সহজ কথা যায় না বলা সহজে by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
এক সপ্তাহ লেখা হয়নি। ফোনের পর ফোন- কেন
লেখা পেলাম না, কি হয়েছে, শরীর খারাপ কিনা? জবাব দিতে দিতে জীবন শেষ। এই
দু’এক বছর আগেও দেশের মানুষ আমাকে নিয়ে যে এত ভাবে বুঝতে পারতাম না।
লেখালেখি
না করে সেই মুক্তিযুদ্ধে রক্ত ঘাম ঝরানোর কথা মনে করে বসে থাকলে সাধারণ
মানুষের এতটা মনের খবর জানতাম না। এ পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ বার মহাত্মা
গান্ধীর জীবনী পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীও ৫-৭ বার পড়া হয়েছে। সব
সময় দেশবাসীর প্রতি নিষ্ঠাবান থাকার চেষ্টা করেছি। বিত্তশালীদের ভ্রূকুটি
যেমন টলাতে পারেনি, তেমনি কোন রিকশাচালক হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া পায়নি- ভুলেও এমন
হলে বেদনায় বুক ফেটে যায়। কোন শ্রমজীবী মানুষ দূর থেকে সালাম দিয়েছে- কোন
কারণে সাড়া দিতে পারিনি- অমন হলে লজ্জায় মুখ দেখানোর আমার কিছু থাকে না।
পাঠকদের প্রতিও দায়বদ্ধ থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষ তো, কিছু না কিছু
ভুল হয়েই যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া কোন উপায় নেই। জীবনে যখন যা
দেখেছি, মন সায় দিলে পক্ষে, সায় না দিলে বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি। কোন সময় মুখ
বুঁঁজে সহ্য করিনি। এ কারণে সারা জীবন যেমন বুকভরা বল পেয়েছি, তেমনি
লাঞ্ছনাও পেয়েছি অনেক। পাকিস্তানের অত্যাচার বঞ্চনার বিরুদ্ধে জীবনের পরোয়া
না করে মুক্তিযুদ্ধ করে নন্দিত নিন্দিত উভয়ই হয়েছি। কিন্তু কখনও সত্যের
বিরুদ্ধে অসত্যের সঙ্গে জানামতে আপস করিনি। এত রক্তে ধোয়া বাংলাদেশ সব সময়
ভাবি মুক্তকণ্ঠে আর কিছু না হোক কথা বলতে পারবো। কলম যখন ধরেছি,
বাধা-বিপত্তি চাপ ও প্রভাবহীন কলম চালাতে পারবো। কিন্তু কেন জানি না কোন
কিছুই নির্মল আকাশের মতো মুক্ত নয়। কোথায় যেন সব কিছু এক অদৃশ্য ডোরে বাধা।
কবে ডোর ছিঁড়ে ঘুড়ি আকাশে মিলিয়ে যাবে সেই সাধনা, সেই প্রত্যাশাতেই পথ
চলছি। আমি ইচ্ছা করে কখনও পাঠকদের বঞ্চিত করতে চাই না। কারও কোন লেখা পড়তে
গিয়ে যদি কোথাও অন্ধকার দেখি, নিজের যেমন খারাপ লাগে, দয়া করে আমার লেখা
যারা ভালবাসেন তারা সময়মতো না পেলে তাদেরও যে খারাপ লাগে সমস্ত হৃদয় দিয়ে
তা উপলব্ধি করি। তবুও প্রিয় পাঠকদের অনুরোধ জানাবো, সারাজীবনের লাগামহীন পা
থেকে মাথা পর্যন্ত একজন বঞ্চিত রাজনৈতিক মানুষ, দয়া করে আমার ত্রুটি আমার
ব্যর্থতা ক্ষমা করবেন।
বহুদিন পর গিয়েছিলাম ধুনটে এন.ইউ. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায়। বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভা ছিল। প্রবীণ চিকিৎসক, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আমন্ত্রণে এবার আমার ধুনট যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার বালাসী, সারিয়াকান্দি, চন্দনবাইসা, কাজীপুর, বেলকুচি, বেতিল, চৌহালি, শাহাজাদপুর পর্যন্ত যমুনায় বিচরণ করেছি। বহুদিন পর ধুনটে গিয়ে প্রথমেই যার কথা মনে পড়েছিল সে ছিল এক সময়ের ধুনটের মুকুটহীন সম্রাট ফেরদৌস জামান মুকুল। আওয়ামী লীগ করতে করতেই জীবন শেষ করেছে। কতবার যে বলেছে, বিত্তশালী গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের অর্থের কাছে কিছুতেই এঁটে উঠছি না। তারপরও জয়ী হয়েছে, পরাজিত হলেও ৭০-৮০ হাজার, কোন কোনবার লাখ ভোট পেয়েছে। সংগ্রামী নেতা বলতে যা বোঝায় তার একজন ছিল ফেরদৌস জামান মুকুল। গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ ধনবান হলেও আদব কায়দায় কোনদিন কোন ত্রুটি দেখিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এক প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা মো. হাবিবর রহমান এমপি হয়েছেন। কোন রাজনৈতিক আদব কায়দার লেশমাত্র তার নেই। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তার এলাকায় যাচ্ছেন, সৌজন্যের খাতিরেও তার খোঁজখবর নেয়া দরকার। তা তো তিনি করেনইনি বরং যাতে সভা সফল না হয় তার জন্যে ফুটবল খেলা দিয়েছিলেন। ভালই করেছেন। যে খেলা খেলছেন আর ক’দিন পর জনগণের পায়ে পায়ে তাদের ফুটবলের মতোই যে এদিক-সেদিক ছুটতে হবে- তা দিব্যি চোখে দেখতে পাচ্ছি। জনসভায় তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী অসাধারণ বক্তব্য রেখেছে। আমি আর কি বলতে পারি? মাননীয় সংসদ সদস্যকে শুধু বলেছি, বাংলাদেশ না হলে এসপি, এমপি কোন কিছুই সম্ভব ছিল না। পুলিশে এএসআই, রাজনীতিতে বড় জোর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যন্তই থাকতে হতো। আমাদের রক্ত ঘামে বাংলাদেশ হয়েছিল বলেই অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
অনেকদিন পর যমুনার উপর দিয়ে গিয়েছিলাম। পানিহীন খাঁ খাঁ করা যমুনা দেখে বুকটা চৌচির হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের নলিন জগৎপুরা থেকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি চন্দনবাইশা প্রায় ২০ মাইল চর আর চর, কোথাও পানি নেই। কত টাকা খরচ করে পাড় বাধা হয় কোন কাজে আসে না। উড়ে যাওয়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের নদীগুলো যদি শাসন না করে খনন করা হতো তাহলে নৌ-চলাচলের কতই না সুবিধা হতো। যত টাকা খরচ করে সড়ক, রেল, আকাশ যোগাযোগ রক্ষা করা হয় তার অর্ধেক টাকা খরচ করলে ৫০ বছরের জন্য নৌ-যোগাযোগ সুগম হতো, কৃষি সেচের পানি হতো। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যমুনার পাড় বাধার কি প্রয়োজন? ২০-২৫ মাইল প্রস্থ যমুনাকে ১০-১৫ মাইলে এনে ৫০-৬০ ফুট গভীর করে ড্রেজিং করলে মাটি রাখার জায়গার যেমন কোন অসুবিধা হতো না, তেমন ২-৪ ফুট গভীরতার ২০-২৫ মাইলে ছড়িয়ে থাকা পানি ৫০-৬০ ফুট গভীরতায় ১০-১৫ মাইলের মধ্যে থাকলে পানিরও প্রাণ থাকতো, মাছ থাকতো, নৌ চলাচল হতো। মরা পানির দুর্গন্ধ সহ্য করতে হতো না। জানি আমার এসব চিন্তা কোন কাজে আসবে না। কারণ যারা এখন রাষ্ট্র চালায় তারা চোখে দেখে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু করে না। আমলারা যা কাগজে লিখে দেয় তা নিয়েই হয় হয় করে। কারণ, তাদের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব ব্যক্তিত্ব কিছুই নেই। অন্যের গলগ্রহ হয়ে যারা চলে তাদের কাছে সৃজনশীল কিছু আশা করা যায় না। ছোট ছোট কত নদী বড়সড় আধুনিক দু’টা ড্রেজার দু’পাশে মাটি ছিটিয়ে গেলে একবারে যে গভীরতা হতো তাতেই ১০ বছর অনায়েসে নৌ-চলাচল করতে পারতো। মহাজোট সরকারের আমলে নদী খননের কিছু পরিকল্পনা দেখলাম। আয়ুব খানের সময় যেমন শুনেছিলাম কোন এক বড় ঠিকাদার কোথায় এক বিশাল পুকুর খননের ঠিকা পেয়েছিল। আয়ুব খানের আমল তো, খনন শুরু হতে হতেই আবার সরকারি প্রয়োজনে সেখানে ঘর-দুয়ার তৈরি করার প্রয়োজন হয়। সেই ভাগ্যবান ঠিকাদার নাকি পুকুর খনন না করেই খননের বিল আবার ভরাট না করেই ভরাটের বিল সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজকর্মও প্রায় সেরকম। কিছু নদীতে নদী খননের ঠিকা দিয়েছেন, ঠিকাদারেরা যে মাটি তুলছে তার জন্যে টাকা পাচ্ছে। আবার নদীর পাড়ে তোলা মাটি বিক্রি করেও টাকা পাচ্ছে। অথচ যারা বালি ইজারা নেয় তারা বরং সরকারকে দু’চার পয়সা দেয়। এখানে উল্টো সরকার তাদের প্রিয় লোকদের হাত খরচের ব্যবস্থা করেছে। তবে যে যাই বলুন, নির্ভরযোগ্য নৌপথ করতে নদী শাসন নয়, নদী বেগবান করতে হবে। যৌবনা করতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্যে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। এখন সংসদ আইন পাস করে দিলেই হলো। গ্রামের গরিব মা-বোনেরা মুরগি বেচা, আন্ডা বেচা, দুধ বেচা জোলা পয়সায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক লুটেরারা লুটে নেবে। গ্রামের পরিশ্রমী মহিলারা কোমরে গামছা বেঁধে ঝাটা হাতে রাস্তায় নেমে তারা তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা করবে কিনা সেটা তারা আর আল্লাহ মাবুদ জানেন, আমি জানি না। সব ক’টি ব্যাংকের যখন নাজুক অবস্থা তখন গ্রামীণ ব্যাংককে এভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অপচেষ্টার নিন্দা না করে পারি না। দেশবাসীকে ন্যায় ও সত্যের খাতিরে রুখে দাঁড়াতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য মানবিক গুণাবলীর কেন এমন অধঃপতন ঘটছে ভাবলে গা শিউরে উঠে। নকল ঔষধ বিক্রি করে যারা মানুষের জীবনহানির কারণ হয় তাদের সেই নকল ঔষধ বাজেয়াপ্ত করলে দোষীদের শাস্তি দিলে সব ঔষধ ব্যবসায়ী একসঙ্গে দোকান বন্ধ করে সারা দেশে কারবালার মাতম তুলতে পারেন এটা ভাবনারও বাইরে ছিল। আলু, পটল, তেল, নুন আর ঔষধ বিক্রি তো এক কথা নয়। যারা মাদক বিক্রি করে, হেরোইন কিংবা ইয়াবা অথবা ফেনসিডিল, তারা ধর্মঘট করলে বরং ধন্যবাদ দেয়া যেতো। কিন্তু মাদক বিক্রেতারা তাদের দোকান বা কারবার বন্ধ রাখেনি। মিটফোর্ডে ভেজাল ঔষধ সনাক্ত করে কাউকে কাউকে জরিমানা করায় একসঙ্গে সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। মুমূর্ষু রোগীদের সেকি দুরবস্থা! মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকার এসব অসৎ ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। অযোগ্য অদক্ষ সরকারের এমনই হয়। একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সেটা কে চালায় কেউ জানে না। ফকির মিসকিন মিলে মন্ত্রণালয়ে কুতুবের শেষ নেই। মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, নানাজন নানা মাতব্বর, কেউ কারও কথা শোনে না। যন্ত্রপাতি ক্রয়, ঔষধ ক্রয় যে যেভাবে পারছে লুট আর লুট। এ লুটের যেন কোন শেষ নেই। দেশবাসীকে তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে আর কতকাল এমন উৎকণ্ঠায় থাকতে হবে?
কতকাল শুনে আসছি, ধান ভানতে শিবের গীত। আদৌ পাড়াগাঁয়ে ধান ভানতে কখনও কোনদিন কোনকালে শিবের গীত গাইতো কিনা অন্তত আমি প্রত্যক্ষ করিনি। কিন্তু সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে অনেকটা তেমনই করেছেন। সারা পৃথিবী যখন পারমাণবিক শক্তি নিয়ে চিন্তিত, জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া পারমাণবিক প্রকল্পগুলো এক এক করে বন্ধ করে দিচ্ছে, সেই সময় আমরা কেন রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিচ্ছি? আমাদের নিরাপত্তা কোথায়, লাভ-ক্ষতি কি- এসব নিয়ে যখন কথা বলা প্রয়োজন তখন সেখানে তিনি জানালেন বিএনপির কথা, বেগম খালেদা জিয়ার কথা। তিনি বললেন, বেগম খালেদা জিয়া তাকে চায় না। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা করেন আওয়ামী লীগ। নীতিগতভাবেই তো তাকে চাইতে পারেন না। এখানে দোষের কি? তিনি তাকে খুনি বলে অভিহিত করলেন। প্রত্যক্ষ নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী তাকে এভাবে অপবাদ দিলে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের লেশমাত্র থাকে? আজ কতদিন সংবিধান অনুসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের কথা বলছেন, প্রতিপক্ষকে খুনি বললে তারা কি সাধু সামন্ত বলবে? নাকি তারা ইট কা জবাব পাত্থর ছে দেবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবিধান অনুসারে শপথ করেছেন, অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন আচরণ করবেন না। প্রকাশ্য জনসভায় লাখো মানুষের সামনে একজন জাতীয় নেতাকে খুনি বলা কি অনুরাগ বিরাগ নয়? রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ- এসব কি ভালর জন্যে নাকি ভবিষ্যতের ভয়াবহ বিপদ সংকেত? যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে তারা এই কেন্দ্রটি ভারতের ৩-৪টি জায়গায় স্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে তারা ছাড়পত্র পায়নি। আমাদের সুন্দরবন সারা পৃথিবীর গর্বের ধন। তাকে ধ্বংসে মহাজোটের এ মহাপ্রয়াস আমরা কি চোখ বন্ধ করে সহ্য করবো? সুন্দরবন একবার ধ্বংস হলে আবার কি কখনও ফিরে পাবো? পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনী পালা বদল, দলীয় ক্ষমতা বদল হতে পারে। সুন্দরবন একবার ধ্বংস হলে আর কখনও ফিরে পাবো না। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান, সময় থাকতে পা চালান, সে পা অধঃগতির দিকে নয়- অগ্রগতির দিকে।
বহুদিন পর গিয়েছিলাম ধুনটে এন.ইউ. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায়। বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভা ছিল। প্রবীণ চিকিৎসক, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আমন্ত্রণে এবার আমার ধুনট যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার বালাসী, সারিয়াকান্দি, চন্দনবাইসা, কাজীপুর, বেলকুচি, বেতিল, চৌহালি, শাহাজাদপুর পর্যন্ত যমুনায় বিচরণ করেছি। বহুদিন পর ধুনটে গিয়ে প্রথমেই যার কথা মনে পড়েছিল সে ছিল এক সময়ের ধুনটের মুকুটহীন সম্রাট ফেরদৌস জামান মুকুল। আওয়ামী লীগ করতে করতেই জীবন শেষ করেছে। কতবার যে বলেছে, বিত্তশালী গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের অর্থের কাছে কিছুতেই এঁটে উঠছি না। তারপরও জয়ী হয়েছে, পরাজিত হলেও ৭০-৮০ হাজার, কোন কোনবার লাখ ভোট পেয়েছে। সংগ্রামী নেতা বলতে যা বোঝায় তার একজন ছিল ফেরদৌস জামান মুকুল। গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ ধনবান হলেও আদব কায়দায় কোনদিন কোন ত্রুটি দেখিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এক প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা মো. হাবিবর রহমান এমপি হয়েছেন। কোন রাজনৈতিক আদব কায়দার লেশমাত্র তার নেই। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তার এলাকায় যাচ্ছেন, সৌজন্যের খাতিরেও তার খোঁজখবর নেয়া দরকার। তা তো তিনি করেনইনি বরং যাতে সভা সফল না হয় তার জন্যে ফুটবল খেলা দিয়েছিলেন। ভালই করেছেন। যে খেলা খেলছেন আর ক’দিন পর জনগণের পায়ে পায়ে তাদের ফুটবলের মতোই যে এদিক-সেদিক ছুটতে হবে- তা দিব্যি চোখে দেখতে পাচ্ছি। জনসভায় তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী অসাধারণ বক্তব্য রেখেছে। আমি আর কি বলতে পারি? মাননীয় সংসদ সদস্যকে শুধু বলেছি, বাংলাদেশ না হলে এসপি, এমপি কোন কিছুই সম্ভব ছিল না। পুলিশে এএসআই, রাজনীতিতে বড় জোর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যন্তই থাকতে হতো। আমাদের রক্ত ঘামে বাংলাদেশ হয়েছিল বলেই অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
অনেকদিন পর যমুনার উপর দিয়ে গিয়েছিলাম। পানিহীন খাঁ খাঁ করা যমুনা দেখে বুকটা চৌচির হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের নলিন জগৎপুরা থেকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি চন্দনবাইশা প্রায় ২০ মাইল চর আর চর, কোথাও পানি নেই। কত টাকা খরচ করে পাড় বাধা হয় কোন কাজে আসে না। উড়ে যাওয়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের নদীগুলো যদি শাসন না করে খনন করা হতো তাহলে নৌ-চলাচলের কতই না সুবিধা হতো। যত টাকা খরচ করে সড়ক, রেল, আকাশ যোগাযোগ রক্ষা করা হয় তার অর্ধেক টাকা খরচ করলে ৫০ বছরের জন্য নৌ-যোগাযোগ সুগম হতো, কৃষি সেচের পানি হতো। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যমুনার পাড় বাধার কি প্রয়োজন? ২০-২৫ মাইল প্রস্থ যমুনাকে ১০-১৫ মাইলে এনে ৫০-৬০ ফুট গভীর করে ড্রেজিং করলে মাটি রাখার জায়গার যেমন কোন অসুবিধা হতো না, তেমন ২-৪ ফুট গভীরতার ২০-২৫ মাইলে ছড়িয়ে থাকা পানি ৫০-৬০ ফুট গভীরতায় ১০-১৫ মাইলের মধ্যে থাকলে পানিরও প্রাণ থাকতো, মাছ থাকতো, নৌ চলাচল হতো। মরা পানির দুর্গন্ধ সহ্য করতে হতো না। জানি আমার এসব চিন্তা কোন কাজে আসবে না। কারণ যারা এখন রাষ্ট্র চালায় তারা চোখে দেখে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু করে না। আমলারা যা কাগজে লিখে দেয় তা নিয়েই হয় হয় করে। কারণ, তাদের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব ব্যক্তিত্ব কিছুই নেই। অন্যের গলগ্রহ হয়ে যারা চলে তাদের কাছে সৃজনশীল কিছু আশা করা যায় না। ছোট ছোট কত নদী বড়সড় আধুনিক দু’টা ড্রেজার দু’পাশে মাটি ছিটিয়ে গেলে একবারে যে গভীরতা হতো তাতেই ১০ বছর অনায়েসে নৌ-চলাচল করতে পারতো। মহাজোট সরকারের আমলে নদী খননের কিছু পরিকল্পনা দেখলাম। আয়ুব খানের সময় যেমন শুনেছিলাম কোন এক বড় ঠিকাদার কোথায় এক বিশাল পুকুর খননের ঠিকা পেয়েছিল। আয়ুব খানের আমল তো, খনন শুরু হতে হতেই আবার সরকারি প্রয়োজনে সেখানে ঘর-দুয়ার তৈরি করার প্রয়োজন হয়। সেই ভাগ্যবান ঠিকাদার নাকি পুকুর খনন না করেই খননের বিল আবার ভরাট না করেই ভরাটের বিল সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজকর্মও প্রায় সেরকম। কিছু নদীতে নদী খননের ঠিকা দিয়েছেন, ঠিকাদারেরা যে মাটি তুলছে তার জন্যে টাকা পাচ্ছে। আবার নদীর পাড়ে তোলা মাটি বিক্রি করেও টাকা পাচ্ছে। অথচ যারা বালি ইজারা নেয় তারা বরং সরকারকে দু’চার পয়সা দেয়। এখানে উল্টো সরকার তাদের প্রিয় লোকদের হাত খরচের ব্যবস্থা করেছে। তবে যে যাই বলুন, নির্ভরযোগ্য নৌপথ করতে নদী শাসন নয়, নদী বেগবান করতে হবে। যৌবনা করতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্যে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। এখন সংসদ আইন পাস করে দিলেই হলো। গ্রামের গরিব মা-বোনেরা মুরগি বেচা, আন্ডা বেচা, দুধ বেচা জোলা পয়সায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক লুটেরারা লুটে নেবে। গ্রামের পরিশ্রমী মহিলারা কোমরে গামছা বেঁধে ঝাটা হাতে রাস্তায় নেমে তারা তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা করবে কিনা সেটা তারা আর আল্লাহ মাবুদ জানেন, আমি জানি না। সব ক’টি ব্যাংকের যখন নাজুক অবস্থা তখন গ্রামীণ ব্যাংককে এভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অপচেষ্টার নিন্দা না করে পারি না। দেশবাসীকে ন্যায় ও সত্যের খাতিরে রুখে দাঁড়াতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য মানবিক গুণাবলীর কেন এমন অধঃপতন ঘটছে ভাবলে গা শিউরে উঠে। নকল ঔষধ বিক্রি করে যারা মানুষের জীবনহানির কারণ হয় তাদের সেই নকল ঔষধ বাজেয়াপ্ত করলে দোষীদের শাস্তি দিলে সব ঔষধ ব্যবসায়ী একসঙ্গে দোকান বন্ধ করে সারা দেশে কারবালার মাতম তুলতে পারেন এটা ভাবনারও বাইরে ছিল। আলু, পটল, তেল, নুন আর ঔষধ বিক্রি তো এক কথা নয়। যারা মাদক বিক্রি করে, হেরোইন কিংবা ইয়াবা অথবা ফেনসিডিল, তারা ধর্মঘট করলে বরং ধন্যবাদ দেয়া যেতো। কিন্তু মাদক বিক্রেতারা তাদের দোকান বা কারবার বন্ধ রাখেনি। মিটফোর্ডে ভেজাল ঔষধ সনাক্ত করে কাউকে কাউকে জরিমানা করায় একসঙ্গে সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। মুমূর্ষু রোগীদের সেকি দুরবস্থা! মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকার এসব অসৎ ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। অযোগ্য অদক্ষ সরকারের এমনই হয়। একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সেটা কে চালায় কেউ জানে না। ফকির মিসকিন মিলে মন্ত্রণালয়ে কুতুবের শেষ নেই। মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, নানাজন নানা মাতব্বর, কেউ কারও কথা শোনে না। যন্ত্রপাতি ক্রয়, ঔষধ ক্রয় যে যেভাবে পারছে লুট আর লুট। এ লুটের যেন কোন শেষ নেই। দেশবাসীকে তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে আর কতকাল এমন উৎকণ্ঠায় থাকতে হবে?
কতকাল শুনে আসছি, ধান ভানতে শিবের গীত। আদৌ পাড়াগাঁয়ে ধান ভানতে কখনও কোনদিন কোনকালে শিবের গীত গাইতো কিনা অন্তত আমি প্রত্যক্ষ করিনি। কিন্তু সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে অনেকটা তেমনই করেছেন। সারা পৃথিবী যখন পারমাণবিক শক্তি নিয়ে চিন্তিত, জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া পারমাণবিক প্রকল্পগুলো এক এক করে বন্ধ করে দিচ্ছে, সেই সময় আমরা কেন রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিচ্ছি? আমাদের নিরাপত্তা কোথায়, লাভ-ক্ষতি কি- এসব নিয়ে যখন কথা বলা প্রয়োজন তখন সেখানে তিনি জানালেন বিএনপির কথা, বেগম খালেদা জিয়ার কথা। তিনি বললেন, বেগম খালেদা জিয়া তাকে চায় না। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা করেন আওয়ামী লীগ। নীতিগতভাবেই তো তাকে চাইতে পারেন না। এখানে দোষের কি? তিনি তাকে খুনি বলে অভিহিত করলেন। প্রত্যক্ষ নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী তাকে এভাবে অপবাদ দিলে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের লেশমাত্র থাকে? আজ কতদিন সংবিধান অনুসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের কথা বলছেন, প্রতিপক্ষকে খুনি বললে তারা কি সাধু সামন্ত বলবে? নাকি তারা ইট কা জবাব পাত্থর ছে দেবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবিধান অনুসারে শপথ করেছেন, অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন আচরণ করবেন না। প্রকাশ্য জনসভায় লাখো মানুষের সামনে একজন জাতীয় নেতাকে খুনি বলা কি অনুরাগ বিরাগ নয়? রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ- এসব কি ভালর জন্যে নাকি ভবিষ্যতের ভয়াবহ বিপদ সংকেত? যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে তারা এই কেন্দ্রটি ভারতের ৩-৪টি জায়গায় স্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে তারা ছাড়পত্র পায়নি। আমাদের সুন্দরবন সারা পৃথিবীর গর্বের ধন। তাকে ধ্বংসে মহাজোটের এ মহাপ্রয়াস আমরা কি চোখ বন্ধ করে সহ্য করবো? সুন্দরবন একবার ধ্বংস হলে আবার কি কখনও ফিরে পাবো? পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনী পালা বদল, দলীয় ক্ষমতা বদল হতে পারে। সুন্দরবন একবার ধ্বংস হলে আর কখনও ফিরে পাবো না। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান, সময় থাকতে পা চালান, সে পা অধঃগতির দিকে নয়- অগ্রগতির দিকে।
No comments