পোশাক শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি বিষয়ে নিরপেক্ষ আলোচনা by অরবিন্দ রায়
পোশাক
শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা করার দাবি উঠেছে। দাবি আদায়ের
লক্ষ্যে বেশ কিছুদিন থেকে শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ ডিউটি ফেলে
রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাংচুর করছে, আবার কেউ নিজ প্রতিষ্ঠানের মেশিন-আসবাবপত্র
ভাংচুরের মাধ্যমে দাবি আদায়কে ত্বরান্বিত করতে চাইছে। আসন্ন ঈদ-পূজার
বেতন-বোনাসের সঙ্গে বাড়তিটাও যেন চলে আসে এটাই সবার আশা। কিন্তু তা হাতে না
পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলার বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে
পারবে না। আবার বেশি রকম বাড়াবাড়ি সইতে না পেরে মালিকরা যদি ঈদ-পূজার আগেই
গেটে তালা লাগিয়ে দেন, তাহলে আম-ছালা দুটোই হারানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে
পারে। কাজেই মালিক যেন কারখানা সিলগালা করতে বাধ্য না হয়, এ বিষয়টি মাথায়
রেখে অগ্রসর হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করি। রক্তাক্ত ইতিহাস বিধৌত এ
ভূখণ্ডে যে কোনো ঝগড়া ফ্যাসাদে বরাবরই তিনটি পক্ষ থাকে। শ্রমিকের ন্যূনতম
মজুরি ধার্য সংক্রান্ত চলমান বিবাদে মূলত দুটি পক্ষ। একটি শ্রম ক্রেতা ও
অন্যটি বিক্রেতা। ক্রেতা হচ্ছেন পোশাক কারখানার মালিকরা। বিক্রেতা হচ্ছেন
শ্রমিক ভাইয়েরা। তবে এর মধ্যেও একটি তৃতীয় পক্ষ গজিয়ে উঠেছে। এ পক্ষটিকে
শ্রমিকের দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশসূচক নানা রকম ফতোয়া দিতে দেখা যাচ্ছে।
এতে শ্রমিকের মঙ্গল কী অমঙ্গল হবে তা তারা খুব বেশি ভাবছেন বলে মনে হয় না।
তবে দাবি আদায়ের জন্য যারা সহিংস মূর্তি ধারণ করছে তাদের এ কথা ভুলে গেলে
চলবে না যে, কোনো প্রিয় নেতাকে জেল থেকে মুক্তির দাবিতে সহিংসতা প্রদর্শন
আর আর্থিক সুবিধা আদায়ের জন্য সহিংসতা এক কথা নয়। যেহেতু মূল লক্ষ্য শ্রমের
বাড়তি মূল্য আদায়, এ আদায় ধার বা কর্জের টাকা আদায়ের পর্যায়ে পড়ে না।
উপরন্তু বাড়তি অর্থ প্রদানের বিষয়টি দাতার মনমর্জির ওপর ষোলআনা নির্ভরশীল।
কাজেই এ ধরনের অর্থ আদায়ের কাজটি সমঝোতার মাধ্যমে করাই সমীচীন বলে মনে করি।
রক্তপাতের সমূহ আশংকাকে হেলায় উড়িয়ে না দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন
করার জন্য উভয় পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে।
এবার ন্যূনতম মজুরি প্রসঙ্গ। একটি কারখানার সব শ্রমিককে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। দক্ষ, আধা দক্ষ ও শিক্ষানবিস। বলার অপেক্ষা রাখে না, ন্যূনতম মজুরি বলতে শিক্ষানবিস এক কথায় ধানের চাতাল বা গম ক্ষেত থেকে উঠে এসে কাজে যোগ দেয়া শ্রমিকের মজুরিকেই বোঝানো হয়। সদ্য কাজে যোগ দেয়া একজন ফ্লোর ক্লিনার বা এফসি’রাও এ ন্যূনতম মজুরির ক্যাটাগরিতে পড়বে। তৈরি পোশাক কারখানার অধিকাংশেই এয়ার শিপমেন্ট ঠেকানোর তাগিদে তথা বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে জাহাজিকরণের স্বার্থে ১২ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। তার মধ্যে আট ঘণ্টা হচ্ছে মূল হাজিরা। বাকি চার ঘণ্টা ওভারটাইম বা ওটি। অধিকাংশ পোশাক কারখানায় যেহেতু ওটি চলে; কাজেই ওটির হিসাব আমলে নিলে একজন শিক্ষানবিস শ্রমিকের পেছনে একজন মালিককে প্রতি মাসে মূল মজুরি আট হাজারের সঙ্গে ওভারটাইম চারসহ মোট ১২ হাজার টাকা গুনতে হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন শিক্ষানবিস শ্রমিকের চেয়ে একজন সুদক্ষ শ্রমিক দুই-তিন গুণ বেশি মজুরি পেয়ে থাকে। সে হিসাবে একজন সুদক্ষ শ্রমিকের পেছনে একজন মালিককে ওটিসহ প্রতি মাসে ২৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে। সুদক্ষ হলে এ টাকা পাবে, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হল, দক্ষ হলেই উল্লিখিত পরিমাণ টাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা যখন নতুনদের হাতছানি দেবে, তখন নতুনদের মধ্যে এক কারখানায় বেশিদিন কাজ করার মনমানসিকতা থাকবে না। এমনকি একজন শ্রমিক শিক্ষানবিস হিসেবে কাজে যোগদানের দু’-এক মাস যেতে না যেতেই ওই কারখানার পরিচিতি কার্ড ব্যবহার করে অন্য কারখানায় ছুটে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকবে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা একজন অশিক্ষিত বা সিকি শিক্ষিত ছেলে বা মেয়ের অদক্ষতা কাটিয়ে উঠতে কম করে হলেও এক বা দেড় বছর সময়ের প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে সে কারখানাকে শতভাগ সেবা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। অথচ তার পেছনে কোম্পানির প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা চলে যাবে। সে যাক। কিন্তু শ্রমিকটি দক্ষ হয়ে ওঠার পর যদি অন্যত্র ভেগে যায় তাহলে টাকা খরচ করে অদক্ষকে দক্ষ বানানোর এ ক্ষতি ওই কারখানা কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে, তা যথেষ্ট ভাবার বিষয়। প্রবাদ আছে, গাছ বাঁচিয়ে রেখে ফল খেতে হয়। কাজেই কোম্পানির ঘারে অতিরিক্ত বেতনের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার ফলে কারখানাটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তখন ন্যূনতম মজুরি আট হাজারের স্থলে আট লাখ করলেও কোনো দিক থেকে কোনো ফায়দা আসবে বলে মনে হয় না।
শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আট বা ওটিসহ ১২ হাজার করলে তাদের মঙ্গল কী অমঙ্গল হবে এর ব্যাখ্যাটি যতটা না ভাষা দিয়ে প্রকাশের; তার চেয়ে বেশি হৃদয় দিয়ে অনুভবের। এ বিষয়ে প্রথমেই যে কথাটি বলার তা হচ্ছে, যে পরিমাণ মজুরি কোনো মালিক মন খোলাসাভাবে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে; তারপরও ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেটি দিতে বাধ্য করানো হলে তা শ্রমিকের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বয়ে আনবে বলে মনে হয়। কেননা কোনো কোম্পানি যখন কাজে যোগদানকালীন মজুরি বেশি দিতে বাধ্য হবে, তখন পরবর্তী সময়ে কিংবা যথাসময়ে সেই কোম্পানি ওই শ্রমিককে ইনক্রিমেন্ট দিতে চাইবে না। বা অপারগতা প্রকাশ করবে। ফলে দেখা যাবে, একজন দুই বছরের পুরনো শ্রমিক যা পাচ্ছে, একজন সদ্য যোগদানকারীও একই মজুরি পাবে। চিনি ও লবণের এ সমমূল্য একজন পুরনো শ্রমিকের কাছে অবিচার বলে মনে হবে। আর এ অবিচার পুরনো শ্রমিকটির মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তখন সে উঠতে-বসতে ঠোঁট উল্টিয়ে বলবে, আমি যা পাই মুখ শুকলে দুধের গন্ধ বের হওয়া শ্রমিকটিও তো সেটাই পাচ্ছে। তাহলে দক্ষ হয়ে লাভ কী! তার এ ঠোঁট উল্টিয়ে কর্মপরিবেশ নষ্ট করা যৌক্তিক বলেই মনে হবে। কেননা তখন শুরুর দিকের বাড়তি মজুরির কথা কেউই তেমন মনে রাখবে না। একই ছাদের নিচে দক্ষ-অদক্ষের মজুরি যেহেতু সমান, তাই দক্ষ শ্রমিকটি অদক্ষের চেয়ে বেশি উৎপাদন দেয়ার গরজ দেখাবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু মনের ভেতর জ্বলা অনির্বাপিত এ আগুন সেই শ্রমিককে দগ্ধ থেকে অঙ্গারে পরিণত করবে। আর এর ছোঁয়াচে শিখায় পুড়বে সেই সব শ্রমিকরাই, আজকে যারা ন্যূনতম মজুরি আট হাজারের দাবিতে কারখানা ও কারখানা লাগোয়া সড়ক মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছে। সবচেয়ে আতংকের বিষয়, মনের ভেতর তুষের আগুন জ্বলা এ ধরনের শ্রমিককে পরিচালনা করা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষে তখন পাগলা ঘোড়া চালানোর পর্যায়ে চলে যাবে। ফলে আজকের এ মৌসুমভিত্তিক অশান্তি একসময় স্থায়ী গৃহদাহে রূপ নিতে পারে।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সস্তা শ্রমবাজারের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু এদেশে হাজার হাজার গার্মেন্টস গড়ে উঠেছে। সেই সস্তা শ্রমবাজার যদি কখনো চড়া বাজারে রূপ নেয়, তখন এ শিল্পটিও বন্ধ হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এসব কথার অর্থ এই নয় যে, কথাগুলো মালিক পক্ষে চলে যাচ্ছে। এটি একটি সাধারণ আলোচনা মাত্র। এ প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয় তা হচ্ছে, আজ যারা শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ধার্য সংক্রান্ত মন্তব্য ছাড়ছেন, তাদের উচিত একটি কারখানা স্থাপন করে ওই পরিমাণ মজুরি শ্রমিকদের দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে, এভাবে কারখানা চালালেও কাক্সিক্ষত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। তখন সবাই তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। একজন কারখানাহীন ব্যক্তি বা কারখানায় শ্রমিক পরিচালনা করেননি এমন ব্যক্তির শ্রমিক সংক্রান্ত কোনো গদবাঁধা বুলি আওড়ানো ঠিক নয়। কারণ পিপলস ম্যানেজমেন্ট বা মানুষ পরিচালনার কাজের মধ্যে অসংখ্য চোরাবালি আছে। এক্ষেত্রে সামান্য ভুলের কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। এসব চোরাবালির খপ্পরে পড়ে অনেক কারখানা বন্ধ হতেও দেখা যায়।
অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ থেকে জানা যায়, কোনো দ্রব্য অবমূল্যায়িত হয় চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে। বাংলাদেশের মতো উচ্চ ফলনশীল মানুষের দেশে জনবলের অধিক সরবরাহের কারণে শ্রমের বাজারে মন্দাভাব দেখা দেয়া স্বাভাবিক ঘটনা। যেখানে বিজ্ঞাপন না দিতেই মাসের প্রথম তারিখে মৌমাছির মতো মানুষ কারখানার গেটে হাজির হয় কর্মসংস্থানের জন্য; সেখানে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা দিয়ে সেটি দিতে বাধ্য করানোর কাজ কতটা সফলতার মুখ দেখবে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা অযৌক্তিক কিছু নয়। এ পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ যদি তাদের বেঁধে দেয়া মজুরির ঘোষণাপত্র তৈরি করে সেই পত্রে অনাপত্তি সূচক মুচলেকা নিয়ে কোনো নবীন শ্রমিককে নিয়োগ দিতে চায় তাহলে মনে হয় ওই কারখানা কাক্সিক্ষত সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হবে না। কথাটি অনেকের কাছে তেতো লাগতে পারে। তবে এটাই বাস্তব।
আগেই বলা হয়েছে যে, কারখানা মালিক ও শ্রমিক এ দুই পক্ষ মূলত শ্রম ক্রেতা ও বিক্রেতা। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই দরদাম করে শ্রম ক্রয় ও বিক্রয়ের অধিকার আছে। এর মাঝখানে দূতিয়ালির কোনো স্থান আছে বলে মনে হয় না। কেউ যদি তার শ্রমকে আট কেন ১৬ হাজারের নিচে বিক্রয় করবে না বলে মনঃস্থির করে তাহলে ঈশ্বর ছাড়া কেউই তাকে কাজে লাগাতে পারবে না। আবার শ্রম ক্রেতা যদি মনে করেন, আমি সাড়ে চারের ওপর ক্রয় করব না, তাহলে তাকেও এর বেশি রেটে শ্রম কেনানো যাবে না। কাজেই এ ধরনের পরিস্থিতি মূলত শ্রম ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে মনে হয় না পরিস্থিতি কখনো ঘোলাটে রূপ ধারণ করবে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন তৃতীয় পক্ষ এসে বাগড়া দেয়া শুরু করে। বিষয়টি কতকটা মায়ের চেয়ে খালার দরদের মতো। শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত হবে এটি কারখানা মালিক ও শ্রমিকের ব্যাপার। এখানে কেউ কিছু মন্তব্য করার বিষয়টি ফপর-দালালি ছাড়া কিছু নয় বলে মনে হয়। তবে মালিকদেরও উচিত বর্তমান গগনচুম্বী দ্রব্যমূল্যের কথা মাথায় রেখে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা, যাতে শ্রমিকরা প্রতিদিন না হলেও দু’-তিন দিন পর পর ভাতের সঙ্গে এক আধ টুকরা মাছ-মাংস খেতে পারে। শরীর ঠিক না থাকলে কেউই কাক্সিক্ষত কর্মদক্ষতা দেখাতে পারবে না। কাজেই শ্রমিকের শরীর ও মন সব দিক থেকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব মূলত মালিকের। অন্য কারও নয়।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
এবার ন্যূনতম মজুরি প্রসঙ্গ। একটি কারখানার সব শ্রমিককে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। দক্ষ, আধা দক্ষ ও শিক্ষানবিস। বলার অপেক্ষা রাখে না, ন্যূনতম মজুরি বলতে শিক্ষানবিস এক কথায় ধানের চাতাল বা গম ক্ষেত থেকে উঠে এসে কাজে যোগ দেয়া শ্রমিকের মজুরিকেই বোঝানো হয়। সদ্য কাজে যোগ দেয়া একজন ফ্লোর ক্লিনার বা এফসি’রাও এ ন্যূনতম মজুরির ক্যাটাগরিতে পড়বে। তৈরি পোশাক কারখানার অধিকাংশেই এয়ার শিপমেন্ট ঠেকানোর তাগিদে তথা বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে জাহাজিকরণের স্বার্থে ১২ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। তার মধ্যে আট ঘণ্টা হচ্ছে মূল হাজিরা। বাকি চার ঘণ্টা ওভারটাইম বা ওটি। অধিকাংশ পোশাক কারখানায় যেহেতু ওটি চলে; কাজেই ওটির হিসাব আমলে নিলে একজন শিক্ষানবিস শ্রমিকের পেছনে একজন মালিককে প্রতি মাসে মূল মজুরি আট হাজারের সঙ্গে ওভারটাইম চারসহ মোট ১২ হাজার টাকা গুনতে হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন শিক্ষানবিস শ্রমিকের চেয়ে একজন সুদক্ষ শ্রমিক দুই-তিন গুণ বেশি মজুরি পেয়ে থাকে। সে হিসাবে একজন সুদক্ষ শ্রমিকের পেছনে একজন মালিককে ওটিসহ প্রতি মাসে ২৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে। সুদক্ষ হলে এ টাকা পাবে, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হল, দক্ষ হলেই উল্লিখিত পরিমাণ টাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা যখন নতুনদের হাতছানি দেবে, তখন নতুনদের মধ্যে এক কারখানায় বেশিদিন কাজ করার মনমানসিকতা থাকবে না। এমনকি একজন শ্রমিক শিক্ষানবিস হিসেবে কাজে যোগদানের দু’-এক মাস যেতে না যেতেই ওই কারখানার পরিচিতি কার্ড ব্যবহার করে অন্য কারখানায় ছুটে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকবে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা একজন অশিক্ষিত বা সিকি শিক্ষিত ছেলে বা মেয়ের অদক্ষতা কাটিয়ে উঠতে কম করে হলেও এক বা দেড় বছর সময়ের প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে সে কারখানাকে শতভাগ সেবা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। অথচ তার পেছনে কোম্পানির প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা চলে যাবে। সে যাক। কিন্তু শ্রমিকটি দক্ষ হয়ে ওঠার পর যদি অন্যত্র ভেগে যায় তাহলে টাকা খরচ করে অদক্ষকে দক্ষ বানানোর এ ক্ষতি ওই কারখানা কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে, তা যথেষ্ট ভাবার বিষয়। প্রবাদ আছে, গাছ বাঁচিয়ে রেখে ফল খেতে হয়। কাজেই কোম্পানির ঘারে অতিরিক্ত বেতনের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার ফলে কারখানাটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তখন ন্যূনতম মজুরি আট হাজারের স্থলে আট লাখ করলেও কোনো দিক থেকে কোনো ফায়দা আসবে বলে মনে হয় না।
শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আট বা ওটিসহ ১২ হাজার করলে তাদের মঙ্গল কী অমঙ্গল হবে এর ব্যাখ্যাটি যতটা না ভাষা দিয়ে প্রকাশের; তার চেয়ে বেশি হৃদয় দিয়ে অনুভবের। এ বিষয়ে প্রথমেই যে কথাটি বলার তা হচ্ছে, যে পরিমাণ মজুরি কোনো মালিক মন খোলাসাভাবে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে; তারপরও ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেটি দিতে বাধ্য করানো হলে তা শ্রমিকের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বয়ে আনবে বলে মনে হয়। কেননা কোনো কোম্পানি যখন কাজে যোগদানকালীন মজুরি বেশি দিতে বাধ্য হবে, তখন পরবর্তী সময়ে কিংবা যথাসময়ে সেই কোম্পানি ওই শ্রমিককে ইনক্রিমেন্ট দিতে চাইবে না। বা অপারগতা প্রকাশ করবে। ফলে দেখা যাবে, একজন দুই বছরের পুরনো শ্রমিক যা পাচ্ছে, একজন সদ্য যোগদানকারীও একই মজুরি পাবে। চিনি ও লবণের এ সমমূল্য একজন পুরনো শ্রমিকের কাছে অবিচার বলে মনে হবে। আর এ অবিচার পুরনো শ্রমিকটির মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তখন সে উঠতে-বসতে ঠোঁট উল্টিয়ে বলবে, আমি যা পাই মুখ শুকলে দুধের গন্ধ বের হওয়া শ্রমিকটিও তো সেটাই পাচ্ছে। তাহলে দক্ষ হয়ে লাভ কী! তার এ ঠোঁট উল্টিয়ে কর্মপরিবেশ নষ্ট করা যৌক্তিক বলেই মনে হবে। কেননা তখন শুরুর দিকের বাড়তি মজুরির কথা কেউই তেমন মনে রাখবে না। একই ছাদের নিচে দক্ষ-অদক্ষের মজুরি যেহেতু সমান, তাই দক্ষ শ্রমিকটি অদক্ষের চেয়ে বেশি উৎপাদন দেয়ার গরজ দেখাবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু মনের ভেতর জ্বলা অনির্বাপিত এ আগুন সেই শ্রমিককে দগ্ধ থেকে অঙ্গারে পরিণত করবে। আর এর ছোঁয়াচে শিখায় পুড়বে সেই সব শ্রমিকরাই, আজকে যারা ন্যূনতম মজুরি আট হাজারের দাবিতে কারখানা ও কারখানা লাগোয়া সড়ক মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছে। সবচেয়ে আতংকের বিষয়, মনের ভেতর তুষের আগুন জ্বলা এ ধরনের শ্রমিককে পরিচালনা করা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষে তখন পাগলা ঘোড়া চালানোর পর্যায়ে চলে যাবে। ফলে আজকের এ মৌসুমভিত্তিক অশান্তি একসময় স্থায়ী গৃহদাহে রূপ নিতে পারে।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সস্তা শ্রমবাজারের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু এদেশে হাজার হাজার গার্মেন্টস গড়ে উঠেছে। সেই সস্তা শ্রমবাজার যদি কখনো চড়া বাজারে রূপ নেয়, তখন এ শিল্পটিও বন্ধ হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এসব কথার অর্থ এই নয় যে, কথাগুলো মালিক পক্ষে চলে যাচ্ছে। এটি একটি সাধারণ আলোচনা মাত্র। এ প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয় তা হচ্ছে, আজ যারা শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ধার্য সংক্রান্ত মন্তব্য ছাড়ছেন, তাদের উচিত একটি কারখানা স্থাপন করে ওই পরিমাণ মজুরি শ্রমিকদের দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে, এভাবে কারখানা চালালেও কাক্সিক্ষত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। তখন সবাই তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। একজন কারখানাহীন ব্যক্তি বা কারখানায় শ্রমিক পরিচালনা করেননি এমন ব্যক্তির শ্রমিক সংক্রান্ত কোনো গদবাঁধা বুলি আওড়ানো ঠিক নয়। কারণ পিপলস ম্যানেজমেন্ট বা মানুষ পরিচালনার কাজের মধ্যে অসংখ্য চোরাবালি আছে। এক্ষেত্রে সামান্য ভুলের কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। এসব চোরাবালির খপ্পরে পড়ে অনেক কারখানা বন্ধ হতেও দেখা যায়।
অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ থেকে জানা যায়, কোনো দ্রব্য অবমূল্যায়িত হয় চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে। বাংলাদেশের মতো উচ্চ ফলনশীল মানুষের দেশে জনবলের অধিক সরবরাহের কারণে শ্রমের বাজারে মন্দাভাব দেখা দেয়া স্বাভাবিক ঘটনা। যেখানে বিজ্ঞাপন না দিতেই মাসের প্রথম তারিখে মৌমাছির মতো মানুষ কারখানার গেটে হাজির হয় কর্মসংস্থানের জন্য; সেখানে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা দিয়ে সেটি দিতে বাধ্য করানোর কাজ কতটা সফলতার মুখ দেখবে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা অযৌক্তিক কিছু নয়। এ পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ যদি তাদের বেঁধে দেয়া মজুরির ঘোষণাপত্র তৈরি করে সেই পত্রে অনাপত্তি সূচক মুচলেকা নিয়ে কোনো নবীন শ্রমিককে নিয়োগ দিতে চায় তাহলে মনে হয় ওই কারখানা কাক্সিক্ষত সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হবে না। কথাটি অনেকের কাছে তেতো লাগতে পারে। তবে এটাই বাস্তব।
আগেই বলা হয়েছে যে, কারখানা মালিক ও শ্রমিক এ দুই পক্ষ মূলত শ্রম ক্রেতা ও বিক্রেতা। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই দরদাম করে শ্রম ক্রয় ও বিক্রয়ের অধিকার আছে। এর মাঝখানে দূতিয়ালির কোনো স্থান আছে বলে মনে হয় না। কেউ যদি তার শ্রমকে আট কেন ১৬ হাজারের নিচে বিক্রয় করবে না বলে মনঃস্থির করে তাহলে ঈশ্বর ছাড়া কেউই তাকে কাজে লাগাতে পারবে না। আবার শ্রম ক্রেতা যদি মনে করেন, আমি সাড়ে চারের ওপর ক্রয় করব না, তাহলে তাকেও এর বেশি রেটে শ্রম কেনানো যাবে না। কাজেই এ ধরনের পরিস্থিতি মূলত শ্রম ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে মনে হয় না পরিস্থিতি কখনো ঘোলাটে রূপ ধারণ করবে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন তৃতীয় পক্ষ এসে বাগড়া দেয়া শুরু করে। বিষয়টি কতকটা মায়ের চেয়ে খালার দরদের মতো। শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত হবে এটি কারখানা মালিক ও শ্রমিকের ব্যাপার। এখানে কেউ কিছু মন্তব্য করার বিষয়টি ফপর-দালালি ছাড়া কিছু নয় বলে মনে হয়। তবে মালিকদেরও উচিত বর্তমান গগনচুম্বী দ্রব্যমূল্যের কথা মাথায় রেখে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা, যাতে শ্রমিকরা প্রতিদিন না হলেও দু’-তিন দিন পর পর ভাতের সঙ্গে এক আধ টুকরা মাছ-মাংস খেতে পারে। শরীর ঠিক না থাকলে কেউই কাক্সিক্ষত কর্মদক্ষতা দেখাতে পারবে না। কাজেই শ্রমিকের শরীর ও মন সব দিক থেকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব মূলত মালিকের। অন্য কারও নয়।
অরবিন্দ রায় : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালক
No comments