পৃথিবী ঘুমায় গাজার মানুষ মুখোমুখি হয় বিশ্বাসঘাতক দখলদারের by দোহা খালুত

আমাদের রাত বড় দীর্ঘ। এই রাতে আমরা সান্ত্বনা দিই লোনা স্মৃতিগুলোকে। পার হই এক অনন্ত আকাক্সক্ষার পথ- যার তীব্রতা কখনো ম্লান হয় না। দিনে আমরা ছুটে বেড়াই নানা সমস্যার পেছনে- যা শুরু হয় এক গ্লাস পানি থেকে, শেষ হয় ক্লান্তির সঙ্গে মেশানো এক টুকরো রুটিতে। ভাববার সময় নেই- আমি কে? এখানে এসে পড়লাম কীভাবে? এই দিনগুলো টিকে থাকতে আমাকে আর কতো কিছু হারাতে হবে? অতীতটাও তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে। তাই যা সময় বাকি আছে, তা আমরা স্মৃতিচারণে ব্যয় করি- ভয়ে, যদি সেগুলোও মুছে যায়।

আমরা প্রশ্নের এক অবিরাম স্রোতের পিছু ছুটি, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি মাথায় ঘূর্ণায়মান অগণিত প্রশ্ন নিয়ে- উত্তর খোঁজার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়।
কীভাবে এত প্রশ্ন জমে গেল?

৭ই অক্টোবর, ২০২৩। এই দিনেই গাজাবাসীর চারপাশে প্রশ্নের অবরোধ শুরু হয়। যেদিকেই তাকায়, একগুঁয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলে থাকে। কেউ কিছুই বুঝতে পারে না, আটকে থাকে সকাল সাড়ে ছয়ের ঘড়ির কাঁটায়- একই দুই প্রশ্নে: ‘কী হচ্ছে?’ ‘এর পরিণতি কী হবে?’
পরদিন সকালে দখলদার বাহিনী নিজেদের উত্তর পাঠায়- অচেনা অস্ত্রের গর্জনে, ঘরবাড়ি ধ্বংসের নীতিতে, আর অমানবিক বক্তব্যে, যা আমাদের ভয়ে স্তব্ধ করে দেয়। যখন সামান্য বিদ্যুৎ থাকতো, টেলিভিশনের সামনে বসে আমরা ব্রেকিং নিউজের লাল ফিতা পরতাম, নিজেদের মধ্যে বলতাম-‘ওখানে আমাদের কে আছে?’
আর ‘ওখানে’ বলতে বোঝানো হতো সেই জায়গা, যেখান থেকে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘বোমা হামলার শিকার।’

কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য আমরা নাম ধরে প্রার্থনা করতাম। খবরের বন্যা চারদিকে। তারই মাঝে একদম খুব কাছে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র সব নীরবতা ভেঙে দেয়। শরীর অবশ লাগে। মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখছি- চোখ খুললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু চেতনা ফিরে পেলে শোনা যায় কম্পমান কণ্ঠস্বর-
‘তুমি বেঁচে আছো? তোমার বোন আর ভাই তোমার সঙ্গে আছে?’
কথা বের হয় না। গলা শুকিয়ে যায়। এক অকল্পনীয় ভয় তোমাকে গিলে নেয়।
একই দৃশ্য, একের পর এক দিন।
সাতদিন ধরে একই প্রশ্ন, একই ভয়, একই নিঃশব্দ ডাক।
ভাবতে শুরু করো- সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছো। কিন্তু না- শত্রুর হাতে এখনো অজানা অনেক দৃশ্যপট বাকি।
এসব প্রশ্ন কীভাবে জমা হলো

১৩ই অক্টোবরের সকাল। গাজাবাসী জেগে উঠলেন এক ‘নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে মোড়া’ বাস্তুচ্যুতির নির্দেশনায়। দখলদার বাহিনীর অফিসিয়াল ঘোষণায় বলা হলো- উত্তর গাজার বাসিন্দারা যেন ‘নিরাপদ দক্ষিণে’ চলে যায়। কারণ উত্তরে ‘ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র’।
তখন প্রতিটি ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো একটাই প্রশ্ন: ‘কোথায় যাবো?’
যাদের আত্মীয় ছিল দক্ষিণে, তারা দেরি না করে রওনা দিলো। যাদের কেউ ছিল না, তারা সামান্য জিনিস, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যেদিকে বাতাস, সেদিকেই চললো। রাস্তায় ভাঙা ঘরের টুকরো বহন করা গাড়ির ভিড়ে মানুষের মুখে লেখা ছিল ভয়- আর কাঁধে ছিল প্রশ্নের ভার। অনেকেই হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল শুধু হালকা কাপড় আর মনের ভেতর ঘরবাড়ির স্মৃতি- যার জন্য প্রতি রাতে কাঁদেন তারা।
শিশুরা জিজ্ঞেস করতো- ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
তাদের প্রশ্নে অভিভাবকরা জড়িয়ে ধরতেন। কিন্তু উত্তর দিতেন না।
‘নিরাপদ’ দক্ষিণের অনিরাপদ কাহিনী:
দক্ষিণে এসে নতুন সব কষ্টের গল্প শুরু হয়। অনেক মা তাদের সন্তানকে বুকে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু স্বামী বা অন্য কোনো সন্তান নেই সঙ্গে। তারা অস্থায়ী তাঁবু গেঁড়ে বসবাস শুরু করেন। পরিষ্কার রাখেন। জিনিসপত্র সাজান যেন ঘরের মতো লাগে। আর প্রতিদিন দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন কোনো চেনা কণ্ঠের জন্য।
ইখলাস, বয়স ৪২। স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে আশ্রয়শিবিরে থাকেন। তার চোখে একটাই প্রশ্ন- ‘আমার ছেলে মুহাম্মদ এখন কেমন আছে?’
সে রয়ে গেছে উত্তর গাজায়। নেটওয়ার্ক পেলে একটুখানি খবর আসে, তাতে কাঁপে মা-ছেলের মন। এমন হাজারো মা- খালি চোখে, ঝুলন্ত হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
৬০ বছর বয়সী ফায়জা উত্তর গাজা ছেড়ে যাননি। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর ওপর ভরসা করে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে ঘরে পালিয়েছেন। তার একমাত্র ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নিখোঁজ করা হয়। ৪০ দিনেরও বেশি কোনো খোঁজ নেই।

স্বামী নিহত হয়েছেন। ছেলে মুক্তি পেলেও তাকে দক্ষিণে পাঠিয়ে দেয়া হয় মায়ের নাগালের বাইরে। এখন তিনি একা, সঙ্গী শুধু বিষাদ আর অশান্ত চিন্তা।
শুরুকের বয়স ২৫। কিন্তু মুখে শৈশবের কোমলতা এখন নিঃশেষ। তাঁবুর দরজায় বসে থাকেন সারাক্ষণ, কোলে শিশু, চোখে অশ্রু। এক বছর তিন মাসের বিবাহিত জীবন তার। এরপরই স্বামী নিহত হয়েছেন। তাদের ঘর, হাসি, শিশুর কান্না- সবই এখন শুধু স্মৃতি। মা বলেন-  মেয়ে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করেন স্বামীর ফেরার জন্য, শিশুকে দেখাবে বলে। এটা কি আশা, নাকি উন্মাদনা?
কোনো উত্তরই যথেষ্ট নয়: এই দীর্ঘ রাতে, জমে থাকা প্রশ্নগুলো ভেঙে পড়ে আমাদের ওপর। প্রতিটি ছবিতে, প্রতিটি স্মৃতিতে ফিরে আসে এক প্রশ্ন- ‘আমাদের ঘর কি আবার হাসবে? আগের দিনগুলো কি ফিরে আসবে?’ উত্তর জানা নেই। তবু আশার প্রতারণায় বিশ্বাস করি- হয়তো ফিরবে। মন জ্বালিয়ে দেয় নতুন প্রশ্ন- এই যুদ্ধ কতোদিন চলবে? আমরা কি আজীবন এমনই থাকবো? এই চিন্তা দূর করতে আমরা হাসাহাসি করি- ‘ফিরে গেলে আবার দেখা হবে।’ কেউ মজা করে যোগ করে- ‘যদি কখনো ফিরি।’
সবাই থেমে যায়।
বাঁচা এখন একমাত্র লক্ষ্য।
এই যুদ্ধ আমরা বেছে নিইনি- তবু এরই শিকার। আমরা ভালোবাসি আমাদের জমি, ঘর, কাজ, রাস্তাঘাটের অভিযান। বঞ্চনার অভিজ্ঞতা আবার সহ্য করা যায় না। ‘কখন? কার সঙ্গে? কোথায়?’- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলে মুক্তি নেই। আর তখনই মাথায় আসে এক ভারী প্রশ্ন- ‘বিশ্ব কি আমাদের দেখে?’
কোনো উত্তরই যথার্থ লাগে না।
যদি দেখে, তবে কোথায় তারা? আর যদি না দেখে, তবে তারা করছে কী?
সময় গড়িয়ে যায়- চার ঋতু কেটে গেছে। আমরা এখন এমন এক জায়গায়, যা আমাদের চেনে না, আমরাও যাকে চিনি না। শরৎ আসে, শীত যায়, বসন্ত পেরিয়ে যায়- কিন্তু আমরা এখনো অপরিচিত এক জীবনে বন্দি। প্রতি মাসে ভাবি, আরেক মাস টিকবো তো? তারপর সেই মাস আসে- আর যুদ্ধ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। প্রতিদিন একই প্রশ্ন, একই ব্যথা- ‘গাজাবাসী কীভাবে এত কষ্ট সহ্য করে?’ ভয়, ক্ষুধা, বিয়োগ- সবই তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। তবু পরের দিনের সূর্য যেন আবারো ধুয়ে দেয় আগের দিনের দুঃখ। এই সহনশীলতা হৃদয়ের অভাব নয়- বরং অবিরাম বেদনা মানুষকে শক্ত করে তোলে, অনুভূতি চেপে রাখতে শেখায়।
বেঁচে থাকা এখানে এক যুদ্ধ- সকালের তাপ থেকে শুরু, রাতে ঠাণ্ডায় শেষ। বিশ্ব জানে এর সামান্যই- কিছু ছবি, কিছু ভিডিও, কিছু আর্তনাদ। তারা ভাবে- আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ভাবতে চায়, আমাদের দৃঢ়তা নাকি এক ‘নায়কোচিত’ কাহিনী। এভাবেই তারা নিজের অপরাধবোধ ধুয়ে ফেলে। কখনো কিছু সহায়তা আসে, আবার থেমে যায়। বিশ্ব তখন শোনে আমাদের মৃত্যুর গল্প- কখনো বিস্ময়ে, কখনো আপত্তিতে। আর যখন পৃথিবী ঘুমায়, গাজার মানুষ তখন মুখোমুখি হয় এক বিশ্বাসঘাতক দখলদারের- আর জেগে থাকে সেই এক প্রশ্ন নিয়ে- ‘আমরা কতোটা একা?’

(দোহা খালুত গাজার কবি ও শিক্ষক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আশবাহ’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ও ইনস্টিটিউট ফর আইডিয়াজ অ্যান্ড ইমাজিনেশনের যৌথ উদ্যোগে প্যারিসের রিড হল-এ শিল্পী আবাসনের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০২৪ সালের মে মাসে ইসরাইলি আগ্রাসনে রাফাহ সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে যেতে পারেননি। বর্তমানে তিনি গাজার মধ্যাঞ্চল দেইর আল-বালাহ-তে অবস্থান করছেন, সেখান থেকেই নিজের লেখা বিশ্বে পাঠাচ্ছেন। তার মূল লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন হাইথাম আল ওয়ারডানি।  লেটারস ফ্রম গাজা- বই থেকে) লেখক: দোহা খালুত অনুবাদ: মোহাম্মদ আবুল হোসেন
https://mzamin.com/uploads/news/main/183495_3.webp

No comments

Powered by Blogger.