বিভাস বিস্মৃতির মেট্রো পরাশর by সিলভিয়া নাজনীন

বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার ইতিহাসে এক ঐতিহ্যপূর্ণ নাম। ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির আগেই এর জন্ম। বাংলার প্রথিতযশা লেখক-সাহিত্যিক-কবি-শিল্পীর মুখর আড্ডার প্রধানতম কেন্দ্রস্থল ছিল বিউটি বোর্ডিং। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরবর্তী সময়ে এই বিউটি বোর্ডিং থেকে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। উল্লেখ্য, কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় এই পত্রিকাতেই। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই বোর্ডিংয়ের মালিক ও
কর্মচারীদের হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংটি চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে এলাকার ব্যক্তিবর্গ খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ-কবি-সাংবাদিক-শিল্পীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। আজও তাই বিউটি বোর্ডিং দাঁড়িয়ে আছে এর সমৃদ্ধ স্মৃতিভান্ডার সঙ্গে নিয়ে। এখনো মাঝেমধ্যেই পুরোনো আড্ডায় মুখর হয়ে ওঠে বোর্ডিংয়ের প্রৌঢ় আঙিনা। Longitude Latitude : 4 শিরোনামে ভিন্নমাত্রার একটি প্রদর্শনী শেষ হলো সম্প্রতি। প্যারীচাঁদ লেনের ‘বিউটি বোর্ডিং’ ছিল এই প্রদর্শনীর নির্ধারিত স্থান। এর বিষয়বস্তু খুব সাধারণ। সাধারণভাবে যে পরিসরটি প্রদর্শনীর জন্য নয়, তা দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে শিল্প প্রদর্শনের জন্য। এই স্থানকে শুধুই ট্রানজিশন বলা যায়। পারফরম্যান্স আর্ট, ফটোগ্রাফি, সিনেমা-ডকুমেন্টারি, মিউজিক্যাল পারফরম্যান্স, কোল্যাবরেটিভ আর্ট, স্থাপনাশিল্প, কথিকা ও কবিতা—এসবের সমন্বয়ে অভিনব এক আয়োজন এখানে ছিল। এই প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন শেহজাদ চৌধুরী ও মুনেম ওয়াসিফ।
এ সময়ের শিল্পধারা সম্পর্কে যদি ধারণা না থাকে, এমনকি একে গ্রহণ করার মানসিকতার সংকট যদি আমাদের হয়, তবে তা সীমাবদ্ধতা হিসেবেই গণ্য হবে। একটি ঐতিহাসিক পরিসরকে ব্যবহার করে সীমিত পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিশীলন করে নতুন আঙ্গিক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। সারা পৃথিবীতেই চলছে সাইকোলজিক্যাল স্পেস, টাইম স্পেস নিয়ে নানা ধরনের ভাবনা ও প্রদর্শনী। এই পরিসরের একটা হিস্টোরিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। এ সময়ের কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা একত্র করে তিন দিনের প্রদর্শনীতে উপস্থাপন প্রশংসনীয়। যদিও প্রশ্ন থাকে, এই আর্ট কমিউনিটি মূলত কাদের জন্য এ ধরনের আয়োজন করেছে? কারণ তাদের কনসেপ্টের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। পুরো প্রদর্শনীর প্রায় সবকিছুই ছিল বিদেশি ভাষায়, যা বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই নয়। অবশ্য কিউরেটরদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘শিল্প শুধু শিল্পীর জন্যও হতে পারে। গতানুগতিক স্পেস গতানুগতিকভাবে শিল্পকর্মের উদ্দেশ্যে ব্যবহার আমাদের পরিকল্পনা নয়। যেকোনো স্পেসকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের মাধ্যমে রূপান্তর ঘটে, সেখানে সময়কে ধারণ করলে অন্য মাত্রা তৈরি হয়। আমরা স্থান ও সময়ের সংশ্লেষণে নতুন কিছু ভাবার ও দেখার খোরাক পাই।’ এই নতুন ভাবনা কতটা নতুন; অথবা সৃষ্টিশীলতার কোন মাত্রায় তার অবস্থান, সে বিবেচনা শিল্প দর্শকের।
শিল্পী রনি আহমেদ ‘দ্য গোল্ডেন ডেজ অব দ্য গোল্ডেন নাইটস’ শিরোনামে করেছেন স্থাপনাশিল্প, যেখানে বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্যপূর্ণ সময়কে স্মৃতিচারণায় উপস্থাপন করেছেন। ম্যাটেরিয়াল হিসেবে লোকজ দৈনন্দিন নানা উপকরণ কুলা, ছাতা, টুকরি—এসবে সোনালি কাগজ মুড়িয়ে চমৎকারভাবে তৈরি করেছেন পিরামিড কম্পোজিশন। বিউটি বোর্ডিংয়ের সোনালি অতীত যেন প্রতিফলিত হচ্ছে স্থাপনার গায়ে লাগানো ছোট ছোট আয়নায়।
স্থপতি সালাউদ্দিন আহমেদ বোর্ডিংয়ের বর্তমান স্থাপত্যিক অবস্থাকে একই রেখে এর রেনোভেশন ও এক্সটেনশনকে ভেবে তিনটি ঘর ১১, ১২ ও ১৩ বেছে নিয়েছেন। এখানে ঘরের রূপান্তর ঘটান লাল রঙের মেঝে দিয়ে এবং তৈরি করেন নতুন তিনটি মডেল। এর সঙ্গে কিছু প্রাসঙ্গিক ড্রইংও তিনি উপস্থাপন করেন। পুরোনো উদ্ভাস ও নতুন চিন্তার দ্বান্দ্বিক উপলব্ধি যেকোনো পরিসরের সম্ভাবনাকে ব্যাপ্ত করে। স্তম্ভিত রূপের সঙ্গে ভারসাম্য মূর্ত হয়। লাইন, স্পেস, ফর্ম কাঙ্ক্ষিত পরিধির অস্তিত্বকে ইঙ্গিতময় করে তুলেছে।
শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান ও সৈয়দা ফারহানার প্রজেক্ট ছিল ‘বেওয়ারিশ চিঠি’ শিরোনামে। এখানে তাঁরা মানুষের বহুল পরিচিত যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি ব্যবহার করেছেন। এই চিঠিগুলোর প্রাপক বা প্রেরক অজ্ঞাত।
শহরের অনেক স্বপ্নচারীর জন্মস্থান বিউটি বোর্ডিং। এটি এখনো গণমানুষের জন্য নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শহরের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। এই শহর ও বিউটি বোর্ডিং—সবকিছুই ট্রানজিট হিসেবে বিবেচিত। এই শহর কাউকে ধারণ করেনি; যদিও আমরা যারা এখানে বসবাস করি, তারা দখল করি বেশ কিছু স্থান, কিছু স্মৃতি, দুঃসহ আবেগ, সত্য, সম্পর্ক—সব বেওয়ারিশ—শবদেহের মতো। এই অনুভূতির প্রকাশ ঘটে বেওয়ারিশ চিঠিতে। এই বেওয়ারিশ চিঠির মতোই বিউটি বোর্ডিংয়ে নিজেদের গল্প রেখে যায় ফেলে যাওয়া বাক্সপেটরা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র। যারা এসব ফেলে যায়, তারা আর ফেরে না তা নিতে। জানা যায় না, কেন তারা নিজস্ব দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। এটা কি সচেতনভাবেই তারা করে, না বিস্মৃতির কারণেই? এসব ফেলে যাওয়া বা রেখে যাওয়া বিষয়াদিতে কি ব্যক্তির মানসিকতা বোঝা যেতে পারে?
অংশগ্রহণকারীরা হলেন আরফুন আহমেদ, আয়েশা সুলতানা, মুরতাদা বুলবুল, নাকিব হোসেন, নাইম মোহাইমেন, রাহুল আনন্দ, রনি আহমেদ, রাসেল চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমেদ, সালজার রহমান, এস দিয়া আলম, ওয়াকিলুর রহমান, দেবাশীষ সোম, ইয়াসমিন কবির, ওয়াকিল আহাদ, খালিদ অরিন্দম, ভিক্টর দাস, নিশা আলম, শাহরিয়ার শাওন, সৈয়দা ফারহানা, চয়ন খায়রুল হাবিব, তেরেসা মিল, পাবলো ডব্লিউ তামবুরেল্লা, এস ই ই আহসানুল হক ও সানিম ফাহাদ আমিন।
==========================
উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(দশ)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(নয়)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(আট)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(সাত)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(ছয়)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(পাঁচ)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(চার)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(তিন)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(দুই)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(এক)  গল্প- পৃথিবীর দীর্ঘতম হাত  কালা পানির অনশন  লেখক না হলে গোয়েন্দা হতাম  অভিবাসী মানুষদের উপন্যাস  আগুনের পরশমণি  প্রেমাংশুর রক্ত চাই  গল্প- কোথায় তুমি  কবিতা বাতাসে অক্সিজেন ছড়ায়  সত্যজিৎ আমার গুরু ছিলেন  গল্প- দৌড়  বাংলা ঋতু-মাসের নামবিচার  যেভাবে মায়ের মন জয় করল বাবা  মানিক পীরের গান  গল্প- চুপি চুপি বাঁশি বাজে  গল্প- বিধুহীন  গল্প- অসমাপ্ত চুম্বনের ১৯ বছর পর...  গল্প- বসন্ত বিলাপ  খোয়াবের প্রতিলিপি  গল্প- জিঞ্জির ফেরা  দুর্লভ সময়ের হলফনামা  ইচ্ছা ছিল কবি হওয়ার  আমার গ্রন্থাগার  সোনার কমলার খোঁজে  রূপবান ঢাকার রক্তক্ষরণ  নারী জীবনের অচলায়তন  'ত্যাগের' মূল্যায়ন ও মুক্তকণ্ঠ তারুণ্য  মূল সংবিধান সংরক্ষণে সরকারের ইউটার্ন  তুরস্কে জেনারেলদের পদত্যাগ কেন?  ছোট দলগুলো ফুরফুরে মেজাজে!  কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষার বেহাল দশা  গল্প- লঞ্চের আপার ক্লাসে বাচ্চা হাতি  গুরুপল্লির আশ্রমে ভর্তি না হয়েই  মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই  মগ্নচৈতন্যের বর্ণময় অভিঘাত  গল্প- চিনেজোঁক  পুস্তক প্রকাশনা ও বাংলা একাডেমীর বইমেলা  শাহি মনজিলে সাহিত্য উৎসব by শাহীন আখতার  বাজে জসীমউদ্দীন  নান্দনিক চৈতন্য  গ্রামকে শহরে এনেছি  গল্প- জলঝড়  একাত্তরের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি  রশীদ করীমে'র সাক্ষাৎকার- 'মনে পড়ে বন্ধুদের'  প্রাচ্যের ছহি খাবনামা  গল্প- এভাবেই ভুল হয়  গল্প- মাঠরঙ্গ


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ সিলভিয়া নাজনীন

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.