পতিত সরকারের অনুগত আমলারা সরকারকে সফল দেখতে চায় না by ড. নুরুল আমিন বেপারী

আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতির মূলে রয়েছে গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস না করা। সেটি দেশের সঙ্গে সঙ্গে দলের মধ্যেও করা হয়নি। একটি দলের মধ্যে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হয়। এমনকি এ আন্দোলনের সময়ও যদি তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা থাকতো তাহলে নিজেরা বুঝতে পারতেন যে- কোথায় ভুল হচ্ছে। কী করা উচিত। দলের পাশাপাশি আইন, বিচার, শাসন বিভাগ সব একজনের হাতে চলে গেছে। গণতন্ত্র শেষ হয়ে যায়। যার কারণে তিনি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছেন। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ নিতে হয়। কিন্তু তিনি এককভাবে নেয়ায় এমন পরিণতি হয়েছে। পালিয়ে যেতে হয়েছে। অতীতের মতো আর এ ক্রাইসিস মোকাবিলা করতে পারেননি। গণতান্ত্রিকভাবে দলটি গড়ে উঠলে এ পরিণতি হতো না।

পতিত সরকারের আমলারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সফল দেখতে চায় না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর আমলাদের অপব্যবহার করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ওই সরকারের সময় জটিল কোনো ক্রাইসিস দেখলে অ্যাকশনে গিয়েছে তারা। কারণ যতগুলো লোক মরবে তত পুরস্কার। পুলিশের মতো সুশৃঙ্খল একটা ইনস্টিটিউটকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তাদের যারা এখনো আছে তারা তো পতিত সরকারের প্রতি অনুগত। সেই সরকারের লোকরা তো চাইবে যেন বর্তমান সরকার সফল না হতে পারে। ৫ই আগস্টের পর পুলিশ যেভাবে দৌড়ানি খেয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে পুলিশের এ দশা হয়নি। এমনকি পাকিস্তান আমলেও এমন হয়নি। তাই এ পুলিশ, আমলারা মনেপ্রাণে সরকারকে ভালোবাসতে পারছে না- তাই এ বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। প্রফেসর নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ইনস্টিটিউশন একটি গাছের মতো। যত জীবন পাবে তত শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশে ইনস্টিটিউশনগুলোকে ডেভেলপ করার সুযোগ দেয়া হয়নি। যার কারণে গণতন্ত্র হোঁচট খাচ্ছে। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এর কারণে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময়ও গণতান্ত্রিকভাবে ক্রাইসিস সমাধানের পথ খুঁজে পাননি তিনি। বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভালো চালাতে পারছে না। পজেটিভ দিক থেকে মানুষ প্রশংসা করছে ঠিকই। এখানে বুঝতে হবে ডায়নামিক কী কী? একটি কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচছে। সে সময় বাক, ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি চলতো। এ পরিবেশ থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার সুযোগ দেয়া। সেটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেও করতে হবে। এ পরিবেশ সৃষ্টি করার অবস্থা আমাদের দেশে ছিল না।
এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে বর্তমান সরকারটি অভ্যুত্থানের, বিপ্লবের নয়। তিনি বলেন, যদিও কেউ কেউ বিপ্লবের সরকার বলছেন। কিন্তু পার্টি ছাড়া বিপ্লব হতে পারে না। এখানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। ফলে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় এসেছেন। অভ্যুত্থানের ফসল তার হাতে এসেছে। মানুষ খুশি হয়েছে। তাই আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক আছে। সে অনেক কিছু চাইলেই করতে পারে না। ব্যক্তি জীবনে দেড়/ দুই মাস যথেষ্ট সময় হলেও একটি জাতির জন্য সেটি যথেষ্ট নয়। কিছু কাজ তো হয়েছে। তবে বিভিন্ন নিয়োগ ইতিমধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের প্রশাসনিক যাত্রাটা ভালোভাবে হয়নি। সব জায়গায় এলোমেলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় একটা লাশ পড়ে গেছে। যারাই শুনেছে তাদের বিবেকে নাড়া দিয়েছে। সবাই সমালোচনা করেছেন। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কাউকে নিয়োগ দিলে এমন হতো না। এভাবে তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন প্রশাসনিক দিক দিয়ে। আর ম্যাজেস্ট্রিসি পাওয়ার দিয়ে তিনি যে সেনাবাহিনী নামিয়েছেন সেটা তো ৮ই আগস্টই নামাতে পারতেন। তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারকে আমরা পছন্দ না করলেও তাদের সময়ে ল’ অ্যান্ড অর্ডার ঠিক ছিল। তাই সেনাবাহিনীকে আরও অ্যাক্টিভ ও সতর্ক হতে হবে। তা না হলে ড. ইউনূস ব্যর্থ হবেন। আর সিভিল সরকার ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার শঙ্কা থাকে।
সংস্কার কমিশন নিয়ে তিনি বলেন, এ কমিশনগুলোর মধ্যে কেউ কেউ শুরুতে বিতর্ক তৈরি করে ফেলেছেন। যেমন বদিউল আলম মজুমদার বলে বসলেন- আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন বৈধতা হবে না। তিনি বলবেন- তবে বলার একটা স্পেস আছে। এখন না। তখন আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে আসতে হবে যে কীভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে। সাখাওয়াত সাহেবও শুরুতে বিতর্ক তৈরি করেছেন। তাদের নিরপেক্ষভাবে কথা বলতে হবে। খুব বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে হবে। তাদের কথার অনেক মূল্য আছে। সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন এ কাজগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ। যদি পুনর্লিখন করতে হয় তাহলে তো জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করা উচিত ছিল। এখন তারা কিছু সংস্কার এনে একটি সংবিধান তৈরি করে জাতিকে দেবে কিন্তু সেটি পাস করবে কে। সংসদকেই করতে হবে। কিন্তু সে সংসদে তো এদের কেউ থাকবে না। সেখানে বিএনপি-জামায়াতের থাকবে- রাজনৈতিক দলগুলো থাকবে। তারা যদি পাস না করে তাহলে কী হবে। সে সময় বিএনপি যদি বলে বসে এটা কাটতে হবে, ওটা কাটতে হবে- তখন কী হবে। তাই আগে এদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে হবে। তাদের বাদ দিয়ে হবে না।
এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শিক্ষা- মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিশেষ করে বিএনপি’র জন্য একটা বড় শিক্ষা। কারণ তারা সবচেয়ে বড় দল। ইনস্টিটিউশনকে শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিএনপি’র আগের মান্ধাতার আমালের রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতির কাজগুলো যদি বিএনপি এখন দখল করে তাহলে সেটা বড় ভুল হবে। মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করবে। সহজভাবে বলতে হলে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় সংস্কার আনতে হবে। দেশপ্রেমিক পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে। তারা তাদের স্বার্থের জন্য ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলে। তাহলে অনেকের কর্মসংস্থান হয়। অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে যেন পুঁজিগুলো পাচার না হয়ে যায়। এগুলো দেশেই বিনিয়োগ করা যায়। পুঁজিপতিদের পুঁজিতে কিছু এলোমেলো থাকবেই। কিন্তু তাকে দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, আমার দেশের গরিব মানুষ মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা পৃথিবীতে কায়িক পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। আর চোরগুলো সে টাকা পাচার করে। পুঁজি না পেলে, ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না উঠলে আমার দেশের ছাত্ররা পড়াশোনা করে চাকরি পাবে না। এভাবে অর্থনৈতিক সেক্টর রক্ষা করতে হবে। অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করে দেশ পরিচালনা করতে হবে। অর্থনীতি এবং রাজনীতি দুটোকেই গুরুত্ব দিতে হবে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দেবে না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে। দেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়া উচিত। তাহলে দেশের বিকাশ হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রকেও সংস্কার করতে হবে। কারণ শিক্ষায় যারা যত এগিয়ে তারা তত অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে না পারলে কায়িক শ্রম করে উপার্জন করতে হবে। তখন তারা মজুরি কম পাবে। আজকে আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরসহ অনেক জায়গায় ভারতের অনেক দক্ষ শ্রমিক কাজ করে। এটা যদি আমাদের কেউ করতো তাহলে টাকাটা দেশেই থাকতো। এদিকে লক্ষ্য রেখে এগুতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ প্রফেসর বলেন, ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা করতে হবে। সেটি দলগুলোর ভেতরে করতে হবে- বাইরে না। দুইবারের বেশি সরকার প্রধান হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। তারেক রহমান সাহেবকেও ধন্যবাদ যে, তিনি সেটি বলেছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, পর পর। তার মানে বিরতি দিয়ে আসতে পারবেন। এটা করতে দেয়া যাবে না। জনগণ এটা গ্রহণ করবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্মসূচি ও নীতিতে ব্যাপকহারে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেন, এ দেশে ইন্ডিয়া আওয়ামী লীগকে সকল অপকর্মে সহায়তা দিয়েছে। যার কারণে এখন বাংলাদেশের জনগণের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত বৈদেশিক শক্তি ইন্ডিয়া। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকেও এটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। বিএনপিসহ সব দলকেই জন চাহিদার ভিত্তিতে, সম্মানের ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে। আমাদের সম্পর্ক হতে হবে সহায়তার- দাসত্বের নয়।
এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতির মূলে রয়েছে গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস না করা। সেটি দেশের সঙ্গে সঙ্গে দলের মধ্যেও করা হয়নি। একটি দলের মধ্যে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হয়। এমনকি এ আন্দোলনের সময়ও যদি তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা থাকতো তাহলে নিজেরা বুঝতে পারতেন যে- কোথায় ভুল হচ্ছে। কী করা উচিত। দলের পাশাপাশি আইন, বিচার, শাসন বিভাগ সব একজনের হাতে চলে গেছে। গণতন্ত্র শেষ হয়ে যায়। যার কারণে তিনি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছেন। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ নিতে হয়। কিন্তু তিনি এককভাবে নেয়ায় এমন পরিণতি হয়েছে। পালিয়ে যেতে হয়েছে। অতীতের মতো আর এ ক্রাইসিস মোকাবিলা করতে পারেননি। গণতান্ত্রিকভাবে দলটি গড়ে উঠলে এ পরিণতি হতো না। নুরুল আমিন বেপারী বলেন, এভাবে চললে সরকার ফেল করবে। এনজিওভিত্তিক কেবিনেট বাদ দিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন লোকদের নিয়ে সরকার গঠন করা। কচিকাঁচার আসর দিয়ে সরকার চালানো কঠিন। যে ছাত্ররা কোটার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তারও কোটায় নিয়োগ পেয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্য লোক নিয়োগ করা। এ সরকার ফেল করলে জাতির জন্য দুর্ভাগ্য রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের দুই থেকে তিন বছরের বেশি সময় নেয়া ঠিক হবে না। আর নির্বাচনের পর যেই সরকার গঠন করুক ড. মুুহাম্মদ ইউনূসকে কাজে লাগাতে হবে। তাকে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যেন কাজগুলো থেমে না যায়। তৃতীয় শক্তির উত্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, এক/এগারোর সময় মাইনাস টু ফর্মুলা এসেছিল। কিন্তু সেটা পারেনি। এখন যদি ওরকম কিছু করতে চায় তাহলে শক্তিশালী একটা দল গঠন করতে হবে। কিন্তু ড. ইউনূসের এখন সে শক্তি আছে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে ছাত্ররাও এখন বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রতিহত করছে শিক্ষার্থীরা।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.