জাতিসংঘের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে by শাহেদা ফেরদৌস
আজ ৩ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদ হচ্ছে, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সনদ। নারীর প্রতি সব ধরনের অন্যায়-অবিচার দূর করার জন্য ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ এই সনদ প্রণয়ন করে। বাংলাদেশও এই সনদে স্বাক্ষর করেছে, তবে শুরুতে এর সব কটি ধারার পূর্ণ অনুমোদন করেনি। সনদ স্বাক্ষরের সময় মোট চারটি ধারার ওপর সংরক্ষণ আরোপ করা হলেও দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে পরবর্তী সময়ে দুটির ওপর থেকে সরকার আপত্তি তুলে নেয়। মূলত ধর্মীয় অনুভূতির কারণে বাংলাদেশ সরকার সিডওর ধারা ২ এবং ১৬.১.গ-এর ব্যাপারে এখনো আপত্তি অব্যাহত রেখেছে। বলা বাহুল্য, সিডওর এই ধারা দুটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এতে প্রচলিত আইনের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ধারা সংশোধন এবং বৈবাহিক জীবনে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
পূর্ণ অনুমোদন না করলেও বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, এ সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিমাপ করার জন্য প্রতি চার বছর পর পর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোকে সিডও কমিটির কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। পাশাপাশি বিবেচনা করা হয় নিজ নিজ দেশের এনজিও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিকল্প বা ছায়া প্রতিবেদন। এ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় চলতি বছর, অর্থাৎ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে জেনেভায় সিডও কমিটির ৪৮তম নিয়মিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারি প্রতিনিধিদলের পাশাপাশি অংশ নিয়ে সিডও বিকল্প প্রতিবেদন পেশ করে বাংলাদেশের ৩৮টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় প্ল্যাটফর্ম সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডওর ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। অধিবেশন শেষে সিডও কমিটি এ দুটি প্রতিবেদন মূল্যায়ন করে সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় সম্পর্কে কতগুলো সমাপনী অভিমত দেয়, যেসব বিষয়ে অগ্রগতি বা অবস্থা সম্পর্কে সরকারকে পরবর্তী সাময়িক প্রতিবেদনে হালনাগাদ তথ্য প্রদান করতে হবে।
সমাপনী অভিমতে সিডও কমিটি সরকারের প্রতি যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সিডও সনদের ওপর অব্যাহত সংরক্ষণ, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বৈষম্যমূলক আইন, প্রথাগত ক্ষতিকর চর্চা বা আচার-আচরণ, নারী নির্যাতন, পাচার ও যৌন শোষণ, রাজনৈতিক ও গণজীবনে অংশগ্রহণ, নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ নারীর অধিকারহীনতা, বিয়ে ও পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদি।
আমরা মনে করি, সিডওর ধারা ২ ও ১৬.১.গ-এর ওপর থেকে সংরক্ষণ বাতিল না করার ফলে বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধানে স্বীকৃত অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান করছে। তা ছাড়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিভিন্ন ধারা ইতিমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের আটটি মুসলিমপ্রধান দেশ—ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, মালদ্বীপ, ওমান, তিউনিসিয়া, তুরস্ক ও ইয়েমেন সিডও সনদ অনুমোদন করেছে ধারা-২-এর ওপর কোনো ধরনের সংরক্ষণ ছাড়াই। তাই সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডও সরকারের প্রতি সুস্পষ্ট দাবি জানাচ্ছে, আইনের চোখে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং পৈতৃক সম্পদে মেয়েদের সম-অধিকার ও অন্যান্য ধর্মের ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অনতিবিলম্বে সিডওর পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন ও জাতীয় আইনে এর নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
একটি কথা না বললেই নয়, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা নারীর অগ্রগতি তথা জাতীয় উন্নয়নের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। যেমন: জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি-২০১১ ঘোষণা; সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০টিতে উন্নীত করা; পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, তথ্য অধিকার আইন এবং জাতীয় মানবাধিকার আইন প্রণয়ন; সদ্যপ্রণীত শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, শিশুনীতি, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদিকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার উদ্যোগ; জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের আওতা সম্প্রসারণ করা ইত্যাদি। সরকারের এসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় যদি আমাদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে তা শুধু বাংলাদেশের নারীসমাজের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার ইতি টানতেই সাহায্য করবে না, বরং বিশ্বের বুকে জেন্ডার সংবেদনশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করবে। সিডও দিবসে সেটাই সবার দাবি।
শাহেদা ফেরদৌসী: উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী।
পূর্ণ অনুমোদন না করলেও বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, এ সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিমাপ করার জন্য প্রতি চার বছর পর পর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোকে সিডও কমিটির কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। পাশাপাশি বিবেচনা করা হয় নিজ নিজ দেশের এনজিও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিকল্প বা ছায়া প্রতিবেদন। এ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় চলতি বছর, অর্থাৎ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে জেনেভায় সিডও কমিটির ৪৮তম নিয়মিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারি প্রতিনিধিদলের পাশাপাশি অংশ নিয়ে সিডও বিকল্প প্রতিবেদন পেশ করে বাংলাদেশের ৩৮টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় প্ল্যাটফর্ম সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডওর ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। অধিবেশন শেষে সিডও কমিটি এ দুটি প্রতিবেদন মূল্যায়ন করে সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় সম্পর্কে কতগুলো সমাপনী অভিমত দেয়, যেসব বিষয়ে অগ্রগতি বা অবস্থা সম্পর্কে সরকারকে পরবর্তী সাময়িক প্রতিবেদনে হালনাগাদ তথ্য প্রদান করতে হবে।
সমাপনী অভিমতে সিডও কমিটি সরকারের প্রতি যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সিডও সনদের ওপর অব্যাহত সংরক্ষণ, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বৈষম্যমূলক আইন, প্রথাগত ক্ষতিকর চর্চা বা আচার-আচরণ, নারী নির্যাতন, পাচার ও যৌন শোষণ, রাজনৈতিক ও গণজীবনে অংশগ্রহণ, নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ নারীর অধিকারহীনতা, বিয়ে ও পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদি।
আমরা মনে করি, সিডওর ধারা ২ ও ১৬.১.গ-এর ওপর থেকে সংরক্ষণ বাতিল না করার ফলে বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধানে স্বীকৃত অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান করছে। তা ছাড়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিভিন্ন ধারা ইতিমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের আটটি মুসলিমপ্রধান দেশ—ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, মালদ্বীপ, ওমান, তিউনিসিয়া, তুরস্ক ও ইয়েমেন সিডও সনদ অনুমোদন করেছে ধারা-২-এর ওপর কোনো ধরনের সংরক্ষণ ছাড়াই। তাই সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডও সরকারের প্রতি সুস্পষ্ট দাবি জানাচ্ছে, আইনের চোখে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং পৈতৃক সম্পদে মেয়েদের সম-অধিকার ও অন্যান্য ধর্মের ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অনতিবিলম্বে সিডওর পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন ও জাতীয় আইনে এর নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
একটি কথা না বললেই নয়, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা নারীর অগ্রগতি তথা জাতীয় উন্নয়নের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। যেমন: জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি-২০১১ ঘোষণা; সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০টিতে উন্নীত করা; পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, তথ্য অধিকার আইন এবং জাতীয় মানবাধিকার আইন প্রণয়ন; সদ্যপ্রণীত শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, শিশুনীতি, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদিকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার উদ্যোগ; জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের আওতা সম্প্রসারণ করা ইত্যাদি। সরকারের এসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় যদি আমাদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে তা শুধু বাংলাদেশের নারীসমাজের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার ইতি টানতেই সাহায্য করবে না, বরং বিশ্বের বুকে জেন্ডার সংবেদনশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করবে। সিডও দিবসে সেটাই সবার দাবি।
শাহেদা ফেরদৌসী: উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী।
No comments