভোট পেয়েও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল। সে সময় জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্যদের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে। আবার ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল ১৯৩টি। আর আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল মাত্র ৬২টি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ৪.২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে তারা ২১০টি আসন লাভ করে। অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। যেখানে আওয়ামী লীগ ২৩০টি এবং বিএনপি ৩০টি আসন লাভ করেছে।
বর্তমান যুগে যে কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল একটি অপরিহার্য উপাদান। রাজনৈতিক দল জনমত প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী বাহন। সমাজের অন্যান্য সংগঠিত গোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের জন্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করার জন্য জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মোটেই সুশৃংখল নয়। অধিকাংশ দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের যেমন খুব একটা চর্চা হয় না, তেমনি প্রার্থী মনোনয়নেও রয়েছে নানা অনিয়ম। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যথার্থই বলেছেন, এ পদ্ধতিতে মাস্তান, কালো টাকার মালিক, অর্থ ও বিত্তের জোরে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন কিংবা নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে ক্ষমতায় যেতে হলে আসন নিয়ে আসতে হবে। তার জন্য প্রথমেই খোঁজা হয় প্রার্থীর অর্থবিত্ত কী পরিমাণ আছে। তার পরের যোগ্যতা বাছাইপর্বে দেখা হয় প্রার্থীর জোর দাপট কেমন আছে। এলাকার মানুষ তাকে ভয় পায় কিনা। ভোটকেন্দ্র দখলে রাখতে পারবে কিনা। মাস্তানিই তার সম্পদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের এ বক্তব্যের সঙ্গে কারও দ্বিমত করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর শৃংখলা বিধান করতে সহায়তা করতে পারে। প্রথমত, দলতালিকা ব্যবস্থাকে নির্বাচন পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হলে প্রতি আসনভিত্তিক যে প্যানেল তৈরি হবে, সেখানকার ভোটারদের আকর্ষণ করার জন্য সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এক্ষেত্রে অর্থ, পেশিশক্তি বা প্রভাব-প্রতিপত্তির সুযোগ কমে আসবে। দ্বিতীয়ত, যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে এলে জাতীয় সংসদের কার্যক্রম গুণগতভাবে উন্নত হবে। সংসদ সদস্যরা গঠনমূলক বিতর্কে জড়িত হবেন বলে আশা করা যায়। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টির প্রস্তাব অনুযায়ী যদি কোটার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, তাহলে সংখ্যালঘু ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে যেসব প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে আসবেন তাতে বৈচিত্র্যময় কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, যা গণতন্ত্রের জন্য সুসংবাদ হিসেবে গণ্য হবে।
যে কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু বাংলাদেশে এক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে যে প্রধান চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, শুধু ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সরকারি ও বিরোধী দলের নিয়মিত অংশগ্রহণে কার্যকর জাতীয় সংসদ দেখা যায়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি দল বহাল হওয়ায় প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আচরণে অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়। এরশাদের অভিমত, নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারের পরিণতি আমরা ২০০৬-এ দেখেছি এবং এখনও দেখছি। অথচ ১৯৯১ সালের সরকার কিংবা ১৯৯৬ সালের সরকারের এ রকম করুণ অবস্থা ছিল না। যদি আনুপাতিক হারে ভোটের ভিত্তিতে কোনো দলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার বিধান থাকত, তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির আসন সংখ্যা হতো ১২১ এবং আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হতো ১২০। সেক্ষেত্রে অন্য ছোট দলের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হতো। অভিজ্ঞতা বলে, কোয়ালিশন সরকার সব সময় নমনীয় হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হলে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সব সময় পিছিয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এক্ষেত্রে গভর্নেন্স ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলে অভূতপূর্ব ফল পাওয়া যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলংকা ও নেপালে এই ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হল দল-তালিকা ব্যবস্থা বা পার্টি লিস্ট পিআর সিস্টেম যা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উপযোগী হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের সংখ্যালঘু, নারী-পুরুষ, পেশাজীবী, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে আরও সঙ্গতিপূর্ণ সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। আবার জাতীয় সংসদকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করা হলে এই ব্যবস্থাকে মিক্সড বা মিশ্র পিআর সিস্টেম হিসেবেও গঠন করা যায়। এজন্য সংসদ ও সংসদের বাইরে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। তাই আমরা মনে করি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ২০১৯/২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, সে জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এখন থেকেই মতামত গঠন করা জরুরি।
প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান : রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং মোশাররফ হোসেন মুসা : সদস্য, সিডিএলজি
No comments