বিশ্বব্যাংক নতুন করে অসন্তুষ্ট, অনিশ্চিত দাতা অর্থায়ন অসন্তোষের চার কারণ
হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ পদ্মা সেতু নিয়ে চার কারণে নতুন করে অসন্তুষ্ট বিশ্বব্যাংক। ফলে সরকারের প্রতি সংস্থাটির অসন্তোষের মাত্রা বাড়ছেই। পাশাপাশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে দাতাদের অর্থায়ন। সর্বোচ্চ ঋণ দাতা এ সংস্থাটির একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনা কিংবা নতুন চুক্তি কোন বিষয়েই কার্যত এখনও সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের আলোচনা শুরুই হয়নি। তবে যে কোন মুহূর্তে আলোচনা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের একটি সূত্র। অন্যদিকে আগামী শুক্রবার ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইন। তার ফেরার পর পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে বলেও জানা গেছে। বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যে চারটি কারণে নতুন করে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে তা হলো প্রথমত, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাদপত্র জমা দিলেও তা এখনও গৃহীত হয়নি। দ্বিতীয়ত দুর্নীতি দমন কমিশন মুখে বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে নেয়ার কথা বললেও বাস্তবিকভাবে তা এখনও কার্যকর হয়নি। তৃতীয়ত দেশে-বিদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বব্যাংক ও আবুল হোসেনকে নিয়ে সাম্প্রতিক লাগামহীন বক্তব্য এবং চতুর্থত একদিকে বিশ্বব্যাংক তোষণ অন্যদিকে বিকল্প অর্থায়নে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে নতুন করে তৎপরতা।এসব কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে কোন সাড়াই পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের কর্মকা- গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সংস্থাটি। পাশাপাশি পদ্মা সেতুতে অর্থায়নকারী অপর দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ কার্যকারিতার সময় এক মাস বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত তাদের অর্থায়নও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। কেননা ওই দুই উন্নয়ন সহযোগীও আশা করছে বর্ধিত সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমান সরকারের কর্মকা-ে তারাও হতাশ হচ্ছেন।
কারণ এডিবি আগেই বলেছে, পরিচালনার ক্ষেত্রে এডিবি ও বিশ্বব্যাংক একই ধরনের নীতি, নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করে। যে কারণে বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এডিবি তা অনুধাবন করতে পারে এবং চুক্তি বাতিলের এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংক সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হওয়ায় এডিবি হতাশ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়ে কার্যকর মতৈক্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের জন্য পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বিবেচনা করে এডিবি মর্মাহত। তবে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কারণে আগামীতেও উন্নয়নসহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের পাশে থাকতে এডিবি প্রতিশ্রুতবদ্ধ। সূত্র জানায়, গত ২৩ জুলাই পদ্মা সেতু নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও পরবর্তীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী আবুল হোসেন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। ফলে তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি গেজেট আকারে প্রকাশ না হওয়ায় তিনি এখনও মন্ত্রীই রয়েছেন। পদত্যাগেরে নামে এ ধরনের কার্যক্রমকে এক ধরনের প্রতারণা হিসেবেই দেখছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের শর্তে দুদককে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সম্প্রতি দুদক বাইরের প্যানেলের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করার কোন আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রাখার বিষয়টি মেনে নিয়েছে বলে বললেও এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিস জানিয়েছে। এ বিষয়টিকে একটি ঘোষণা মাত্র হিসেবে দেখছে সংস্থাটি। জুলাই মাসের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরের সময় বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের আবদার রক্ষা না করায় ঋণচুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একটি বিদেশী কোম্পানিকে পরামর্শক কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের চাপের বিনিময়ে পার্সেন্টেজ কত ছিল এটি যদি আমরা জানতে চাই তা কি খুব অন্যায় হবে? আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন দেশপ্রেম আছে বলেই আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছেন। তাছাড়া দেশেও বিভিন্ন সভা সেমিনারে বিশ্বব্যাংককে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর লাগামহীন বিষোদ্গার পদ্মা সেতুতে ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনায় বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব বাস্তবায়নে মনোযোগী না হয়ে সরকার বিকল্প অর্থায়নে বিশেষ করে মালয়েশিয়ার প্রতি বেশি আগ্রহ থাকায় বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্বব্যাংক। গত ৫ আগস্ট মালয়েশিয়া সরকারের দক্ষিণ এশীয় অবকাঠামো বিষয়ক দূত দাতো সেরি এস সামির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যোগাযোগমন্ত্রী ওয়াবদুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাত করে পদ্মা সেতু নির্মাণে কনসেশনস এগ্রিমেন্ট হস্তান্তর করে। এ সময় যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে চূড়ান্ত প্রস্তাব দেবে মালয়েশিয়া। পরে প্রতিনিধি দলটি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গেও বৈঠক করে। এছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে। সফররত প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের টেকনিক্যাল কমিটি সেতু ভবনে দীর্ঘ বৈঠকও করেছে। ওই বৈঠকে নদী শাসন, মূল ভিত্তি নির্র্মাণে কারিগরি দিক, নকশা এবং নির্মাণকালীন অর্থায়নে কর রেয়াত ও নির্মাণের পর টোল আদায়ে রাজস্ব গ্যারান্টিসহ মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়গুলোকে সরকারের দ্বিমুখী নীতি হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূলসেতু ও তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দরপত্রে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল বিশ্বব্যাংক। সংস্থার পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত বছরের সেপ্টম্বর মাসে অর্থমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছিল। সেখানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন সাকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। যোগাযোগমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন পেলে সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়ে সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে অবশেষে সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ওবায়দুল কাদেরকে। এতেও কোন ফল হয়নি। গত ২৯ জুন পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। চুক্তি বাতিলের কারণ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক দীর্ঘ ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। সংস্থাটি বলেছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তা, এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারী পর্যায়ে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দুটি তদন্তের তথ্য-প্রমাণ প্রদান করেছে। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি পূর্ণ তদন্ত করতে এবং যথাযথ বিবেচিত হলে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমরা এ পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, কারণ আমরা আশা করেছিলাম যে সরকার বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করবে।
No comments