শেয়ারবাজার, সূচক এবং কালো মেঘ by হানিফ মাহমুদ
সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক একদিনে কমে যায় ২০৫ পয়েন্ট। আবার পরের দিনই সূচকের মান কিছুটা বাড়ে। বাজারের এই উল্টাপাল্টা গতিবিধি নিয়ে বিনিয়োগকারীরা খুবই আতঙ্কে রয়েছেন। বিশেষ করে, যাঁরা গত দুই বছরে বাজারে ঢুকেছেন। কারণটা অজানা নয়। সীমিত সঞ্চয়ের অর্থ যখন শেয়ারবাজারে খাটানো হয়, তখন তো এমন আশঙ্কা থাকতেই পারে যে প্রত্যাশিত আয় হাতে আসার আগেই পুঁজি খোয়া যেতে পারে। এ অভিজ্ঞতা বিনিয়োগকারীদের আগেও হয়েছে ১৯৯৬ সালে।
কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বরাবরই প্রচার করা হচ্ছে, বাজার আগের চেয়ে অনেক পরিণতি লাভ করেছে। বড় ধরনের বিপর্যের কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখা যাবে, বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্বাসের মধ্যে অনেক ফাঁকি আছে। সূচক থেকে শুরু করে বাজারে নজরদারি—সবকিছুতেই নানা মাত্রার ত্রুটি রয়েছে।
অনেকেরই মত, জুয়াড়ি চক্রই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের পুঁজিবাজারকে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্রোকারেজ হাউসের মালিক ও প্রতিনিধি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির শীর্ষ কর্তাব্যক্তি এবং বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী এই চক্রের সদস্য। এঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ছিয়ানব্বইয়ের শেয়ার কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা ছিলেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। তাঁরা কী ছক আঁকছেন, এর ওপর নির্ভর করে সে সপ্তাহে শেয়ারবাজার কেমন যাবে। অভিজাত ক্লাব ও পাঁচতারা হোটেলে নানা ধরনের কারসাজি প্রস্তুত করার জন্য গোপন বৈঠকও হয় নিয়মিত। অর্থ মন্ত্রণালয়, দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্য এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থারও কেউ কেউ এঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে থাকেন। গণমাধ্যমের কিছু কর্মীও এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠকের গোপন তথ্য তাঁরা আদান-প্রদান করছেন সংবাদটি বাজারে আসার আগেই।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৫-০৬ থেকে ২০০৮-০৯—এই চার বছরে সংস্থা ২৩৬টি সন্দেহজনক অনিয়ম উদ্ঘাটন করেছে। আর তদন্ত হয়েছে মাত্র ৩৭টি ঘটনার। শাস্তি দেওয়া হয়েছে আরও কমসংখ্যক ঘটনায়। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এসইসির দুর্বলতার কারণেই শেয়ারবাজারের এসব দুষ্টচক্র কোনো শাস্তি পাচ্ছে না।
ছিয়ানব্বইয়ের কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই বর্তমান বাজারে আবারও সক্রিয় রয়েছেন—এমন তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। কিন্তু তাঁদের থামানোর ব্যাপারে কোনো জোরালো উদ্যোগ নেই।
তবে এসবের চেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এসইসির শক্ত নজরদারির ব্যবস্থা। সংস্থাটির বয়স ১৭ বছর অতিক্রম করতে চলেছে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা এবং বাজারের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে নিজস্ব কোনো সার্ভেইলেন্স সফটওয়্যার নেই। এ ধরনের একটি সফটওয়্যারের ব্যয় তিন লাখ ডলার বা দুই কোটি টাকা। এর জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কারিগরি সহায়তা ও অর্থ দিতেও রাজি আছে। তবে এ ব্যাপারে কমিশন ধীরে চলছে।
বর্তমানে এসইসি ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সফটওয়্যার ব্যবহার করে নজরদারি করে থাকে। মাত্র দুজন লোক দিয়ে প্রতিদিনের বাজার নজরদারি করা হয়। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারবাজারে সুশাসন আনতে নজরদারি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার কথা বলে আসছেন। এডিবির পক্ষ থেকেও দীর্ঘদিন ধরে কমিশনকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। নজরদারিব্যবস্থার দুর্বলতার বিষয়টি উল্লেখ করে এর আগে কয়েক দফা সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেয়ার কেনাবেচার পদ্ধতি কম্পিউটার ভিত্তিক হয়েছে। কিন্তু এর জন্য কোনো ডিজিটাল নজরদারিব্যবস্থা স্থাপন করা হয়নি।
সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলেছে। যে সূচকটির ভিত্তিতে প্রতিদিনের বাজারের প্রবণতা উঠে আসে, সেটি দীর্ঘদিন ধরে ভুলভাবে পরিমাপ হয়ে আসছে। ভুল পদ্ধতিতে সূচক গণনার জন্য সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সিদ্ধান্তটি নেওয়ার পর এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, সূচক নির্ণয়ের ব্যাপারে স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। এসব বিচ্যুতি অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তাই ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্যই এ জরিমানা করা হয়েছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এ রকম একটি ভুল সূচকের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিদিন বাজারে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সূচক হিসাবের দাবি করলেও ডিএসই সচেতনভাবে ভুল সূচক পরিমাপ করে আসছে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনস (আইএসকো) নির্ধারিত পদ্ধতি বা সূত্র অনুসারে সূচক হিসাবের ক্ষেত্রে যেকোনো নতুন শেয়ার বাজারে এলে প্রথম দিনেই এর মূল্যের ওঠানামাকে বিবেচনা না করে দ্বিতীয় দিনের বাজার প্রারম্ভিক দামকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে আইএসকো সূত্র অনুসরণের ঘোষণা দিলেও ডিএসই এই বিধি মেনে সূচক পরিমাপ করে না। বরং নতুন শেয়ারের বাজারে লেনদেন শুরুর প্রারম্ভিক দামকে বিবেচনা করে সূচক পরিমাপ করে আসছে। আর এ কারণেই গ্রামীণফোনের লেনদেন যেদিন শুরু হয়, সেদিন ডিএসইর সাধারণ সূচক ৭০৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
ডিএসই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি না মানার পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাচারিতা করেছে বিভিন্ন সময়। এসইসি থেকে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত যমুনা অয়েল কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি। কিন্তু এর তিন দিন পর ১৩ জানুয়ারি কোম্পানিটির লেনদেনের তথ্য সূচকে যুক্ত হয়। একই ঘটনা ঘটে সরাসারি তালিকাভুক্ত বেসরকারি খাতের দুই কোম্পানি এসিআই লিমিটেড ও শাইনপুকুর সিরামিকসের ক্ষেত্রে। এ দুই কোম্পানি সূচকে যুক্ত হয় চতুর্থ লেনদেন দিবসে। অথচ মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও নাভানা সিএনজি লেনদেনের প্রথম দিনেই সূচকে যুক্ত হয়। কিন্তু এ ধরনের বিকৃত সূচক ব্যবস্থাকে দ্রুত সংশোধনের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা স্টক এক্সচেঞ্জ কারোরই কোনো উদ্যোগ নেই।
তা ছাড়া, বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংক নিয়ম ভেঙে শেয়ারবাজারের ফটকা বিনিয়োগে বড় আকারে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, কোনো ব্যাংকের ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ সমষ্টিগতভাবে ব্যাংকের মোট দায়ের ১০ ভাগের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু এই সীমা না মানার কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের বেঁধে দেওয়া সীমার তোয়াক্কা না করে রীতিমতো বড় আকারে বিনিয়োগ করে বসে আছে সাতটি ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে শীর্ষ তালিকায় আছে আল-আরাফাহ ব্যাংক। বেসরকারি এই ব্যাংকটি মোট দায়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থ শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। ন্যাশনাল ব্যাংক সাড়ে ২৪ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ২৩ শতাংশ, সিটি ব্যাংক ২২ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক প্রায় ২২ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ২১ শতাংশ এবং আইএফআইসি ব্যাংক প্রায় ১৯ শতাংশ।
এ ধরনের প্রবণতা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের মত হলো, কোনোভাবেই ১০ শতাংশের বেশি ব্যাংকের অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না। কারণ এই বাজার একটি ফটকা বাজার। আমানতকারীর জামানতের টাকা এ ধরনের বাজারে সীমার বাইরে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কঠোরভাবে তদারকি করা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ বিষয়ে আগে কয়েক দফা সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও নীতিনির্ধারকদের। তাদের পর্যবেক্ষণ, প্রথাগত ব্যাংক কার্যক্রমের বাইরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে, যা দেশের ব্যাংক খাতের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের পতন ঘটলে তা কোনো কোনো ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
শেয়ারবাজারের তেজিভাব নিশ্চয়ই বিনিয়োগকারীদের খুশির কারণ; কিন্তু যেসব দুর্বলতা ও ঝুঁকি রয়েছে, তাতে শঙ্কার কালো মেঘ যে পুরোপুরি কেটেছে, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তাই সময় থাকতে সতর্ক না হলে আমাদের অর্থনীতির পালে এর জোর ধাক্কা লাগতে বাধ্য।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বরাবরই প্রচার করা হচ্ছে, বাজার আগের চেয়ে অনেক পরিণতি লাভ করেছে। বড় ধরনের বিপর্যের কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখা যাবে, বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্বাসের মধ্যে অনেক ফাঁকি আছে। সূচক থেকে শুরু করে বাজারে নজরদারি—সবকিছুতেই নানা মাত্রার ত্রুটি রয়েছে।
অনেকেরই মত, জুয়াড়ি চক্রই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের পুঁজিবাজারকে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্রোকারেজ হাউসের মালিক ও প্রতিনিধি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির শীর্ষ কর্তাব্যক্তি এবং বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী এই চক্রের সদস্য। এঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ছিয়ানব্বইয়ের শেয়ার কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা ছিলেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। তাঁরা কী ছক আঁকছেন, এর ওপর নির্ভর করে সে সপ্তাহে শেয়ারবাজার কেমন যাবে। অভিজাত ক্লাব ও পাঁচতারা হোটেলে নানা ধরনের কারসাজি প্রস্তুত করার জন্য গোপন বৈঠকও হয় নিয়মিত। অর্থ মন্ত্রণালয়, দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্য এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থারও কেউ কেউ এঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে থাকেন। গণমাধ্যমের কিছু কর্মীও এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠকের গোপন তথ্য তাঁরা আদান-প্রদান করছেন সংবাদটি বাজারে আসার আগেই।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৫-০৬ থেকে ২০০৮-০৯—এই চার বছরে সংস্থা ২৩৬টি সন্দেহজনক অনিয়ম উদ্ঘাটন করেছে। আর তদন্ত হয়েছে মাত্র ৩৭টি ঘটনার। শাস্তি দেওয়া হয়েছে আরও কমসংখ্যক ঘটনায়। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এসইসির দুর্বলতার কারণেই শেয়ারবাজারের এসব দুষ্টচক্র কোনো শাস্তি পাচ্ছে না।
ছিয়ানব্বইয়ের কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই বর্তমান বাজারে আবারও সক্রিয় রয়েছেন—এমন তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। কিন্তু তাঁদের থামানোর ব্যাপারে কোনো জোরালো উদ্যোগ নেই।
তবে এসবের চেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এসইসির শক্ত নজরদারির ব্যবস্থা। সংস্থাটির বয়স ১৭ বছর অতিক্রম করতে চলেছে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা এবং বাজারের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে নিজস্ব কোনো সার্ভেইলেন্স সফটওয়্যার নেই। এ ধরনের একটি সফটওয়্যারের ব্যয় তিন লাখ ডলার বা দুই কোটি টাকা। এর জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কারিগরি সহায়তা ও অর্থ দিতেও রাজি আছে। তবে এ ব্যাপারে কমিশন ধীরে চলছে।
বর্তমানে এসইসি ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সফটওয়্যার ব্যবহার করে নজরদারি করে থাকে। মাত্র দুজন লোক দিয়ে প্রতিদিনের বাজার নজরদারি করা হয়। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারবাজারে সুশাসন আনতে নজরদারি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার কথা বলে আসছেন। এডিবির পক্ষ থেকেও দীর্ঘদিন ধরে কমিশনকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। নজরদারিব্যবস্থার দুর্বলতার বিষয়টি উল্লেখ করে এর আগে কয়েক দফা সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেয়ার কেনাবেচার পদ্ধতি কম্পিউটার ভিত্তিক হয়েছে। কিন্তু এর জন্য কোনো ডিজিটাল নজরদারিব্যবস্থা স্থাপন করা হয়নি।
সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলেছে। যে সূচকটির ভিত্তিতে প্রতিদিনের বাজারের প্রবণতা উঠে আসে, সেটি দীর্ঘদিন ধরে ভুলভাবে পরিমাপ হয়ে আসছে। ভুল পদ্ধতিতে সূচক গণনার জন্য সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সিদ্ধান্তটি নেওয়ার পর এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, সূচক নির্ণয়ের ব্যাপারে স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। এসব বিচ্যুতি অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তাই ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্যই এ জরিমানা করা হয়েছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এ রকম একটি ভুল সূচকের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিদিন বাজারে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সূচক হিসাবের দাবি করলেও ডিএসই সচেতনভাবে ভুল সূচক পরিমাপ করে আসছে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনস (আইএসকো) নির্ধারিত পদ্ধতি বা সূত্র অনুসারে সূচক হিসাবের ক্ষেত্রে যেকোনো নতুন শেয়ার বাজারে এলে প্রথম দিনেই এর মূল্যের ওঠানামাকে বিবেচনা না করে দ্বিতীয় দিনের বাজার প্রারম্ভিক দামকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে আইএসকো সূত্র অনুসরণের ঘোষণা দিলেও ডিএসই এই বিধি মেনে সূচক পরিমাপ করে না। বরং নতুন শেয়ারের বাজারে লেনদেন শুরুর প্রারম্ভিক দামকে বিবেচনা করে সূচক পরিমাপ করে আসছে। আর এ কারণেই গ্রামীণফোনের লেনদেন যেদিন শুরু হয়, সেদিন ডিএসইর সাধারণ সূচক ৭০৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
ডিএসই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি না মানার পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাচারিতা করেছে বিভিন্ন সময়। এসইসি থেকে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত যমুনা অয়েল কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি। কিন্তু এর তিন দিন পর ১৩ জানুয়ারি কোম্পানিটির লেনদেনের তথ্য সূচকে যুক্ত হয়। একই ঘটনা ঘটে সরাসারি তালিকাভুক্ত বেসরকারি খাতের দুই কোম্পানি এসিআই লিমিটেড ও শাইনপুকুর সিরামিকসের ক্ষেত্রে। এ দুই কোম্পানি সূচকে যুক্ত হয় চতুর্থ লেনদেন দিবসে। অথচ মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও নাভানা সিএনজি লেনদেনের প্রথম দিনেই সূচকে যুক্ত হয়। কিন্তু এ ধরনের বিকৃত সূচক ব্যবস্থাকে দ্রুত সংশোধনের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা স্টক এক্সচেঞ্জ কারোরই কোনো উদ্যোগ নেই।
তা ছাড়া, বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংক নিয়ম ভেঙে শেয়ারবাজারের ফটকা বিনিয়োগে বড় আকারে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, কোনো ব্যাংকের ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ সমষ্টিগতভাবে ব্যাংকের মোট দায়ের ১০ ভাগের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু এই সীমা না মানার কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের বেঁধে দেওয়া সীমার তোয়াক্কা না করে রীতিমতো বড় আকারে বিনিয়োগ করে বসে আছে সাতটি ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে শীর্ষ তালিকায় আছে আল-আরাফাহ ব্যাংক। বেসরকারি এই ব্যাংকটি মোট দায়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থ শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। ন্যাশনাল ব্যাংক সাড়ে ২৪ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ২৩ শতাংশ, সিটি ব্যাংক ২২ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক প্রায় ২২ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ২১ শতাংশ এবং আইএফআইসি ব্যাংক প্রায় ১৯ শতাংশ।
এ ধরনের প্রবণতা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের মত হলো, কোনোভাবেই ১০ শতাংশের বেশি ব্যাংকের অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না। কারণ এই বাজার একটি ফটকা বাজার। আমানতকারীর জামানতের টাকা এ ধরনের বাজারে সীমার বাইরে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কঠোরভাবে তদারকি করা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ বিষয়ে আগে কয়েক দফা সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও নীতিনির্ধারকদের। তাদের পর্যবেক্ষণ, প্রথাগত ব্যাংক কার্যক্রমের বাইরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে, যা দেশের ব্যাংক খাতের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের পতন ঘটলে তা কোনো কোনো ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
শেয়ারবাজারের তেজিভাব নিশ্চয়ই বিনিয়োগকারীদের খুশির কারণ; কিন্তু যেসব দুর্বলতা ও ঝুঁকি রয়েছে, তাতে শঙ্কার কালো মেঘ যে পুরোপুরি কেটেছে, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তাই সময় থাকতে সতর্ক না হলে আমাদের অর্থনীতির পালে এর জোর ধাক্কা লাগতে বাধ্য।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
No comments