এটা হাসিনার পথ নয় by মতিউর রহমান চৌধুরী
এটা কি শেখ হাসিনার পথ? যদি কেউ তার অতীত
নিয়ে গবেষণা করেন তাহলে চটজলদি জবাব দেবেন এটা তার পথ নয়। আমরা সবাই জানি,
হাসিনার পথ লড়াইয়ের পথ। লড়াই-লড়াই-লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই।
রাজপথের
এই স্লোগান একদিন ধারণ করে স্বৈরশাসককে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন। আওয়ামী লীগ
তখন একদম বিধ্বস্ত। নেতৃত্বেও সঙ্কট। দলের ভেতরে নানামুখী কারেন্ট।
দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র তো আছেই। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে প্রবাস জীবন কাটিয়ে
ঢাকা এসেছিলেন। সেদিন সংবাদের রিপোর্টার হিসেবে বিমানবন্দরে হাজির ছিলাম।
প্রতি মুহূর্তেই ভয়। কখন কি হয়। কারণ, তখন গুজব রটেছিল নাশকতা হতে পারে
বিমানবন্দরেই। শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
বিমান থেকে নেমে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করবেন। আইনের আওতায় আনবেন। তা তিনি করেছেন। তবে তার লেগেছে দুই যুগেরও বেশি সময়। দলকে প্রথম ক্ষমতায় আনেন ২১ বছর পর। পাঁচ বছর সরকার চালান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। যা এক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। দলের ভেতরকার একটি উচ্চাভিলাষী, দুর্নীতিবাজ ও গডফাদারদের সমূলে বিনাশ করতে পারলে হয়তো ২০০১-এর নির্বাচনের ফলাফলও তার কব্জায় থাকতো। কেন জানি তিনি সরকারের শেষের দিকে এসে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। সে যা-ই হোক, লড়াই তার আর থামেনি। বিএনপির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন আবারও। নির্বাচন নিয়ে জট তৈরি হলো। বিএনপির ছক ভণ্ডুল করে দেয়ার জন্য তিনি মরিয়া। ২২শে জানুয়ারির নির্বাচনেও যেতে চাইলেন। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার প্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন তখন তিনি টের পেলেন নির্বাচনে গেলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই তিনি আন্দোলনের পথে পা বাড়ালেন। সরে দাঁড়ালেন নির্বাচন থেকে। রক্তাক্ত হতে থাকলো ঢাকার রাজপথ। অসহযোগ আর ঘেরাও- এর মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পূর্ণ উবে গেল। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের সরকার অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করলো। পর্দার আড়াল থেকে বিএনপি যদি না খেলতো তাহলে ইতিহাস অন্য হতে পারতো। পরিণতিতে জরুরি শাসন জারি হলো। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া- দুজনই জেলে গেলেন। তখন ঢাকায় একই আলোচনা, মাইনাস টু হয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা বিদেশ চলে গেলেন। আসতেও বারণ করা হলো। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকেও ফেরত গেলেন। বৃটিশ এয়ারওয়েজ তাকে বহন করতে অস্বীকৃতি জানালো। খালেদা জিয়াকে সৌদি আরব পাঠানোর প্রস্তুতিও সম্পন্ন হলো। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন। খালেদা জিয়াও জেল থেকে মুক্তি পেলেন। এর আগে নেপথ্যে অনেক আলোচনা, অনেক সমঝোতা। ড. গওহর রিজভী এই নেপথ্যের কারিগর। প্রকাশ্য কূটনীতি নয়, নেপথ্যের কূটনীতিতে তিনি বড় বেশি পারদর্শী। সংলাপের এই আকাল সময়ে তিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দূতিয়ালি চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেও পুরোপুরি সফল হননি। এ জন্য তিনি বিদেশমন্ত্রী দীপুমনিকেই কার্যত দায়ী করেন। বলেন, তার অতি উৎসাহ আর সমস্যার পেছনে না গিয়ে দ্রুত প্রতিশ্রুতি দান অনেক সময় নয়া সঙ্কট তৈরি করেছে। ২০০৮-এর মার্চে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি বিবৃতি জরুরি জমানার ভিত একদম নড়বড়ে করে দেয়। তারা অবিলম্বে নির্বাচন দেয়ার তাগিদ দেয়। জরুরি শাসনের অবসান করতে বলে। এর আগে জেনারেল মঈনউদ্দিন আহমেদকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর চরমপত্র পাঠায়। তারা জানিয়ে দেয়, দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোন পারভেজ মোশাররফকে দেখতে চায় না। মঈনউদ্দিনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার তখন। জেনারেলরা ঘন ঘন বৈঠকে মিলিত হন। একপর্যায়ে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আলোচনা শুরু হয় দুই নেত্রীর সঙ্গে। তৎকালীন সরকারের দু’জন প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রে যান শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে। কথা হয় অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে। শেখ হাসিনা সবুজ সংকেত দেন। বেগম জিয়া তখন সাব-জেলে আটক। একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে দু’দফা আলোচনা হয়। প্রথম আলোচনায় অবশ্য ওই কর্মকর্তা কিছুটা দুর্ব্যবহার করেন নেত্রীর সঙ্গে। বিএনপি ভাঙা নিয়ে কথা উঠতেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বলেন, নির্বাচনে যেতে রাজি না হলে তার দুই ছেলেকে আজীবন জেলে থাকতে হবে। তাকেও জেলের মধ্যেই মরতে হবে। এরপর দ্বিতীয় দফা আলোচনায় জট খুলে যায়। প্যারোলে বিদেশে পাঠানো হয় তার দুই ছেলেকে। মুক্ত হন বেগম জিয়া। নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। শেখ হাসিনা তিন-চতুর্থাংশ ভোটে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের ভোটের ইতিহাসে নজির স্থাপন করেন। ক্ষমতা হারিয়ে সেনা শাসকরা এক সুদূরপ্রসারী খেলা খেলেন। যার কারণে রাজনীতিতে অবিশ্বাস স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তারা দুই নেত্রীর কাছে দুই দলের নেতাদের কিছু টেপ হাজির করেন। যা শুনে তারা স্তম্ভিত হন। পরিণতিতে অনেক বড় বড় নেতার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। এটা কেন তারা করেছিলেন এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। জাতীয় সরকার আর মাইনাস-টু ফর্মুলা নিয়ে দেশী-বিদেশী কারা বেশি সোচ্চার ছিলেন তা-ও গবেষণার বিষয়। ১৯৮১ থেকে ২০১৩ এই সময়ে যদি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে কি দেখতে পাই। তিনি আপসহীন, তিনি জেদী, তিনি মানবিক। কখনও কখনও একরোখা। অনেকে ’৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কড়া সমালোচনা করেন। সমালোচনার সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। তিনি তখন দলের স্বার্থই দেখেছেন। আওয়ামী লীগ তখনও অগোছালো। শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল না। কোরবান আলীদের মতো লোকরা দল ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। দলের অনেক নেতা নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছেন। তখন শেখ হাসিনা নির্বাচনের পথেই পা বাড়ান। উদ্দেশ্য সফল হবে না, জয়ী হবেন না নির্বাচনে- তিনি জানতেন। অন্য কি কারণ ছিল নির্বাচনে যোগ দেয়ার আজ অবধি তা অস্পষ্ট। প্রসঙ্গগুলো টেনে আনলাম এই কারণে- শেখ হাসিনা বরাবরই নির্বাচনমুখী। যে কোন নির্বাচনকে তিনি আনচ্যালেঞ্জড ছেড়ে দিতে চান না। শুধু ব্যতিক্রম, বিএনপি জমানার ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। সে নির্বাচনের ফলাফল অবশ্য তাকে ক্ষমতায় আনার পথকেই প্রশস্ত করেছিল। সফল হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বিএনপি কৌশল করে নির্বাচনে হেরেছে। শুধু হেরেছে বলবো না, দলের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখোমুখি। এই পথ রাজনীতিকদের পথ নয়। এটা স্বৈরশাসকদের পথ হতে পারে। শেখ হাসিনা কেন সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন। নিকট অতীতেই তো আমরা দেখলাম। বিএনপি এই কৌশল গ্রহণ করে কি মূল্যই না দিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনা যে কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যেতে রাজি। এটাই তো আমরা দেখে এসেছি। এখন কেন তিনি জনগণকে আস্থায় নিতে পারছেন না? আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগকে কেন কৌশল ঠিক করতে হবে। যারা তাকে এই বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের স্বার্থ অন্য। এভাবেই খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। বিচারপতি কেএম হাসানকে দৃশ্যপটে আনার মধ্যে দেশের বা দলের স্বার্থ নয়, ব্যক্তি-স্বার্থই কাজ করেছিল। এখনও একদল আছেন যারা মনে করেন ক্ষমতা ধরে রাখতেই হবে যে কোন প্রকারে, পরিণতি যাই হোক না কেন? কোন একটি ঘটনা দিয়ে তার পেছনের ঘটনার যুক্তিযুক্ত বোঝানোর মধ্যে ভয় থাকে। সরলীকরণের ভয়। বেশির ভাগ সময় অবশ্য এই একটি ঘটনাই বাস্তবের পক্ষে কথা বলে। ৭০-এর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের আস্সালামু আলাইকুম বলতে পারতেন। জনগণ তাকে সে ক্ষমতা দিয়েছিল। মাওলানা ভাসানী সে পরামর্শও দিয়েছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, হুজুর আমি জানি পাকিস্তান এখন একটি লাশ। দাফনটা করে আসি না। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু বরাবরই সংলাপের পক্ষে ছিলেন।
ধরা যাক, কৌশলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হয়ে গেল। শেখ হাসিনা জয়ী হয়ে গেলেন। তাতে তার সরকার কতটা স্থায়ী হবে সে বিতর্কে না গিয়ে বলবো, এটা আওয়ামী লীগের জন্য মোটেই সুখকর হবে না। জাতিসংঘ যুক্ত হয়ে গেছে। খালি খালি ওরা যুক্ত হয় না। দেশে দেশে আমরা তা দেখছি। বাংলাদেশে তারা কি চাচ্ছে? এখন হয়তো শেখ হাসিনা দেখছেন সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। জামায়াত-শিবির গেছে। বিএনপিও যাওয়ার পথে। হেফাজত তো এখন নিজেদের হেফাজত নিয়েই ব্যস্ত। তাতে কি সব শেষ হয়ে গেল। বিএনপিও ভেবেছিল প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণে। সেনাবাহিনীও তাদের কথার বাইরে যাবে না। বড়াই করে নেত্রী বলতেন, আমার মঈন আছে। মাসুদ আছে। আমিন আর বারী তো আছেই। ওরা আমাদের সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু এক বিকালে দেখা গেল সব ওলট-পালট। তারা আর বিএনপিকে চেনে না। খড়গ নেমে এলো বিএনপির ওপর। এমন কি তারেক রহমানকে যখন সেফ হাউসে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তখন একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিলেন। তৃপ্তির হাসিটা তখন থামাতে পারেননি। এখান থেকে আমরা কি দেখতে পেলাম। ওরা কারো নয়। একটি তসবিহ গাঁথা হয় সুতো দিয়ে। সুতোটা ছিঁড়ে গেলে দানা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও তাই। দেশটা এক কঠিন পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অনেক কথাই অনেকে আমলে নেন না। বলেন, তিনি জাতির সঙ্গে মশকরা করেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার খাঁটি কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তার মুখে একটা হতাশার চিত্র এর আগে আর কখনও দেখিনি। অর্থনীতিবিদরা বললে না হয় নানা যুক্তি দেখিয়ে খণ্ডন করা সম্ভব বা করা হয়ে থাকে। যখন মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, তখন তো অবিশ্বাস করার কিছু থাকে না। দেশটা থমকে যাচ্ছে বা যাবে এভাবে চলতে থাকলে। সামনের দিনগুলো ভয়ঙ্কর। এই অবস্থায় রাজনৈতিক নেতারা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা না দেন তাহলে জনগণ যাবে কোথায়?
বিমান থেকে নেমে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করবেন। আইনের আওতায় আনবেন। তা তিনি করেছেন। তবে তার লেগেছে দুই যুগেরও বেশি সময়। দলকে প্রথম ক্ষমতায় আনেন ২১ বছর পর। পাঁচ বছর সরকার চালান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। যা এক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। দলের ভেতরকার একটি উচ্চাভিলাষী, দুর্নীতিবাজ ও গডফাদারদের সমূলে বিনাশ করতে পারলে হয়তো ২০০১-এর নির্বাচনের ফলাফলও তার কব্জায় থাকতো। কেন জানি তিনি সরকারের শেষের দিকে এসে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। সে যা-ই হোক, লড়াই তার আর থামেনি। বিএনপির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন আবারও। নির্বাচন নিয়ে জট তৈরি হলো। বিএনপির ছক ভণ্ডুল করে দেয়ার জন্য তিনি মরিয়া। ২২শে জানুয়ারির নির্বাচনেও যেতে চাইলেন। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার প্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন তখন তিনি টের পেলেন নির্বাচনে গেলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই তিনি আন্দোলনের পথে পা বাড়ালেন। সরে দাঁড়ালেন নির্বাচন থেকে। রক্তাক্ত হতে থাকলো ঢাকার রাজপথ। অসহযোগ আর ঘেরাও- এর মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পূর্ণ উবে গেল। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের সরকার অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করলো। পর্দার আড়াল থেকে বিএনপি যদি না খেলতো তাহলে ইতিহাস অন্য হতে পারতো। পরিণতিতে জরুরি শাসন জারি হলো। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া- দুজনই জেলে গেলেন। তখন ঢাকায় একই আলোচনা, মাইনাস টু হয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা বিদেশ চলে গেলেন। আসতেও বারণ করা হলো। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকেও ফেরত গেলেন। বৃটিশ এয়ারওয়েজ তাকে বহন করতে অস্বীকৃতি জানালো। খালেদা জিয়াকে সৌদি আরব পাঠানোর প্রস্তুতিও সম্পন্ন হলো। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন। খালেদা জিয়াও জেল থেকে মুক্তি পেলেন। এর আগে নেপথ্যে অনেক আলোচনা, অনেক সমঝোতা। ড. গওহর রিজভী এই নেপথ্যের কারিগর। প্রকাশ্য কূটনীতি নয়, নেপথ্যের কূটনীতিতে তিনি বড় বেশি পারদর্শী। সংলাপের এই আকাল সময়ে তিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দূতিয়ালি চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেও পুরোপুরি সফল হননি। এ জন্য তিনি বিদেশমন্ত্রী দীপুমনিকেই কার্যত দায়ী করেন। বলেন, তার অতি উৎসাহ আর সমস্যার পেছনে না গিয়ে দ্রুত প্রতিশ্রুতি দান অনেক সময় নয়া সঙ্কট তৈরি করেছে। ২০০৮-এর মার্চে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি বিবৃতি জরুরি জমানার ভিত একদম নড়বড়ে করে দেয়। তারা অবিলম্বে নির্বাচন দেয়ার তাগিদ দেয়। জরুরি শাসনের অবসান করতে বলে। এর আগে জেনারেল মঈনউদ্দিন আহমেদকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর চরমপত্র পাঠায়। তারা জানিয়ে দেয়, দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোন পারভেজ মোশাররফকে দেখতে চায় না। মঈনউদ্দিনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার তখন। জেনারেলরা ঘন ঘন বৈঠকে মিলিত হন। একপর্যায়ে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আলোচনা শুরু হয় দুই নেত্রীর সঙ্গে। তৎকালীন সরকারের দু’জন প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রে যান শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে। কথা হয় অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে। শেখ হাসিনা সবুজ সংকেত দেন। বেগম জিয়া তখন সাব-জেলে আটক। একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে দু’দফা আলোচনা হয়। প্রথম আলোচনায় অবশ্য ওই কর্মকর্তা কিছুটা দুর্ব্যবহার করেন নেত্রীর সঙ্গে। বিএনপি ভাঙা নিয়ে কথা উঠতেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বলেন, নির্বাচনে যেতে রাজি না হলে তার দুই ছেলেকে আজীবন জেলে থাকতে হবে। তাকেও জেলের মধ্যেই মরতে হবে। এরপর দ্বিতীয় দফা আলোচনায় জট খুলে যায়। প্যারোলে বিদেশে পাঠানো হয় তার দুই ছেলেকে। মুক্ত হন বেগম জিয়া। নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। শেখ হাসিনা তিন-চতুর্থাংশ ভোটে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের ভোটের ইতিহাসে নজির স্থাপন করেন। ক্ষমতা হারিয়ে সেনা শাসকরা এক সুদূরপ্রসারী খেলা খেলেন। যার কারণে রাজনীতিতে অবিশ্বাস স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তারা দুই নেত্রীর কাছে দুই দলের নেতাদের কিছু টেপ হাজির করেন। যা শুনে তারা স্তম্ভিত হন। পরিণতিতে অনেক বড় বড় নেতার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। এটা কেন তারা করেছিলেন এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। জাতীয় সরকার আর মাইনাস-টু ফর্মুলা নিয়ে দেশী-বিদেশী কারা বেশি সোচ্চার ছিলেন তা-ও গবেষণার বিষয়। ১৯৮১ থেকে ২০১৩ এই সময়ে যদি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে কি দেখতে পাই। তিনি আপসহীন, তিনি জেদী, তিনি মানবিক। কখনও কখনও একরোখা। অনেকে ’৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কড়া সমালোচনা করেন। সমালোচনার সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। তিনি তখন দলের স্বার্থই দেখেছেন। আওয়ামী লীগ তখনও অগোছালো। শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল না। কোরবান আলীদের মতো লোকরা দল ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। দলের অনেক নেতা নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছেন। তখন শেখ হাসিনা নির্বাচনের পথেই পা বাড়ান। উদ্দেশ্য সফল হবে না, জয়ী হবেন না নির্বাচনে- তিনি জানতেন। অন্য কি কারণ ছিল নির্বাচনে যোগ দেয়ার আজ অবধি তা অস্পষ্ট। প্রসঙ্গগুলো টেনে আনলাম এই কারণে- শেখ হাসিনা বরাবরই নির্বাচনমুখী। যে কোন নির্বাচনকে তিনি আনচ্যালেঞ্জড ছেড়ে দিতে চান না। শুধু ব্যতিক্রম, বিএনপি জমানার ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। সে নির্বাচনের ফলাফল অবশ্য তাকে ক্ষমতায় আনার পথকেই প্রশস্ত করেছিল। সফল হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বিএনপি কৌশল করে নির্বাচনে হেরেছে। শুধু হেরেছে বলবো না, দলের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখোমুখি। এই পথ রাজনীতিকদের পথ নয়। এটা স্বৈরশাসকদের পথ হতে পারে। শেখ হাসিনা কেন সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন। নিকট অতীতেই তো আমরা দেখলাম। বিএনপি এই কৌশল গ্রহণ করে কি মূল্যই না দিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনা যে কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যেতে রাজি। এটাই তো আমরা দেখে এসেছি। এখন কেন তিনি জনগণকে আস্থায় নিতে পারছেন না? আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগকে কেন কৌশল ঠিক করতে হবে। যারা তাকে এই বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের স্বার্থ অন্য। এভাবেই খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। বিচারপতি কেএম হাসানকে দৃশ্যপটে আনার মধ্যে দেশের বা দলের স্বার্থ নয়, ব্যক্তি-স্বার্থই কাজ করেছিল। এখনও একদল আছেন যারা মনে করেন ক্ষমতা ধরে রাখতেই হবে যে কোন প্রকারে, পরিণতি যাই হোক না কেন? কোন একটি ঘটনা দিয়ে তার পেছনের ঘটনার যুক্তিযুক্ত বোঝানোর মধ্যে ভয় থাকে। সরলীকরণের ভয়। বেশির ভাগ সময় অবশ্য এই একটি ঘটনাই বাস্তবের পক্ষে কথা বলে। ৭০-এর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের আস্সালামু আলাইকুম বলতে পারতেন। জনগণ তাকে সে ক্ষমতা দিয়েছিল। মাওলানা ভাসানী সে পরামর্শও দিয়েছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, হুজুর আমি জানি পাকিস্তান এখন একটি লাশ। দাফনটা করে আসি না। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু বরাবরই সংলাপের পক্ষে ছিলেন।
ধরা যাক, কৌশলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হয়ে গেল। শেখ হাসিনা জয়ী হয়ে গেলেন। তাতে তার সরকার কতটা স্থায়ী হবে সে বিতর্কে না গিয়ে বলবো, এটা আওয়ামী লীগের জন্য মোটেই সুখকর হবে না। জাতিসংঘ যুক্ত হয়ে গেছে। খালি খালি ওরা যুক্ত হয় না। দেশে দেশে আমরা তা দেখছি। বাংলাদেশে তারা কি চাচ্ছে? এখন হয়তো শেখ হাসিনা দেখছেন সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। জামায়াত-শিবির গেছে। বিএনপিও যাওয়ার পথে। হেফাজত তো এখন নিজেদের হেফাজত নিয়েই ব্যস্ত। তাতে কি সব শেষ হয়ে গেল। বিএনপিও ভেবেছিল প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণে। সেনাবাহিনীও তাদের কথার বাইরে যাবে না। বড়াই করে নেত্রী বলতেন, আমার মঈন আছে। মাসুদ আছে। আমিন আর বারী তো আছেই। ওরা আমাদের সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু এক বিকালে দেখা গেল সব ওলট-পালট। তারা আর বিএনপিকে চেনে না। খড়গ নেমে এলো বিএনপির ওপর। এমন কি তারেক রহমানকে যখন সেফ হাউসে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তখন একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিলেন। তৃপ্তির হাসিটা তখন থামাতে পারেননি। এখান থেকে আমরা কি দেখতে পেলাম। ওরা কারো নয়। একটি তসবিহ গাঁথা হয় সুতো দিয়ে। সুতোটা ছিঁড়ে গেলে দানা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও তাই। দেশটা এক কঠিন পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অনেক কথাই অনেকে আমলে নেন না। বলেন, তিনি জাতির সঙ্গে মশকরা করেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার খাঁটি কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তার মুখে একটা হতাশার চিত্র এর আগে আর কখনও দেখিনি। অর্থনীতিবিদরা বললে না হয় নানা যুক্তি দেখিয়ে খণ্ডন করা সম্ভব বা করা হয়ে থাকে। যখন মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, তখন তো অবিশ্বাস করার কিছু থাকে না। দেশটা থমকে যাচ্ছে বা যাবে এভাবে চলতে থাকলে। সামনের দিনগুলো ভয়ঙ্কর। এই অবস্থায় রাজনৈতিক নেতারা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা না দেন তাহলে জনগণ যাবে কোথায়?
No comments