যুদ্ধোন্মাদনা ও যৌন অনাচার by ড. মাহফুজ পারভেজ
যুদ্ধের উন্মাদনা ও যৌন অনাচারের মধ্যে কি
কোনও কার্যকর সম্পর্ক আছে? থাকাটাই স্বাভাবিক। সাইকোলজির বিশেষজ্ঞরা বিশদে
ভাল বলতে পারবেন। সাধারণ চোখে আমরা দেখি, যুদ্ধের মাঠে সৈন্যরা উন্মাদনায়
প্রতিপক্ষ নিধনের সঙ্গে সঙ্গে যৌন অপরাধেও জড়িত হয়।
একাত্তরের
বাংলাদেশে এমন নৃশংসতা করেছে পাকিস্তানি হানাদারেরা। ভিয়েতনামে মার্কিন
বাহিনী, কোরিয়ায় জাপানি বাহিনী যখন আক্রমণ করতে গেছে, তখন নারীদের
প্রচণ্ডভাবে নিগৃহীত করেছে। ভারতীয় বাহিনী যখন কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব
ভারতের আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর, অরুনাচল, ত্রিপুরায়
আক্রমণ করে, তখন নারী নিগ্রহের বহু খবরও পাওয়া যায়। এখন মার্কিন বাহিনী
বিশ্বের দেশে দেশে হানা দিয়ে চলেছে। তাদের অপকর্মের কুৎসিত নজির হয়ে আছে
গুয়ান্তানামো এবং আবু গারিব কারাগার এবং সেখানকার বীভৎস নির্যাতন। মনে করার
কারণ নেই যে, সকল অপরাধই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যুদ্ধের তাণ্ডবে বহু
অপরাধের কথাই চাপা পড়ে যায় বড় বড় অপরাধের আড়ালে। অপরের প্রতি অপরাধ করার
তীব্র হিংসা যে ক্রমে ক্রমে নিজেদের মধ্যে সংক্রমিত হয়, এমন উদাহরণও পাওয়া
যাচ্ছে। মিডিয়া জানাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যৌন
হয়রানির ঘটনা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। পেন্টাগনের বরাত দিয়ে
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানানো
হয়েছে, কেবল ২০১২ সালে ২৬ হাজারের মতো যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে দেশটির
সেনাবাহিনীতে। সশস্ত্রবাহিনীর অন্তত ৬ শতাংশ নারী সদস্য যৌন হয়রানির শিকার
হচ্ছেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এদের অনেকেই অভিযোগ করতে রাজি হচ্ছেন না।
দেশটির বিমানবাহিনীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির প্রধানকে এক নারীকে যৌন
হয়রানির অভিযোগে আটক করা হয়। আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়েছে,
আগের বছরের তুলনায় ২০১২ সালে যৌন হয়রানির ঘটনায় প্রায় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
অন্তত ১২ হাজার নারী সদস্য অভিযোগ করেছেন, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার
হয়েছেন। পদোন্নতি এবং সুযোগ সুবিধার বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে তাদের এ ধরনের
হয়রানি করা হয় বলে জানানো হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে পুরুষ সদস্যদের ক্ষেত্রেও।
২০১২ সালে প্রায় ১৪ হাজার পুরুষের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীতে বিভিন্ন সরবরাহকারী
প্রতিষ্ঠান, কন্ট্রাকটর সংস্থার পুরুষদের ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়।
প্রেসিডেন্ট ওবামা এর বিরুদ্ধাচরণ করে বলেছেন, শুধু মনিটরিং বা আলোচনা নয়, এ
ধরনের জঘন্য কাজ শিগগির বন্ধ করতে হবে। প্রেসিডেন্টের আশাবাদ মনে হয় না
চট করে যৌন অপরাধকে কমিয়ে দিতে পারবে। তবে সমস্যাটির গতি রোধ করতে পারবে
অবশ্যই। তবে যুদ্ধংদেহী মনোভাব ত্যাগ করতে না পারলে যৌন কামুকতা কমবে বলে
মনে হয় না। মনসত্ত্ব এ কথাই বলে। প্রসঙ্গত বিশ্বে উন্নয়ন-অগ্রগতির আদর্শ
মার্কিন মুল্লুকেই যদি এমন অনাচার ঘটে, তাহলে তাদের বিশ্বব্যাপী গর্ব ও
শ্রেষ্ঠত্ব ম্লান হয় বৈকী! ‘আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শিখাও’ মর্মে যে বাংলার
প্রাচীন প্রবাদ বাক্যটি রয়েছে, এক্ষণে তা-ই স্মরণ করা যায়। মার্কিন
পুঁজিবাদী সমাজ ও সংস্কৃতির সব কিছুই ভাল বলে যারা নৃত্য করেন, আশা করি
তাদেরও এবার বোধোদয় হবে। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর
মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমানোর ব্যাপারে নেতৃবৃন্দের চোখ খুলবে বলেও
প্রত্যাশা করা যায়। যুদ্ধ একটি নির্মম প্রসঙ্গ। যুদ্ধের ময়দানের ক্ষয়ক্ষতি
অনেক সময় কোনও পক্ষেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু যুদ্ধের উন্মাদনা মাথায়
নিয়ে সর্বদা অপরাধে জড়িত থাকা স্বাভাবিকত্বেও লক্ষণ নয়। বিশেষত অবলা
সহকর্মীদের প্রতি যৌন লোলুপতায় ঝাঁপিয়ে পরাটা পাশবিক বর্বরতা। এহেন
অপকর্মের অবসান ঘটা জরুরি। নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিতরা নিরাপত্তা হানি কারণে
পরিণত হলে বড়ই বিপদ। এ বিপদ থেকে সুচিন্তিত পদক্ষেপের মাধ্যমে উদ্ধার পেতে
হবে। মার্কিন প্রশাসন তেমন ব্যবস্থাই গ্রহণ করবে বলে আশা করি।
mahfuzparvez@gmail.com
No comments