দেশে কি একদলীয় শাসন? by আমীর খসরু
সরকার সভা-সমাবেশের উপরে বিধি-নিষেধ আরোপ
করার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অবশ্য নজিরবিহীন বলাটি বাংলাদেশ
নামক রাষ্ট্রে সঠিক শব্দ প্রয়োগ বলে মনে হয় না। এ ধরণের বিধি-নিষেধের কঠিন
এবং শক্ত বেড়াজালে ইতোপূর্বেও আমরা বার বার পড়েছি।
তবে
এগুলো হয়েছে নির্বাচিত সরকারের লেবাসে অনূদার গণতন্ত্রের মোড়কে
স্বৈরতান্ত্রিক সরকার এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক সরকারের সময়ে। তবে
বর্তমান সরকার নিজেকে যখন গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন বলে দাবি করে এবং এতো সব
ঘটনার পরেও করছে, তখন হিসাব মিলাতে কষ্ট হলেও, অঙ্ক যে মিলছে না তা নয়।
মানুষের মৌলিক অধিকার হরণসহ অধিকারকে সরাসরি অস্বীকার করার ঘটনা এ সরকারটির
কম নয়।
অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, সভা-সমাবেশের অধিকার হরণ থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার ‘ঐতিহ্য’ তাদের রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় এর প্রণেতারা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সামনে নিয়ে এবং পাকিস্তানি শাসনের যে সব কালো দিকগুলো ছিল, তা থেকে পরিত্রাণের পথ ও পদ্ধতি গ্রহণে সংবিধান রচনা করেছিলেন। আর মানুষের ন্যূনতম অধিকারগুলোকে রক্ষাকবচ হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খার বিকাশ যে সব কারণে শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণটি ছিল ১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘকালের সামরিক শাসন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ওই সময়কালে এ দেশের মানুষ অধিকার হরণের নানা কূটকৌশল ও ফন্দিফিকির দেখেছে। এ থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্খার কারণে জনগণের অধিকারগুলোকে সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের যে মূল কপিটি এই প্রতিবেদকের হাতে আছে, তা হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে গেলেও, তাতে কোথাও জরুরি অবস্থার বিধান ছিল না। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার যে সংবিধান প্রকাশিত হয়, তার ব্যবচ্ছেদ শুরু হতে সময় লেগেছে মাত্র ৭ মাস। তবে সংবিধানের মৌল চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক এবং পরিপন্থী সংশোধনীটি আনা হয় ৯ মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। আর এটি সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী - যাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানসহ নানা নিবর্তনমূলক বিষয়গুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। আর এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ এবং ৪২ অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা স্থগিত করার বিধান রাখা হয়। এর ফলে যে মৌলিক অধিকার সংবিধান নিশ্চিত করেছিল অর্থাৎ চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক, ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের মূল বিষয়গুলো স্থগিতকরণ বা কার্যকারিতা হরণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এভাবেই শুরু হয় হোচট খাবার প্রথম পর্বটি। এর পরে ওই আমলেই মানুষ অসংখ্যবার হোচট খেয়েছে। নির্বিচারে গ্রেফতার, অত্যাচার-নির্যাতন, বিরোধী পক্ষকে হত্যা, গুম করা শুরু হয়ে যায়। হোচট খেতে খেতে আহত অবস্থায় পৌছানোর কাছাকাছি এসে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো এদেশে জারি হয়। যদিও ওই বিধানের বলে যা যা করা যায়, তা বাস্তবে আগে থেকেই চলছিল। জরুরি অবস্থা ঘোষণার অন্য আরেকটি কারণ যে ছিল তা খুব স্বল্প সময়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাত্র ২৭ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। এই চতুর্থ সংশোধনীটি বিদ্যুতের বেগে দ্রুত পাস হয়ে যায় এবং গঠিত হয় বাকশাল পদ্ধতির বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সংশোধনীর ১১৭ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমন এক দল গঠন করা হয়, যেখানে একটি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, সবাইকে তাতে যোগ দিতে হবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি সংবাদপত্র ছাড়া কোনো সংবাদপত্র থাকবে না- জাতীয় বিভিন্ন বিষয় এই সংশোধনীতে সন্নিবেশিত হয়েছিল। এ ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার এমন এক নজিরবিহীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা - যা জনগণের প্রত্যাশিত ছিল না, যার জন্য তারা প্রস্তুতও ছিলেন না - না মানসিক বা অন্যভাবে। মুক্তিযুদ্ধের দগ দগে ঘা তখনো না শুকালেও ক্ষমতার রাজনীতিতে কূটকৌশলের ক্ষেত্রে এটি ছিল এক অভিনব উদ্ভাবন।
কাজেই এতো বছর পরে এসেও এসব কূটকৌশল আর অভিনব উদ্ভাবন বা কর্মকাণ্ড অনেককে হতবাক, বিস্মিত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং কখনো কখনো হতাশ করলেও, এই হচ্ছে আমাদের সূচনাকাল এবং কারো কারো জন্য মেনে চলার এক ঐতিহাসিক পাথেয় ও আদর্শ। আর সূচনাকাল নির্দেশিত পথে চলার আদর্শের যারা সৈনিক,তারা এই পথেই চলবেন, এটাই প্রত্যাশিত। যদিও পরবর্তীকালে ১৯৮১, ১৯৮৭, ১৯৯০ এবং ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা আমাদের দেখতে হয়েছে। ১৯৯০-এ স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পরে এ দেশের রাজনীতির যে নবযাত্রা শুরু হয়, নতুন এক পর্বের শুরু হয়, সেখানে অতীতের স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিহার করার অঙ্গীকার ছিল ও কমবেশি তার চর্চা হয়েছে, যদিও জনগণের চাপের কারণে। ২০০৭-এর জরুরি অবস্থার সময় সেনাসমর্থিত কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সবার মনে দগ দগে ঘায়ের মতো স্মৃতি হয়ে আছে। জনগণ এটা সমর্থন করেননি। যদিও যারা এর সুফল পেয়েছেন তাদের মধ্যে, এ কারণে এখনো পর্যন্ত একটা কৃতজ্ঞতাবোধ ক্রিয়াশীল।
ওই্ দগদগে ঘায়ের উপর দাঁড়িয়ে জনমানুষের আকাঙ্খা ছিল, আর ওই পথে নয়, নতুন করে চলতে হবে। আবার যাত্রা করতে হবে একটি নিখাদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ তারা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান পাঁচটি অগ্রাধিকারের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ জ্বালানি সঙ্কট নিরসন, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে উল্লেখ করেছিল। এর পাশাপাশি ইশতেহারের ৫.৪ - এ উল্লেখ ছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণবিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।
কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে শুরু করে খুব অল্পকালেই টের পাওয়া গেল, ওই সব প্রতিশ্রুতি ছিল কথার কথা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র এবং যুব সংগঠনসহ সবাই মিলে একযোগে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের নেমে পড়ে। এ ছিল একবেলায় বহুদিনের খাবার এক সঙ্গে খেয়ে ফেলার মতো। সে সময়ও সংবাদপত্রে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্বয়ঃক্রিয় অস্ত্র হাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের ছবি ছাপা হয়েছে, এখনো তাদের ছবি ছাপা হয় - কিন্তু কোনো বিচার হয় না। তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। উল্টো প্রথমদিন থেকে বিরোধী দল, মত ও পক্ষাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার এবং সঙ্গে সঙ্গে হত্যা-গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। দিনে দিনে তা বেড়েছে এবং বাড়ছে। স্বাধীনতার পর পরই বিরোধী পক্ষকে দমনের জন্য রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সে কাজটিই করানো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দিয়ে। কালের বিবর্তনে যেমন অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়, এক্ষেত্রেও তাই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, বিরোধী পক্ষ তো দূরে থাক, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাবিতে আমজনতাও যদি রাস্তায় নামেন,তবে তারাও নিজ ঘরে আর প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন কিনা এমন নিশ্চয়তা নেই।
সংসদে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয় তা কানে তুলো দিলেও মানে না। জীবিতদের চরিত্র হননমূলক বক্তব্য যখন শীর্ষ ও উচ্চ পর্যায় থেকে আসে তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তারা বিরোধী মত ও পথ চান না, কামনা করেন না। এতেও তারা থেমে নেই। মৃত ব্যক্তি বা তাদের কবর সম্পর্কেও যে সব মন্তব্য ইতোমধ্যে করা হয়েছে, তা সংসদের ইতিহাসে কোনো দিন শোনা যায়নি। সংসদ অকার্যকর।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে এমন সব নিত্যনতুন অভিনব কৌশল আবিস্কার করা হয় যে, বঙ্গীয় এসব মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির সক্ষমতার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ক্ষেত্রে যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখে, তাদের এখন তারিফ করা হয়, করা হয় পুর®কৃত। বিরোধী চিফ হুইপকে নির্মম এবং নির্দয়ভাবে প্রহারের জন্য সর্বোচ্চ পদক পাওয়া যায় এবং স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা সত্যায়িত করেছেন। এখন ঝাকুনি তথ্য, বিরোধী কোনো নেতার মাথা ফাটিয়ে দেয়া হলে ‘গরুর রক্ত তত্ত্ব’ ‘বাসায় তালা মেরে বাড়ি যাওয়া তত্ত্ব’ এমনকি হরতাল কিভাবে পালন করতে হয় সে তত্ত্বও শিখেয়েছেন তারা। এর সঙ্গে বরাবরই উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই ‘নাশকতা তত্ত্বটি’ ব্যবহার করে থাকেন। এসব কারণ দেখিয়ে সভা-সমাবেশের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, আর এটি এর সব শেষ উদাহরণ। তবে বিধি-নিষেধ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের মধ্যে অমিল রয়েছে। আবার এদের সঙ্গে মিল নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের আইজির বক্তব্যে। সব মিলিয়ে বলা চলে, বিরোধী পক্ষ দমন এবং নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায়রত থাকাকালীন সময়ে বাস্তবে অনেক অসংলগ্ন কথাবার্তা হতে পারে এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ উদ্দেশে মহৎ হলে এমনটা হতো না। উদ্দেশ্যে সহি না হওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে, পুরো বিষয়টিকে সে বাস্তবতায়ই দেখা বাঞ্ছনীয়।
সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দিয়ে এখন এলেও, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই কোথায়, কোনদিন বিরোধী দল কিংবা বিরোধী পথ এবং মতাবলম্বীরা বাধাহীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে পেরেছে? বিরোধী দল বাদই দিলাম, এমনকি যৌন সন্ত্রাসীদের মহা তাণ্ডবের সময়ে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে সমবেতরা কি এই সরকার লাঠিপেটা করেনি? তেল, গ্যাস খনিজ সম্পদ বন্দর রক্ষা কমিটির সমাবেশে পুলিশি হামলায় কি পুলিশ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পা ভেঙে দেয়নি? নিরীহ শিক্ষকদের কি নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয়নি? বিশ্বজিতকে কারা হত্যা করেছে? রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় পেটোয়া বাহিনীকে দিয়ে কতো দফা হামলা চালানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে? বিরোধী সভা-সমাবেশ ভাঙার জন্য কতো শতো বার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে? কারা নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে? আড়িয়াল বিল, রূপগঞ্জ, রামপালসহ বিভিন্ন স্থানে জনপ্রতিরোধ দমনে সরকার কি গুলি চালিয়ে হত্যা করেনি? এ সবই ছিল এবং এখনো আছে। বরং মাত্রায় আরো বেড়েছে। গলার সরটা আরো বেশি চড়া হয়েছে। সভা-সমাবেশ তো ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ ছিল। এখন ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এই হচ্ছে পার্থক্য।
কিন্তু সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার, দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে এসবের পাশাপাশি গ্রেফতার আর নির্বিচারে জেলে পাঠানো, স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকার মনে করছে, এভাবেই বিরোধী দল ও মতের নেতাকর্মীদের দমন করা যাবে এবং এটাই হচ্ছে উত্তম পন্থা।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বেশ কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার মধ্যদিয়ে দেশে যে জটিল রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়, তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এর ফলে সঙ্কট কতোটা গভীর হয়েছে, সাংঘর্ষিক রাজনীতি দিনে দিনে আরো কতোটা সাংঘর্ষিক হচ্ছে কিংবা সকল দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা যে ধীরে ধীরে তিরোহিত হচ্ছে, তা সবাই বুঝতে পারছেন। সবাই বুঝতে পারছেন বলেই দিনে দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি জনসমর্থন বেড়ে এখন শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সরকার প্রধান এবং ক্ষমতাসীনরা মানুষের ভাষা বুঝেন না, বুঝেন না সাধারণ মানুষের বক্তব্য এবং তাদের মনের আকাঙ্খা।
এখন সংলাপ অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। এটা যে লোক দেখানো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ হাত পা বেধে পানিতে ফেলে সাঁতার কাটতে বলা এবং এখন সংলাপে অংশ নেয়ার কথা বলা একই।
কিন্তু সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত এবং চিরস্থায়ী করার বাসনা। সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, এমন বক্তব্যের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা, সভা-সমাবেশে বিধি-নিষেধ আরোপ, গ্রেফতার, নির্যাতন সবই করা হচ্ছে ওই একই উদ্দেশ্যে। কার্যতঃ অনেকদিন ধরেই দেশে জরুরি অবস্থা চলছে - এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কিছু নেই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও সভা-সমাবেশের অধিকার বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের যে সব অনুচ্ছেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে স্থগিত হয়ে যায়, সে পরিস্থিতি কি দেশে বিরাজ করছে না? দেশে এক দল, এক মত, এক চিন্তার অনানুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না? সবাই পারছেন। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন, উপলব্ধি করতে পারছেন, টের পাচ্ছেন ভয়াবহতা এবং তীব্রতা। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রে এক দল, এক মত, এক চিন্তা অর্থাৎ এক এবং এককের কোনো স্থান নেই। ইতিহাস বড়ই নির্মম এবং নিষ্ঠুর - এটা শাসকরা কখনই মনে রাখে না। রাখে না বলেই তারা কখনো না কখনো নিজেদের পরিণতি ভোগ করে, আর ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়ে যায় খোদ রাষ্ট্রটি এবং এর জনগণকে। আমীন!
অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, সভা-সমাবেশের অধিকার হরণ থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার ‘ঐতিহ্য’ তাদের রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় এর প্রণেতারা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সামনে নিয়ে এবং পাকিস্তানি শাসনের যে সব কালো দিকগুলো ছিল, তা থেকে পরিত্রাণের পথ ও পদ্ধতি গ্রহণে সংবিধান রচনা করেছিলেন। আর মানুষের ন্যূনতম অধিকারগুলোকে রক্ষাকবচ হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খার বিকাশ যে সব কারণে শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণটি ছিল ১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘকালের সামরিক শাসন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ওই সময়কালে এ দেশের মানুষ অধিকার হরণের নানা কূটকৌশল ও ফন্দিফিকির দেখেছে। এ থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্খার কারণে জনগণের অধিকারগুলোকে সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের যে মূল কপিটি এই প্রতিবেদকের হাতে আছে, তা হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে গেলেও, তাতে কোথাও জরুরি অবস্থার বিধান ছিল না। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার যে সংবিধান প্রকাশিত হয়, তার ব্যবচ্ছেদ শুরু হতে সময় লেগেছে মাত্র ৭ মাস। তবে সংবিধানের মৌল চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক এবং পরিপন্থী সংশোধনীটি আনা হয় ৯ মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। আর এটি সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী - যাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানসহ নানা নিবর্তনমূলক বিষয়গুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। আর এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ এবং ৪২ অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা স্থগিত করার বিধান রাখা হয়। এর ফলে যে মৌলিক অধিকার সংবিধান নিশ্চিত করেছিল অর্থাৎ চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক, ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের মূল বিষয়গুলো স্থগিতকরণ বা কার্যকারিতা হরণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এভাবেই শুরু হয় হোচট খাবার প্রথম পর্বটি। এর পরে ওই আমলেই মানুষ অসংখ্যবার হোচট খেয়েছে। নির্বিচারে গ্রেফতার, অত্যাচার-নির্যাতন, বিরোধী পক্ষকে হত্যা, গুম করা শুরু হয়ে যায়। হোচট খেতে খেতে আহত অবস্থায় পৌছানোর কাছাকাছি এসে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো এদেশে জারি হয়। যদিও ওই বিধানের বলে যা যা করা যায়, তা বাস্তবে আগে থেকেই চলছিল। জরুরি অবস্থা ঘোষণার অন্য আরেকটি কারণ যে ছিল তা খুব স্বল্প সময়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাত্র ২৭ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। এই চতুর্থ সংশোধনীটি বিদ্যুতের বেগে দ্রুত পাস হয়ে যায় এবং গঠিত হয় বাকশাল পদ্ধতির বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সংশোধনীর ১১৭ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমন এক দল গঠন করা হয়, যেখানে একটি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, সবাইকে তাতে যোগ দিতে হবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি সংবাদপত্র ছাড়া কোনো সংবাদপত্র থাকবে না- জাতীয় বিভিন্ন বিষয় এই সংশোধনীতে সন্নিবেশিত হয়েছিল। এ ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার এমন এক নজিরবিহীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা - যা জনগণের প্রত্যাশিত ছিল না, যার জন্য তারা প্রস্তুতও ছিলেন না - না মানসিক বা অন্যভাবে। মুক্তিযুদ্ধের দগ দগে ঘা তখনো না শুকালেও ক্ষমতার রাজনীতিতে কূটকৌশলের ক্ষেত্রে এটি ছিল এক অভিনব উদ্ভাবন।
কাজেই এতো বছর পরে এসেও এসব কূটকৌশল আর অভিনব উদ্ভাবন বা কর্মকাণ্ড অনেককে হতবাক, বিস্মিত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং কখনো কখনো হতাশ করলেও, এই হচ্ছে আমাদের সূচনাকাল এবং কারো কারো জন্য মেনে চলার এক ঐতিহাসিক পাথেয় ও আদর্শ। আর সূচনাকাল নির্দেশিত পথে চলার আদর্শের যারা সৈনিক,তারা এই পথেই চলবেন, এটাই প্রত্যাশিত। যদিও পরবর্তীকালে ১৯৮১, ১৯৮৭, ১৯৯০ এবং ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা আমাদের দেখতে হয়েছে। ১৯৯০-এ স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পরে এ দেশের রাজনীতির যে নবযাত্রা শুরু হয়, নতুন এক পর্বের শুরু হয়, সেখানে অতীতের স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিহার করার অঙ্গীকার ছিল ও কমবেশি তার চর্চা হয়েছে, যদিও জনগণের চাপের কারণে। ২০০৭-এর জরুরি অবস্থার সময় সেনাসমর্থিত কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সবার মনে দগ দগে ঘায়ের মতো স্মৃতি হয়ে আছে। জনগণ এটা সমর্থন করেননি। যদিও যারা এর সুফল পেয়েছেন তাদের মধ্যে, এ কারণে এখনো পর্যন্ত একটা কৃতজ্ঞতাবোধ ক্রিয়াশীল।
ওই্ দগদগে ঘায়ের উপর দাঁড়িয়ে জনমানুষের আকাঙ্খা ছিল, আর ওই পথে নয়, নতুন করে চলতে হবে। আবার যাত্রা করতে হবে একটি নিখাদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ তারা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান পাঁচটি অগ্রাধিকারের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদ্যুৎ জ্বালানি সঙ্কট নিরসন, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে উল্লেখ করেছিল। এর পাশাপাশি ইশতেহারের ৫.৪ - এ উল্লেখ ছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণবিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।
কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে শুরু করে খুব অল্পকালেই টের পাওয়া গেল, ওই সব প্রতিশ্রুতি ছিল কথার কথা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র এবং যুব সংগঠনসহ সবাই মিলে একযোগে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের নেমে পড়ে। এ ছিল একবেলায় বহুদিনের খাবার এক সঙ্গে খেয়ে ফেলার মতো। সে সময়ও সংবাদপত্রে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্বয়ঃক্রিয় অস্ত্র হাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের ছবি ছাপা হয়েছে, এখনো তাদের ছবি ছাপা হয় - কিন্তু কোনো বিচার হয় না। তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। উল্টো প্রথমদিন থেকে বিরোধী দল, মত ও পক্ষাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার এবং সঙ্গে সঙ্গে হত্যা-গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। দিনে দিনে তা বেড়েছে এবং বাড়ছে। স্বাধীনতার পর পরই বিরোধী পক্ষকে দমনের জন্য রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সে কাজটিই করানো হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দিয়ে। কালের বিবর্তনে যেমন অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়, এক্ষেত্রেও তাই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, বিরোধী পক্ষ তো দূরে থাক, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাবিতে আমজনতাও যদি রাস্তায় নামেন,তবে তারাও নিজ ঘরে আর প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন কিনা এমন নিশ্চয়তা নেই।
সংসদে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয় তা কানে তুলো দিলেও মানে না। জীবিতদের চরিত্র হননমূলক বক্তব্য যখন শীর্ষ ও উচ্চ পর্যায় থেকে আসে তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তারা বিরোধী মত ও পথ চান না, কামনা করেন না। এতেও তারা থেমে নেই। মৃত ব্যক্তি বা তাদের কবর সম্পর্কেও যে সব মন্তব্য ইতোমধ্যে করা হয়েছে, তা সংসদের ইতিহাসে কোনো দিন শোনা যায়নি। সংসদ অকার্যকর।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে এমন সব নিত্যনতুন অভিনব কৌশল আবিস্কার করা হয় যে, বঙ্গীয় এসব মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির সক্ষমতার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ক্ষেত্রে যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখে, তাদের এখন তারিফ করা হয়, করা হয় পুর®কৃত। বিরোধী চিফ হুইপকে নির্মম এবং নির্দয়ভাবে প্রহারের জন্য সর্বোচ্চ পদক পাওয়া যায় এবং স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা সত্যায়িত করেছেন। এখন ঝাকুনি তথ্য, বিরোধী কোনো নেতার মাথা ফাটিয়ে দেয়া হলে ‘গরুর রক্ত তত্ত্ব’ ‘বাসায় তালা মেরে বাড়ি যাওয়া তত্ত্ব’ এমনকি হরতাল কিভাবে পালন করতে হয় সে তত্ত্বও শিখেয়েছেন তারা। এর সঙ্গে বরাবরই উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই ‘নাশকতা তত্ত্বটি’ ব্যবহার করে থাকেন। এসব কারণ দেখিয়ে সভা-সমাবেশের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, আর এটি এর সব শেষ উদাহরণ। তবে বিধি-নিষেধ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের মধ্যে অমিল রয়েছে। আবার এদের সঙ্গে মিল নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের আইজির বক্তব্যে। সব মিলিয়ে বলা চলে, বিরোধী পক্ষ দমন এবং নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায়রত থাকাকালীন সময়ে বাস্তবে অনেক অসংলগ্ন কথাবার্তা হতে পারে এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ উদ্দেশে মহৎ হলে এমনটা হতো না। উদ্দেশ্যে সহি না হওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে, পুরো বিষয়টিকে সে বাস্তবতায়ই দেখা বাঞ্ছনীয়।
সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দিয়ে এখন এলেও, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই কোথায়, কোনদিন বিরোধী দল কিংবা বিরোধী পথ এবং মতাবলম্বীরা বাধাহীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে পেরেছে? বিরোধী দল বাদই দিলাম, এমনকি যৌন সন্ত্রাসীদের মহা তাণ্ডবের সময়ে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে সমবেতরা কি এই সরকার লাঠিপেটা করেনি? তেল, গ্যাস খনিজ সম্পদ বন্দর রক্ষা কমিটির সমাবেশে পুলিশি হামলায় কি পুলিশ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পা ভেঙে দেয়নি? নিরীহ শিক্ষকদের কি নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয়নি? বিশ্বজিতকে কারা হত্যা করেছে? রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় পেটোয়া বাহিনীকে দিয়ে কতো দফা হামলা চালানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে? বিরোধী সভা-সমাবেশ ভাঙার জন্য কতো শতো বার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে? কারা নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে? আড়িয়াল বিল, রূপগঞ্জ, রামপালসহ বিভিন্ন স্থানে জনপ্রতিরোধ দমনে সরকার কি গুলি চালিয়ে হত্যা করেনি? এ সবই ছিল এবং এখনো আছে। বরং মাত্রায় আরো বেড়েছে। গলার সরটা আরো বেশি চড়া হয়েছে। সভা-সমাবেশ তো ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ ছিল। এখন ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এই হচ্ছে পার্থক্য।
কিন্তু সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার, দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে এসবের পাশাপাশি গ্রেফতার আর নির্বিচারে জেলে পাঠানো, স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকার মনে করছে, এভাবেই বিরোধী দল ও মতের নেতাকর্মীদের দমন করা যাবে এবং এটাই হচ্ছে উত্তম পন্থা।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বেশ কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার মধ্যদিয়ে দেশে যে জটিল রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়, তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এর ফলে সঙ্কট কতোটা গভীর হয়েছে, সাংঘর্ষিক রাজনীতি দিনে দিনে আরো কতোটা সাংঘর্ষিক হচ্ছে কিংবা সকল দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা যে ধীরে ধীরে তিরোহিত হচ্ছে, তা সবাই বুঝতে পারছেন। সবাই বুঝতে পারছেন বলেই দিনে দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি জনসমর্থন বেড়ে এখন শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সরকার প্রধান এবং ক্ষমতাসীনরা মানুষের ভাষা বুঝেন না, বুঝেন না সাধারণ মানুষের বক্তব্য এবং তাদের মনের আকাঙ্খা।
এখন সংলাপ অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। এটা যে লোক দেখানো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ হাত পা বেধে পানিতে ফেলে সাঁতার কাটতে বলা এবং এখন সংলাপে অংশ নেয়ার কথা বলা একই।
কিন্তু সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত এবং চিরস্থায়ী করার বাসনা। সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, এমন বক্তব্যের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা, সভা-সমাবেশে বিধি-নিষেধ আরোপ, গ্রেফতার, নির্যাতন সবই করা হচ্ছে ওই একই উদ্দেশ্যে। কার্যতঃ অনেকদিন ধরেই দেশে জরুরি অবস্থা চলছে - এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কিছু নেই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও সভা-সমাবেশের অধিকার বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের যে সব অনুচ্ছেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে স্থগিত হয়ে যায়, সে পরিস্থিতি কি দেশে বিরাজ করছে না? দেশে এক দল, এক মত, এক চিন্তার অনানুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না? সবাই পারছেন। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন, উপলব্ধি করতে পারছেন, টের পাচ্ছেন ভয়াবহতা এবং তীব্রতা। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রে এক দল, এক মত, এক চিন্তা অর্থাৎ এক এবং এককের কোনো স্থান নেই। ইতিহাস বড়ই নির্মম এবং নিষ্ঠুর - এটা শাসকরা কখনই মনে রাখে না। রাখে না বলেই তারা কখনো না কখনো নিজেদের পরিণতি ভোগ করে, আর ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়ে যায় খোদ রাষ্ট্রটি এবং এর জনগণকে। আমীন!
সৌজন্যে- আমাদের বুধবার ডট কম
No comments