১৪০- এটাও কি তার দেশপ্রেম? by বদিউর রহমান
পরশ্রীকাতরতা
অবশ্যই খুবই খারাপ, খাস-বাংলায় বলা যেতে পারে ছোটলোকি। সে বিবেচনায় আমরা
অনেকেই হয়তো ছোটলোকই বটে। কিন্তু বাদ সাধে ব্যাখ্যায়, কোনটা পরশ্রীকারতরতা
আর কোনটা ছোটলোকি। ন্যায়সঙ্গতভাবে কেউ যদি ভালো কোনো অবস্থানে যেতে পারেন,
সফল হোন, সার্থক হতে পারেন, তবে তার সেই ভালো অবস্থান, সফলতা এবং সার্থকতা
নিয়ে অন্যায় আচরণ করাটাই পরশ্রীকাতরতা; তার ন্যায়সম্মত অর্জন নিয়ে
বদহজমী-মন্তব্য করাটাই হতে পারে ছোটলোকি। কিন্তু ন্যায়ানুগ না হলে, সাধারণ
বিবেচনায় প্রচলিত রেওয়াজেও কোনো কাজ গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলে তেমন কোনো
কর্মকাণ্ডের যথার্থ সমালোচনা করাটাকে কোনোভাবেই পরশ্রীকাতরতা যেমন বলা যাবে
না, তেমনি সমালোচকদেরও ছোটলোক বলা আবশ্যই সমীচীন হবে না। এহেন বিবেচনায়
আমরা যদি ১৪০ নিয়ে প্রশ্ন তুলি, সমালোচনা করি তাহলে আমাদের দয়া করে
পরশ্রীকাতরতা বা ছোটলোকির খেতাব দেবেন না।
সম্প্রতি তিনি জাতিসংঘে গেলেন, ভালো কথা। গত চার বছরও গিয়েছেন। তাকে যেতে হয়। বিশ্বক্লাবে দেশকে তুলে ধরতে না পারা আমাদেরও কাম্য নয়। আর নিজ মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেয়ার সাহসী ইতিহাস তো তার পিতা আমাদের জাতির জনকই সৃষ্টি করেছেন। তিনি তা ধরে রেখেছেন বলে আমরা গৌরবান্বিত। তার অনেক সাহসী কর্মের আমরা প্রশংসা করি। সেনা-নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তার দেশে ফেরার বাধা উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরেছেন, আমরা বলেছি বাপকা বেটি। জেলে গিয়েও মাথা নত করেননি, আমরা তার মাঝে পিতৃ-রক্তের মহিমা লক্ষ্য করলাম। ঢাকা সেনানিবাসের ১৬৮ কাঠা সম্পত্তি তিনি কল্যাণমুখী কাজে নিয়ে এলেন, গণতন্ত্রকে সেনাছাউনিতে বন্দিত্ব থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত করলেন, সঙ্গে এক দেশনেত্রীকেও সেনা-আশ্রয়ে থাকার ‘অপবাদ’ থেকে রেহাই দিলেন; আমরা বাহবা দিলাম। জাতির জনক হত্যার পর টলটলায়মান নৌকার দলকে চাঙা করলেন, আমরা তার দেশপ্রেমে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থানে প্রীত হলাম। তার অনেক অর্জনে আমরা আশাবাদী অবশ্যই। কিন্তু তার কিছু কথাবার্তায় আমরা হতাশ হই। তাকে জননেত্রী বললে তা বলতে তিনি চামচাদের নিষেধ করেন না, তা-ও আমরা মেনে নিই। নেতা হলে তো নাম ফুটাতে হয়, নাম না ফুটালে কি ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়? একজন স্বামীর নামে রাজনীতি করে যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারেন, দেশনেত্রী হয়ে যেতে পারেন, তিনি কেন জননেত্রী হতে পারবেন না? আমরা পরশ্রীকাতর নই, আমরা ছোটলোক হব না, তারা দেশনেত্রী-জননেত্রী থাকুন। আমরা না বললেও কিছু আসে-যায় না, চামচারা তো আছেন, বলবেন। আমরা বৃক্ষ তোমার নাম কী শুনতে তত আগ্রহী নই, কারণ আমরা যে ফলের পরিচয়ে বিশ্বাস করি। অতএব, আমরা তার একটা আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের নাম বদলানোকে ভালোভাবে দেখি না। প্রতিহিংসারূপে ভাবি; আমরা এক নভোথিয়েটারের নাম বদলানোও সহজভাবে গ্রহণ করি না, এটিকে ছোটলোকি ভাবি, কারণ তার পিতাও অন্তত এ কাজটি করতেন না। যার নামে নভোথিয়েটারটি পরিচিত হয়ে গিয়েছিল তাকে তার পিতাও বেশ সম্মান করতেন এবং সে ব্যক্তিটি তার দলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার এমনতরো কিছু কিছু ছোটখাটো কাজ আমাদের পীড়িত করেছে, তার মহত্ত্ব¡ আর বড়ত্ব নিয়ে আমাদের সন্দিহান করেছে। কিছু সম্মানিত ব্যক্তিকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাক্যবাণে অসম্মান করে তিনি অযথা নিজকে ‘ছোট’ করেছেন, তিনি নিজকে নিচে নামিয়েছেন। আমরা অসন্তষ্ট হয়েছি। রাজনীতি করলে অন্যকে বা বিপক্ষ কাউকে ঘায়েল করতে হতেই পারে। তবে তারও মাত্রা থাকে। ওই ঘায়েল করাটা রাজার মতো হতে হয়। সেখানে শ্রদ্ধাবোধ আর সম্মানবোধ ক্ষুণ্ন করার দরকার পড়ে না। সংসদীয় রীতিতে মিথ্যাকে সরাসরি মিথ্যা না বলে অসত্য বলা হয়। এভাবে শালীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপক্ষ নেতাকে মাননীয় বলেও কঠোর সমালোচনা করা হয়, তাতে সমালোচনার গুরুত্ব কমে না, অথচ গণতান্ত্রিক ভব্যতা রক্ষা পায়। তাই ‘আমি কার খালুরে’, ‘মোটাতাজা’, ‘সিঁদেল চোর’, ‘নির্বাচন করতে ব্যর্থ’ জাতীয় বিভিন্ন কাঁচা শব্দে সম্মানিত ব্যক্তিদের গেঁয়ো-ঝগড়াটের মতো আক্রমণ যেমন আমরা পছন্দ করিনি, তেমনি বিশ্ববরেণ্য কাউকে সুদখোর, রক্তচোষা বলাও আমাদের ভালো লাগেনি। এ আক্রমণগুলো তিনি তার পদ এবং পিতৃ-পরিচয় বিবেচনায় আরও অনেক সম্মানজনকভাবে উদারতার সঙ্গেও করতে পারতেন। তাহলে আমরা খুশি হতাম, তাকে আমরা রাষ্ট্রনায়কোচিত পর্যায়ে ভাবতে আনন্দ পেতাম। কিন্তু তিনি আমাদের হতাশ করেছেন। তার আরও অনেক অনেক কর্মকাণ্ডে, বিশেষত বাক্যচয়নে আমরা ব্যথিত হয়েছি। অথচ আমরা তার গুণমুগ্ধ ভক্ত হতে চেয়েছিলাম, তার মাঝে দেশপ্রেমের ঔদার্যের সঙ্গে রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণ দেখতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এ কারণে যে, তিনি জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন, তিনি সত্যিই দেশকে কিছু দিতে চেয়েছেন।
তার দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ জাগেনি। তিনি যখন আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, মা-বাবা-ভাই সব হারিয়ে দেশকে কিছু দেয়া ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, তখন আমরা আপ্লুত হই, আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন দেখি তার ছালী (ছাত্রলীগ) -যুলী (যুবলীগ) এবং কিছু আলী (আওয়ামী লীগ) সদস্যও টেন্ডারবাজি আর খুন-খারাবিতে যুক্ত হয় এবং তিনি যেন কিছুটা নমনীয় তখন আমাদের খারাপ লাগে। তার আলী-ছালী-যুলীর অনেকেই যে তাকে ডোবাচ্ছেন, তা যদি তিনি বুঝেও না বুঝতে চান তখন আমাদের মনে হতে চায়, তিনি বোধহয় এদের আশকারা দিতে চান। আমরা কষ্ট পাই। এরপরও তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখান, আমরা আশাবাদী হই। আমরা তার কিছু ভালো কাজের জন্য কিছু অন্যায় কাজকেও হজম করে নিতে চাই, হজম করে নিতে বাধ্য হই। কারণ মূলত এটিই এবং সেটা হচ্ছে- আমরা যাবটা কোথায়? তাকে বাদ দিলে যে ওনার কাছে যেতে হয়! ওনার কাছে গেলে তো আবার বাতাসভবন, আবার দুর্নীতি, আবার জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ, আবার বাংলাভাই কিংবা ইংরেজিভাই! কিন্তু তার কাছেও যদি আমরা আলী-ছালী-যুলীর বঁটির নিচে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের কাছে ‘ভাইছা’ আর ‘ভাইয়া’র পার্থক্য থাকল কোথায়? তারপরও আমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় যেতে যেন ভয় পাই। আমাদের এ ভয় স্বাভাবিক- ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ভয় পাবেই। তিনি আমাদের যেন সে ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তার দেশপ্রেম নিয়ে আমরা সন্দেহ করতে চাই না। আমরা অবশ্যই স্বীকার করি, তিনি গত কয়েক বছরে আমাদের বেশ সম্মানজনক অবস্থানে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। বিলবোর্ড নিয়ে দুষ্টলোকেরা বানানের ই-কারকে আ-কার করে হয়তো ঠাট্টা-মশকরা করে ফেলতে পারেন। কিন্তু আমরা বিলবোর্ড-প্রচার ছাড়াই তার আলী সরকারের অনেক অর্জন জানি, স্বীকার করি এবং এসব অর্জনের সুফলভোগী। কিন্তু তার কিছু অসহিষ্ণু-আচরণ, আগেই বলেছি কিছু বাক্যবাণ বা শব্দচয়ন, প্রতিহিংসা জাতীয় ক্ষুদ্রতা ছোট করে ফেলে, তার দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি তো আমাদের সবার, বিরোধী দলের জনগণও তো তার সরকারেরই অধীনে। তার কোনো প্রতিমন্ত্রী হয়তো বলে ফেলতে পারেন যে, বিরোধী দলের লোকদের রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আমরা ক্ষমতায় আসিনি, কিন্তু তিনি তো তেমন কিছু করতে পারেন না। তিনি দল করবেন ঠিকই, কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পদে থেকে তো দলীয় হতে পারেন না; তিনি দলীয় প্রধান অবশ্যই থাকতে পারেন, কিন্তু সরকারপ্রধান হিসেবে তো দলীয়প্রধানের ভূমিকায় যেতে পারেন না। সরকারের কর্মকাণ্ডে তিনি সবার, তিনি সরকারপ্রধান; দলীয় কর্মকাণ্ডে তিনি অবশ্যই দলের, শুধুই আলী-ছালী-যুলীর। কিন্তু আমরা মাঝে-মধ্যে অপ্রস্তুত হয়ে যাই যখন দেখি, তিনি সরকার এবং দলকে গুলিয়ে ফেলেন, তিনি সরকারপ্রধান আর দলীয় প্রধানের মধ্যে সীমারেখা হারিয়ে ফেলেন। এবারের তার জাতিসংঘে গমনে সফরসঙ্গী নির্বাচন এবং তা-ই যেন চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল।
জাতিসংঘের অধিবেশনে তার সফরসঙ্গী নাকি ১৪০, আমাদের বিশ্বাসই হতে চায় না। এ ১৪০-এর নামধাম-পদবি জানতে পারলে একটা চুলচেরা বিশ্লেষণে হয়তো যাওয়া সহজ হতো- একজন একজন করে বলা যেত কে প্রয়োজনীয় আর কে অপ্রয়োজনীয়। প্রাতঃভ্রমণের সময়ে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছেন, এ ১৪০ কে চিনি কি-না, কে সেখানে কী কাজে গেলেন? একজন তো আগ বাড়িয়ে রসিকতা করে বলেই ফেললেন, আরে ভাই, বিয়ে তো হয় শুধু কনের, একজনের, তাই বলে বরযাত্রী কি শত শত হয় না? তার সঙ্গে বাকিদের গোটা কয়েককে বর-কনের চাচা-জেঠা, ভাই-বেরাদার, কাজী-ঘটক ভেবে নিন, বাকি সব ওই যাত্রী। এর মধ্যে নাকি আবার ৯৪ জনের খরচ সরকারের, জনপ্রতি নাকি ৫ লাখ টাকারও বেশি ব্যয়। এক সাবেক চাকরিজীবী তো বললেন, হোটেল-যাতায়াত সব মিলিয়ে ৫ লাখেরও অনেক বেশি পড়বে। রাজা-বাদশাদের সফরসঙ্গী যত বেশি তত মজা, তিনিও হয়তো তেমন কাজটিই করেছেন। কিন্তু আমরা বড় নিষ্ঠুরভাবে প্রশ্ন রাখতে চাই- ১৪০ কেন? এরা দেশকে জাতিসংঘে কীভাবে উপকৃত করলেন? তিনি কি মেয়াদের শেষদিকে ‘ওস্তাদের মার শেষরাত’ করে দেখালেন? কার টাকায় তিনি এটা করলেন? ক্ষমতা থাকলেই কি সব করতে হয়? আর সুযোগ না হতে পারে ভেবেই কি তিনি দল-তুষ্টিতে এ ‘অপকর্ম’টা করলেন? মানুষের মুখ তো আর বন্ধ রাখা যায় না, একজন জিজ্ঞেস করলেন, ১৪০- এটাও কি তার দেশপ্রেম? তিনি জবাব দিতে বাধ্য নন, তা-ও জবাব দেবেন কি?
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
সম্প্রতি তিনি জাতিসংঘে গেলেন, ভালো কথা। গত চার বছরও গিয়েছেন। তাকে যেতে হয়। বিশ্বক্লাবে দেশকে তুলে ধরতে না পারা আমাদেরও কাম্য নয়। আর নিজ মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেয়ার সাহসী ইতিহাস তো তার পিতা আমাদের জাতির জনকই সৃষ্টি করেছেন। তিনি তা ধরে রেখেছেন বলে আমরা গৌরবান্বিত। তার অনেক সাহসী কর্মের আমরা প্রশংসা করি। সেনা-নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তার দেশে ফেরার বাধা উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরেছেন, আমরা বলেছি বাপকা বেটি। জেলে গিয়েও মাথা নত করেননি, আমরা তার মাঝে পিতৃ-রক্তের মহিমা লক্ষ্য করলাম। ঢাকা সেনানিবাসের ১৬৮ কাঠা সম্পত্তি তিনি কল্যাণমুখী কাজে নিয়ে এলেন, গণতন্ত্রকে সেনাছাউনিতে বন্দিত্ব থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত করলেন, সঙ্গে এক দেশনেত্রীকেও সেনা-আশ্রয়ে থাকার ‘অপবাদ’ থেকে রেহাই দিলেন; আমরা বাহবা দিলাম। জাতির জনক হত্যার পর টলটলায়মান নৌকার দলকে চাঙা করলেন, আমরা তার দেশপ্রেমে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থানে প্রীত হলাম। তার অনেক অর্জনে আমরা আশাবাদী অবশ্যই। কিন্তু তার কিছু কথাবার্তায় আমরা হতাশ হই। তাকে জননেত্রী বললে তা বলতে তিনি চামচাদের নিষেধ করেন না, তা-ও আমরা মেনে নিই। নেতা হলে তো নাম ফুটাতে হয়, নাম না ফুটালে কি ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়? একজন স্বামীর নামে রাজনীতি করে যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারেন, দেশনেত্রী হয়ে যেতে পারেন, তিনি কেন জননেত্রী হতে পারবেন না? আমরা পরশ্রীকাতর নই, আমরা ছোটলোক হব না, তারা দেশনেত্রী-জননেত্রী থাকুন। আমরা না বললেও কিছু আসে-যায় না, চামচারা তো আছেন, বলবেন। আমরা বৃক্ষ তোমার নাম কী শুনতে তত আগ্রহী নই, কারণ আমরা যে ফলের পরিচয়ে বিশ্বাস করি। অতএব, আমরা তার একটা আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের নাম বদলানোকে ভালোভাবে দেখি না। প্রতিহিংসারূপে ভাবি; আমরা এক নভোথিয়েটারের নাম বদলানোও সহজভাবে গ্রহণ করি না, এটিকে ছোটলোকি ভাবি, কারণ তার পিতাও অন্তত এ কাজটি করতেন না। যার নামে নভোথিয়েটারটি পরিচিত হয়ে গিয়েছিল তাকে তার পিতাও বেশ সম্মান করতেন এবং সে ব্যক্তিটি তার দলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার এমনতরো কিছু কিছু ছোটখাটো কাজ আমাদের পীড়িত করেছে, তার মহত্ত্ব¡ আর বড়ত্ব নিয়ে আমাদের সন্দিহান করেছে। কিছু সম্মানিত ব্যক্তিকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাক্যবাণে অসম্মান করে তিনি অযথা নিজকে ‘ছোট’ করেছেন, তিনি নিজকে নিচে নামিয়েছেন। আমরা অসন্তষ্ট হয়েছি। রাজনীতি করলে অন্যকে বা বিপক্ষ কাউকে ঘায়েল করতে হতেই পারে। তবে তারও মাত্রা থাকে। ওই ঘায়েল করাটা রাজার মতো হতে হয়। সেখানে শ্রদ্ধাবোধ আর সম্মানবোধ ক্ষুণ্ন করার দরকার পড়ে না। সংসদীয় রীতিতে মিথ্যাকে সরাসরি মিথ্যা না বলে অসত্য বলা হয়। এভাবে শালীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপক্ষ নেতাকে মাননীয় বলেও কঠোর সমালোচনা করা হয়, তাতে সমালোচনার গুরুত্ব কমে না, অথচ গণতান্ত্রিক ভব্যতা রক্ষা পায়। তাই ‘আমি কার খালুরে’, ‘মোটাতাজা’, ‘সিঁদেল চোর’, ‘নির্বাচন করতে ব্যর্থ’ জাতীয় বিভিন্ন কাঁচা শব্দে সম্মানিত ব্যক্তিদের গেঁয়ো-ঝগড়াটের মতো আক্রমণ যেমন আমরা পছন্দ করিনি, তেমনি বিশ্ববরেণ্য কাউকে সুদখোর, রক্তচোষা বলাও আমাদের ভালো লাগেনি। এ আক্রমণগুলো তিনি তার পদ এবং পিতৃ-পরিচয় বিবেচনায় আরও অনেক সম্মানজনকভাবে উদারতার সঙ্গেও করতে পারতেন। তাহলে আমরা খুশি হতাম, তাকে আমরা রাষ্ট্রনায়কোচিত পর্যায়ে ভাবতে আনন্দ পেতাম। কিন্তু তিনি আমাদের হতাশ করেছেন। তার আরও অনেক অনেক কর্মকাণ্ডে, বিশেষত বাক্যচয়নে আমরা ব্যথিত হয়েছি। অথচ আমরা তার গুণমুগ্ধ ভক্ত হতে চেয়েছিলাম, তার মাঝে দেশপ্রেমের ঔদার্যের সঙ্গে রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণ দেখতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এ কারণে যে, তিনি জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন, তিনি সত্যিই দেশকে কিছু দিতে চেয়েছেন।
তার দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ জাগেনি। তিনি যখন আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, মা-বাবা-ভাই সব হারিয়ে দেশকে কিছু দেয়া ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, তখন আমরা আপ্লুত হই, আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন দেখি তার ছালী (ছাত্রলীগ) -যুলী (যুবলীগ) এবং কিছু আলী (আওয়ামী লীগ) সদস্যও টেন্ডারবাজি আর খুন-খারাবিতে যুক্ত হয় এবং তিনি যেন কিছুটা নমনীয় তখন আমাদের খারাপ লাগে। তার আলী-ছালী-যুলীর অনেকেই যে তাকে ডোবাচ্ছেন, তা যদি তিনি বুঝেও না বুঝতে চান তখন আমাদের মনে হতে চায়, তিনি বোধহয় এদের আশকারা দিতে চান। আমরা কষ্ট পাই। এরপরও তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখান, আমরা আশাবাদী হই। আমরা তার কিছু ভালো কাজের জন্য কিছু অন্যায় কাজকেও হজম করে নিতে চাই, হজম করে নিতে বাধ্য হই। কারণ মূলত এটিই এবং সেটা হচ্ছে- আমরা যাবটা কোথায়? তাকে বাদ দিলে যে ওনার কাছে যেতে হয়! ওনার কাছে গেলে তো আবার বাতাসভবন, আবার দুর্নীতি, আবার জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ, আবার বাংলাভাই কিংবা ইংরেজিভাই! কিন্তু তার কাছেও যদি আমরা আলী-ছালী-যুলীর বঁটির নিচে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের কাছে ‘ভাইছা’ আর ‘ভাইয়া’র পার্থক্য থাকল কোথায়? তারপরও আমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় যেতে যেন ভয় পাই। আমাদের এ ভয় স্বাভাবিক- ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ভয় পাবেই। তিনি আমাদের যেন সে ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তার দেশপ্রেম নিয়ে আমরা সন্দেহ করতে চাই না। আমরা অবশ্যই স্বীকার করি, তিনি গত কয়েক বছরে আমাদের বেশ সম্মানজনক অবস্থানে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। বিলবোর্ড নিয়ে দুষ্টলোকেরা বানানের ই-কারকে আ-কার করে হয়তো ঠাট্টা-মশকরা করে ফেলতে পারেন। কিন্তু আমরা বিলবোর্ড-প্রচার ছাড়াই তার আলী সরকারের অনেক অর্জন জানি, স্বীকার করি এবং এসব অর্জনের সুফলভোগী। কিন্তু তার কিছু অসহিষ্ণু-আচরণ, আগেই বলেছি কিছু বাক্যবাণ বা শব্দচয়ন, প্রতিহিংসা জাতীয় ক্ষুদ্রতা ছোট করে ফেলে, তার দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি তো আমাদের সবার, বিরোধী দলের জনগণও তো তার সরকারেরই অধীনে। তার কোনো প্রতিমন্ত্রী হয়তো বলে ফেলতে পারেন যে, বিরোধী দলের লোকদের রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আমরা ক্ষমতায় আসিনি, কিন্তু তিনি তো তেমন কিছু করতে পারেন না। তিনি দল করবেন ঠিকই, কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পদে থেকে তো দলীয় হতে পারেন না; তিনি দলীয় প্রধান অবশ্যই থাকতে পারেন, কিন্তু সরকারপ্রধান হিসেবে তো দলীয়প্রধানের ভূমিকায় যেতে পারেন না। সরকারের কর্মকাণ্ডে তিনি সবার, তিনি সরকারপ্রধান; দলীয় কর্মকাণ্ডে তিনি অবশ্যই দলের, শুধুই আলী-ছালী-যুলীর। কিন্তু আমরা মাঝে-মধ্যে অপ্রস্তুত হয়ে যাই যখন দেখি, তিনি সরকার এবং দলকে গুলিয়ে ফেলেন, তিনি সরকারপ্রধান আর দলীয় প্রধানের মধ্যে সীমারেখা হারিয়ে ফেলেন। এবারের তার জাতিসংঘে গমনে সফরসঙ্গী নির্বাচন এবং তা-ই যেন চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল।
জাতিসংঘের অধিবেশনে তার সফরসঙ্গী নাকি ১৪০, আমাদের বিশ্বাসই হতে চায় না। এ ১৪০-এর নামধাম-পদবি জানতে পারলে একটা চুলচেরা বিশ্লেষণে হয়তো যাওয়া সহজ হতো- একজন একজন করে বলা যেত কে প্রয়োজনীয় আর কে অপ্রয়োজনীয়। প্রাতঃভ্রমণের সময়ে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছেন, এ ১৪০ কে চিনি কি-না, কে সেখানে কী কাজে গেলেন? একজন তো আগ বাড়িয়ে রসিকতা করে বলেই ফেললেন, আরে ভাই, বিয়ে তো হয় শুধু কনের, একজনের, তাই বলে বরযাত্রী কি শত শত হয় না? তার সঙ্গে বাকিদের গোটা কয়েককে বর-কনের চাচা-জেঠা, ভাই-বেরাদার, কাজী-ঘটক ভেবে নিন, বাকি সব ওই যাত্রী। এর মধ্যে নাকি আবার ৯৪ জনের খরচ সরকারের, জনপ্রতি নাকি ৫ লাখ টাকারও বেশি ব্যয়। এক সাবেক চাকরিজীবী তো বললেন, হোটেল-যাতায়াত সব মিলিয়ে ৫ লাখেরও অনেক বেশি পড়বে। রাজা-বাদশাদের সফরসঙ্গী যত বেশি তত মজা, তিনিও হয়তো তেমন কাজটিই করেছেন। কিন্তু আমরা বড় নিষ্ঠুরভাবে প্রশ্ন রাখতে চাই- ১৪০ কেন? এরা দেশকে জাতিসংঘে কীভাবে উপকৃত করলেন? তিনি কি মেয়াদের শেষদিকে ‘ওস্তাদের মার শেষরাত’ করে দেখালেন? কার টাকায় তিনি এটা করলেন? ক্ষমতা থাকলেই কি সব করতে হয়? আর সুযোগ না হতে পারে ভেবেই কি তিনি দল-তুষ্টিতে এ ‘অপকর্ম’টা করলেন? মানুষের মুখ তো আর বন্ধ রাখা যায় না, একজন জিজ্ঞেস করলেন, ১৪০- এটাও কি তার দেশপ্রেম? তিনি জবাব দিতে বাধ্য নন, তা-ও জবাব দেবেন কি?
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments