দুই নেত্রীর ফোনালাপ কি সমস্যা বাড়াল
কথা ছিল, প্রধানমন্ত্রী ফোনে বিরোধী
নেত্রীকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানাবেন। এর আগে ঢাকায় ১৮ দলীয় জোটের জনসভায়
খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের জন্যে যোগাযোগের সময় বেঁধে দিয়ে
২৭-২৮-২৯ অক্টোবর ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন।
স্বভাবতই মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ফোন এবং তার ফলাফল নিয়ে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা থেকে বেরোবার আশায় বসে ছিল।
শেখ হাসিনা সময় পেরনোর আগেই ২৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ফোন করেছিলেন। দুই নেত্রীর ফোনালাপ চলেছে ৩৭ মিনিট ধরে!
বুঝতে অসুবিধা নেই, এ আলাপ আমন্ত্রণ এবং তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের মধ্যে শেষ হতে পারেনি। দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর ফোনালাপ সে দিন রাতেই নেটে ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন কিছু কিছু বৈদ্যুতিন টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণটা প্রচার করে। আর ২৮ তারিখ প্রায় সব পত্রিকাতেই আলাপের পুরোটাই ছাপিয়ে দেওয়া হয়।
শুনে-পড়ে বলতে হয়, আলাপ তো নয়, বাদানুবাদ হয়েছে। তাতে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা প্রথমে বিব্রত বোধ করেছিলেন মনে হয়, কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কাজটাকে শিষ্টাচার-বহির্ভূত আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের আপত্তিটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারণ বিবাদে জড়িয়ে তাঁর নেত্রী প্রতিপক্ষকে অভিযোগের বাণে লাগাতার চাপে রাখতে গিয়ে শিষ্টাচার লঙ্ঘনে অনেক এগিয়ে ছিলেন। শব্দালঙ্কার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা এ বাদানুবাদের মধ্যে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, শ্লেষ, পরিহাস, টিপ্পনী ইত্যাদির ভিয়েন খুঁজে পাবেন। তবে, সব ছাপিয়ে বোঝা যাচ্ছিল খালেদার উষ্মা; মেজাজ তাঁর একেবারে তেতে ছিল। হাসিনা এই তপ্ত বর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু বলার সুযোগ পেয়েছেন, তা প্রতিপক্ষকে শান্ত বা আশ্বস্ত করার কাজ করেনি আগুনে জ্বালানিই পড়েছে।
বিবাদে জড়িয়ে গেলে সময় কোন দিকে বয়ে যায় তা খেয়াল থাকে না। ফোনে তো দু’মাথায় দু’জন মানুষই কথা বলছেন, তাও দুই দলের এমন দুই শীর্ষ নেতা, যাঁদের ওপর কিছু বলার রেওয়াজ বা অধিকার কোনও দলে কারওরই নেই। ফলে মধ্যস্থতার কোনও সুযোগই ছিল না। শেষে ক্লান্ত প্রধানমন্ত্রী জরুরি সভার কথা বলে বহু-প্রতীক্ষিত সংলাপের ইতি টানেন। ফোন-রঙ্গ শেষে বা ফোন-রণাঙ্গন থেকে ফিরে বিরোধী নেত্রী প্রতীক্ষারত সহকর্মীদের হয়তো বলতে পারেন: কষে উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছি! হতে পারে, কারণ দু’দিন পরে সেই সিনিয়র নেতারা বলছেন, বাগ্যুদ্ধে তাদের নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রী পাত্তা পাননি।
কিন্তু জনগণের কি এ আলাপকে যথোচিত মনে হয়েছে? বড় অংশ হতাশ হয়েছে। কেবল সংলাপের দ্বার খুলল না বলেই নয়, এর বিষয় ও ধরনটাও হতাশার কারণ। এক জন বিশ্লেষকের এ বিষয়ে লেখার শিরোনাম তাই: ‘এ সংলাপ না হলেই ভাল ছিল’, এক টিভি চ্যানেলের টক-শোর নাম রাখা হল: ‘সম্ভাবনা না সম্ভব না?’
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকতে পারে না, অচলাবস্থাও আসলে থেমে থাকে না। প্রতিদিনই তার ধরনে কিছু-না-কিছু পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
যে দেশে গণমাধ্যম-বাতিক সংক্রামক ভাবে বর্ধিষ্ণু আর টিভি চ্যানেলে গান-নাটকের চেয়ে খবর ও টক-শো বিস্ময়কর ভাবে বেশি জনপ্রিয়, সেখানে এ ধরনের ঘটনা তো মহার্ঘ সওদা। টক-শো, কলাম এবং খবরে মতামত দিতে দিতে দেশের বিশিষ্টজনরা ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন। রাতও, কারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় টক-শোগুলো নাকি অধিক রাতেই জমে। বিশুদ্ধ নিরপেক্ষতা এ ক্ষেত্রে একেবারে নিরামিষ ব্যাপার, তর্ক জমে আলোচকরা পক্ষ নিয়ে ভাগ হয়ে গেলে।
বার বার মুখ পুড়লেও, আশায় বুক বাঁধতে বাংলাদেশের মানুষের জুড়ি নেই। মনে হয় বিএনপি এখন দু’ভাবে সংলাপের দরজা খোলার কথা ভাবছে। এক দিকে রাজপথের আন্দোলনকে আরও জোরদার করবে তারা, অন্য দিকে বিদেশি কূটনীতিকদের দূতিয়ালিতে লাগাবে। আওয়ামি লিগের চিন্তা আপাতত একটিই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটেনি। প্রথম বার ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করে আত্মবিশ্বাসী হাসিনা সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে নেমেছিলেন। এই এক বার ছাড়া গণতান্ত্রিক আমলেও কখনওই শান্তিপূর্ণ ভাবে এক সরকার থেকে পরবর্তী সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। বিস্তর জলঘোলা করে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ বেয়েই নির্বাচন হয়েছে। ২০০১-এর অভিজ্ঞতা এবং গত ৬ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে হারার কারণে এ বারে হাসিনা স্বভাবতই খুব সতর্ক।
আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল, সাম্প্রতিক এই বিজয়গুলোকে আগামী নির্বাচনেও বিজয়ের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে বিএনপি একটা মুখ বাঁচানো সংলাপ সেরে দ্রুত নির্বাচনেই যেতে চাইবে। এখন মনে হচ্ছে, বেগম জিয়ার আরও কিছু হিসেব আছে। হতে পারে পুত্রদের মামলামুক্ত হয়ে দেশে ফেরার ব্যবস্থা, হতে পারে জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক জামায়াতের অনুকূলে কিছু ছাড় আদায়, বা হতে পারে ভোটের আগে রাজপথের আন্দোলন থেকে সুস্পষ্ট বিজয় পেতে চান তিনি। সম্ভবত তারই প্রভাব পড়েছে তাঁর ফোনালাপে, তিনি কথার লড়াইয়ে জিততে চেয়েছেন।
আসল কথা হল, বাংলাদেশ এ বার সত্যিই কঠিন রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই পড়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন ইতিহাসের বেশ কিছু বকেয়া দাম মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তার প্রধান হল যুদ্ধপরাধীদের বিচার। তা ছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের আলোকে স্কুলের পাঠ্যবই পরিমার্জন, গণমাধ্যম-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমন ইত্যাদিও এ দায়ের অংশ। সেই সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। তাতে অন্তত দুই দশক পরে নবপ্রজন্মের তরুণদের ভোট টানতে পেরেছিল আওয়ামি লিগ। তার বড় জয়ের পিছনে এটাই ছিল মুখ্য।
এখানে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে দুটি মূলধারায় রাজনীতি চলছে এই দেশে, তার বিপরীতমুখিতার ভিত্তি হল আওয়ামি লিগ এবং অ্যান্টি-আওয়ামি লিগ রাজনীতি। পঁচাত্তরের পর থেকেই এটিই বাস্তবতা। এর মধ্যে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক ও ছদ্ম সামরিক-গণতন্ত্রের মধ্যে আওয়ামি লিগের ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ ছিল না। ১৯৯৬-এ প্রথম বার ক্ষমতায় এসে হাসিনা বিরোধীদের সঙ্গে মোটামুটি আপস-সমঝোতা করেই চলেছেন। কিন্তু এ বারের ক্ষমতায় এসে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাঠ্যবই পরিমার্জন-সহ ইতিহাসের বকেয়া দায় মেটানো ও ইতিহাস শুদ্ধিকরণের কাজে হাত দিয়েছেন। পাশাপাশি জঙ্গি দমনেও আন্তরিক ছিলেন। এর ফলে দেশে প্রায় একাত্তরের অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ, এই দু’টি ক্ষেত্রেই জামায়াত-বিএনপি অভিযুক্ত হয়েছে। এর ফলে, যা ১৯৯০ থেকে এ যাবৎ কেবল দু’টি ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী দলের মধ্যেকার সেয়ানে সেয়ানে মোকাবিলার বাইরে যায়নি, এ বার তা আকস্মিক ভাবে দু’পক্ষের ইতিহাস ও আদর্শের ভিন্নতা খুলে ধরেছে। আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় ফিরে এলে এবং বিএনপি জামায়াত ও ধর্মান্ধদের না ছাড়লে তাদের অবস্থা খুব সঙ্গিন হবে।
তাই, এক দলকে এই ধারা ধরে রাখতে এবং অন্য দলকে এর থেকে বেরোতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। এ কারণেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনও পক্ষই এতটুকু ছাড় দিতে চাইছে না। বরং বলা যায়, স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে দুই দলই পরাজয়ে অপারগ এবং তাই ছাড় দিতে অক্ষম।
বিএনপির পক্ষে সমীকরণ আরও জটিল, কারণ ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার জন্য তৈরি দলকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে সচল রাখা মুশকিল। অতীতে মুসলিম লিগের পরিণতি আমরা দেখেছি। অবশ্য তা বলে বিএনপি দুর্বল হয়ে গেলেও অ্যান্টি আওয়ামি লিগ রাজনীতির অবসান হবে না। জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলেও তারা এবং নানান ধারার ধর্মীয় গোষ্ঠী সমাজে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে। তারা সমাজে সেকুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জোরালো প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম সমাজে আলোকন-নবায়নের কাজ খুব ফলপ্রসূ ভাবে না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
মুশকিল হল, নানা কারণে আমজনতা ও ছাত্র-তরুণরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আর আগ্রহী নয়। জ্বলন্ত চুলা আর তপ্ত কড়াইয়ের এই ফাঁড়া থেকে তারা বেরোতে চায়। দুই পক্ষের কারও ওপর তাদের আর কোনও আস্থা নেই, তাই দুই পক্ষের কেউই তাদের দলে টানতে পারছে না। তাতে অবশ্য এক হিসেবে মন্দের ভাল, কারণ এর ফলে হয়তো গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দূর হয়। কিন্তু আপাতত রাজনৈতিক অঙ্গনের ঈশানে থমথমে মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকবে বলেই মনে হয়।
সুত্র- আনন্দবাজার
No comments