দাস-প্রভূ চিন্তার বিদঘুটে পরিণতি by সারওয়ার চৌধুরী
রাজনীতি সচেতন থাকা আর দলীয় রাজনীতি করা
এক নয়। এই ব্যাপারটা দাস-প্রভূ-চিন্তা-বলয়ে আটকে থাকা মানুষদের মাথায় সহজে
ঢুকে না। তাদের সহজ বুঝ হল, কোনো-না-কোনো পক্ষে থাকতেই হয় বা আছে সকল
মানুষ।
আবার পক্ষে থাকলেই কেউ বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করতে পারবে না- ব্যাপারটা এমনও নয়।
কোনো দলের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকার পেছনে সদর্থেই মতলব থাকে। এই মতলব কারো জীবনের জন্যে বিশেষ জরুরীও হতে পারে নিদেনপক্ষে। মানে, একটা অবলম্বন ধরে বাঁচার প্রয়াস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিবেচনায়। যদিও ওটা পোক্ত চিন্তা নয়। বিপরীত দিকে কোনো দলের প্রতি অন্ধতামুক্ত কোনো দলনিরপেক্ষ অবলম্বনও থাকতে পারে।
দলনিরপেক্ষ অবস্থান ব্যাপারটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলীয় রাজনীতির দ্বারাও রচিত হয়। দল যখন এমপি মন্ত্রী বানায় কাউকে, সেই এমপি বা মন্ত্রী হয়ে ওঠেন এলাকার সকলের এমপি, দেশের সকল জনগণের মন্ত্রী। ব্যাপারটা এমন যে, দলীয় লড়াইয়ের দৌলতে নির্দলীয় অবস্থানে পৌঁছতে পারা। এটাও মনে রাখা যায়, একজন এমপি ভোটের রাজনীতির বাস্তবতাতে শুধু নিজ দলের মানুষের ভোট পান না, স্থানীয় কৌশলের অংশ হিসাবে অন্যদলের মানুষের ভোটও যথেষ্ট পেয়ে যান।
কিন্তু নানা অপকৌশলের দ্বারা ভোট পেয়ে বিজয়ী এমপি ওই নির্দলীয় অবস্থানটির কদর বুঝেন না এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীন আর মতান্ধ মতলববাজ হওয়ার কারণে দেশের জনগণের অকল্যাণ ঘটায় বেশি। অমন এমপিগণ/মন্ত্রীগণ দাস-প্রভূ-চিন্তার ক্রীড়নক হয়। গণতন্ত্রের মুখোশে ফ্যাসিস্ট হয়। দাঙ্গাবাজিতে উস্কানি দিয়ে দেশকে বিপন্ন করে। নিজেদেরও সর্বনাশ ডেকে আনে। ওদের মাথায় থাকে- ‘দাস হও অথবা প্রভূ হও’। কিংবা ‘মারো নয়তো মার খাও’ ইত্যাকার চমকপ্রদ ফালতু চিন্তা। এর বাইরে তারা যেনো চিন্তাই করতে পারেন না। অথবা চিন্তা করলেও মতলববাজির অন্ধতার কাছে পরাজিত হওয়া মেনে নেন। তাদের তর্জন-গর্জন আস্ফালন তথাকথিত বীরত্ব প্রদর্শনের অজুহাতে হলেও অবশেষে নিজেদের রক্ষার উপায় খুঁজে পায় না।
পরিচ্ছন্ন বুদ্ধিবৃত্তির ভেতরে দলীয় অন্ধতার প্রভাব থাকে না। থাকে স্থান কাল পাত্র বিবেচনার দ্বারা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এবং অন্যায্য কর্মসমূহের শক্তিশালী প্রতিবাদ। সে-বিশ্লেষণে সতর্কীকরণ পয়েন্ট আউট হয়। তুলনামুলক উত্তম পথের সম্ভাবনার কথা থাকে। পরিচ্ছন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিকগুলোও দেখিয়ে দেয়া হয়। বিষয় ও ঘটনার তুলনামুলক বিচার সাপেক্ষে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর কখনো কারো পক্ষে কখনো বিপক্ষে কথা বলেন সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবি-লেখক-সাংবাদিক। কারণ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার ব্যাপারটি তার কাছে মূখ্য নয়, তার দৃষ্টি থাকে ঘটনার সুফল কুফল কি হতে পারে সেদিকে মনোযোগ দেয়া। কিন্তু এই মনোযোগ দাস-প্রভু-চিন্তা-বলয়ে থাকা মন্ত্রী এমপি এবং তাদের সুবিধাভোগী মানুষের কাছ থেকে আশা করা যায় না। তাদের কাছে শুধু অন্ধভাবে পক্ষপাতদুষ্টতার প্রলয় চিন্তা।
দেশের মানুষ দেখলো ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি টক শো-তে (২১মে ২০১৩ দিবাগত রাত) নিউএইজ সম্পাদক নূরুল কবিরের শাণিত সত্য প্রতিবাদি কথাগুলোর সামনে সরকারের পক্ষে ষোলআনা থাকা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকেন, জবাব খুঁজে পান না। নুরুল কবির, বদরউদ্দিন উমর প্রমুখের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা পক্ষাবলম্বন যা-ই থাক, জাতীয় সংকটকালে তাদের কথা বস্তুনিষ্ঠ এবং সকলের জন্যে কল্যাণকর বুঝবার যথেষ্ট কারণ আছে। নুরুল কবিরগণ এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুগণ কে কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সেটা বিবেচনা জরুরী। নুরুল কবিরগণ কথা বলেন দলীয় স্পিরিটের বাইরে থেকে, আর নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুগণ কথা বলেন দলীয় স্পিরিটের ভেতরে থেকে। ফলে দলীয় স্বার্থের প্রবণতা নুরুল কবিরের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। বুঝে নেয়া দরকার, মাহমুদুর রহমানের সম্পাদকীয় নীতির সাথে একমত না হয়েও কিছু বুদ্ধিজীবি ও কিছু সম্পাদক তার অবৈধ গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ কি কারণে করছেন। গণতন্ত্রের নামে তারা ফ্যাসিবাদ চান না বলেই অমন প্রতিবাদ করছেন। গণতন্ত্রের নামে দাস-প্রভু চিন্তাকে সরকার কর্তৃক আশকারা দিয়ে বিদঘুটে পরিণতিতে দেশ জাতি পড়ুক তারা চান না।
No comments