ভালোর পসরা
ভালো চাই, ভালো
ভালো নেবেন গো ভালো?
আরও ভালো...
আরও ভালোর পসরা নিয়ে কলম ধরেছেন অনেকে। যতই কাজ করেন। তাঁদের কিছুই ভালো লাগে না। তাঁদের বক্তব্য হলো, ‘এই সরকার (আওয়ামী লীগ) কিছুই করছে না, মানুষের অনেক আশা ছিল, কিন্তু তা পূরণ হচ্ছে না। মানুষ হতাশ হয়ে যাচ্ছে, দেশ একদম ভালো চলছে না। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ।’
লেখালেখি, মধ্যরাতের টেলিভিশনে টক শো, গোল টেবিল, লম্বা টেবিল, চৌকো টেবিল, সেমিনার—কোথায় নেই তাঁরা? তাঁদের এসব কথায় সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রভাবও পড়ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে, অনেক সময় নিজের অজান্তে এই ডায়ালগ বলে দিচ্ছে। যাঁরা এটা করছেন, তাঁদের এই ‘বলার’ কথার ফুলঝুরি কি সব সময় অব্যাহত থাকে?
সব সরকারের আমলে? না না, তা শোনা যায় না। যেমন ধরুন, সামরিক সরকারের সময় তাঁদের কলমের কালি বা রিফিল থাকে না। কলম চলে না। মুখে কথা থাকে না। তখন বাঘের গর্জন বিড়ালের মিউ মিউয়ে পরিণত হয়। এখন যাঁদের কথায় টেলিভিশনের পর্দা ফেটে মনে হচ্ছে বেরিয়ে পড়বেন লাফ দিয়ে এক্কেবারে সরকারের ঘাড়ের ওপর। ‘সর্বনাশ’! পারলে এই মুহূর্তে সরকারের ঘাড়টাই ভেঙে দেবেন আরও ভালো কিছুর আশায়। এঁরাই আবার কখনো কখনো চুপ থাকেন।
তাঁদের ডায়ালগ বা বাক্যবিন্যাস অথবা উপদেশ শোনা যায়নি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বা ৩ নভেম্বর জেলহত্যা, একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, সিপাই-জনতার বিপ্লবের নামে একটার পর একটা ক্যু, তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ডে। অন্যায়ভাবে ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে সামরিক অফিসার ও সেনাদের হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, রিমান্ড ও হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় তাঁরা চুপ থেকেছেন। তাঁদের বিবেক জাগ্রত হয়নি ভালো না মন্দ, তা দেখার জন্য। বরং ঘাপটি মেরে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বাতাস কোন দিকে যায়, সেটা বুঝে নিয়ে সময়ের সুযোগে উদয় হওয়ার জন্য।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময়ে তাদের সোচ্চার হওয়ার একটা নির্দিষ্ট ক্ষণ ছিল, সেটা হলো মিলিটারি ডিক্টেটরদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতা কেনাবেচার সময়। যাঁরা নিজেদের উচ্চ দরে বিক্রি করতে পারলেন তাঁদের একধরনের সুর। আর যাঁরা কপালে কিছু জোটাতে পারলেন না তাঁদের সুর হলো দৃষ্টি আকর্ষণীয়-অর্থাৎ ‘আমরাও আছি, ক্রয় করুন, সেল-এ পাবেন।’ অর্থাৎ (‘use me’.)|
এরপর যাঁরা অবশিষ্ট থেকে গেলেন, তাঁরা তখন বাতাস ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সুর পাল্টিয়ে বিপ্লবী হয়ে গেলেন। এটা আমি ১৯৫৮ সালের জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির পর দেখেছি, আমাদের কত রাজনৈতিক ‘চাচার’ দল। যাঁরা আব্বা মন্ত্রী থাকা অবস্থায় নিজের বাড়িঘর সংসার ভুলে রাতদিন আমাদের বাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর প্রশংসার ফুলঝুরি উড়িয়েছেন, তাঁরাই কেমন ডিগবাজি খেয়েছেন। সুর পাল্টিয়েছেন তাও দেখেছি। ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১ সালসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছে।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যারা ভালো থেকে আরও ভালো, আরও ভালোও হয় না কেন বলে লেখালেখি করেছেন, মুখের বুলি আর কথার ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন, সমালোচনায় জর্জরিত করেছেন, তাঁরাই সুর পাল্টিয়ে ফেলেছেন। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি:
১৯৯৬ সালে ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। খাদ্য উৎপাদন এক কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন ছিল। ২০০০ সালের মধ্যে ঘাটতি মিটিয়ে চাল উৎপাদন দুই কোটি ৬৯ লাখ মেট্রিক টনে বৃদ্ধি করলাম। কী শুনেছি? ‘না, আরও একটু ভালো হতে পারত।’
পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ৭৯ লাখ মেট্রিক টনের বেশি অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন বাড়াল, তার পরও শুনে যেতে হলো, আরও একটু ভালো হতে পারত। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চালের উৎপাদন কতটুকু বেড়েছিল? বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরের মধ্যে চার বছর কোনো উৎপাদন বাড়েনি, বরং হ্রাস পেয়েছিল। অর্থাৎ উৎপাদন ছিল নেতিবাচক।
আর একটি উদাহরণ বিদ্যুতের ব্যাপারে। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ কম বেশি ১৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হতো। চরম বিদ্যুৎ ঘাটতি। সঞ্চালন লাইনগুলো জরাজীর্ণ ছিল। দ্রুত সরকারি ও প্রথমবারের মতো করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন বৃদ্ধি করলাম। সঞ্চালন লাইন উন্নত করার কাজ শুরু করলাম। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য নীতিমালা গ্রহণ ও প্রকল্প প্রণয়ন করে গেলাম। ২০০১ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বৃদ্ধি করলাম, তখন শুনেছি না ‘আরও ভালো করা যেত।’
কোনো তৃতীয় পক্ষের সাহায্য ছাড়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে গঙ্গা পানি চুক্তি করলাম। দীর্ঘদিনের একটা সমস্যার সমাধান হলো। দুই দশক ধরে চলা অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান করে শান্তি চুক্তি করলাম। অথচ একশ্রেণীর কাছ থেকে কখনো এ বিষয়ে ভালো কথা শুনিনি।
২০০১ সালের পয়লা অক্টোবর নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এল। কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিল পাঁচ বছরে? যেসব প্রকল্পের কাজ শুরু করে গিয়েছিলাম, তার কয়েকটা শেষ হয়েছিল তাতে উৎপাদন যা বেড়েছিল তাও ধরে রাখতে পারেনি।
২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারাও উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। আমরা এসে পেলাম কত? তিন হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা রেখে গিয়েছিলাম তার থেকেও ১২০০ মেগাওয়াট কম। পাঁচ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা যে কিছু করতে পারেনি, সে সম্পর্কে এই ‘ভালোর আশাবাদীরা’ কী ভূমিকা পালন করেছিলেন? আরও ভালো করার জন্য ১/১১-এর পর যারা উচ্চ দরের ডিগ্রিসম্পন্ন ও ওজনদার ব্যক্তিবর্গ— তারাই বা কি উন্নতি করতে পেরেছিলেন?
সে কথায় পরে আসব, কারণ তারা তখন এ কথা বলেনি যে, আওয়ামী লীগ সরকার ভালো করেছিল, কাজেই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। তারা তখন আরও ভালো মানুষের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল, সৎ মানুষের সন্ধানে সার্চ লাইট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রের সৎকার, অর্থাৎ কবর দেওয়া।
এই ধরনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারব। সব থেকে মজার কথা হলো, এই আরও ভালোর সন্ধানকারীদের নিশ্চুপ থাকতে দেখেছি ২০০১ সালের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই। প্রশাসনের ১৩ জন সচিবের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া নিয়ে যে শুরু, তা সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠানকেও কীভাবে প্রভাবিত করেছে ও ভীতসন্ত্রস্ত করেছিল, তা তখনকার অবস্থা স্মরণ করলেই জানা যাবে। শপথ অনুষ্ঠান হলো বঙ্গভবনে, সচিবেরা উপস্থিত ছিলেন। ফিরে এসে আর নিজের অফিসে ঢুকতে পারলেন না, কারণ চাকরি নেই। রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমেই ১৩ সচিবসহ অনেক অফিসারের চাকরি খেয়ে ফেলেছেন। শপথ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তাঁর পরিষদ গঠন করেননি। ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ হয়নি তখনো, অফিসেও বসেননি, কারণ শপথ অনুষ্ঠান অফিস সময়সূচির পরে হয়েছিল। তখনই কীভাবে চাকরি থেকে অফিসারদের বরখাস্ত করে? এমনকি নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়েও আনার জন্য যে অফিসে যাবেন, তারও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
গণভবনের টেলিফোন লাইনও কেটে দেওয়া হয়। আরও ভালোর ভক্তরা তখন এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করে বরং বাহবা দিয়েছিল।
প্রথম দিনের এই আচরণের মধ্য দিয়েই কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে ততবারই রক্তপাত ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে কখনো হয়নি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান যে পক্ষপাতদুষ্ট ও অসহিষ্ণু আচরণ দেখিয়েছিলেন, তাতে জাতি বিভ্রান্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের যে গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও বিশ্বাস, সে কারণেই গণতন্ত্রের স্বার্থে তখন আমরা নির্বাচন বয়কট করিনি। নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ভোট পেয়েছিলাম সংখ্যার দিক থেকে বেশি কিন্তু সিট সংখ্যা ছিল কম।
আরও একটি কথা, সাহাবুদ্দীন ও লতিফুর রহমান দুজনই প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আইনের ব্যবসাও করেছেন জীবিকার জন্য, আবার জাস্টিস হয়ে আইনের রক্ষাও করেছিলেন। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এখনো পেলাম না, সেটা হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের অর্থাৎ জীবিত দুই কন্যার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য একটা আইন পার্লামেন্টে পাস করেছিল, সেই আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় এবং সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের ফোনের লাইন ও বিদ্যুতের লাইন কীভাবে কেটে দেয়? পানির লাইন কেটেছিল কি না বুঝতে পারিনি, কারণ পানির ট্যাংক তো ভরা থাকত, শেষ হতে সময় লাগে। একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারীও সরকারি বাড়ি ছাড়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পায়, কিন্তু আমাকে সে সময়টুকুও দেওয়া হয়নি কেন? বিবেকবান বা আরও ভালোর দল কে কে তখন এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন?
আমার নামে ছড়ানো হলো, আমি গণভবন এক টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি, কিন্তু কেউ কি কোনো প্রমাণ দেখাতে পেরেছিল? পারেনি। কিন্তু মিথ্যা অপপ্রচারে ঠিকই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। সত্যটা কিন্তু কেউ বলেনি বা কোনো ডকুমেন্টও দেখাতে পারেনি। আমি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, এ পর্যন্ত কোনো সরকারি প্লট নিইনি।
২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপির ক্ষমতার আমল—১৫ জুলাই ২০০১ সালে যেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করল সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে এল অমানবিক অত্যাচার। নির্বাচনের দিনে একদিকে বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডার দল, অপরদিকে সামরিক বাহিনী ও পুলিশের নির্যাতনে নেতা-কর্মীরা ঘরে ঘুমাতে পারেননি। রেহানার বাড়ি দখল করে যখন পুলিশ স্টেশন করা হলো, তখনো কারও কাছ থেকে এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ শোনা যায়নি। অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে যে তাণ্ডব সেনাবাহিনী নামিয়ে করা হয়েছিল এবং মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, তা নিশ্চয়ই মনে আছে। আওয়ামী লীগের রিসার্চ সেন্টার থেকে ১৫টা কম্পিউটার, ১০ হাজার বই, ৩০০ ফাইল, এক লাখ ফরম, নগদ টাকা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেন্টারটা তালাবদ্ধ করে রাখা হয় পাঁচটা বছর। এটা কি গণতন্ত্রচর্চা? তাদের কাছ থেকে একটা প্রতিবাদও শুনিনি এর পরই শুরু হলো র্যাব গঠন ও ক্রসফায়ার। তখন তো সবাই র্যাবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেবল আমিই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম ও প্রতিবাদ করেছিলাম, তখন এই বিবেকবানেরা আমার সমালোচনা করেছিল। কাজগুলো নাকি খুবই ভালো হচ্ছিল বলে মন্তব্য করেছিল। এখন অবশ্য উল্টোটা শুনি।
সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকেই চায়, কিন্তু তাদের ভোট দেওয়ার উপায় নেই। ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বিশেষ করে, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ যারা আওয়ামী লীগ বা নৌকায় ভোট দেয়, তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচন চলাকালীন। তার পরও জনগণের ভোট আমরাই পাই কিন্তু সিট ঠিক গুনেই দেওয়া হয়। সরকার গঠন করার আগে থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের তাণ্ডব শুরু হলো। গ্যাং রেপ করেছে, ঠিক হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালে যেভাবে নির্যাতন করেছিল, ঠিক সেভাবেই নির্যাতন চলছিল। একটা সুখবর হলো পূর্ণিমা ধর্ষণ কেসের আসামিরা সাজা পেয়েছে। সাধারণত, সামাজিক লজ্জার ভয়ে কোনো পরিবার মামলা করতে চায় না। পূর্ণিমা সাহস করেছে বলেই বিচার পেয়েছে। আমার মনে হয়, এই একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। হাঁড়ি ভরা ভাত একটা টিপলেই তো বোঝা যায় সব ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না। ঠিক তেমনি একটা মামলার রায়ই প্রমাণ করে, কী ধরনের নির্যাতন বিএনপি ও জামায়াত দেশের মানুষের ওপর করেছিল। আমি এর বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাই না, কারণ এত বেশি ঘটনা যে এখানে সব উল্লেখও করা যাবে না, শুধু এটুকুই বলতে চাই, তখন দেখেছিলাম অনেক বিবেকবান চুপ করে আছেন। মুখে কথাও নেই। কলমের জোরও নেই। তাদের জোর বাড়ে শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে।
ঠিক স্বাধীনতার পর যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়তে সবাই ব্যস্ত। তখনো বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য ঘাটতি, দেশে দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। আর বাংলাদেশে তো ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়া। দিনরাত পরিশ্রম করে শূন্যের ওপর যাত্রা শুরু করে দেশকে গড়ে তুলতে ব্যস্ত, তখন ‘আরও ভালোর’ দলের সমালোচনা শুনেছি। কিছু নাকি হচ্ছে না। তখনো দেখেছিলাম তাদের কলম ও মুখের জোর। আর পরিণতি মার্শাল ল জারি এবং স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন। স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে দেশকে পিছিয়ে নেওয়া। ক্ষমতা দখলের ও ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে ১৯ ক্যু ও পাল্টা ক্যু হয়েছিল। দেশবাসীর অকল্যাণ হয়েছে, দেশ পিছিয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও সেই ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা থেমে নেই। যতবার জনগণ তাদের পরাজিত করে, ততবার আবার তারা পরগাছার মতো বেড়ে ওঠে। এবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লেগেছে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন, ১৯-২০ মে সামরিক ক্যুর অপচেষ্টা হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংঘটিত সামরিক ক্যু গণতন্ত্র ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল। নির্বাচনের পর সরকার গঠন করতেও টালবাহানা করে আবদুর রহমান বিশ্বাস। এসব কারা এবং কেন করেছিল এসব কথা আমরা কেন বিস্মৃত হই?
দেশের অবস্থা কী? খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত আছে? ২০০১ সালে যে মোটা চাল মাত্র ১০ টাকা ছিল (আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে), সেই চাল ২০০৮ সালে ৪০-৪৫ টাকা দাম হয়েছিল, তা কমিয়ে ১৮ টাকায় আনা হয়। কৃষকের খরচ পোষানো হয়। প্রতি কেজি চাল ৩২-৩৪ টাকায় ঢাকার বাজারে এবং ঢাকার বাইরে ২৬-২৭ টাকায়ও পাওয়া যায়। সরকার ৪০-৫২ টাকায় বিদেশ থেকে চাল কিনে এনে মাত্র ২৪ টাকায় খোলাবাজারে বিক্রি করছে। ফেয়ার প্রাইস কার্ড, রেশন কার্ড, ভিজিএফ, ভিজিডিসহ বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যনিরাপত্তা দিচ্ছে। না খেয়ে কেউ কষ্ট পাচ্ছে না। ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়া আটা ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাজেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত আছে। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে মঙ্গা হয় না।
সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত, মানুষ নানাভাবে সাহায্য পাচ্ছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, স্তন্যদানকারী মা, সন্তানসম্ভবা গরিব মা, স্কুলে গমনকারী গরিব শিশুর মাসহ এ ধরনের নানাভাবে সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টিকারী আর্থিক অনুদান সরকার দিয়ে যাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে। গরিব মানুষের কষ্ট লাঘব হচ্ছে। ১৯৯৮ সালের বন্যার পর আওয়ামী লীগ সরকার নয় মাস দুই কোটি লোককে বিনা পয়সায় খাইয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এসবই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা। ইতিপূর্বে আর কোনো সরকার এদিকে দৃষ্টি দেয়নি।
শিক্ষার হার, ভর্তির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাসের হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ২৩ কোটি ২২ লাখ বই বিনা পয়সায় বিতরণ করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সরকার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ৭১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুই বছরেই ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অতিরিক্ত উৎপাদন করা হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে, আরও বৃদ্ধির কাজ চলছে।
আইনশৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তার প্রমাণ আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ, হজ, ঈদ, পূজা, বড়দিন, পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। সবার বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে একদিকে, আর অপরদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। মূল্যস্ফীতি ১১ ভাগ থেকে কমিয়ে ছয় ভাগে আনা হয়েছিল, এখন কিছুটা বেড়ে আট ভাগ হয়েছে। শ্রমিক ও দিনমজুরদের আয় বেড়েছে। সরকার সদা সচেষ্ট আছে এসব বিষয়ে। ১৫০০ টাকা যারা শ্রমের মূল্য পেত, তারা ৩০০০ টাকা পায়। ধান কাটার সময় ৩০০-৪০০ টাকা দিনে মজুরি পেয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
অনেক কাজ, যা এই সরকার আসার আগে সাত বছরে হয়নি, তার থেকেও বেশি কাজ সরকার দুই বছরে করেছে এবং করে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজও সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪,৫০১টি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, টেন্ডার সর্বক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে এসেছে। কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধী যে-ই হোক, সরকার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিডিআর (বিজিবি) হত্যা ও বিদ্রোহের বিচার চলছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকার তৎপর ও সফল। যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার চলছে। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এ পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি। বরং সরকার দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর। এবার বোরো ফসল বাম্পার হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা সরাসরি পাচ্ছে। ডিজেলে ২০ শতাংশ সাবসিডি পাচ্ছে। হাওর এলাকায় ও এলাকাবিশেষে বিনা মূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক রিজার্ভ সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্স বেড়েছে। দুই বছরে নয় লাখ মানুষ বিদেশে গেছে। ফিরে এসেছে এক লাখ, যা স্বাভাবিক।
সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ছয় ভাগে ধরে রাখা হয়েছে, এবার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে।
চাকরিজীবীরা সন্তুষ্ট মনে চাকরি করে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা এত শান্তিতে কোনো দিন ব্যবসা করতে পারেননি। একটু অতীতের দিকে তাকালে স্মরণ করতে পারবেন। একদিকে ছিল হাওয়া ভবনের কমিশন ও ভাগ দেওয়া, অপরদিকে তত্ত্বাবধায়কের সময় ছিল আতঙ্ক, মামলা, দেশছাড়া। অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সে আতঙ্কের পরিবেশ নেই। মুক্ত পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন। রপ্তানি-বাণিজ্যে যা টার্গেট ছিল তার থেকে বেশি রপ্তানি হচ্ছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বরং, জমির অভাবে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। কাজেই সার্বিক দিক থেকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনে স্বস্তি আছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
এসব প্রশ্নের উত্তরের পরও আরও ভালোর দল বলবে, তার পরও দেশের অবস্থা ভালো নেই। এর কারণ কী? কারণ একটাই, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক সরকার থাকলে তাদের দাম থাকে। এই শ্রেণীটা জীবনে জনগণের মুখোমুখি হতে পারে না। ভোটে জিততে পারে না। কিন্তু ক্ষমতার লোভ ছাড়তে পারে না। তাই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক সরকারের যে খোশামোদি, তোষামোদি ও চাটুকারের দলও প্রয়োজন হয়—এরা সেই দল। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী ও চেতনায় বিশ্বাসীরা ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের উপকার হয়। আর দেশে মানুষ যদি দরিদ্র না থাকে, তাহলে এই শ্রেণীর বাণিজ্য শেষ হয়ে যাবে, কারণ দরিদ্র্য মানুষগুলোই তো তাদের বড় পণ্য। যাদের নিয়ে তারা বাণিজ্য করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে।
আমি বেঁচে থাকতে আমার দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর খেলতে দেব না।
২২.৫.২০১১
টরন্টো, কানাডা
শেখ হাসিনা: প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
ভালো নেবেন গো ভালো?
আরও ভালো...
আরও ভালোর পসরা নিয়ে কলম ধরেছেন অনেকে। যতই কাজ করেন। তাঁদের কিছুই ভালো লাগে না। তাঁদের বক্তব্য হলো, ‘এই সরকার (আওয়ামী লীগ) কিছুই করছে না, মানুষের অনেক আশা ছিল, কিন্তু তা পূরণ হচ্ছে না। মানুষ হতাশ হয়ে যাচ্ছে, দেশ একদম ভালো চলছে না। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ।’
লেখালেখি, মধ্যরাতের টেলিভিশনে টক শো, গোল টেবিল, লম্বা টেবিল, চৌকো টেবিল, সেমিনার—কোথায় নেই তাঁরা? তাঁদের এসব কথায় সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রভাবও পড়ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে, অনেক সময় নিজের অজান্তে এই ডায়ালগ বলে দিচ্ছে। যাঁরা এটা করছেন, তাঁদের এই ‘বলার’ কথার ফুলঝুরি কি সব সময় অব্যাহত থাকে?
সব সরকারের আমলে? না না, তা শোনা যায় না। যেমন ধরুন, সামরিক সরকারের সময় তাঁদের কলমের কালি বা রিফিল থাকে না। কলম চলে না। মুখে কথা থাকে না। তখন বাঘের গর্জন বিড়ালের মিউ মিউয়ে পরিণত হয়। এখন যাঁদের কথায় টেলিভিশনের পর্দা ফেটে মনে হচ্ছে বেরিয়ে পড়বেন লাফ দিয়ে এক্কেবারে সরকারের ঘাড়ের ওপর। ‘সর্বনাশ’! পারলে এই মুহূর্তে সরকারের ঘাড়টাই ভেঙে দেবেন আরও ভালো কিছুর আশায়। এঁরাই আবার কখনো কখনো চুপ থাকেন।
তাঁদের ডায়ালগ বা বাক্যবিন্যাস অথবা উপদেশ শোনা যায়নি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বা ৩ নভেম্বর জেলহত্যা, একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, সিপাই-জনতার বিপ্লবের নামে একটার পর একটা ক্যু, তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ডে। অন্যায়ভাবে ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে সামরিক অফিসার ও সেনাদের হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, রিমান্ড ও হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় তাঁরা চুপ থেকেছেন। তাঁদের বিবেক জাগ্রত হয়নি ভালো না মন্দ, তা দেখার জন্য। বরং ঘাপটি মেরে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বাতাস কোন দিকে যায়, সেটা বুঝে নিয়ে সময়ের সুযোগে উদয় হওয়ার জন্য।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময়ে তাদের সোচ্চার হওয়ার একটা নির্দিষ্ট ক্ষণ ছিল, সেটা হলো মিলিটারি ডিক্টেটরদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতা কেনাবেচার সময়। যাঁরা নিজেদের উচ্চ দরে বিক্রি করতে পারলেন তাঁদের একধরনের সুর। আর যাঁরা কপালে কিছু জোটাতে পারলেন না তাঁদের সুর হলো দৃষ্টি আকর্ষণীয়-অর্থাৎ ‘আমরাও আছি, ক্রয় করুন, সেল-এ পাবেন।’ অর্থাৎ (‘use me’.)|
এরপর যাঁরা অবশিষ্ট থেকে গেলেন, তাঁরা তখন বাতাস ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সুর পাল্টিয়ে বিপ্লবী হয়ে গেলেন। এটা আমি ১৯৫৮ সালের জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির পর দেখেছি, আমাদের কত রাজনৈতিক ‘চাচার’ দল। যাঁরা আব্বা মন্ত্রী থাকা অবস্থায় নিজের বাড়িঘর সংসার ভুলে রাতদিন আমাদের বাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর প্রশংসার ফুলঝুরি উড়িয়েছেন, তাঁরাই কেমন ডিগবাজি খেয়েছেন। সুর পাল্টিয়েছেন তাও দেখেছি। ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১ সালসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছে।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যারা ভালো থেকে আরও ভালো, আরও ভালোও হয় না কেন বলে লেখালেখি করেছেন, মুখের বুলি আর কথার ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন, সমালোচনায় জর্জরিত করেছেন, তাঁরাই সুর পাল্টিয়ে ফেলেছেন। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি:
১৯৯৬ সালে ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। খাদ্য উৎপাদন এক কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন ছিল। ২০০০ সালের মধ্যে ঘাটতি মিটিয়ে চাল উৎপাদন দুই কোটি ৬৯ লাখ মেট্রিক টনে বৃদ্ধি করলাম। কী শুনেছি? ‘না, আরও একটু ভালো হতে পারত।’
পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ৭৯ লাখ মেট্রিক টনের বেশি অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন বাড়াল, তার পরও শুনে যেতে হলো, আরও একটু ভালো হতে পারত। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চালের উৎপাদন কতটুকু বেড়েছিল? বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরের মধ্যে চার বছর কোনো উৎপাদন বাড়েনি, বরং হ্রাস পেয়েছিল। অর্থাৎ উৎপাদন ছিল নেতিবাচক।
আর একটি উদাহরণ বিদ্যুতের ব্যাপারে। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ কম বেশি ১৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হতো। চরম বিদ্যুৎ ঘাটতি। সঞ্চালন লাইনগুলো জরাজীর্ণ ছিল। দ্রুত সরকারি ও প্রথমবারের মতো করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন বৃদ্ধি করলাম। সঞ্চালন লাইন উন্নত করার কাজ শুরু করলাম। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য নীতিমালা গ্রহণ ও প্রকল্প প্রণয়ন করে গেলাম। ২০০১ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বৃদ্ধি করলাম, তখন শুনেছি না ‘আরও ভালো করা যেত।’
কোনো তৃতীয় পক্ষের সাহায্য ছাড়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে গঙ্গা পানি চুক্তি করলাম। দীর্ঘদিনের একটা সমস্যার সমাধান হলো। দুই দশক ধরে চলা অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান করে শান্তি চুক্তি করলাম। অথচ একশ্রেণীর কাছ থেকে কখনো এ বিষয়ে ভালো কথা শুনিনি।
২০০১ সালের পয়লা অক্টোবর নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এল। কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিল পাঁচ বছরে? যেসব প্রকল্পের কাজ শুরু করে গিয়েছিলাম, তার কয়েকটা শেষ হয়েছিল তাতে উৎপাদন যা বেড়েছিল তাও ধরে রাখতে পারেনি।
২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারাও উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। আমরা এসে পেলাম কত? তিন হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা রেখে গিয়েছিলাম তার থেকেও ১২০০ মেগাওয়াট কম। পাঁচ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা যে কিছু করতে পারেনি, সে সম্পর্কে এই ‘ভালোর আশাবাদীরা’ কী ভূমিকা পালন করেছিলেন? আরও ভালো করার জন্য ১/১১-এর পর যারা উচ্চ দরের ডিগ্রিসম্পন্ন ও ওজনদার ব্যক্তিবর্গ— তারাই বা কি উন্নতি করতে পেরেছিলেন?
সে কথায় পরে আসব, কারণ তারা তখন এ কথা বলেনি যে, আওয়ামী লীগ সরকার ভালো করেছিল, কাজেই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। তারা তখন আরও ভালো মানুষের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল, সৎ মানুষের সন্ধানে সার্চ লাইট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রের সৎকার, অর্থাৎ কবর দেওয়া।
এই ধরনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারব। সব থেকে মজার কথা হলো, এই আরও ভালোর সন্ধানকারীদের নিশ্চুপ থাকতে দেখেছি ২০০১ সালের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই। প্রশাসনের ১৩ জন সচিবের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া নিয়ে যে শুরু, তা সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠানকেও কীভাবে প্রভাবিত করেছে ও ভীতসন্ত্রস্ত করেছিল, তা তখনকার অবস্থা স্মরণ করলেই জানা যাবে। শপথ অনুষ্ঠান হলো বঙ্গভবনে, সচিবেরা উপস্থিত ছিলেন। ফিরে এসে আর নিজের অফিসে ঢুকতে পারলেন না, কারণ চাকরি নেই। রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমেই ১৩ সচিবসহ অনেক অফিসারের চাকরি খেয়ে ফেলেছেন। শপথ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তাঁর পরিষদ গঠন করেননি। ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ হয়নি তখনো, অফিসেও বসেননি, কারণ শপথ অনুষ্ঠান অফিস সময়সূচির পরে হয়েছিল। তখনই কীভাবে চাকরি থেকে অফিসারদের বরখাস্ত করে? এমনকি নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়েও আনার জন্য যে অফিসে যাবেন, তারও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
গণভবনের টেলিফোন লাইনও কেটে দেওয়া হয়। আরও ভালোর ভক্তরা তখন এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করে বরং বাহবা দিয়েছিল।
প্রথম দিনের এই আচরণের মধ্য দিয়েই কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে ততবারই রক্তপাত ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে কখনো হয়নি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান যে পক্ষপাতদুষ্ট ও অসহিষ্ণু আচরণ দেখিয়েছিলেন, তাতে জাতি বিভ্রান্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের যে গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও বিশ্বাস, সে কারণেই গণতন্ত্রের স্বার্থে তখন আমরা নির্বাচন বয়কট করিনি। নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ভোট পেয়েছিলাম সংখ্যার দিক থেকে বেশি কিন্তু সিট সংখ্যা ছিল কম।
আরও একটি কথা, সাহাবুদ্দীন ও লতিফুর রহমান দুজনই প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আইনের ব্যবসাও করেছেন জীবিকার জন্য, আবার জাস্টিস হয়ে আইনের রক্ষাও করেছিলেন। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এখনো পেলাম না, সেটা হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের অর্থাৎ জীবিত দুই কন্যার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য একটা আইন পার্লামেন্টে পাস করেছিল, সেই আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় এবং সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের ফোনের লাইন ও বিদ্যুতের লাইন কীভাবে কেটে দেয়? পানির লাইন কেটেছিল কি না বুঝতে পারিনি, কারণ পানির ট্যাংক তো ভরা থাকত, শেষ হতে সময় লাগে। একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারীও সরকারি বাড়ি ছাড়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পায়, কিন্তু আমাকে সে সময়টুকুও দেওয়া হয়নি কেন? বিবেকবান বা আরও ভালোর দল কে কে তখন এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন?
আমার নামে ছড়ানো হলো, আমি গণভবন এক টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি, কিন্তু কেউ কি কোনো প্রমাণ দেখাতে পেরেছিল? পারেনি। কিন্তু মিথ্যা অপপ্রচারে ঠিকই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। সত্যটা কিন্তু কেউ বলেনি বা কোনো ডকুমেন্টও দেখাতে পারেনি। আমি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, এ পর্যন্ত কোনো সরকারি প্লট নিইনি।
২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপির ক্ষমতার আমল—১৫ জুলাই ২০০১ সালে যেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করল সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে এল অমানবিক অত্যাচার। নির্বাচনের দিনে একদিকে বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডার দল, অপরদিকে সামরিক বাহিনী ও পুলিশের নির্যাতনে নেতা-কর্মীরা ঘরে ঘুমাতে পারেননি। রেহানার বাড়ি দখল করে যখন পুলিশ স্টেশন করা হলো, তখনো কারও কাছ থেকে এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ শোনা যায়নি। অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে যে তাণ্ডব সেনাবাহিনী নামিয়ে করা হয়েছিল এবং মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, তা নিশ্চয়ই মনে আছে। আওয়ামী লীগের রিসার্চ সেন্টার থেকে ১৫টা কম্পিউটার, ১০ হাজার বই, ৩০০ ফাইল, এক লাখ ফরম, নগদ টাকা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেন্টারটা তালাবদ্ধ করে রাখা হয় পাঁচটা বছর। এটা কি গণতন্ত্রচর্চা? তাদের কাছ থেকে একটা প্রতিবাদও শুনিনি এর পরই শুরু হলো র্যাব গঠন ও ক্রসফায়ার। তখন তো সবাই র্যাবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেবল আমিই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম ও প্রতিবাদ করেছিলাম, তখন এই বিবেকবানেরা আমার সমালোচনা করেছিল। কাজগুলো নাকি খুবই ভালো হচ্ছিল বলে মন্তব্য করেছিল। এখন অবশ্য উল্টোটা শুনি।
সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকেই চায়, কিন্তু তাদের ভোট দেওয়ার উপায় নেই। ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বিশেষ করে, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ যারা আওয়ামী লীগ বা নৌকায় ভোট দেয়, তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচন চলাকালীন। তার পরও জনগণের ভোট আমরাই পাই কিন্তু সিট ঠিক গুনেই দেওয়া হয়। সরকার গঠন করার আগে থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের তাণ্ডব শুরু হলো। গ্যাং রেপ করেছে, ঠিক হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালে যেভাবে নির্যাতন করেছিল, ঠিক সেভাবেই নির্যাতন চলছিল। একটা সুখবর হলো পূর্ণিমা ধর্ষণ কেসের আসামিরা সাজা পেয়েছে। সাধারণত, সামাজিক লজ্জার ভয়ে কোনো পরিবার মামলা করতে চায় না। পূর্ণিমা সাহস করেছে বলেই বিচার পেয়েছে। আমার মনে হয়, এই একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। হাঁড়ি ভরা ভাত একটা টিপলেই তো বোঝা যায় সব ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না। ঠিক তেমনি একটা মামলার রায়ই প্রমাণ করে, কী ধরনের নির্যাতন বিএনপি ও জামায়াত দেশের মানুষের ওপর করেছিল। আমি এর বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাই না, কারণ এত বেশি ঘটনা যে এখানে সব উল্লেখও করা যাবে না, শুধু এটুকুই বলতে চাই, তখন দেখেছিলাম অনেক বিবেকবান চুপ করে আছেন। মুখে কথাও নেই। কলমের জোরও নেই। তাদের জোর বাড়ে শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে।
ঠিক স্বাধীনতার পর যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়তে সবাই ব্যস্ত। তখনো বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য ঘাটতি, দেশে দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। আর বাংলাদেশে তো ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়া। দিনরাত পরিশ্রম করে শূন্যের ওপর যাত্রা শুরু করে দেশকে গড়ে তুলতে ব্যস্ত, তখন ‘আরও ভালোর’ দলের সমালোচনা শুনেছি। কিছু নাকি হচ্ছে না। তখনো দেখেছিলাম তাদের কলম ও মুখের জোর। আর পরিণতি মার্শাল ল জারি এবং স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন। স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে দেশকে পিছিয়ে নেওয়া। ক্ষমতা দখলের ও ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে ১৯ ক্যু ও পাল্টা ক্যু হয়েছিল। দেশবাসীর অকল্যাণ হয়েছে, দেশ পিছিয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও সেই ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা থেমে নেই। যতবার জনগণ তাদের পরাজিত করে, ততবার আবার তারা পরগাছার মতো বেড়ে ওঠে। এবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লেগেছে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন, ১৯-২০ মে সামরিক ক্যুর অপচেষ্টা হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংঘটিত সামরিক ক্যু গণতন্ত্র ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল। নির্বাচনের পর সরকার গঠন করতেও টালবাহানা করে আবদুর রহমান বিশ্বাস। এসব কারা এবং কেন করেছিল এসব কথা আমরা কেন বিস্মৃত হই?
দেশের অবস্থা কী? খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত আছে? ২০০১ সালে যে মোটা চাল মাত্র ১০ টাকা ছিল (আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে), সেই চাল ২০০৮ সালে ৪০-৪৫ টাকা দাম হয়েছিল, তা কমিয়ে ১৮ টাকায় আনা হয়। কৃষকের খরচ পোষানো হয়। প্রতি কেজি চাল ৩২-৩৪ টাকায় ঢাকার বাজারে এবং ঢাকার বাইরে ২৬-২৭ টাকায়ও পাওয়া যায়। সরকার ৪০-৫২ টাকায় বিদেশ থেকে চাল কিনে এনে মাত্র ২৪ টাকায় খোলাবাজারে বিক্রি করছে। ফেয়ার প্রাইস কার্ড, রেশন কার্ড, ভিজিএফ, ভিজিডিসহ বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যনিরাপত্তা দিচ্ছে। না খেয়ে কেউ কষ্ট পাচ্ছে না। ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়া আটা ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাজেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত আছে। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে মঙ্গা হয় না।
সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত, মানুষ নানাভাবে সাহায্য পাচ্ছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, স্তন্যদানকারী মা, সন্তানসম্ভবা গরিব মা, স্কুলে গমনকারী গরিব শিশুর মাসহ এ ধরনের নানাভাবে সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টিকারী আর্থিক অনুদান সরকার দিয়ে যাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে। গরিব মানুষের কষ্ট লাঘব হচ্ছে। ১৯৯৮ সালের বন্যার পর আওয়ামী লীগ সরকার নয় মাস দুই কোটি লোককে বিনা পয়সায় খাইয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এসবই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা। ইতিপূর্বে আর কোনো সরকার এদিকে দৃষ্টি দেয়নি।
শিক্ষার হার, ভর্তির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাসের হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ২৩ কোটি ২২ লাখ বই বিনা পয়সায় বিতরণ করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সরকার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ৭১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুই বছরেই ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অতিরিক্ত উৎপাদন করা হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে, আরও বৃদ্ধির কাজ চলছে।
আইনশৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তার প্রমাণ আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ, হজ, ঈদ, পূজা, বড়দিন, পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। সবার বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে একদিকে, আর অপরদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। মূল্যস্ফীতি ১১ ভাগ থেকে কমিয়ে ছয় ভাগে আনা হয়েছিল, এখন কিছুটা বেড়ে আট ভাগ হয়েছে। শ্রমিক ও দিনমজুরদের আয় বেড়েছে। সরকার সদা সচেষ্ট আছে এসব বিষয়ে। ১৫০০ টাকা যারা শ্রমের মূল্য পেত, তারা ৩০০০ টাকা পায়। ধান কাটার সময় ৩০০-৪০০ টাকা দিনে মজুরি পেয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
অনেক কাজ, যা এই সরকার আসার আগে সাত বছরে হয়নি, তার থেকেও বেশি কাজ সরকার দুই বছরে করেছে এবং করে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজও সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪,৫০১টি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, টেন্ডার সর্বক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে এসেছে। কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধী যে-ই হোক, সরকার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিডিআর (বিজিবি) হত্যা ও বিদ্রোহের বিচার চলছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকার তৎপর ও সফল। যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার চলছে। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এ পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি। বরং সরকার দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর। এবার বোরো ফসল বাম্পার হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা সরাসরি পাচ্ছে। ডিজেলে ২০ শতাংশ সাবসিডি পাচ্ছে। হাওর এলাকায় ও এলাকাবিশেষে বিনা মূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক রিজার্ভ সর্বোচ্চ। রেমিট্যান্স বেড়েছে। দুই বছরে নয় লাখ মানুষ বিদেশে গেছে। ফিরে এসেছে এক লাখ, যা স্বাভাবিক।
সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ছয় ভাগে ধরে রাখা হয়েছে, এবার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে।
চাকরিজীবীরা সন্তুষ্ট মনে চাকরি করে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা এত শান্তিতে কোনো দিন ব্যবসা করতে পারেননি। একটু অতীতের দিকে তাকালে স্মরণ করতে পারবেন। একদিকে ছিল হাওয়া ভবনের কমিশন ও ভাগ দেওয়া, অপরদিকে তত্ত্বাবধায়কের সময় ছিল আতঙ্ক, মামলা, দেশছাড়া। অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সে আতঙ্কের পরিবেশ নেই। মুক্ত পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন। রপ্তানি-বাণিজ্যে যা টার্গেট ছিল তার থেকে বেশি রপ্তানি হচ্ছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বরং, জমির অভাবে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। কাজেই সার্বিক দিক থেকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনে স্বস্তি আছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
এসব প্রশ্নের উত্তরের পরও আরও ভালোর দল বলবে, তার পরও দেশের অবস্থা ভালো নেই। এর কারণ কী? কারণ একটাই, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক সরকার থাকলে তাদের দাম থাকে। এই শ্রেণীটা জীবনে জনগণের মুখোমুখি হতে পারে না। ভোটে জিততে পারে না। কিন্তু ক্ষমতার লোভ ছাড়তে পারে না। তাই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক সরকারের যে খোশামোদি, তোষামোদি ও চাটুকারের দলও প্রয়োজন হয়—এরা সেই দল। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী ও চেতনায় বিশ্বাসীরা ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের উপকার হয়। আর দেশে মানুষ যদি দরিদ্র না থাকে, তাহলে এই শ্রেণীর বাণিজ্য শেষ হয়ে যাবে, কারণ দরিদ্র্য মানুষগুলোই তো তাদের বড় পণ্য। যাদের নিয়ে তারা বাণিজ্য করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে।
আমি বেঁচে থাকতে আমার দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর খেলতে দেব না।
২২.৫.২০১১
টরন্টো, কানাডা
শেখ হাসিনা: প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
No comments