অক্টোবরের আন্দোলন এবং হাসিনা সরকারের পতন কি হতে যাচ্ছে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকার
বন্ধু-বান্ধবদের প্রায়ই জিজ্ঞাসা করি কেমন আছেন? তারা কেউ বলেন, ভালো আছি,
কেউ বলেন ভালো নেই। কিন্তু সম্প্রতি এক বন্ধু বললেন, বড় দুশ্চিন্তায় আছি।
দুশ্চিন্তা কেন? তিনি বললেন, আগামী ২৫ অক্টোবরের পর অর্থাৎ আসন্ন কোরবানির
ঈদের পর দেশে কী হবে তা তো বুঝতে পারছি না। বিএনপির নেতা-নেত্রীরা তো হুমকি
দিয়েছেন, তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে অক্টোবরের শেষ থেকে
ঘোর অরাজকতা সৃষ্টি করে দেশ অচল করে দেয়া হবে। কী ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ,
রক্তপাত, প্রাণহানি শুরু হয় তা তো বুঝতে পারছি না। দেশের মানুষ আতংকে দিন
কাটাচ্ছে। সভয়ে, রুদ্ধশ্বাসে মাস শেষের দিকে তাকিয়ে আছে। বন্ধুর কথা শুনে
শৈশবের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ল। বাংলা ১৩৪৮ এবং ইংরেজি ১৯৪১ সালের কথা। তখন
আমার সাত-আট বছর বয়স। গ্রামের স্কুলে পড়ি। এ সময় সাধারণ মানুষ পঞ্জিকার
কথা খুব বিশ্বাস করত। ঘরে ঘরে পঞ্জিকা থাকত। তখন গুপ্ত প্রেস ডাইরেক্টরি
পঞ্জিকার যুগ। আবার মুসলমানদের জন্য মোহাম্মদী পঞ্জিকাও বের হতো। এই গুপ্ত
প্রেস পঞ্জিকায় রাশিফল থাকত। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রেরও অনেকেই তা পড়ত এবং
অন্ধভাবে বিশ্বাসও করত। এসব রাশিফল বা ভবিষ্যৎগণনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলত
না, কিন্তু দু-একটি হয়তো কখনও-সখনও খেটে যেত। তখন চারদিকে হৈচৈ পড়ে যেত। ১৩৪৮
(১৯৪১) সালের পঞ্জিকাতেও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। সে বছর ১১ জ্যৈষ্ঠ
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে প্রচণ্ড সাইক্লোন হবে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হবে।
প্রকৃতির রুদ্ররোষে অসংখ্য মানুষ, গবাদিপশুর মৃত্যু হবে, ঘরবাড়ি, ক্ষেতের
ফসল ধ্বংস হবে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকাগুলো প্লাবিত হবে। বৈশাখ
মাস শুরু হতেই গুপ্ত প্রেস ডাইরেক্টরি পঞ্জিকায় এই রাশিফল মানুষের মুখে
মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ বাংলার মানুষ অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে
থাকে। তখন ব্রিটিশ আমল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া বা ঝড়ের আভাস পেলে
লোকোপসারণের ব্যবস্থা কিছুই ছিল না। দক্ষিণ বাংলার মানুষ ভাগ্যের ওপর
নিজেদের ছেড়ে সেই ভয়ঙ্কর ১১ জ্যৈষ্ঠের অপেক্ষা করছিল।
আগেই লিখেছি আমি তখন সাত-আট বছরের বালক। দক্ষিণ বাংলার বরিশাল জেলার উলানিয়া গ্রামের এক স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ি। জ্যৈষ্ঠ মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষ আসন্ন সাইক্লোনের কথা ভেবে কতটা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, সে কথা এখনও আমার মনে আছে। অনেকে অবশ্য পঞ্জিকায় ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করেননি। কিন্তু ১০ জ্যৈষ্ঠ সকাল থেকে আকাশ খুব মেঘলা হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় সেই কালো মেঘের ওপর একটা লালচে আভা। সবাই বলল, সাইক্লোনের পূর্বাভাস।
বয়সে খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু সেই দারুণ অভিজ্ঞতার কথা এখনও মনে আছে। ১০ জ্যৈষ্ঠের (১৩৪৮) সন্ধ্যা থেকে বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। তারপর মধ্যরাতে প্রচণ্ড তাণ্ডব। সেই তাণ্ডবের রাতের অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। আমরা বাড়িঘর ছেড়ে পুরনো জীর্ণ একটা ইটের দালানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সকালে ঝড় থামলে দেখেছি সারা গ্রাম যেন একটা ধ্বংসস্তূপ। এই ঝড়ের পরই শুরু হয় পঞ্চাশের সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের পর মন্বন্তর। অবিভক্ত বাংলার ৫০ লাখ মানুষ তাতে মারা যায়। অতীতের কথা থাক। আজ ৭২ বছর পর দেখছি স্বাধীন বাংলার মানুষ আবার শঙ্কিত। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে নয়, মনুষ্যসৃষ্ট রাজনৈতিক দুর্যোগের ভয়ে তারা ভীত। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, গ্রামের দিকে এই ভয় ততটা প্রকট নয়, যতটা প্রকট শহরে এবং শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে। কারণ, রাজনৈতিক ঝড়ের প্রকোপটা শহরের দিকেই বেশি হয়। শহরের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এটা পঞ্জিকার যুগ নয় এবং অক্টোবরের শেষে বাংলাদেশে কী ঘটবে সেটা পঞ্জিকার ভবিষ্যদ্বাণী নয়. একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হুমকি। সেই হুমকির ভাষা বড় ভয়ঙ্কর। বিএনপির শীর্ষ নেতা-নেত্রীরাই বলেছেন, অক্টোবরের শেষে তারা যে আন্দোলন শুরু করবেন, তাতে হাসিনা সরকার আর ক্ষমতায় থাকবে না। বিএনপির এক পাতিনেতা বলেছেন, ২৫ অক্টোবরের পর দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন বেগম খালেদা জিয়া। হেফাজত গত ৫ মে শাপলা চত্বরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটাবে এই আশায় শেখ হাসিনাকে বেগম জিয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতা ত্যাগ ও দেশত্যাগের চরমপত্র দিয়েছিলেন। এবার হেফাজত ঘোষণা দিয়েছে, তারা ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও করবে। বিএনপির নেতা-নেত্রীদের মুখে এখন শুধু হুমকি আর হুমকি। তিনি ব্যারিস্টার মওদুদ কিংবা এমকে আনোয়ার হোন, আর সাদেক হোসেন খোকা কিংবা মির্জা ফখরুল হোন, তাদের রাজনীতির ভাষা এখন হুমকির ভাষা। ফলে দেশের মানুষ বিশেষ করে শহরবাসীর মধ্যে দারুণ শঙ্কা। তারা জানে গণআন্দোলন করার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং সংগঠন কোনোটাই বিএনপির নেই। একসময় তাদের শক্তির ভিত্তি ছিল ক্যান্টনমেন্ট, এখন সেই শক্তির ভিত্তি জামায়াত ও হেফাজত। শেষোক্ত এই দুই দল মৌলবাদী এবং তাদের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই। দেশে নির্বাচন এলেই এটা প্রমাণিত হয়।
কিন্তু জামায়াতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডার আছে। কিছু মসজিদ ও মাদ্রাসা দখলে আছে। এই সশস্ত্র ক্যাডার ও মাদ্রাসা ছাত্র এবং শিক্ষকদের সাহায্যে তারা হরতাল ডাকার নামে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায়। সাধারণ পথচারী ও পুলিশ হত্যা করে। দু’চারটি বাস পোড়ানো হয়। বেশির ভাগ পোড়ে প্রাইভেট কার। হরতালের সমর্থনে নয়, আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কিছু দোকানপাট বন্ধ থাকে। স্কুলের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ হয়। অর্থাৎ ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশের রাজধানীসহ কিছু শহরে প্রায় আধা সচল আধা অচল অবস্থা সৃষ্টি করা যায়। শহরবাসীর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের তথাকথিত আন্দোলনের হুঙ্কারে তাই আতঙ্ক বেশি। এই ‘আন্দোলনে’ তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগামী ২৫ অক্টোবরের পর যদি বিএনপি তাদের ঘোষিত দেশ অচল করার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে, তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটা জেনে আতঙ্কিত যে, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে যে ভাংচুর, সন্ত্রাসের কর্মকাণ্ড শুরু হবে তার নেতৃত্ব দেবে জামায়াত। বিএনপি নয়। জামায়াতিদের নৃশংসতা ’৭১ সাল থেকে দেশের মানুষের জানা। বিএনপির এমন সাংগঠনিক শক্তি নেই, যাতে তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে বিএনপির ছাতার তলে লুকিয়ে এই সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে জামায়াত।
বেগম খালেদা জিয়ার বিশাল জনসভাগুলো তারাই এখন পূর্ণ করছে। জামায়াতি দাড়ি-টুপির সমাহার দেখলেই এই জনসভাগুলোর বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। সিলেটে তো বিএনপি নেত্রীর জনসভা উপলক্ষ করে ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে এক দফা সংঘর্ষই হয়ে গেছে। ২৫ অক্টোবরের পর বিএনপি যদি তাদের ‘আন্দোলনের’ ডাক দেয় এবং যে আন্দোলন রূপ নেবে দেশময়- বিশেষ করে ছোট-বড় শহরগুলোতে ভাংচুর, সন্ত্রাসে তাতে যে জামায়াত নেতৃত্ব দেবে দেশের মানুষ তা জানে এবং সে জন্যই তারা শঙ্কিত।
গণআন্দোলন করার ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা এবং জনসমর্থন বিএনপি এবং জামায়াত কোনো দলেরই নেই। তবে ভাংচুর, সন্ত্রাস সৃষ্টির দক্ষতা দুই দলেরই আছে। তাতে জামায়াতের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাই অনেক বেশি। সুতরাং আগামী ২৫ অক্টোবরের পরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য ‘দেশ অচল করার’ আন্দোলনে নামলে তাতে দেশ অচল হবে না, দেশময় সন্ত্রাস ছড়াবে। আর এই সন্ত্রাস ছড়াতে জামায়াতের সমর্থন ও সহযোগিতা বিএনপির অবশ্যই প্রয়োজন হবে। এই সত্যটা জেনেই ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানের প্রশ্নে বিএনপি এখন আর জামায়াতের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড বানচাল করার লক্ষ্যে তারা এখন প্রকাশ্যে জামায়াতকে সমর্থন দিতে শুরু করেছে। ব্যারিস্টার মওদুদ ফতোয়া দিয়েছেন, সর্বোচ্চ আদালতের ফাঁসির আদেশ রিভিউ করা ছাড়া কাদের মোল্লার প্রাণদণ্ড কার্যকর করা যাবে না। জামায়াতি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকেরও একই দাবি। অন্যদিকে বিএনপির এক আইনজীবী হুমকি দিয়েছেন, ‘এখন যেসব বিচারপতি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, ভবিষ্যতে বাংলার মাটিতে তাদের বিচার করা হবে।’ স্পষ্টই বোঝা যায়, ২৫ অক্টোবরের পর যদি কোনো তথাকথিত আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে তা হবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনের মোড়কে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি ভণ্ডুল করার আন্দোলন। ২৫ অক্টোবরের আগে বিএনপির দাবি মানা বা দলটির সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার এগোবে কিনা আমি জানি না। ধরে নেয়া যাক, তারাও তাদের জেদ বজায় রাখবেন এবং কোনো আপস করতে চাইবেন না। তাহলে বিএনপি ও জামায়াতের যৌথ শক্তি এবং পেছনে ইউনূস সেন্টার, সুশীল সমাজ ও একশ্রেণীর বিগ এনজিও ও বিগ মিডিয়ার সমর্থন কি হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে পারবে?
এখানে একটি বড় জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন আঁকতে হয়। আমি বিএনপির দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা দাবি করছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবেন। এটা সম্ভব বলে তারা কি ভাবছেন? দু’নেতাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তারা দুটি লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন। এক. ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা দেশ অচল করে দিয়ে হাসিনা-সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে তারা ক্ষমতায় যাবেন। দুই. অরাজকতা সৃষ্টি দ্বারা তারা নিজেরা হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে না পারলেও দেশের অন্য কোনো শক্তি (সম্ভবত সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন) অরাজকতা দূর করার জন্য মাঠে নামতে বাধ্য হবে এবং তাতে হাসিনা সরকারের পতন হবে। হাসিনা সরকারের পতন হলে ওই শক্তি হয় বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে, না হয় নিজেরা ক্ষমতা নেবে। সামনে ফখরুদ্দীনের মতো একজন শিখণ্ডী খাড়া রাখবে। তাও যদি হয়, বিএনপির আপত্তি নেই। বিএনপির উদ্দেশ্য হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। আর হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানও স্থগিত হয়ে যাবে; চাই কি বাতিল হয়েও যেতে পারে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়াও সম্ভব ও সহজ হবে।
বিএনপি নেতাদের এই আশাবাদের পাশে আরও একটি মহলের প্রবল আশাবাদ জাগ্রত রয়েছে। সেটি হল সুশীল সমাজ, ইউনূস সেন্টার এবং একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া ও বিগ এনজিও’র সমন্বয়ে গঠিত এলিটসক্লাব। তার পেছনে ২০০১ সালের বিদেশী টুয়েসডেক্লাবেরও যোগসাজশ আছে বলে জানা যায়। তারা এই আশায় গোঁফে তেল মাখছেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের লড়াইয়ে তারা বক্তৃতা-বিবৃতি ও সেমিনারের মাধ্যমে বিএনপিকে মদদ দিচ্ছেন বটে, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা এই লড়াইয়ে দুই পক্ষই হারবে এবং তৃতীয় পক্ষ বা তৃতীয় শক্তি হিসেবে বহুকাল পর তাদের ক্ষমতায় বসার সুযোগটি নাকের ডগায় এসে যাবে। এ ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো এমনকি ভারতও তাদের সমর্থন দেবে। এই আশায় ভাগাড়ে গরু মরার আগেই এরা শকুনের মতো আকাশে উড়তে শুরু করেছেন। তাদের শীর্ষ নেতাদের কেউ বিদেশে সমর্থন সংগ্রহের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ দেশে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সমর্থন দানের নামে হাসিনাবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা বড় রুই। কিন্তু তাদের সমর্থক ছোট ছোট পুঁটিও বাংলাদেশের খালে-বিলে নাচতে শুরু করেছে। সংবাদপত্রের কলামে, টিভি টকশোতে এদেরই আধিক্য দেখা যায়।
কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি, বড় বড় শক্তির বিশ্ব স্ট্র্যাটেজি যে বদলে গেছে এটা এই আত্মপ্রত্যয়ীদের দল সম্ভবত বুঝতে পারছেন না। এরা সত্যই ‘সুশীল বালক’। আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমেরিকাসহ বিশ্বের তাবৎ বড় শক্তিই বুঝতে পেরেছে যে, কারজাই, জারদারি মার্কা সিভিল ফেস ক্ষমতায় বসিয়ে কোনো লাভ হয়নি, হবেও না। বাংলাদেশেও এক-এগারোর এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছে। তাই রাজনীতিকদের দ্বারাই রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের অনিবার্যতা আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো বুঝতে পেরেছে। সেজন্যই প্রেসিডেন্ট ওবামা শেখ হাসিনাকে তার ছেলে জয় সম্পর্কে বলেন, ‘ইওর সান ইজ এ ভেরি ফার্স্ট বয়’। অন্যদিকে গুজব রটেছে, লন্ডনে বিএনপি নেত্রীর পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাধিক কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল খারাপ হোক আর ভালো হোক, তাদের মাইনাস করে কোনো সমস্যারই সমাধান করা যাবে না। সুতরাং দেশটির সংকট সমাধানে এই দুই দলকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। এই সত্যিটি না বুঝে যারা এখন সুশীল সমাজ ও ইউনূস সেন্টারে গিয়ে জড়ো হয়েছেন এবং তাদের সমর্থনে পাগড়ি বেঁধেছেন, শিগগিরই তারা বুঝতে পারবেন কত বড় শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যে তারা বাস করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামীতেও শক্তি পরীক্ষা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মিত্র এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধবাদী শক্তির মধ্যে। এক্ষেত্রে একটাই ভরসা, বিএনপির আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই; আছে জামায়াতের সহযোগিতায় সন্ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতা। সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা কোনো সরকারের পতন ঘটানো যায় না, আগামী ২৫ অক্টোবরের পরও যদি বিএনপি সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে, তারা সফল হবে না। দেশে শান্তি-শৃংখলায় কিছুটা ক্ষতি করবে মাত্র। আওয়ামী লীগ তথা হাসিনা সরকার যদি তার জনসমর্থনের শিকড়টিতে জোড়া লাগাতে পারে, তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবরের রাজনৈতিক প্রলয়ের ঝুঁকি ১৯৪১ সালের গুপ্ত প্রেস ডাইরেক্টরি পঞ্জিকায় প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার সতর্কবাণী নয়; সুতরাং ভয় পাওয়ার তেমন কিছু আছে বলে মনে করি না।
আগেই লিখেছি আমি তখন সাত-আট বছরের বালক। দক্ষিণ বাংলার বরিশাল জেলার উলানিয়া গ্রামের এক স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ি। জ্যৈষ্ঠ মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষ আসন্ন সাইক্লোনের কথা ভেবে কতটা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, সে কথা এখনও আমার মনে আছে। অনেকে অবশ্য পঞ্জিকায় ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করেননি। কিন্তু ১০ জ্যৈষ্ঠ সকাল থেকে আকাশ খুব মেঘলা হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় সেই কালো মেঘের ওপর একটা লালচে আভা। সবাই বলল, সাইক্লোনের পূর্বাভাস।
বয়সে খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু সেই দারুণ অভিজ্ঞতার কথা এখনও মনে আছে। ১০ জ্যৈষ্ঠের (১৩৪৮) সন্ধ্যা থেকে বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। তারপর মধ্যরাতে প্রচণ্ড তাণ্ডব। সেই তাণ্ডবের রাতের অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। আমরা বাড়িঘর ছেড়ে পুরনো জীর্ণ একটা ইটের দালানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সকালে ঝড় থামলে দেখেছি সারা গ্রাম যেন একটা ধ্বংসস্তূপ। এই ঝড়ের পরই শুরু হয় পঞ্চাশের সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের পর মন্বন্তর। অবিভক্ত বাংলার ৫০ লাখ মানুষ তাতে মারা যায়। অতীতের কথা থাক। আজ ৭২ বছর পর দেখছি স্বাধীন বাংলার মানুষ আবার শঙ্কিত। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে নয়, মনুষ্যসৃষ্ট রাজনৈতিক দুর্যোগের ভয়ে তারা ভীত। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, গ্রামের দিকে এই ভয় ততটা প্রকট নয়, যতটা প্রকট শহরে এবং শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে। কারণ, রাজনৈতিক ঝড়ের প্রকোপটা শহরের দিকেই বেশি হয়। শহরের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এটা পঞ্জিকার যুগ নয় এবং অক্টোবরের শেষে বাংলাদেশে কী ঘটবে সেটা পঞ্জিকার ভবিষ্যদ্বাণী নয়. একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হুমকি। সেই হুমকির ভাষা বড় ভয়ঙ্কর। বিএনপির শীর্ষ নেতা-নেত্রীরাই বলেছেন, অক্টোবরের শেষে তারা যে আন্দোলন শুরু করবেন, তাতে হাসিনা সরকার আর ক্ষমতায় থাকবে না। বিএনপির এক পাতিনেতা বলেছেন, ২৫ অক্টোবরের পর দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন বেগম খালেদা জিয়া। হেফাজত গত ৫ মে শাপলা চত্বরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটাবে এই আশায় শেখ হাসিনাকে বেগম জিয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতা ত্যাগ ও দেশত্যাগের চরমপত্র দিয়েছিলেন। এবার হেফাজত ঘোষণা দিয়েছে, তারা ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও করবে। বিএনপির নেতা-নেত্রীদের মুখে এখন শুধু হুমকি আর হুমকি। তিনি ব্যারিস্টার মওদুদ কিংবা এমকে আনোয়ার হোন, আর সাদেক হোসেন খোকা কিংবা মির্জা ফখরুল হোন, তাদের রাজনীতির ভাষা এখন হুমকির ভাষা। ফলে দেশের মানুষ বিশেষ করে শহরবাসীর মধ্যে দারুণ শঙ্কা। তারা জানে গণআন্দোলন করার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং সংগঠন কোনোটাই বিএনপির নেই। একসময় তাদের শক্তির ভিত্তি ছিল ক্যান্টনমেন্ট, এখন সেই শক্তির ভিত্তি জামায়াত ও হেফাজত। শেষোক্ত এই দুই দল মৌলবাদী এবং তাদের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই। দেশে নির্বাচন এলেই এটা প্রমাণিত হয়।
কিন্তু জামায়াতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডার আছে। কিছু মসজিদ ও মাদ্রাসা দখলে আছে। এই সশস্ত্র ক্যাডার ও মাদ্রাসা ছাত্র এবং শিক্ষকদের সাহায্যে তারা হরতাল ডাকার নামে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায়। সাধারণ পথচারী ও পুলিশ হত্যা করে। দু’চারটি বাস পোড়ানো হয়। বেশির ভাগ পোড়ে প্রাইভেট কার। হরতালের সমর্থনে নয়, আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কিছু দোকানপাট বন্ধ থাকে। স্কুলের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ হয়। অর্থাৎ ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশের রাজধানীসহ কিছু শহরে প্রায় আধা সচল আধা অচল অবস্থা সৃষ্টি করা যায়। শহরবাসীর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের তথাকথিত আন্দোলনের হুঙ্কারে তাই আতঙ্ক বেশি। এই ‘আন্দোলনে’ তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগামী ২৫ অক্টোবরের পর যদি বিএনপি তাদের ঘোষিত দেশ অচল করার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে, তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটা জেনে আতঙ্কিত যে, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে যে ভাংচুর, সন্ত্রাসের কর্মকাণ্ড শুরু হবে তার নেতৃত্ব দেবে জামায়াত। বিএনপি নয়। জামায়াতিদের নৃশংসতা ’৭১ সাল থেকে দেশের মানুষের জানা। বিএনপির এমন সাংগঠনিক শক্তি নেই, যাতে তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে বিএনপির ছাতার তলে লুকিয়ে এই সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে জামায়াত।
বেগম খালেদা জিয়ার বিশাল জনসভাগুলো তারাই এখন পূর্ণ করছে। জামায়াতি দাড়ি-টুপির সমাহার দেখলেই এই জনসভাগুলোর বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। সিলেটে তো বিএনপি নেত্রীর জনসভা উপলক্ষ করে ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে এক দফা সংঘর্ষই হয়ে গেছে। ২৫ অক্টোবরের পর বিএনপি যদি তাদের ‘আন্দোলনের’ ডাক দেয় এবং যে আন্দোলন রূপ নেবে দেশময়- বিশেষ করে ছোট-বড় শহরগুলোতে ভাংচুর, সন্ত্রাসে তাতে যে জামায়াত নেতৃত্ব দেবে দেশের মানুষ তা জানে এবং সে জন্যই তারা শঙ্কিত।
গণআন্দোলন করার ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা এবং জনসমর্থন বিএনপি এবং জামায়াত কোনো দলেরই নেই। তবে ভাংচুর, সন্ত্রাস সৃষ্টির দক্ষতা দুই দলেরই আছে। তাতে জামায়াতের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাই অনেক বেশি। সুতরাং আগামী ২৫ অক্টোবরের পরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য ‘দেশ অচল করার’ আন্দোলনে নামলে তাতে দেশ অচল হবে না, দেশময় সন্ত্রাস ছড়াবে। আর এই সন্ত্রাস ছড়াতে জামায়াতের সমর্থন ও সহযোগিতা বিএনপির অবশ্যই প্রয়োজন হবে। এই সত্যটা জেনেই ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানের প্রশ্নে বিএনপি এখন আর জামায়াতের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড বানচাল করার লক্ষ্যে তারা এখন প্রকাশ্যে জামায়াতকে সমর্থন দিতে শুরু করেছে। ব্যারিস্টার মওদুদ ফতোয়া দিয়েছেন, সর্বোচ্চ আদালতের ফাঁসির আদেশ রিভিউ করা ছাড়া কাদের মোল্লার প্রাণদণ্ড কার্যকর করা যাবে না। জামায়াতি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকেরও একই দাবি। অন্যদিকে বিএনপির এক আইনজীবী হুমকি দিয়েছেন, ‘এখন যেসব বিচারপতি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, ভবিষ্যতে বাংলার মাটিতে তাদের বিচার করা হবে।’ স্পষ্টই বোঝা যায়, ২৫ অক্টোবরের পর যদি কোনো তথাকথিত আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে তা হবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনের মোড়কে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি ভণ্ডুল করার আন্দোলন। ২৫ অক্টোবরের আগে বিএনপির দাবি মানা বা দলটির সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার এগোবে কিনা আমি জানি না। ধরে নেয়া যাক, তারাও তাদের জেদ বজায় রাখবেন এবং কোনো আপস করতে চাইবেন না। তাহলে বিএনপি ও জামায়াতের যৌথ শক্তি এবং পেছনে ইউনূস সেন্টার, সুশীল সমাজ ও একশ্রেণীর বিগ এনজিও ও বিগ মিডিয়ার সমর্থন কি হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে পারবে?
এখানে একটি বড় জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন আঁকতে হয়। আমি বিএনপির দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা দাবি করছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবেন। এটা সম্ভব বলে তারা কি ভাবছেন? দু’নেতাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তারা দুটি লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন। এক. ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা দেশ অচল করে দিয়ে হাসিনা-সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে তারা ক্ষমতায় যাবেন। দুই. অরাজকতা সৃষ্টি দ্বারা তারা নিজেরা হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে না পারলেও দেশের অন্য কোনো শক্তি (সম্ভবত সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন) অরাজকতা দূর করার জন্য মাঠে নামতে বাধ্য হবে এবং তাতে হাসিনা সরকারের পতন হবে। হাসিনা সরকারের পতন হলে ওই শক্তি হয় বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে, না হয় নিজেরা ক্ষমতা নেবে। সামনে ফখরুদ্দীনের মতো একজন শিখণ্ডী খাড়া রাখবে। তাও যদি হয়, বিএনপির আপত্তি নেই। বিএনপির উদ্দেশ্য হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। আর হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানও স্থগিত হয়ে যাবে; চাই কি বাতিল হয়েও যেতে পারে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়াও সম্ভব ও সহজ হবে।
বিএনপি নেতাদের এই আশাবাদের পাশে আরও একটি মহলের প্রবল আশাবাদ জাগ্রত রয়েছে। সেটি হল সুশীল সমাজ, ইউনূস সেন্টার এবং একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া ও বিগ এনজিও’র সমন্বয়ে গঠিত এলিটসক্লাব। তার পেছনে ২০০১ সালের বিদেশী টুয়েসডেক্লাবেরও যোগসাজশ আছে বলে জানা যায়। তারা এই আশায় গোঁফে তেল মাখছেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের লড়াইয়ে তারা বক্তৃতা-বিবৃতি ও সেমিনারের মাধ্যমে বিএনপিকে মদদ দিচ্ছেন বটে, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা এই লড়াইয়ে দুই পক্ষই হারবে এবং তৃতীয় পক্ষ বা তৃতীয় শক্তি হিসেবে বহুকাল পর তাদের ক্ষমতায় বসার সুযোগটি নাকের ডগায় এসে যাবে। এ ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো এমনকি ভারতও তাদের সমর্থন দেবে। এই আশায় ভাগাড়ে গরু মরার আগেই এরা শকুনের মতো আকাশে উড়তে শুরু করেছেন। তাদের শীর্ষ নেতাদের কেউ বিদেশে সমর্থন সংগ্রহের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ দেশে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সমর্থন দানের নামে হাসিনাবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা বড় রুই। কিন্তু তাদের সমর্থক ছোট ছোট পুঁটিও বাংলাদেশের খালে-বিলে নাচতে শুরু করেছে। সংবাদপত্রের কলামে, টিভি টকশোতে এদেরই আধিক্য দেখা যায়।
কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি, বড় বড় শক্তির বিশ্ব স্ট্র্যাটেজি যে বদলে গেছে এটা এই আত্মপ্রত্যয়ীদের দল সম্ভবত বুঝতে পারছেন না। এরা সত্যই ‘সুশীল বালক’। আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমেরিকাসহ বিশ্বের তাবৎ বড় শক্তিই বুঝতে পেরেছে যে, কারজাই, জারদারি মার্কা সিভিল ফেস ক্ষমতায় বসিয়ে কোনো লাভ হয়নি, হবেও না। বাংলাদেশেও এক-এগারোর এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছে। তাই রাজনীতিকদের দ্বারাই রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের অনিবার্যতা আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো বুঝতে পেরেছে। সেজন্যই প্রেসিডেন্ট ওবামা শেখ হাসিনাকে তার ছেলে জয় সম্পর্কে বলেন, ‘ইওর সান ইজ এ ভেরি ফার্স্ট বয়’। অন্যদিকে গুজব রটেছে, লন্ডনে বিএনপি নেত্রীর পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাধিক কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল খারাপ হোক আর ভালো হোক, তাদের মাইনাস করে কোনো সমস্যারই সমাধান করা যাবে না। সুতরাং দেশটির সংকট সমাধানে এই দুই দলকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। এই সত্যিটি না বুঝে যারা এখন সুশীল সমাজ ও ইউনূস সেন্টারে গিয়ে জড়ো হয়েছেন এবং তাদের সমর্থনে পাগড়ি বেঁধেছেন, শিগগিরই তারা বুঝতে পারবেন কত বড় শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যে তারা বাস করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামীতেও শক্তি পরীক্ষা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মিত্র এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধবাদী শক্তির মধ্যে। এক্ষেত্রে একটাই ভরসা, বিএনপির আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই; আছে জামায়াতের সহযোগিতায় সন্ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতা। সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা কোনো সরকারের পতন ঘটানো যায় না, আগামী ২৫ অক্টোবরের পরও যদি বিএনপি সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে, তারা সফল হবে না। দেশে শান্তি-শৃংখলায় কিছুটা ক্ষতি করবে মাত্র। আওয়ামী লীগ তথা হাসিনা সরকার যদি তার জনসমর্থনের শিকড়টিতে জোড়া লাগাতে পারে, তাহলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবরের রাজনৈতিক প্রলয়ের ঝুঁকি ১৯৪১ সালের গুপ্ত প্রেস ডাইরেক্টরি পঞ্জিকায় প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার সতর্কবাণী নয়; সুতরাং ভয় পাওয়ার তেমন কিছু আছে বলে মনে করি না।
No comments